জগাদা গম্ভীর মুখে হঠাৎ বলে উঠলেন, ” বুঝলি কেতো, লুঙ্গি পরা মানুষ দেখলেই এখন আমার হৃৎপিণ্ড লাফাতে লাফাতে মুখে উঠে আসতে শুরু করছে, হাঁটু দুটো কাঁপতে কাঁপতে ঠোকাঠুকি শুরু করছে, এই ভরা শীতেও হাতের তালু ঘামতে শুরু করছে!”
গরম আলুর চপটায় সবে কামড় দিয়েছিলাম। কথাগুলো শুনে প্রায় বিষম আর ভির্মি খেতে খেতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, জগাদা কথাগুলো যথেষ্ট সিরিয়াসলিই বলছেন, মুড়ি চিবুতে চিবুতে। মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না কথাগুলোর, যথারীতি। কিন্তু, সন্ধ্যা বেলায় রাস্তার মোড়ে এই ভরা দোকানে লোকজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি আর ফিসফিসানি দেখে বেশ বুঝলাম আবহাওয়া খারাপের দিকে যাচ্ছে! একজন লুঙ্গি ওয়ালা চাচা তো দেখি বেগুনি খাওয়া থামিয়ে এখানেই কটমট করে তাকিয়ে আছে। বুকটা আমার ধুকপুক করে উঠলো। পেটটাও কেমন যেন একটু গুড়গুড় করছে মনে হলো।
জগাদাকে থামাবার জন্য বললাম, “চলুন, বাড়ির দিকে যাই কিন্তু কে শোনে কার কথা?! উনি যেন দম দেওয়া পুতুল হয়ে গেছেন, যা শুরু করেছেন তা শেষ না করে থামবেন না! লঙ্কায় এক কামড় বসিয়ে বললেন, বুঝলি ভাই কার্তিক, তুইও একটু সাবধানে থাকিস। লুঙ্গি পরনে ওয়ালা থেকে অলটাইম দশ হাত দূর। কী বুঝলি?” আমি থোড়াই বুঝলাম। আমার দৃষ্টি আড়চোখে তখন বেগুনি-লুঙ্গির দিকে থুড়ি বেগুনি চিবুতে থাকা লুঙ্গি পরা চাচার দিকে! বেশ বুঝতে পারলাম উনি খানিকটা এগিয়ে এসেছেন আমাদের দিকে, দোকানের হই হট্টগোল কাটিয়ে উঠে আমাদের কথোপকথনটা ঠিক ঠাক শোনার জন্য। আর হ্যাঁ, হাতে এখন পেঁয়াজি!
অজান্তেই বুকটা খচখচ করে উঠলো; পেঁয়াজির মন মাতানো গন্ধটা যেন ফিল করতে পারলাম! জগাদা তো আর এই দুর্মূল্যের বাজারে ২ টাকা দাম বেশি দিয়ে পেঁয়াজি খাওয়াবে না! “কি রে হাঁদা, ঐখানে হাঁ করে কী দেখছিস? আমি কী বললাম কানে গেছে?!” ঠকাস করে একটা রাম-গাট্টা এসে পড়লো মাথায়। দেখি জগাদা বিরক্ত মুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে নিয়ে বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ শুনেছি তো! লুঙ্গি বলেই জিভ কেটে গলার আওয়াজ আস্তে করে নিয়ে বললাম, “থেকে দশ হাত দূরে থাকবো!” চাচা কি শুনতে পেলো?! পেটটা আবার কেমন গুড়গুড় করছে যেন! যাইহোক, গাট্টা খাওয়া মাথাটা চপ খাওয়া তেলা হাত দিয়ে চুলকাতে চুলকাতে জগাদার দিকে মনক্ষেপ করলাম (ভ্রুক্ষেপ করার মতো, আরকি!)
জগাদা তখন সদ্য হিমালয় ফেরত জীবনের নিগূঢ় রহস্য উপলব্ধকারী বিজ্ঞ প্রাজ্ঞর মতো বলতে শুরু করেছেন, ” তা সেদিন তোর বৌদির মুখ ঝামটা খেয়ে পড়ি মড়ি করে সাইকেল আর কেরোসিনের পিপা নিয়ে ছুটলাম রেশনের দোকানে। গিয়ে তো আক্কেল গুড়ুম! শালা! ছুটির দিনে কোথায় একটু ঘরে শুয়ে বসে আয়েস করে খবরের কাগজটা পড়বো, তা নয় কেরোসিনের পিপা নিয়ে ছোট!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে, তারপর, বলল, “ভালো করেছিস ভাই বিয়ে করিসনি।” যাইহোক ভাই, খাল যখন কেটেছি কুমির তো আসবেই!” একটু থেমে জগাদা ঠোঙাটা উপুড় করে শেষ মুড়ির টুকরোটাও গলাধঃকরণ করে নিয়ে বললেন, “একে তো কেরোসিনের তেলের জন্য অত লোকের ভিড়, তার ওপর আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া।”
– “মানে?!”
অজান্তেই অস্ফুটে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। লুঙ্গি-চাচা তখন হাতে চায়ের ভাঁড় নিয়ে আমাদের আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে, বেশ বুঝতে পারলাম। বিশু আমাদেরকেও ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড় ধরিয়ে গেল। সুড়ুৎ করে চুমুক দিয়ে জগাদা আবার শুরু করলেন, ” তা কপালে গোপাল না থাকলে যা হয় আর কি, বুঝলি ভাই?! একে ঐ ভিড় তার ওপর শালা হাতে বিড়ি ধরিয়ে হাঁটু মুড়ে বসার কাজটারও তখনই সাড়া দেওয়ার ইচ্ছে হলো?! শালা, বিড়ি আর সাইকেলের হ্যান্ডেলেরও মধ্যে আজকাল আর তফাৎ রইল না?! ঘোর কলিযুগ!” জগাদা থামলেন। এই ফাঁকে বললাম, কিন্তু এতকিছুর পরেও লুঙ্গি পরা মানুষ থেকে কেন দূরে থাকতে বলছেন সেটাই তো বুঝতে পারছি না। চায়ের ভাঁড় হাতে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা লুঙ্গিরও সেই একই প্রশ্ন থাকবে হয়তো, কেমন উশখুশ করছে মনে হলো।
জগাদাকে কেমন বিমর্ষ আর কিঞ্চিত আতঙ্কিত দেখালো: কিছু একটা মনে করে যেন ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলেন। তারপর কিছু একটা ঢোঁক গিলে নিয়ে বললেন, “তুই তো জানিস ই তোর বৌদি কেমন জাঁদরেল। আর ওর বাপ মানে আমার শ্বশুরটাও সবই তো জানিস ফ্ল্যাশব্যাকে আমি যেন পরিস্কার দেখতে পেলাম ১১ বছর আগে জগাদা পাড়ারই মুনিয়াদিকে থুড়ি এখন মুনিয়া বৌদি যাইহোক তাকে নিয়ে পালিয়ে সোজা কালিঘাট তারপর জাস্ট ম্যারেড কাপল হয়ে ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন।
সন্তোষ জেঠু, মানে, জগাদার শ্বশুর মশায় লুঙ্গিতে গিঁট বাঁধতে বাঁধতে নিজের অসন্তোষ অনেক চেষ্টা করেও চেপে রাখতে না পেরে জগাদার বাড়ি গিয়ে তুমুল লাফালাফি করেছিলেন, যদিও শেষ পর্যন্ত যা হয় তাই হয়েছিল। জগাদা তারপর থেকে এ পাড়ার ঘরজামাই। কিন্তু শ্বশুরের সাথে শোলের গব্বর আর ঠাকুরের সম্পর্ক! বাস্তবে ফিরে এলাম। সহানুভূতির মাখন মাখানো গলায় বললাম, “হ্যাঁ জগাদা সবই জানি।”
জগাদা একটু বল পেলেন মনে হলো। তারপর আবার শুরু করলেন, “কোনমতে পিপাটা লাইনে রেখে, সাইকেলে বডিটা ফেলে হাঁই হাঁই করে প্যাডেল করে বাড়ি মুখো হয়েছি, কতক্ষণে গিয়ে যথাস্থানে হাঁটু মুড়ে বসে মালমশলা আনলোড করবো সেই মুহূর্তের কথা ভেবেও কেমন যেন শিহরিত হচ্ছিলাম, তা তুই কী বুঝবি রে ভাই, যার হয়েছে সেই জানে।” আসন্ন ক্লাইম্যাক্সের তাড়নায় চাচা দেখি কখন দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে পাশে বেঞ্চে এসে বসেছে! জগাদাকে তখন মহর্ষি বেদব্যাস ভর করেছেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষাঙ্ক এক নিঃশ্বাসে বলে তবেই থামবেন: ” আমি তখন ভাগ মিলখা ভাগ! সাইকেল পাঁই পাঁই করে ছুটছে এদিকে ভেতরের মালমশলাও মুখের কাছে প্রায় চলে এসেছে, কখন না জানি ন্যাত করে গোবরের মতো আমার হাফ প্যান্ট গলে পড়ে, এমন সময়! হঠাৎ এমন সময়!” জগাদা চুপ।
– “আরে কী হলো? থেমে গেলেন কেন? বলবেন তো!”
আমি আঁতকে উঠলাম। আড়চোখে দেখলাম চাচা লুঙ্গির খুঁট দিয়ে ঘাম মুছছে! কী সাসপেন্স রে বাবা! ধ্যানমগ্ন ঝষির মতো জগাদা বলতে লাগলেন, “ভোলার মুদির দোকান থেকে বাঁদিকে টার্ন মারতেই কেলেঙ্কারি কান্ড! কে একজন লুঙ্গি পরা মানুষ দু’হাতে ব্যাগ ভর্তি জিনিস পত্তর নিয়ে সামনে পিছনে না দেখে বাঁই করে রাস্তার মাঝখানে, একেবারে আমার সাইকেলের মুখে! পুরো হেড-অন-কলিশন!” জগাদার চোখ মুখে দেখি এক অদ্ভুত আতঙ্ক! ঢোঁক গিলে নিয়ে বললেন, “সর্বনাশ হয়ে গেল!” আমি ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “লোকটার হাত পা ভেঙে গেল নাকি?”
– “না।”
– “ব্যাগভর্তি জিনিস গুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে নষ্ট হলো, তাহলে?!”
– “না।” আমি অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে?!”
– “লুঙ্গি।”
– “মানে?!”
জগাদা অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে বললেন, “মানে,ওনার লুঙ্গিটা আর ওনার কোমরে রইলনা! আমার সাইকেলের সামনের চাকাতে জড়িয়ে পেঁচিয়ে একাকার কান্ড! তবে ব্যাটা ঐ জলহস্তীর মতো চেহারা নিয়ে নিজেও পড়েনি আর ব্যাগ থেকে একটা জিনিসও পড়তে দেয়নি! শুধু আমার সাইকেলটাই সামনে তুবড়ে গেল! আর আমি চারচিৎপাত মাটিতে!”
– “তারপর?!” আমার আর তর সইছে না।
– “সে এক বিরল বীভৎস দৃশ্য! দুধ সাদা আন্ডার ওয়্যার পর যমকালো এক ছোট খাটো জলহস্তীর মতো একটা মানুষ দু’হাতে দুটো ব্যাগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
আর তার ক্রোধের আগুনে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া এক অসহায় মানুষটাকে, আমাকে, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে চাইছে। তার দৃষ্টি তে আমার পিলে চমকে গেল! কে আমি, কোথায় আমি, কী সমস্যা হয়েছিল, কোথায় যাচ্ছিলাম সব কেমন ঐ জড়িয়ে যাওয়া লুঙ্গিটার মতোই তালগোল পাকিয়ে গেল। হালকা একটা জটলা তৈরী হলো, হালকা ফিসফিস হালকা ফিকফিক সব কানে এলো।
কেউ সাহায্য করতে এলনা রে ভাই! কে একজন দেখি মোবাইল বের করে ফটো না ভিডিও করতে শুরু করেছে। আমি মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে দেখলাম, ঐ লুঙ্গি-হীন চলন্ত যমটা ঐ অবস্থাতেই ব্যাগ নিয়ে হাঁটা লাগিয়েছে! তার মুখ থমথমে, চোখ ভাটার আগুনের মতো জ্বলছে। আমার পাশ থেকে যাওয়ার সময় চিবিয়ে চিবিয়ে খালি বলে গেলেন, ‘বাড়িতে এসো।’ আমি মড়ার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম, ওনার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে।” আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “উনি কে ছিলেন?” জগাদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আমার শ্বশুর!” হঠাৎ নীরবতা! তারপর, পেছনে কে যেন খকখক করে কেশে (নাকি হেসে) উঠলো। দেখি লুঙ্গি-চাচা খৈনি ডলতে ডলতে কী একটা গান ভাঁজতে ভাঁজতে রাস্তার দিকে এগিয়ে চলেছে।
সমাপ্ত