অফিস শেষ করে তারপর রোজ রাতে রেললাইন দিয়ে ৩০ মিনিট হেটে বাসায় আসতে হয় আমায়। রেলপথে হাটার দুইটা উদ্দেশ্য, এক রেলপথে একা নিঝুম রাতে হাটতে আমার ভালো লাগে আর পাশাপাশি বাস ভাড়ার টাকাটাও বেচে যায়। শুধুই যে টাকা বেচে যায় তা নয় বরং টাকার চেয়ে মূল্যবান সময় বেচে যায়। অফিস শেষে বাসের জন্য ১০ মিনিট দাড়ানো তারপর বাসে উঠে সিট না পেয়ে দাড়িয়ে যাওয়া উপরন্ত জ্যামে পড়ে ১০ মিনিটের রাস্তায় ৪০ মিনিট বসে থাকা এইতো ঢাকা শহর।তারচেয়ে আমি বরং রেলপথটাই বেছে নিয়েছি।
প্রতিদিনের মত আজও হাটছি এই পরিচিত রেল লাইনে। কখনো ট্রেন আসে ঝিক-ঝিক-ঝিক-ঝিক করে আমার ভালোই লাগে। কালো অন্ধকারের মাঝে একটু দুরেই লক্ষ করলাম সাদা ধোয়া। কিহ!!!!! কি ছিল ওটা??? মনটা আমার চমকে গেল। প্রতিদিন হাটি এরকম তো কিছুই দেখিনা। ধোয়াটা যেই রুটে ছিল বিপরীত পাশ থেকে ঐ রুটেই ট্রেন আসছিল। কাছাকাছি যেতেই লক্ষ করলাম কেউ একজন রেল লাইনে শুয়ে আছে হয়তো আত্মহত্যা করবে। তার মুখে আগুনের শিখা ধিকি-ধিকি জ্বলছে, ওটা সিগারেট আর সাদা ধোয়াটা ওখান থেকেই আসছিলো।
একটু দাড়ালাম ট্রেন প্রায় চলেই এসেছে লোকটা যেই হোক মরবার পুরো প্ল্যান করেই রেল লাইনে শুয়েছে। একদম শেষ মুহূর্তে বাচালাম তাকে আর একটু দেরি হলে ও মরত নয়ত আমি আহত হতাম। আমি তো অবাক!!! আমি যাকে বাচিয়েছি এ কোন ছেলে না এ তো একটা মেয়ে। মুখে তার সিগারেট তখনো জ্বলছে। মেয়েটার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে তো মনে হচ্ছে তাকে বাচিয়ে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধ করেছি। তবে কি ছিল এই আত্মহত্যার পেছনে। রহস্য জানতে উৎসুক আমার মন। নিশ্চয় এটা রহস্যজনিত কোন আত্মহত্যা হবে।
মানুষের থেকে থেকে কি এমন হয় যে সে তার জীবণটাকেই শেষ করে দিতে চায়? সুন্দর এই পৃথিবীটা কেনই বা কারো কাছে হঠাৎ বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠে? ৬০ বছরের জীবণী নিয়ে মানুষের কিসের এত পার্থিব কল্পনা যার ৫ বছর কেটে যায় মায়ের কোলেই আর ৫ বছর কাটে কিছু বুঝতে শেখার আগেই। বাকি থাকে আর ৫০ বছর- ২০ বছর তো মানুষ ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেয়। ১০ বছর পড়াশোনার ব্যস্ততা বাকি ২০ বছরের ১০ বছর তো বৃদ্ধ বয়সে শিশুদের মতই কাটে তবে ১০ বছরের পার্থিব সুখের তারতম্যেই কি মানুষ বেছে নেয় আত্মহত্যার মত পথ!!!
“ওকে না পেলেই মরে যাবো” গাধাকে গাধা বলা হলে মানুষ নামের প্রাণীটাকে তবে কি বলা যাবে? মেয়েটি এতক্ষণ আমার কথাগুলো ক্লাশরুমে শিক্ষকের দেয়া বক্তব্যের মতই শুনছিল। এবার সে মুখ খুললো। মেয়েটির নাম নীলা। মা বাবার বড় আদরের মেয়ে দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি আধুনিক স্টাইলিশ। আকাশ নামের একটা ছেলের সাথে ছিল তার গভীর ভালবাসা। তাদের ভালবাসা এতই গভীর ছিল যে নিজেরাই বিয়ের দিন সময় ঠিক করে ফেলেছিল। বিয়ের দিন রেজিস্ট্রি অফিসে নীলা সময়মত পৌছালেও আকাশ হয়তোবা মেঘের আড়ালেই ঢাকা ছিল।
সময় বাড়তে থাকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে আকাশ আর আসেনা। তার ফোনে ফোন ও আর ঢোকে না।
রাগে ক্ষোভে নীলা বাড়ি চলে আসে। সেদিন থেকে আকাশের সাথে আর যোগাযোগ হয়না নীলার। ততদিনে খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়েই দেয় নীলা। ঘুমের ঔষুধ হয় তার প্রতি রাতের নিত্য সঙ্গী। ধীরে ধীরে নীলা নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে আকাশকে ভুলে থাকার জন্য। সিগারেটের ধোয়া ছাড়া তার চলেই না। আমায় যখন কথাগুলো বলছিল তখনো মুখে সিগারেট ফুকছিল নীলা। কালো অন্ধকারে সাদা ধোয়া স্পস্ট ঐ আকাশ পানেই উড়ছিল আর অবাক হয়ে দেখছিলাম আমি।
বুঝিনা কেনই বা মানুষ প্রেম রোগে আক্রান্ত হয়ে সিগারেটের নেশায় পড়ে। যদি ১০০ জনকে প্রশ্ন করা হয় সবচেয়ে বেশি ভালবাসো কাকে? ৯৫ % মানুষই উত্তর দেবে মা-বাবাকে ভালবাসে। মা-বাবার মৃত্যু শোকে সিগারেটের নেশা ধরেছে কেউ এরকমটা আজো আমি শুনিনি। তবে কেন গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ড নামক সস্তা বস্তু যে কিনা মারা যায় নি ঠকিয়ে চলে গেছে তার জন্য নেশা ধরে?তাকে তো ঘৃণা করা উচিত। তোমার জীবণ তোমার কাছে অপ্রিয় হতে পারে। হতে পারে তোমার কাছে তোমার জীবণ মূল্যহীন তবে তোমার মা-বাবা পরিবারের কাছে শেষ ভরসা কিন্তু তুমি-ই। তবে কেন নিজেকে শেষ করে তাদের বৃদ্ধ বয়সের শেষ ভরসাটেকে গলা টিপে হত্যা করতে মানুষ দুই বার ভাবেনা। নীলা আমার কথাগুলো শুনে কেদে উঠলো।
-কে-কে আমায় বাচার অনুপ্রেরনা দেবে বলতে পারেন। কার ওপর ভরসা করব। যে আকাশকে ভরসা করেছিলাম সেইতো ঠকালো।অনেকদিন ধোয়ার নেশায় ডুবে ছিলাম কিন্তু আজ যখন শুনলাম আকাশের বিয়ে বেচে থাকার শেষ ইচ্ছাটাও মরে গেল আর তাইতো সিগারেট হাতে এত রাতে রেললাইনে আমি নিজেকে শেষ করার চেষ্টায়, যার বাধা হলেন আপনি।
বুঝিনা ভালবাসার জন্য কেন এত কিছু হয় যেখানে প্রতারিত হবার আশংকা অনেক বেশি। কেনই বা মানুষ ভালবাসার ক্ষেত্রে আগেই শরীরের বাহ্যিক চাকচিক্য দেখে? শরীরের চাকচিক্যে যে ভালবাসার সৃস্টি হয় তা অচিরেই প্রতারিত। এই আমাদের শরীরটা মাটির তৈরি। সাদা চামড়া বলুন আর কালো চামড়া মাটি ছাড়া আর কিছুই না। দুদিন আগে বা পরে এই সুন্দর মাটির শরীর কিন্তু মাটিতেই মিশে যাবে। শরীরের শিরা-উপশিরার এই রক্ত পানির সাথে মিশে যাবে হাড়গুলো পোকামাকড় খেয়ে ফেলবে। কোন চিহ্ন থাকবে না কারো। এই যে মানুষ নিশ্বাস নেয় এটাও বাতাসে মিশে যাবে।
তবে কি অস্তিত্ব এই মাটির দেহ নামক পুতুলের? তাই ক্ষণিকের এই প্রেম ভালবাসায় সুন্দর চেহারা না সুন্দর মনকে খুজে বের করুন। অদ্ভুুত শব্দে কেদে উঠলো নীলা। সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। বেচে থাকার এক অপ্লুত আগ্রহ জেগেছে নীলার মনে আমার এই কথাগুলো শুনে। মায়াবী মুখে কিছু মিষ্টি হাসির অম্লান সৃস্টিতে কখন যেন হাতের সিগারেট টা পড়ে গেছে খেয়াল করেনি সে। রাত অনেকটা বেড়ে গেছে জোৎস্নার আলোতে নীলাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে হাসিমুখে। নীলা উঠে দাড়ালো রেলপথে হেটে তাকে বাড়ি পৌছে দিলাম।
একটা জীবণের সমাপ্তির মুখ থেকে কাওকে বাচাতে পেরে আনন্দিত আমি। এরপরে মেয়েটার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ধীরে ধীরে গভীর সম্পর্কের সৃস্টি হয় নীলার সাথে পরে আমি নীলাকে বিয়ে করে নিই। গল্পটার চরিত্র গুলো কাল্পনিক তবে কাহিনি পুরোটাই সত্য। দুইটা জীবণী থেকে এই গল্পটা লিখেছি যা একত্রে দিলাম। যে দুই জনের জীবণী শেয়ার করেছে তারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তবে আপনাদের মন্তব্য তারা দেখবে।