কলেজ থেকে ফেরার পথে ট্রেন থেকে নেমে হাঁটার মধ্যে দৌড় মিশিয়ে দিল লাবণ্য। আজ সিমকার্ডটা নিতেই হবে আশ্রয়ের থেকে, তার দেওয়া সিমকার্ড ব্যবহার করে অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা কিছুতেই মেনে নেবে না লাবণ্য। স্বাভাবিক, খুব স্বাভাবিক, এমনটাই হওয়া উচিত। কিন্তু কেন! কোন অধিকারে আশ্রয়ের প্রতি এই টান, আশ্রয় তো কোনোদিন তাদের সম্পর্ককে বন্ধুত্ব ছাড়া অন্য কোনো নাম দেয়নি, অনেক সময় ব্যাঙ্গের সুরে “পরিচিতা” বলেও সম্বোধিত হতে হয়েছে তাকে, তাহলে কি লাবণ্য নিজের মনে মনে আশ্রয়কে।
যাইহোক, অতকিছু ভাবার সময় এখন নেই তার কাছে, সিমকার্ডটা তার আজই চাই। আশ্রয়ের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি আসতেই রিং করলো আশ্রয়ের নম্বরে। ৫২ সেকেন্ডের পুরো রিংটোন সম্পূর্ণ না হলে যেন ফোন ধরা মানা, প্রতিবার আশ্রয়ের নম্বরে ফোন করে এমনটাই মনে হয় তার। যাক ভালো তবু সুইচ অফ নেই। “সিমকার্ডটা আমার এক্ষুনি চাই, আমি ফ্ল্যাটের সামনে চলে এসেছি, দিয়ে গেলে ভালো হয়”—-আশ্রয় মুঠোফোন ধরতেই বেশ রূঢ় গলায় কথাগুলো বলে লাইনটা কেটে দিল সে।
বিকেলের কাঁচা ঘুম থেকে উঠে কিছুতেই পড়াতে যেতে ইচ্ছে করে না আশ্রয়ের। কলেজ শেষের পর শুধু টিউশনির টাকায় আর সংসার না চলায় বাধ্য হয়েই নতুন ডিউটিতে জয়েন করতে হয় তাকে। নাইট ডিউটি থেকে ফেরার পরের দিন স্নান-খাওয়া ছাড়া বাকি সময়টা প্রায় ঘুমিয়েই কাটে তার।
“এভাবে গুণ্ডাদের মতো গোঁফ রাখার কি মানে হয় বলত!”, সেদিন আশ্রয়ের কাছ থেকে সিমকার্ড নেবার সময় তার বদন দেখে গুণ্ডা বলেই মনে হয়েছিল লাবণ্যর। ইদানিং সময়ে আশ্রয় সম্পর্কে এরকম আরও কিছু কথা লাবণ্যর মুখে শুনে তার মনের বেশ কিছুটা হদিস পায় রূপসা। বুঝতে পারে কিভাবে লাবণ্যর মনে আশ্রয় পাচ্ছে আশ্রয়। ছোটবেলার নিজের সবথেকে কাছের খেলার সাথীটা ছেড়ে যাবার পর একটা সময় যেন কিছুটা থেমে গিয়েছিল লাবণ্যর শৈশব। তাই হয়তো আজও তার বন্ধু সংখ্যা হাতে গোনা দু-একজন, যাদের মধ্যে রূপসা একজন। লাবণ্য নিজে খুব চাপা স্বভাবের তবে রূপসার সাথে কথা বলতে গেলে কিছুটা প্রানের পরশ পায় সে, তাইতো সেদিন রূপসার সাথে কলেজ থেকে ফেরার সময় যখন ট্রেনে আশ্রয়ের সাথে দেখা হয়ে যায়, পরিচিত লোকজনের দেখে ফেলার ভয়ে আশ্রয়ের পাশে রূপসাকে বসিয়েছিল সে।
লাবণ্যর মুঠোফোনের ডায়াল লিস্ট – এ ইদানীং আশ্রয়ের নম্বরটা সবসময় সবার উপরে। কখন ফোন করে পায়, বেশীরভাগ সময়ই পায় না। ঐ দিনের সিমকার্ডের ঘটনাটা ভাবাচ্ছিল লাবণ্যকে। ঘটনাটা সে ঠিক করল না ভুল। ঐভাবে সিমকার্ড চেয়ে নেওয়াটা কিভাবে নেবে আশ্রয়। ঐদিনের ঘটনার জেরে তার সাথে আশ্রয়ের বন্ধুত্বের সম্পর্কটাও কি নষ্ট হয়ে যাবে! নাকি সে ধরা পড়ে গেল আশ্রয়ের কাছে! আশ্রয় কি পড়ে নিতে পেরেছে তার চোখের ভাষা, সে ও কি লাবণ্যকে! এ রকম আরও কত প্রশ্ন আঁকিবুকি কাটতে লাগল লাবণ্যর মনে। অন্যান্য দিনের মতো আজও কম্পিউটার ক্লাসটা অতটা ইন্টারেস্টিং লাগছে না। ঘড়ির কাঁটার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল লাবণ্য। ক্লাস থেকে ফেরার পথে আশ্রয়ের সাথে দেখা হবার কথা। ফোনে ব্যালেন্স না থাকায় ক্লাস থেকে বেরিয়েই সামনের মোবাইল স্টোর থেকে একটা দশ টাকার টপ-আপ কিনে দোকান থেকে বেরোতেই সামনে আশ্রয়।
আশ্রয়ের সাথে হাঁটার মূহুর্তে রাতের কালো আকাশকেও যেন অপরূপা মনে হচ্ছিল লাবণ্যর। কপালের বড় গোল টিপে আকাশ ও যেন নববধূ সাজ নিয়েছে। লাবণ্যর হাতে হাত দিয়ে ঘনিষ্ঠ হতে চাইল আশ্রয়। ভয়, ভালোলাগা, ভালোবাসা, লজ্জা যেন একসাথে জড়িয়ে ধরল লাবণ্যকে। এরকম আড়ষ্ঠ লাগছে কেন নিজেকে, সে কি অন্যায় করল, ভাবতে ভাবতে দরজাটা বন্ধ করে আলোটা নিভিয়ে দিল লাবণ্য। যদি এই অন্ধকার তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে এই আশায়।
আশ্রয় কি তাকে বন্ধু ভাবে, শুধুই বন্ধু, নাকি !! মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে আশ্রয়ের নম্বরটা ডায়াল করল। ব্যালেন্স নেই কেন!! তার মানে আজও সে টপ-আপটা দিয়ে রিচার্জ না করেই ফেলে দিয়েছে! মানুষটার সাথে থাকার সময় যেন বাকি পৃথিবীটা আর নেই বলেই মনে হয় তার। আজও তাহলে উত্তর পাওয়া হল না লাবণ্যর। আশার বালিশে মুখ চেপে নিরুদ্দেশ হতে চাইল সে, ঠিক সেই মুহূর্তে মুঠোফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল “আশ্রয় কলিং”।