এক মহিলার ঘটনা শুনলাম। আপনাদের বলি। ভদ্রমহিলা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছেন। তাঁর বিয়ে হয়েছে (এরেঞ্জড) এমন এক ছেলের সাথে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের বিভাগে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া ছেলে। প্রচন্ড মেধাবী বোঝাই যায়। মহিলার বিয়ের পেছনে শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়েও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর রূপ, ঢাকা শহরে তাঁর বাবার বাড়ি ইত্যাদি।
বিয়ের পরে জানা গেল মাস্টার্স পাশ করলেও মহিলা ততটা স্মার্ট নন। আইকিউ কম, সহজ সরলই কেবল নন, বোকাও। আদর্শ গৃহিণীর মতন তিনি বছর ঘুরতেই সংসারে বাচ্চা নামিয়ে আনলেন। স্বামীর সংসার সামলালেন। শ্বাশুড়ি ননদের অত্যাচার সহ্য করেও হাসিমুখে সংসার করে গেলেন।
এখানে একটি পয়েন্ট মাথায় রাখুন। কিছু ননদ-শ্বাশুড়ীকে ঐশ্বরিয়া রাই এনে দিলেও ফাজলামি বন্ধ করবে না। এদের হাড্ডিতে হাড্ডিতে বদমাইশি। দুর্ভাগ্যবশত মহিলার ভাগ্যে ছিল এমন শ্বাশুড়ি ননদ।
স্বামীরও মেজাজ খারাপ থাকে মহিলার উপর। স্বাভাবিক। রূপে মুগ্ধ হয়ে কতদিন সংসার করা যায়? সে নিজে ভীষণ বুদ্ধিমান, স্মার্ট এক ছেলে। সে যখন নিজের বৌয়ের সাথে কথাবার্তা, নিজের ইমোশন শেয়ার করবে, বৌ যদি সমান রেস্পন্স না দেয়, তাহলেতো ঝামেলা বাঁধবেই। সে বৌর সাথে দুর্ব্যবহার করে। কথায় কথায় অপমান করে। মহিলা মুখ বুজে সহ্য করেন।
ভদ্রমহিলার নিজের বাবা মারা গেছেন। যে শ্বশুর বিয়ে দিয়েছেন, তিনিও মারা গেছেন। স্বামীর সংসারে তাঁর কোন অভিভাবক নেই। বুড়ো মায়ের কাছে ফেরত যাবেন? কিভাবে বৃদ্ধ বয়সে তিনি তাঁর ডিভোর্সি মেয়ের দায়িত্ব নেবেন? ও আচ্ছা, বলা হয়নি, মহিলা কোন চাকরি করেন না। কারন, “স্বামীর কামাই যথেষ্ট, মহিলাদের এত টাকার লোভ কেন থাকবে যে চাকরি করতে হবে?”
তো বৃদ্ধা মা সব শুনে নিজের চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মেয়েকে স্বামীর বাড়িতে ফেরত পাঠান। “সহ্য করে যা মা। মেয়েদের ধৈর্য্য ধরা শিখতে হয়।” মহিলার ভাইবোন নিজেদের সংসার নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে। কার ঠ্যাকা পড়েছে বাড়তি বোঝা টানার? সবারই সংসারে টুকিটাকি ঝামেলা হয়। সামলাতে না পারলে তোমার দোষ।
অতি সম্প্রতি জানা গেছে মহিলার স্বামীর বাইরে এফেয়ার আছে। কথায় কথায় আগে অপমান করতো, এখন ডিভোর্সের হুমকি দেয়। মহিলার শ্বাশুড়ি ননদ সে কথায় তাল দেয়। বলেছিলাম না, কিছু শ্বাশুড়ি ননদ জন্ম থেকেই হারামি হয়ে থাকে। মহিলার বাচ্চারাও তাঁকে সম্মান করেনা। ওদের দোষ দিবেন কোন যুক্তিতে? ওরা জন্ম থেকেই দেখে এসেছে, শিখে এসেছে তাঁদের মাকে সবাই অপমান করে। তারাও সেটাই করে। যে বাচ্চা এখনও স্কুল পাশ করেনি, সে মাকে অশিক্ষিত, মূর্খ ইত্যাদি বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।
এই কারণেই আমি সব সময়ে বলি, ছেলে মেয়েদের মানুষ বানাতে চাইলে ওদের সামনে দেখান আপনি আপনার স্পাউসকে কতটা সম্মান করেন। যদি দেখেন ছেলে মেয়ে তাঁর বাবা বা মায়ের সাথে বেয়াদবি করছে, জায়গায় দাঁড়িয়ে কষে চড় দিবেন। আপনার স্বামী/স্ত্রীর সাথে ঝগড়া মনোমালিন্য করার অধিকার আপনার আছে, ওদের নেই। ওদের বাবা/মা – কাজেই ওদের সম্মান করতেই হবে। মহিলা স্বামীর পা চেপে ধরে সংসারে টিকে আছে। স্বামী বাইরে এফেয়ার করুক, কোন সমস্যা নাই। তাঁকে যেন তালাক না দেয়।
সে ভাল করেই জানে, তালাক দিলেই সে রাস্তায় নেমে যাবে। তাঁর যাবার কোন জায়গা নেই। যেহেতু কোন জব এক্সপিরিয়েন্স নাই, মাস্টার্স ডিগ্রি এখন কোন কাজে আসবেনা। মহিলার বোধশক্তিও কম। আগেই বলেছি, সহজ সরল। কর্পোরেট দুনিয়া স্মার্ট মানুষদের জন্য। কর্পোরেট দুনিয়া খুবই নিষ্ঠুর। এখন আপনারা বলেন, আপনারা কী চান আপনার মেয়ে, আপনার বোন, আপনার মা এই মহিলার মত অবস্থায় পড়ুক?
এক পত্রিকার শিরোনাম দেখলাম, অমুক হুজুর নাকি লোকজনের থেকে ওয়াদা নিচ্ছেন মেয়েদের ক্লাস ফোর ফাইভের বেশি না পড়াতে। স্বামীর টাকায় সংসার চালাতে। স্বামীর টাকা পয়সার হিসেবে রাখতে পারলেই যথেষ্ট। আর শিক্ষার দরকার নাই। বিএ এমএ পাশ করে ফেললে মেয়ে আর নিজের থাকেনা, অন্যের হয়ে যায়। যার যার অপিনিয়ন শেয়ার করার অধিকার স্বাধীন বাংলাদেশে আছে। তিনি তাঁর অপিনিয়ন দিয়েছেন। তিনি চান, তাঁর মেয়ের জামাই বদমাইশি করলেও তাঁর মেয়ে লোকটার পা জড়িয়ে ধরে সংসারে টিকে থাকুক। কোনই সমস্যা নাই।
গোল বাঁধিয়ে ফেলেছেন একটি কথা বলে। “মহানবীর (সা.) আদর্শের মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত শান্তি। যাঁরা মহানবীর (সা.) আদর্শ অনুসরণ করবেন তাঁরা দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তিতে থাকবেন। পরকালে তাঁরাই হবেন সফল ব্যক্তি।” কথা হচ্ছে, মেয়েদের শিক্ষা না দেয়াটা কী আসলেই মহানবীর (সঃ) আদর্শ? ফাজলামি করো?
মহানবী(সঃ) কোথাওই বলেন নাই, নারীদের শিক্ষা গ্রহণ নিষেধ। তাঁর সময়ে শিক্ষার জন্য কোন স্কুল কলেজ ছিল না। হাদিস কুরআন বাড়িতে বসেই শেখানো হতো। এবং তাঁর নিজের স্ত্রী, হজরত আয়েশা সেই হিসেবে একজন ইনস্টিটিউশন। আমাদের ধর্ম টিকে আছে তাঁর বর্ননা করা হাজারের উপর হাদিসের ভিত্তির উপর। ইসলামের ইতিহাসের সেরা স্কলারদের একজন তিনি। উম্মুল মুমিনীন।
তাঁর স্ত্রী হাফসাকে (রাঃ) লেখাপড়া শেখাতেন শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ নামের আরেক নারী। যেই মহিলা উমারের (রাঃ) খিলাফতে মদিনা মার্কেটের “সিকিউরিটি এবং এক্সচেঞ্জ কমিশন” ছিলেন। দুর্নীতি রোধে তাঁর আইনই ছিল উমারের (রাঃ) আইন।
নবী (সঃ) নিজে মসজিদে নববীতে বসে নারীদের “ইসলাম শিক্ষা” শিখিয়েছেন। তখনকার যুগের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি বলতে এই মসজিদে নববীই ছিল। আহলে সুফ্ফা (people of Suffa) এখানে বসেই শিক্ষা নিতেন। কুরআনের নাজেল হওয়া প্রথম শব্দ ইক্বরা, যার মানে পড়। সেখানে কোথাও বলা হয়নি পুরুষ হলেই কেবল পড়বে, মেয়ে হলে নয়।
হুজুর কোন লজিকে কী বলেন আল্লাহ মালুম। বার্ধক্য গুণনাশীনি। তিনি বুড়ো হয়ে গেছেন, কী বলতে কী বলেন সেটা তিনি নিজেও বুঝেন কিনা জানিনা। তবে চিন্তার বিষয় হচ্ছে যেসব ফলোয়ার কিছু না বুঝেই “ওয়াদা” করে ফেলেন তাঁদের নিয়ে। কমন সেন্স বলে, যদি আক্ষরিক অর্থেই আমাদের সুন্নাহ ফলো করতে হয়, তাহলে আমাদের নবী (সঃ) নিজেও ছিলেন উম্মি। তাঁর অক্ষরজ্ঞান ছিল না। তখনকার আরবে খুব কম মানুষ লেখাপড়া শেখার মতন সৌভাগ্যবান ছিলেন। যদি নারী শিক্ষা ইসলামে নিষিদ্ধই হয়, তাহলে এই যে আমরা ছেলেরা পড়াশোনা করি, স্কুল কলেজে যাই – সেটাওতো একই লজিকে হারাম হয়ে যাবে।
ইসলাম বরাবরই শিক্ষার্জনের উৎসাহ দিয়ে আসে। সাহাবীগণ এইটা উপলব্ধি করেছিলেন বলেই মাত্র কয়েক বছরে বর্বর বেদুইনদের নিয়ে তাঁরা বিশ্বের পরাশক্তি হয়ে গিয়েছিলেন। গ্রীক, ভারতীয়, পারস্য – যাবতীয় সভ্যতার শিক্ষা গ্রহণ করেই ইসলাম নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল। খলিফা হারুনর রশিদ নিজের রাজ্যের কোনা কোনা থেকে স্কলার খুঁজে এনে তাঁদের হুকুম দেন বিশ্বের তাবৎ জ্ঞান বিজ্ঞানের বইগুলো আরবিতে তর্জমা করে সংগ্রহ করতে।
আমাদের আফসোস, আমাদের মাওলানারা এখনও নব্যপ্রস্তর যুগেই পড়ে আছেন। যেখানে তাঁদের বয়ান হবার কথা কিভাবে নিজের ছেলেমেয়েদের আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে হয়, কিভাবে চরিত্রবান করে তুলতে হয়, কিভাবে বিরুদ্ধে স্রোতেও নিজেকে সামলাতে হয়, কিভাবে নিজ ধর্মকে জানতে হয়, ভালবাসতে হয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রে “এক্সেলেন্ট” হতে হয় – সেখানে এরা ফালতু ওয়াদা নিয়ে বেড়ায়। যেই মেয়ে পড়াশোনাকে ভালবাসে, যে স্বপ্ন দেখে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবার, সে যখন দেখবে তাঁর এলাকার হুজুর ফতোয়া দিয়ে বেড়াচ্ছে ইসলামে নারী শিক্ষা হারাম, সে তখন কাকে ঘৃণা করবে? হুজুরকে? না। সে ঘৃণা করবে ইসলামকে। কারন তাঁর কাছে তাঁর ধর্মকে এইভাবেই প্রচার করা হচ্ছে।
একটা ব্যাপারে খুব অবাক হই। এই হুজুররাই নিজের প্রেগন্যান্ট স্ত্রী, কন্যা বা পরিবারের মহিলাদের যে কোন অসুস্থতায় নারী ডাক্তারের খোঁজ করেন। আল্লাহ না করুক, যদি কোন কারনে কোন মুসলিম নারীর অপঘাতে মৃত্যু হয়, এবং তাঁর পোস্টমর্টেমের প্রয়োজন হয়, আন্তর্জাতিক ইসলামিক শরিয়া আইন অনুযায়ী সেই নারীর মরদেহ পরীক্ষা করার জন্য মেয়ে ডাক্তারকে নিয়োগ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। না পেলে ভিন্ন কথা। এখন মেয়েদের ফাইভ পর্যন্ত পড়ালে ডাক্তারি পাশ কী আসমানী কিতাব পড়ে করবে? এদের মাথার লজিক আসলে কই থাকে? আদৌ কী লজিক কাজ করে?
আপনার মেয়েকে এখন আপনি কী বানাবেন সেটা আপনার সিদ্ধান্ত। উপরে যে উদাহরনটা দিলাম, সেটা আল্লাহ না করুক, আপনার মেয়ের সাথেও ঘটতে পারে। সেই মেয়েটিকে তাঁর বাবা মা শিক্ষিতা বানিয়েছেন, তারপরেও তাঁর এই পরিণতি। ফাইভ পাশ হলেতো মরেই যেত। আজকে সেই মেয়ের চাকরি করার মানসিকতা থাকলে, হয়তো পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো। আপনার মেয়ের যদি এই পরিণতি হয়, সেজন্য আপনিও দায়ী থাকবেন বহুলাংশে।