– মা, ও মা।
– কি হইলো বাপ? আর কয়ডা ভাত নিবা?
– না, মা।
– তাইলে ভাত ঠান্ডা দেইহা খাইবা না?
– উঁহু।
– তাইলে?
– আমারে একখান নতুন সোয়েটার কিনা দিবা।
– বাপ, আগের সোয়েটারডা তো অহনো নতুনই আছে। রাসেল মুখভার করে বললো,
– আগের সোয়েটারডা ছোট হইয়া গ্যাছে। আর তিন হানে ফুডা হইয়া গ্যাছে।
– বাপ, অহন তো হাতে টাহা পয়সা নাই। তুমি বরং আমার চাঁইদ্দরডা গায়ে দিও। এই মাসের ব্যাতন পাইলেই তোমারে নতুন সোয়েটার কিন্না দিমু। আনন্দে রাসেলের চোখ চকচক করে উঠলো।
– সত্যি কইতাছো মা?
– হ, বাবা। নিজের শরীর থেকে চাঁদর খুলে ছেলেকে দিতে গেলে রাসেল বললো,
– মা, আমারে চাঁইদ্দরডা দিয়া দিলে তুমি গায় দিবা কি? তোমারও তো ঠান্ডা লাগবো।
– মায়ে গো ঠান্ডা লাগে না বাপ। আমি তো সারাদিন কাম করি। আমার গরম লাগে। ঠান্ডা কাছে আইতেই পারে না। তাই তুমি চাঁইদ্দর প্যাঁচাইয়া বইয়া থাকবা। দেখবা, একটুও ঠান্ডা লাগবো না।
বেলা বেড়েছে। আছিয়াকে কাজে যেতে হবে। শীতের প্রদাহ কমে গেছে। রাসেলকে বাড়িতে রেখে কাজে চলে গেল আছিয়া। আজ কাজ শেষ হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাড়িতে ফিরতে রাত হলো আছিয়ার। শীত বেড়েছে। শীতের প্রবলে হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে। বাড়ি ফিরে উঠানের উনুনে আগুন ধরিয়ে তার পাশে বসে পড়লো আছিয়া। আগুনের তাপে হাত-পা কিছুটা গরম হয়েছে। রায়হান পড়তে বসেছে৷ মা’কে দেখেই জড়িয়ে ধরলো। খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লো। মাঝরাতে শীতের প্রবাহ অতিমাত্রায় বেড়ে গেল। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। মনে হচ্ছে কাঁথা ছিদ্র করে শীত যেন শরীরের ভেতর বিঁধছে। রাসেলের গায়ে চাঁদর আর কাঁথা ভালো ভাবে টেনে দিয়ে পাতলা কাঁথায় কোন রকমে রাত পার করলো আছিয়া।
মাস শেষ হতে এখনো দশ দিন বাকি। বাড়িওয়ালির এক কথা, সে মাস শেষের আগে কোন টাকা দেবে না। আছিয়ার স্বামী এক্সিডেন্টে মারা যাবার পর উনিই কাজ দিয়ে দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল। তার জন্যই ছেলের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতে পেরেছিল। বাড়িওয়ালি এমনিতে একটু কড়া হলেও মনটা অনেক ভালো। অন্যদের চাইতে বেশি বেতন দেয় সে আছিয়াকে। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকে আছিয়া আএ অন্য কোথাও কাজ নেয়নি।
আছিয়া প্রতিদিন কাজ থেকে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করে। সন্ধ্যার পরে শীতের প্রভাব বেড়ে যায় বলে। আজ মাসের শেষ দিন। বেতন দেবে। রাসেল প্রতিদিনের মতো আজও বললো, ” মা, নতুন সোয়েটার আইনা দিবা কবে?” আছিয়া ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বললো, ” আইজকা ব্যাতন পাইলেই তোমার লাইগা নতুন সোয়েটার নিয়া আসুম। ” কাজে যেতেই দারোয়ান বললো, ” আফা, ম্যাডামে বাড়িত নাই। তার মায় মারা গেছে। তাই গ্যারামে গেছে। আপনারে কইতে কইছে, ম্যাডাম এক সপ্তা পর ফিরবো। আপনি এক সপ্তা পর কামে আইসেন।”
আছিয়ার খুব মন খারাপ করলো। ছেলেটা যে বড্ড আশা নিয়ে বসে আছে৷ কিন্তু সে সোয়েটার কিনবে কী দিয়ে? হাতে তো একটা টাকাও নেই। খালি হাতেও তো সে যেতে পারবে না। ছেলেটা যে বড্ড কষ্ট পাবে। হঠাৎ তার নাক ফুলের দিকে নজর পরলো। নাক ফুলডা তো শইন্নের। বিয়ার সময় রাসেলের বাপ দিছিলো। এইডা বেঁচলেই তো তিন-চাইর’শ ট্যাকা পাওন যাইবো। যদিও এইডা রাসেলের বাপের শ্যাষ স্মিতি। তাতে কি? বিধবা মাইয়া মাইনষের আবার নাক ফুল কিসের? এইডা বেইচ্চা দিলে তো ছেলেডার মুখে হাসি ফুডবো।
সে নাক ফুলটা স্বর্ণের দোকানে বিক্রি করে, ফুটপাতের দোকান থেকে ছেলের জন্য ভালো একটা সোয়েটার কিনে বাড়ি ফিরলো। নতুন সোয়েটার পেয়ে ছেলেটা আজ বড্ড খুশি। হঠাৎ, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রাসেল বললো, ” মা, তোমার নাকের ফুলডা কই? ” আছিয়া ছেলেকে আদর করে কোলে বসিয়ে বললো, ” কোন হানে হয়তো পইড়া গ্যাছে। খেয়াল করি নাই, বাপ।