ফিরে দেখা শৈশব

ফিরে দেখা শৈশব

রোজের অভ্যাসমত দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে উঠে পাঁচবছরের ছোট্ট মেয়ে টিকলিকে ঘুম পাড়িয়ে নিজে সবেমাত্র একটু বিছানায় গড়িয়ে ভাতঘুম দেবে বলে শুতে যাচ্ছিল শ্রীময়ী এমনসময় জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই মনটা ভালো হয়ে যায় ওর।প্রখর দাবদাহের পর আজ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমেছে সেইসাথে ঠাণ্ডা বাতাস।যদিও এই শহরে বৃষ্টির রূপ সম্পূর্ণ আলাদা।বিয়ের আগে শ্রীময়ীর ঠিকানা মানে বাপের বাড়ি ছিল উত্তর চব্বিশ পরগণার সংগ্রামপুর নামে একটি গ্রামে।যৌথ পরিবারে থাকত ওরা একসাথে সকলে মিলেমিশে।এরকম বৃষ্টিদিনে তো কথাই নেই কোনো!

জমিয়ে তেলেভাজা,মুড়িমাখা খেতে খেতে ছোটকাকে ঘিরে ধরত সব ভাই,বোন,দাদা,দিদিরা মিলে। ছোটকাও বা সেই সুযোগ হাতছাড়া করেন কেন?কত গা ছমছমে ভূতের গল্প ফেঁদে বসতেন দারুণভাবে।আর গোগ্রাসে গল্পগুলো গিলে রাত্তিরে বাথরুম যাবার সময় সেকি ভয় কচিকাঁচাদের। টিনের চালে পাতা খসার আওয়াজ শুনে মনে হত বোধয় তেনারা আসছেন সাদা চাদর জড়িয়ে নিয়ে।সুযোগ পেলেই ঝপ করে ওদের কচি ঘাড়টা মটকে দেবে।

জোরে জোরে মন্ত্র আওড়াত ওরা,”ভূত আমার পুত পেত্নী আমার ঝি রাম লক্ষণ বুকে আছে ভয়টা আমার কি! সত্যি ছেলেমানুষী ভরা সোনাঝরা দিনগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেল অচিরে কোন অতলে।কলকাতায় বিয়ে হয়ে চলে আসার পর একটা ছোটখাট চাকরি করত শ্রীময়ী।কিন্তু বছর দুই পর টিকলি ওর জীবনে আসতেই সারাদিনের সবটুকু সময় কেটে যায় টিকলিকে নিয়ে।একদম ছোটবেলায় সঠিক খাওয়াদাওয়া,রাত জেগে ন্যাপি পাল্টানো,ওষুধ, ভ্যাকসিনেশন।

আর তারপর টিকলি একটু বড় হয়ে স্কুলে ভর্তি হবার পর সাতসকালে উঠে বিছানা থেকে ঘুমকাতর অবস্থায় ওকে নামানো, ঝটপট তৈরি করা,দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে সারা বাড়ি পিছনে পিছন ছুটে বেড়ানো।একটু দেরি হলেই শুরু হবে টিকলির বাবা অংশু মানে শ্রীময়ীর বরের বিরক্তি,”মেয়েকে তৈরি করোনি এখনও?সত্যি কি যে করো!ওকে স্কুলে পৌঁছে আমার তাহলে অফিস যেতে অনেকটা দেরি হবে সেইসাথে বসের ধমকানি জুটবে।প্লিজ জলদি করো শ্রী।আমি গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করছি।তুমি ওকে নিয়ে এসো।”

তবুও ভালো বলতে গেলে সকালের দিকে রান্নাঘরের দিকটা শ্রীময়ীর শাশুড়ি দেখাশুনা করেন।তাও কি কম ধকল যায় ওর উপর দিয়ে?টিকলির পাশাপাশি অংশুর জামা,টাই,রুমাল সবটাই গুছিয়ে দিতে হয় ওকে।নিজের দিকে ফিরে তাকানোর আর সময় কই?

ভাবনার সাগরে বেশ ভালোই ডুব দিয়েছিল ও।হটাৎ মনে পরে ছাদে জামা কাপড় শুকাতে দেওয়া আছে।ইসস!এতক্ষণে ভিজে গেল বোধয়। নিজের উদাসীনতায় লজ্জা পেয়ে প্রায় সাথেসাথেই ছাদে ছোটে ও।না এখনও পুরো ভেজেনি যা অবস্থা তাতে একটু ফ্যানের হাওয়ায় দিলেই শুকিয়ে যাবে।যথাস্থানে জামা,কাপড়গুলোকে রেখে আবার ছাদে যায় ও।টিকলি ঘুমাচ্ছে এই সুযোগে একটু ভিজে নেওয়া যাক।কতদিন ভেজা হয়না প্রাণভরে।চোখ বন্ধ করে দু হাত মেলে ভিজতে শুরু করে। এভাবে কতক্ষণ কেটেছে নিজেও জানেনা শ্রী।হটাৎ ওর শাড়ির আঁচলে টান পড়তেই চোখ খুলে ও টিকলি ওর ঠাম্মা মানে শ্রীময়ীর শাশুড়িমা নীরজাদেবীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।

__”মা তুমি এখানে এইভাবে ভিজছ।বয়েস হয়েছে তোমার ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”;শ্রী বলে ওর শাশুড়িকে।

__”আরে ছাড় তো মাঝেমধ্যে সংসার থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ফেলে আসা মেয়েবেলাকে খুঁজে পেতে বড্ড ইচ্ছে করে রে। তুই ধরমর করে উঠে আসাতে টিকলি দিদিভাইয়ের ঘুমটা ভেঙে যায় সেটা তুই খেয়াল করিসনি।একটু চুপচাপ থেকে আমার কাছে গিয়ে বায়না করতেই ওকে নিয়ে উঠে এলাম ছাদে।দেখ আমাদের বাড়ির নীচে কেমন জল জমেছে। আজ আয় একসাথে চল একসাথে রঙিন কাগজের নৌকা ভাসাবো আমরা। নিজেদের মেয়েবেলাটা উদযাপন করব নতুনভাবে।”

বাঃ দারুণ বলেছে তো মা।মেয়ে টিকলি আর নীরজাদেবীর সাথে ভিজতে ভিজতে শ্রীময়ীর মনে হয় এই সংসার সীমান্তে বোধয় সব নারীর জীবন একই খাতে বয়।কিন্তু তারই মাঝে খুঁজে নিতে হয় ভালো থাকার পাসওয়ার্ডগুলো একদম নিজের মত করে তবেই না বেঁচে থাকার সার্থকতা। জমা জলে রঙিন কাগজের নৌকা ভাসিয়ে গুনগুন করে শ্রীময়ী গেয়ে ওঠে,”আমার প্রথম দেখা বৃষ্টির জলে/ভাসিয়েছি ভেলা খেলাচ্ছলে।” সত্যিই নীরজা আর শ্রীময়ী দুই নারীর মনের কোণে লুকিয়ে থাকা শিশুসত্তাটা আজ ডানা মেললো টিকলির জন্য। তাই বোধয় বলে একজন শিশুই পারে বড়দের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ছেলেমানুষীগুলো সময়মত বের করে আনতে। ভেসে চলে ওদের তিনজনের ভালোবাসার নৌকা অজানা গন্তব্যে উজানস্রোতে পাল তুলে।।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত