প্রতীক্ষা

প্রতীক্ষা

ঘড়িতে তখন রাত ১১টা | তিথি পার্কের বেঞ্চে বসে একা একা আনমনাভাবে ফেইসবুক স্ক্রল করতে থাকে | চতুর্দিকে এত রাতেও কতরকমের আওয়াজ | না, শুধু ঝিঁঝিঁপোকা নয়, কিছু নিশাচর পাখির ডাক, শুকনো পাতার শব্দ, আশেপাশে মাঝে মাঝে অহরহ গাড়ির শব্দ, কুকুরের ডাক… তবে সবচেয়ে বেশি সবচেয়ে তীক্ষ্ণ এক শুন্যতার শব্দ |
রাতের স্তব্ধতা ও তার মনের চঞ্চলতা | দুটি বিপরীত মিলে যেন এক অদ্ভুত ব্যূহ তৈরী করেছে, যার মধ্যে তিথি একা পাঁক খেয়ে যাচ্ছে, বেরোতে পারছেনা কিছুতেই | অন্ধকারের মধ্যেও পার্কের আলোয় তিথি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, সেই গাছটা |

— ” ওই দেখ, কি গাছ বলতো ওটা ? ওটাকে বলে বাদুরলাঠি গাছ ” , নেচে উঠেছিল তিথি !
— ” কথাটা বাদুরলাঠি নয়, বাদরলাঠি !” একটা গুরুগম্ভীর গলায় প্রত্যুত্তর এসেছিলো , “আর ওটা বটলগ্রাস নট বাদরলাঠি !

হাসি ম্লান হয়ে গেছিলো তিথির | যাহ, এটাও সে জানেনা | সে তো কিছুই জানেনা | একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিথি | সোয়া এগারোটা, শীতের রাতে, সে একা পার্কে বসে আছে সে | তার শ্বাসের সাদা ধোয়া সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে |হালকা কুয়াশা ধরেছে চারপাশে | আচ্ছা সত্যিই কি সে একবার ও আসবেনা ?

পুজোর সময় টালা বারোয়ারি দিয়ে ঠাকুর দেখা শুরু হতো | তারপর বাগবাজার | সময় বাঁধা ছিল রাত ৮টা | সেদিন আসতে দেরি হয়েছিল তিথির | প্রচন্ড ঝগড়া হয়েছিল টালা বারোয়ারী প্যান্ডেলের বাইরে দাঁড়িয়েই | চোখের জল মুছে সোজা হাঁটা লাগিয়েছিল তিথি | প্রায় মেট্রো অব্দি পৌঁছে গেছিলো সে। যখন পিছনে ফিরে তার পিছনে পুজোর ভিড়ের মধ্যে সেই অতি চেনা সবজে গেঞ্জীটাকে দেখতে পেয়েছিল, তখন তিথি ইচ্ছে করে পাশে একটা দোকানের খাঁজে লুকিয়ে যায় | ও পাগলের মতো তিথিকে খুঁজতে থাকে | তিথি পিছন থেকে গিয়ে ছোটবেলার মতো তাকে ধাপ্পা দিয়েছিল | রাগ সব উধাও করে দুজনেই খুব হেসেছিল | সারা রাত পায়ে হেঁটে উত্তর আর দক্ষিণ কলকাতা মিলিয়ে সব বড় ঠাকুরগুলো দেখেছিল দুজনে | রাত সাড়ে এগারোটা | ফেইসবুকে ভারী অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস থাকে | এরকমই একটি ২৫ প্রশ্নের কুইজ খেলে তিথি জানতে পারলো যে তার পার্টনার নাকি তাকে ৯৫% ভালোবাসে | মনে মনে হাসলো তিথি | এখন তাহলে সেই অধরা ৫% এর সময় চলছে ! তাহলে তো কোনো চিন্তাই নেই | তাকে নিতে সে এল বলে !

সত্যিই আসবেনা ? কলেজ এ তখন ফার্স্ট ইয়ার | নতুন ব্যাঙ্ক একাউন্ট খুলেছে তিথির , নতুন এটিএম | লজ্জার বিষয় তিথি এটিএম ব্যবহার করতে জানেনা | লজ্জায় সে কাউকে বলতে পারেনি | তার সমবয়সীদের কাছে সে যে হাসির পাত্রী হয়ে উঠবে | কোনভাবে কয়েক মাস ম্যানেজ হল, তারপর একদিন হাতে টাকা কম পড়ল | সবাই তাকে এটিএম দেখিয়ে দিল | তিথি সেদিন চাপের মুখে একা একা গেছিল এটিএম অব্দি, আর পিছন ফিরেই দেখেছিল “সে” দাঁড়িয়ে আছে |

— ” কি? জানিসনা তাই তো ? মুখ দেখেই বুঝেছি !”

কিভাবে একটা সব কিছু যেন সে তিথির মুখ দেখেই বুঝে যেত | আজ কি হল? আজ কি সে বোঝেনি যে তিথি কষ্ট পেয়েছে ? জ্যাকেটের হুডিটা তুলে নিয়ে একটু টেনেটুনে বসল তিথি | পায়ে মোজা নেই তার, পা ঠান্ডায় বরফ হয়ে যাচ্ছে | উত্তর ভারতে নভেম্বর মাস, কলকাতার সাথে বিস্তর ফারাক | এখানে রীতিমতো শীত নেমে এসেছে | তাদের বিয়ে হয়েছিল শীতকালে | ও বরাবর বলে এসেছিলো, বিয়ে করলে শীতেই করবে |তিথি তো চিরকালই ওর সমস্ত কথাতেই শেষ পর্যন্ত হ্যাঁ বলে এসেছে |

–“ছেলেদের সাথে মেলামেশা আমার পছন্দ নয় !”
–“রাত ১০:৩০টার পর অনলাইন যেন না দেখি !”
–“ওসব ব্যাকলেস, স্লীভলেস আমার পোষায় না !”

সব কিছুতেই শেষ অব্দি লড়ে তিথির পরাজয় স্বীকার | তাকে ছেড়ে যে তিথি অন্ধকার দেখে | এই একটা বিষয় বোধহয় সে খুব ভালোই বুঝতো | সব লড়াই এ তার একটাই হাতিয়ার ছিল,

–“না পোষালে চলে যাও !”

এই হাস্য কৌতুক পূর্ণ “গল্প হলেও সত্যি” সিনেমার লাইনটা ওর মুখে শুনলে তিথির গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেত | তার প্রাণ কেঁপে উঠতো | না, না, তার সব পোষাবে, সে সব মানিয়ে নেবে | রাত ১২টা | বিয়ের আগের বছর পুজোয় আবার তাদের চূড়ান্ত ঝগড়া হয়, সেই রাস্তায় | এবারে বাগিচা -য় খাবারের লাইনে | ঝগড়ার বিষয়, কেন তিথি রাত ১০:৩০টার পরেও অনলাইন ছিল এবং কেন সে এক বিশেষ পুরুষ বন্ধুর সাথে চ্যাটে গল্প করেছে ?

বাইরে তুমুল বর্ষা, হাতিবাগান ভাসিয়ে দিচ্ছে | বাগিচায় তাদের বয়সীদের ভিড় | আধভেজা নতুন জামাকাপড় পরা সব হাসি হাসি মুখ | সবাই আড্ডারত, সবাই আনন্দে ভাসছে | বৃষ্টিটাও যেন আনন্দের | সেদিন এই আনন্দের ভিড় ঠেলে, চোখের জলে ভেসে, তিথি চলে গেছিল | সেদিন পিছনে কেউ আসেনি ! এক হাঁটু জলে ডিঙিয়ে কোনোমতে সে একটি বাসে উঠেছিল | সেখানেও ভেজা নোট নেবেনা বলে রীতিমতো অপমান করে তিথিকে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় | মাঝরাস্তায় দুরন্ত বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়েও নিজের চোখের জলের তোড় অনেক বেশি করে বুঝতে পেরেছিলো তিথি, তার চোখের জল যে বৃষ্টিকে ছাপিয়ে গিয়েছিলো | বারবার পিছনে চেয়ে দেখেছিল সে, কেউ ছিলোনা ! তিথি সেদিন একা বাড়ি ফিরে আসে | আর বাড়ি এসে সেই ফেসবুকের দৌলতে জানতে পারে যে তার অনুপস্থিতি ঠাকুর দেখার প্রোগ্রামে কোনরকম প্রভাব ফেলেনি ! তিথির বদলে সে অন্য বন্ধুদের সাথে দিব্বি ঠাকুর দেখে বেড়াচ্ছে |

–” না পোষালে চলে যেও !”

পরেরদিন অভ্যাসমতো তিথি ক্ষমা চায় এবং পুষিয়ে নেয়, মানিয়ে নেয় | তবে সেদিন তিথি তাকে জীবনে প্রথম একটা কথা বলেছিল,

–” তবে কি জানিস তো, একদিন এমন আসবে যেদিন আমার আর ভয় করবেনা, আমি একা নিজে নিজের হাত ধরে রাস্তায় চলতে পারব |”
–“আমার কিস্সু আসবে যাবেনা , সেদিন ও, আজ ও এবং দেখেইছিস, এর আগেও !” তৎক্ষণাৎ গুরুগম্ভীর গলার উত্তর এসেছিলো |

এর ঠিক এক বছর বাদে তাদের বিয়ে হয় | সেই কতযুগ আগেকার কথা যেন ! তিথি ঠান্ডার কামড় থেকে মন সরাতে আরেকটা কুইজ খেলল | ২৬টা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সে জানতে পারে যে সে এক প্রতিভাময়ী , স্বাবলম্বী ব্যক্তি | তাকে বেঁচে থাকার জন্য কাউকে লাগেনা এবং যে কোন পরিস্থিতিকে নিজের আনুকূল্যে এনে সে চলার ক্ষমতা রাখে ! হ্যা ঠিক! একদম ঠিক ! সে প্রতিভাময়ী, সে স্বাবলম্বী এবং সবচেয়ে বড় কথা, সে আর ভয় পায়না |

রাত সোয়া বারোটা | পার্কের ভেজা ঘাসে পা ফেলে তিথি ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় | পার্কের একটা বড় মেটাল আলোয়, হঠাৎই বেশ উষ্ণতার রেশ অনুভব করে সে | দূরে দারোয়ান হুইসেল বাজিয়ে টহল দিতে দিতে যাচ্ছে | পার্ক ছেড়ে তখন তিথি বাড়ির দরজার সামনে |ঘরে আলো জ্বলছে, মানে “সে” এখনো জেগে ! টিভির আওয়াজ পাচ্ছে তিথি | এদিকে রাত তখন ১২ টা বেজে ২০ মিনিট, তিথি বাড়ি
ফেরেনি |

একটা দীর্ঘশাস ফেলে তিথি বাড়ির দরজার দিকে এগোয় | যা বলার আজ সে বলবে | এতো বছরের প্রতীক্ষার পর অবশেষে তার আর পোষাচ্ছে না আর তার প্রাণ ও কাঁপছেনা | আজ সে একা থাকতে পারবে | সামনে কঠিন পথ, অনেক ঝড় ঝাপ্টা আসতে চলেছে তবে সে পারবে, সে সব পারবে | জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা আজ হতে চলেছে তার জন্য এবং সব ছাপিয়ে, সকল ভয় দুঃখ কাটিয়ে আজ সে নিজে তার জীবনের সব চেয়ে কঠিন সত্যটাকে মেনে নিতে চলেছে | হয়ত এটা তার অনেক আগে করা উচিত ছিল | তবে দেরি হলেও, শেষ পর্যন্ত তিথি নিজের ভবিষ্যতের দরজা খুলে এগিয়ে গেলো, মনে তার তখন ওই কঘন্টা ঠান্ডায় পার্কে একা বসে থাকার একটাই উপলব্ধি ,”Her marriage is over !”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত