কিচিমিচি পাখির ডাকে ঘুম ভেঙে গেলো। হাতের বাম পাশে ফোন চার্জে লাগানো।সুমিত ঘুমের ঘোরে ফোন হাতে নিয়ে দেখে ৪০টা মিসকল। পাশে ছোট্ট করে লেখা রূপা। সুমিতের মন ধরফর করে উঠলো।আজ নিশ্চিত কপালে শনি আছে।রূপা অনেকবার বলেছে ফোন জেনারেল মুডে রাখার কথা।কিন্তু কোন না কোন কারণে সাইলেন্ট থেকেই যায়। এইতো কিছুদিন আগেও সুমিত ফোন জেনারেল মুডে রেখে ঘুমিয়েছিলো।ভাগ্যক্রমে মাঝে আননোন নাম্বার থেকে তুমুল কল।রিসিভ করলে কোন কথা বলে না।এরকম টানা আধ ঘণ্টা চলার পর অবশেষে সাইলেন্ট করে ঘুমাতে হয়েছিলো।ফলস্বরূপ রূপার কাছে বকা খাওয়া। আজ কি হয় কে জানে? সুমিত বুকে ফুঁ দিয়ে কল ব্যক করলো।রিং হয়ে যাচ্ছে।রিসিভ হচ্ছে না। ১২টা কল দেওয়ার পর বিরক্ত হয়ে সুমিত শেষ চেষ্টা করতে রিসিভ হয়ে গেলো। “মরার ঘুম ভাঙছে?না ভাঙলে আরও দশ মিনিট ঘুমা।” সুমিত ভয়ে ভয়ে বললো “ঘুম ভাঙছে জান।”
রূপা দাত কটমট করে বললো “তাহলে শোন, আমাকে আজ ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসছে।এতক্ষণ সেখানে ছিলাম।ছেলে সিভিল ইঞ্জিয়ারে বুয়েট থেকে BSC কম্পিলিট।দেখেতেও খারাপ না।বাপের ব্যংক ব্যালেন্স দিয়ে তোর চৌদ্দ গুষ্টি কিনে ফেলতে পারবে।এ যাত্রায় মনে হয় বিয়েটা আটকাতে পারলাম না।” সুমিত মাথা চুলকে জিজ্ঞাসা করলো “বাপের এত টাকা থাকতে বুয়েটে পড়তে গেছে কেন?কোন প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়তো।তোমার আব্বুকে ভালভাবে খোঁজ নিতে বলো, দেখবা শালা জম্মের ফকিন্নি।” “হুম তুই এই চিন্তাই কর।এদিকে আমি বিয়ে করে দুই-চারটা ডাউনলোড দিয়ে ফেলি।”সুমিত বাংলা ছবির আদিম নায়কদের মতন বললো “না রূপা না।তুমি এরকম করতে পারো না।এতদিন আমার ডাটা খরচ করে ডাউনলোড দিবা অন্যকারো ওয়াইফাই দিয়ে।”রূপা গম্ভীর সুরে বললো “এটা জোক্সস ছিলো?” সুমিত বোকা বোকা হাসি দিয়ে বললো “তুমি বিয়েটা আটকাও।আমি সামনে মাসে তোমার বাসায় প্রস্তাব পাঠাচ্ছি।”
“বিয়ে আটকানো সম্ভব না।ছেলের সাথে আব্বুর আগে থেকে পরিচয়।আজ শুধু দিন তারিখ ঠিক করতে আসছে।”
“তাহলে ছেলেকে আমার কথা বলে দাও।”
“তোমার কি মনে হয় আমি বলি নাই?”
সুমিত অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো “পরে ছেলে কি বললো?” “সমস্যা নাই।এই যুগের মেয়েরা দুই একটু প্রেম করে।আর সবচেয়ে বড় কথা, বিষয়টা অনেকদূর এগিয়ে গেছে।এখন বিয়ে ভেঙে দিলে আমার রেপুটেশন খারাপ হবে।”
“হ্লা কত্তো বড় ছ্যাচড়া।”
“হুম।আব্বু বলতেছে কালকে ইংগেজমেন্ট করে ফেলবে।দুই সপ্তাহ পর বিয়ে।”
“কংগ্রাচুলেশনস।”
রূপা কান্নার সুরে বললো “তোর কাছে এসব মজা হতে পারে।আমার কাছে জীবন মরণের ব্যপার।যেভাবে পাড়িস আমাকে নিয়ে যা।” সুমিত ঢোক গিলে বললো “ওকে।পরশুদিন টাকা ম্যানেজ করে আসতেছি।” রূপা চিল্লায়ে বললো “ওই কুত্তারবাচ্চা তোর কি মনে হয় আমি অন্য ছেলের হাতে আংটি পড়বো?”
“ইয়ে মানে একটুপর আসতেছি।”
“ঢাকা থেকে ফরিদপুর আসতে চার ঘণ্টা সময় লাগে।
তোরে আমি পাঁচ ঘণ্টা দিলাম।এক মিনিট দেরি হলে ধরে নে রূপা শেষ।” সুমিত ফোন কেটে লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলো।সে জানে রূপা সিরিয়াস মাইন্ডের মেয়ে।নয় ছয় হলে কি করে ফেলবে নিজেও জানেনা। এদিকে পকেট শূন্য।সিগারেট খাওয়ার টাকা পর্যন্ত নেই।ম্যাচের সামনে চায়ের দোকানদারের থেকে সিগারেট বাকি করে চলতে হচ্ছে।কিন্তু সে কি টাকা ধার দিবে? নাহ্!অসম্ভব। অন্য কিছু ভাবতে হবে।পরক্ষণে মনে পড়লো জাহিদের কথা।
“হ্যালো দোস্ত।” জাহিদ সন্দেহজনক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো “ব্যাপার কি?তুই ফোন দিছিস।”
“এমন ভাব করতেছিস যেন ফোনই দেই না।”
“দেসই তো না।” সুমিত চিন্তা করে দেখলো জাহিদের সাথে শেষ কথা হইছে দেড় মাস আগে।তাও মেসেঞ্জারের কয়েকটা রিপ্লে।এরপর কনভার্সন সিন করা হয়নি।
“ইয়ে মানে তোরে খুব মিস করতেছিলাম।”
“নাইস জোক্সস।”
“দোস্ত লাভ্ ইউ।মিস ইউ।উম্মা উম্মা উম্মা উম্মাহ্।”
“হুর শালা।মজা লস?”
সুমিত নিচু স্বরে বললো “তোর গাড়িটা ফ্রি আছে?” জাহিস নির্দয়ভাবে বললো “আছে।কিন্তু তোরে দিমুনা।ভুলে গেছিস পরীক্ষার হলের কথা?৪ নম্বর প্রশ্নের নকল চাইছিলাম।দিছিলি?” সুমিত মন খারাপ করে বললো “দোস্ত রূপার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।”
“তো আমি কি করবো?”
“একটু হেল্প কর প্লিজ।”
“আমার কাছে টাকা নাই গাড়িও নাই।”
“দোস্ত প্লিজ।প্লিজ..প্লিজ..প্লিজ।”
জাহিদ ঝাড়ি দিয়ে বললো “বলছি তো নাই।ফোন রখ।”সুমিত মন খারাপ করে ফোন কেটে দিলো।বাসায় যাওয়ার মতন পর্যাপ্ত টাকা পর্যন্ত নেই।রূপাকে নিয়ে পালাবে কিভাবে? ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে।প্রিয় মানুষ অন্যের হয়ে যাবে ভাবলে কেমন শরীর শিউরে উঠে।যার সাথে এতটা পথ চলা।কতশত স্বপ্ন বোনা।তাকে ছাড়া বাকি জীবন পাড়ি দেওয়া?ওপ্স! এটা সম্ভব নয়। সুমিতের ফোন বেজে উঠলো।
“কে?”
“জাহিদ।নিচে আয়।ফরিদপুর যাবো।”
“সরি দোস্ত।তোর সাথে এর আগে অনেক মজা করছি।জানি এর জন্য আমার ওপর অনেক ক্ষোভ জমে আছে।কিন্তু প্লিজ তার জন্য এই সময়টায় মজা করিস না।” “তুই নিচে আসবি নাকি আমি ওপরে আসবো?” পরক্ষণে সুমিতের মুখ উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতন জ্বলজ্বল করে উঠলো।সে ফোন কেটে দৌড়ে নিচে চলে গেলো।সামনে জাহিদ প্রাইভেট কার নিয়ে অপেক্ষা করছে। সুমিত প্রাইভেট কারে বসে জিজ্ঞাসা করলো “বাইক কোথায় তোর?” জাহিদ হেসে বললো “রেখে আসছি।বাইকে বসে সিগারেট ঠিক জমে না।সিটের পাশে দেখ সিগারেট রাখা আছে জ্বালা।” সুমিত খুশিতে আন্তহারা।জাহিদের মতন বন্ধু পাওয়া সত্যি ভাগ্যের বিষয়।ছেলেটা যেমনই হোক, সবাইকে বুঝে। গাড়িতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না।
আড়াই ঘণ্টার জায়গায় দেড় ঘণ্টায় ফেরিঘাটে এসে থামলো। তারপর ফেরিতে উঠে দুজনে ফেরির ছাদে চলে গেলো।মানুষের যাত্রা এখানটায় এসে বিশ্রাম পায়।না জানি কত রকম মানুষের যাতায়াত এখানে। কিছু লোক জায়গা করা স্থানে নামাজ আদায় করে আবার কিছু লোক সিগারেটের ধোঁয়ায় পবিত্র জায়গার অসম্মান করে। অনেক ভাবলে দেখা যায় মানুষ বলতে বিচিত্র। সুমিত কথা গুলো ভাবতে ভাবতে নিচে তাকিয়ে দেখলো এক লোক তাঁর ছোট্ট মেয়েকে কোলে করে ফেরিতে উঠছে।অন্য হাতে ব্রিফকেস। মেয়েটা একবার চুল ধরে টানছে একবার নাক ধরে টানছে।কিন্তু তাতে তিনি কিঞ্চিৎ পরিমাণ বিরক্ত হচ্ছেন না।বরংচ হাসি মুখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছেন। পরক্ষণে রূপার বাবার কথা মনে পড়লো।রূপাও তো একসময় ছোট ছিলো।তখন হয়তো রূপা তাঁর বাবাকে এভাবে জ্বালিয়েছে।
সুমিত যদি এখন রূপাকে নিয়ে পালিয়ে যায় তাহলে কি দাঁরাবে? নাহ্! কাজটা ঠিক হবে না।নিজ সার্থের জন্য এভাবে একজন বাবাকে কষ্ট দেওয়া ঘোর অন্যায়। সুমিত ডিসিশন বদলে ভেবে নিলো রূপাকে নিয়ে পালাবে না। হঠাত পাশ থেকে জাহিদ জিজ্ঞাসা করলো “কিরে কি ভাবছিস?” সুমিত থতমত খেয়ে বললো “দোস্ত আমি ভুল করতে যাচ্ছি।” “কেন?” “রূপাকে নিয়ে পালানো ঠিক হবে না।” জাহিদ অবাক হয়ে বললো “ধুর পাগল।এতক্ষণ পর কি বলছিস?” “হুম দোস্ত।ভেবে দেখ তোর বা আমার বোন যদি পালিয়ে যেতো তাহলে কি করতি?আমাদের বাবা মা কি খুব সহজে সহ্য করতে পারতো?” জাহিদ কিছুক্ষণ ভেবে বললো “তাহলে কি করবি এখন?” সুমিত হতাশার নিশ্বাস ফেলে বললো “রূপাকে না বলে দিবো।”
জাহিদ ভাষা খুঁজে পেলো না।একজন বাবার সম্মানের কাছে হয়তো বন্ধুত্ব বড় নয়।বরংচ বন্ধু তো সে যে সৎ কর্মে উৎসাহ এবং অসৎ কর্মে তাল মেলায়। সুমিত রূপার নম্বরে “সরি” লিখে ছাদ থেকে নিচে নেমে গেলো।ফেরি প্রায় কিনারায় পৌছে গেছে। আকাশে মেঘ জমেছে।বাতাস ছাড়লে নদীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।ভাগ্য ভালো আগে থাকতে তাঁরা চলে এসেছে। জাহিদ গাড়িতে বসে সুমিতের উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করলো “ফরিদপুর যাবি নাকি ঢাকা ফিরে যাবো?” সুমিত বাহিরে চোখ বুলিয়ে বললো “নদীর অবস্থা বেশি ভালো না।আপাতত বাসায় চল।কাল ঢাকা ফিরে যাবো।”
“ওকে শোন, আব্বু ওনার এক বন্ধুর সাথে কথা বলছে।ডাটা এন্ট্রির কাজ।স্যালারি মোটামুটি ১৮ হাজার।তুই চাইলে পরশু থেকে জয়েন করতে পারিস।”
“এখন আর জব দিয়ে কি করবো?”
“ব্যস্ততার মধ্যে থাকলে কষ্ট কম হবে।”
সুমিত কিছু বলতে যাবে অমনি ফোন বেজে উঠলো।স্ক্রিনে রূপার ভাবীর নাম্বার। রিসিভ করতে কান্না জড়িত কণ্ঠে ওপাশ থেকে ভেসে এলো “রূপা বিষ খেয়েছে।”সুমিত থমকে গেলো।জাহিদ কয়েকবার জিজ্ঞাসা করলো “কি হয়েছে?” কিন্তু কোন জবাব এলো না। অবশেষে সে সুমিতের হাত থেকে ফোন নিয়ে বললো “কে?” জবাবে ভেসে এলো “রূপা বিষ খেয়েছে।”
জাহিদও শিউরে উঠলো।তবে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েনি।”আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রূপাকে আরোগ্য সদন হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।আমি সেখানকার ডাক্তারকে ফোন করে দিচ্ছি।রূপার কিচ্ছু হবে না।”
বলে ফোন কেটে জাহিদ সুমিতের দিকে তাকালো।সুমিত জীবিত লাশের মতন বসে আছে।দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কিন্তু তাকে শান্তনা দেওয়ার মতন পর্যাপ্ত সময় হাতে নেই।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে হবে। রাত প্রায় দুইটা। রূপার জ্ঞান ফিরেছে।সে মিটমিট করে চোখ খুলে চারিপাশে একবার চোখ বুলালো।তারপর হাতের কাছে তাকাতে দেখে সুমিত বসে আছে। চোখ ফুলে একাকার।রক্তাক্ত বর্ণ ধারণ করেছে। রূপা ফিসফিস করে বললো “তোর এই অবস্থা কেন?” সুমিত রূপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো “আমার কিছু হয়নি।সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আগে বল তোর চোখ লাল কেন?”
“এমনি।”
“তুই চাস এখন হাত থেকে স্যালাইন খুলে ফেলি?”
“কান্না করছি।”
“কান্না করছিস কেন?”
“তুমি বিষ খাইলা কেন?”
“তুই সরি বলে চলে যাবি আর আমি বসে থাকবো?”
“সরি।”
“কিসের সরি?”
“ভাবছিলাম তোমাকে নিয়ে পালালে তোমার আব্বু-আম্মু কষ্ট পাবে।তাই”
“তোর আবার জ্ঞান-বুদ্ধি হলো কবে থেকে?”
জাহিদ কোন জবাব দিলো না।এক ধেনে রূপার দিকে চেয়ে রইলো।রূপা লজ্জা পাচ্ছে।সে লজ্জা কাটাতে গম্ভীর কণ্ঠে বললো “আব্বু-আম্মু কোথায়?” “অন্য কেবিনে ঘুমাচ্ছে।” “তোরে দেখছে?” “হুম।” “কিছু বলে নাই?” “একটা থাপ্পড় মেরে বলছে ওনাকে আমাদের কথা জানালাম না কেন।” “যাক।তাহলে আমার থাপ্পড় তোর ওপর দিয়ে গেছে।এখন বল তোকে কি শাস্তি দিবো?” সুমিত চোখ বড় বড় করে বললো “আবার শাস্তি কেন?”
“আমার ইচ্ছা।” সুমিত খেয়াল করলো রূপা কথা বলার সময় ঠোঁট উঁচু করে কথা বলছে।ব্যপারটা সুমিতের মনযোগ অন্যদিকে নিয়ে গেলো। রূপা কি বলছে সুমিত বুঝতে পারছে না।মন শুধু একটা উদ্দেশ্য টার্গেট করেছে। কিন্তু হঠাৎ এভাবে কি ঠিক হবে? রূপা যদি রাগ করে? ভাবতে ভাবতে সুমিত ধৈর্যহারা হয়ে রূপার ঠোঁটে ঠোঁট মেলালো। রূপা হতভম্ব।সে আর যাইহোক এটা আশাকরেনি।কিন্তু কি বা করার? পাগলের প্রেমে যে পড়েছে। পাগলের সাথে প্রেম করতে গেলে তাদের সাই না দিয়ে উপায় কোথায়?