বাড়িতে ঝাড়া-ঝুড়ো, ধোঁয়া-মোছা চলছে।আজ দশদিন হলো মা চলে গেছে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অমৃতলোকে। তার শেষ কৃতকার্য হবে, বাড়িতে লোকজন আত্মীয় স্বজন আসবে।অফিস থেকে তো ছুটি দিয়েছে, হাতে তেমন কাজও নেই তাই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজের তদারকি করছে আবির । দাদাবাবু, আপনাদের ঐ পেছনের কর্ণারের ঘরটাও বৌদিমনি পরিস্কার করতে বলেছেন।কিন্তু ওটাতো বন্ধ!
হ্যাঁ, চলো আমি খুলে দিচ্ছি।―বলে আবির ঘরটা খুলে দিল।এটা মায়ের ঘর। বয়স হয়েছিল, তারপরে চলাফেরা করার ক্ষমতা হারিয়েছিল।বড্ডো নোংরা করত,তাই সোনিয়া বলেছিল ঘরের সামনে সবসময় নোংরা ভালোলাগেনা।তোমার মাকে পেছনে একটা ঘরে রাখ। তাই করা হয়েছিল। ঘরে তেমন কিছু নেই, মা খাটে শুতে পারতো না খাট দেওয়া হয়নি।মা নিচে মেঝেতেই শুত।
ওপাশের জালনাটা খুলতে গিয়ে পায়ের কাছে কি একটা যেন ঠেকলো আবিরের। ডায়রি না! হ্যাঁ ডায়রি তো। মায়ের ডায়রি মনে হচ্ছে। ডায়রিটা তুলে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো আবির। ডায়রির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আবিরের মনে পড়ল―কি সুন্দর হাতের লেখা ছিল আমার মায়ের।আমার স্কুলের প্রোজেক্টের খাতা মা লিখে দিত। বন্ধুদের কাছ থেকে আনা নোট দেখে মা রাত জেগে আমার নোট লিখে দিত। পরে মায়ের হাতের লেখা এতো খারাপ হয়ে গিয়েছিল! হয়তো বয়সের ভারে, হয়তো ভালো চোখে দেখতে পেতোনা,হয়তো হাত কাঁপত।আমার অবশ্য খোঁজ রাখা হয়নি। মায়ের লেখা গুলো দেখতে দেখতে একটা পৃষ্ঠায় এসে থমকে গেল আবির।এগুলো কি লিখেছে মা কাঁপা কাঁপা হাতে!
“বাবু আজ তোর জন্মদিন। আজ অন্তত একবার আমার ঘরে আসতে পারতি, আমি জানি তুই ভীষন ব্যস্ত।অতবড় অফিসার, কত দায়িত্ব।তারপর তোর সংসার সব মিলিয়ে তুই—আমি জানি বাবা।তবুও আজ যে তোকে বড় দেখতে ইচ্ছে করছে রে।আ—মি জা—নি আমার গায়ে অনেক নোংরা, গন্ধে তোর বমি পায়।আসলে তোরা তো আমাকে নির্বাসন দিয়েছিস।নির্বাসন ছাড়া আর কি বা বলব।হলোই বা নিজের বাড়ি, যে বাড়িতে কারো সঙ্গে দেখা হয়না, দিনের পর দিন কোনো কথা হয়না কারো সঙ্গে। চলাফেরা করার ক্ষমতা হারিয়ে এই চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি ,শুধু কাজের লোকের দুবেলা ভাত দিয়ে যাওয়া , এই জীবনটাকে নির্বাসন ছাড়া আর কি বলা যায়?
জানিস বাবু তুই যখন ছোটো ছিলি,খুব ছোট, আমি খেতে বসলেই তোর পায়খানা পেতো। কৃষি বাড়ির বৌ আমি, সংসারের কাজে সবসময় ব্যস্ত থাকতে হতো।ঠিকমতো খাওয়ারও সময় হতো না।তুই কান্না শুরু করলে তোর ঠাকুমা আর রাখতে পারতো না। তাই বেশিরভাগ দিন তোকে কোলে করে আমার ভাত খেতে হতো।আর অমনি দিতিস পায়খানা করে, কি আর করবো নাড়া লাগলে তোর আবার পায়খানা হবেনা।তাই এই ভাবেই তোকে কোলের মধ্যে রেখে খাবার খেতাম।জানিস একটু গন্ধও আমার নাকে লাগতো না।বরং তাড়াতাড়ি খেতাম যাতে আমার সোনা ছেলের কোনো অসুবিধা না হয়।তোর একটা বদঅভ্যাস ছিল রাতজাগা।দিনে ঘুমোবি আর রাতে জেগে থাকতিস, সারাদিনের কাজের ধকল আর রাতে না ঘুমাতে পারা তোর সাথে জেগে রাত কাটানো দিনের পর দিন তবুও মনে ক্লান্তি আসত না জানিস ।তোর মুখের দিকে তাকালে সব কষ্ট কেমন যেন মুঁছে যেত।
তোর বাবার সামান্য রোজগারে আজকের এই এতো বড় অফিসার হয়তো তোকে বানানো সম্ভব হতোনা। সংসারে কার্পণ্য করে, কোনো বিলাসিতা না করে, তোকে মানুষ করার সেই আমার অদম্য জেদ।সংসারের কাজের ফাঁকে রাতে তোর পড়ার সময় তোরই পাশে বসে হাতের কাজ করছি দু’টো পয়শার জন্য তোর একটা টিউশন খরচ জোগানোর জন্য তুই দেখেছিস তো!তারপর যখন একটা একটা করে আমার গয়না গুলো বিক্রি করে দিলাম, তখন তুই অনেক বড়ো।আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলি ― মা আমি তোমাকে হীরের গয়না বানিয়ে দেবো। এক অজানা আনন্দে সেদিন চোখের জল আর বাঁধ মানছিলনা আমার। কিন্তু বিশ্বাস কর বাবু শুধু আমি কেন পৃথিবীর কোনো মা-ই সন্তানের কাছ থেকে দামী গিফ্ট চায় না।চায় একটু ভালোবাসা, একটু স্পর্শ ,চায় সন্তানের ছোঁয়া।
আজকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রে তোকে বাবু।যদি একবার আমার ঘরে আমার কাছে আসতিস। সেই ছোট বেলার মতো তোকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছে করছে। তুই না হয় স্নান করার আগেই আসতি,আমার এই নোংরা হাত দিয়ে তোকে নাহয় একটু ছুঁয়েই দিতাম, একটু আদর না হয় করেই দিতাম। তারপর তুই ভালো করে দামী শ্যাম্পু,বডি ওয়াশ মেখে স্নান কর নিতিস। দিন চলে গেল, রাত হয়ে গেল, রাতও চলে যাবে।তুই এলিনা।ভালো থাকিস বাবা। ঈশ্বর যেন তোর মঙ্গল করে, তোর দীর্ঘায়ু কামনা করছি। শুভজন্মদিনে এই শুভকামনা রইলো। ― ইতি আর্শীবাদক মা ।”
ডায়রিটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল আবির।চোখের জলে ভরে উঠল চোখের পাতা।কি যেন কি ব্যাথায় টন টন করে উঠলো বুকের ভেতরটা। মনে মনে শুধু বলল ―মা যে ভুল আমি করেছি তার হয়তো কোনো ক্ষমা হয়না, যদি পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও। আজ মনে হচ্ছে আমার এই সবকিছুর বিনিময়ে যদি একবার শুধু একবার তোমাকে ফিরে পেতাম মা।