ফোনের গ্লাসটা হালকা ফাটানোর অপরাধে আপু আমায় প্রচন্ড জোরে থাপ্পড় মারলো,, এতোটা জোরে যে আমার মনে হচ্ছিলো গাল ফেটে রক্ত বেরোবে,, আমি শুধু নিষ্পলক ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম,, তারপর ও ফোনটা হাতে নিয়ে চলে গেলো। একটা সেল্ফি তুলতে গিয়ে হাত থেকে ফোনটা পড়ে গিয়েছিলো।
আমি গালে হাত রেখে ধীর পায়ে জানালার পাশে এসে দাড়াঁলাম। সাদা ধবধবে আকাশকেও আজ বড্ড কালো লাগছে,, ছোটবেলায়ই আমার মা মারা গেছে, তখন থেকে আপুই আমার সব। বাবা আমাদের কথা চিন্তা করে আর বিয়ে করেন নি,, শুধু কাজের লোক রেখে দিয়েছেন ২ টা,, সারাদিন বাবা বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকেন,, আর বাসায় আমি আর আপু,, আপু দেখতে একদম মায়ের মতো হয়েছে, তাই আপুকে দেখলেই কেমন মায়ের কথা মনে পড়ে! কিন্তু আপু আমায় দেখতে পারে না কেন! আমি দেখতে ওর মতো সুন্দরী হইনি বলে, নাকি আমি আনস্মার্ট বলে, নাকি ও আমায় পছন্দই করে না।
আমি তো আপুকে অনেক ভালোবাসি! আমি তো ওর ভালোবাসা অনেক বেশি চাই,, তবে ও কেন এতো কষ্ট দেয়??
সেই ছোটবেলা থেকেই আমায় কখনো খেলতে নিতো না,, বান্ধবীদের সাথে একাই ঘুরতে যেতো, আমার সাথে বেশি কথাও বলতো না..! আমায় কেন যেন ও কখনো দেখতে পারতো না..! অথচ ও সবসময়ই আমার সবচেয়ে দূর্বল জায়গা। চোখ মুছে ওর কাছে গিয়ে বললাম “সরি আপু,, আর তোর ফোন ধরবো না প্রমিস, তবু তুই আমার সাথে রাগ করে থাকিস না..!” ও জবাবে কিছুই বললো না।
একদিন হঠাৎ দেখলাম আপু আরফান ভাইয়ার বাইকে করে কোথায় যেন যাচ্ছে..! আরে! আরফান ভাইয়া তো খুব বাজে ছেলে, প্লে বয়..! আপু আবার ওই বদমাশের ফাঁদে পা দেয়নি তো..! আপু বাসায় আসার পর একটু ভয়ে ভয়ে বললাম -“আপু, আরফান ভাইয়া না ইভটিজিং এর দায়ে কিছুদিন আগে জেল খেটে এসেছে..! ওর মতো খারাপ ছেলে আমি আর দেখি নি আমাদের এলাকায়,, ওর কাজই মেয়েদের উত্যক্ত করা ” আপু আচমকা আগুনের মতো ক্ষেপে গিয়ে আমায় পরপর ৩ টা থাপ্পড় মারলো,, বললো- “তোর সাহস কি করে হলো ওর সম্পর্কে এসব কথা বলার?? ক্ষ্যাত ফকিন্নি কোথাকার,, এরপর থেকে কথা-বার্তা হিসেব করে বলবি..! খুব বাড় বেড়েছিস না?মজা দেখাচ্ছি। ”
খুব কষ্ট পেলাম,, বলার মতো না,,মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিলো,, হঠাৎ হিমেলের ফোন এলো,, এই একমাত্র মানুষ যে আমার কষ্টের সময় বুকে আগলে রাখে, শান্তনা দেয়,, সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়,, হিমেলের কণ্ঠ শুনেই মন কিছুটা ভালো হয়ে গেলো,, ছেলেটা অদ্ভুত রকম ভালো,, ২ বছরের রিলেশনে কখনো আমায় কিঞ্চিৎ পরিমান কষ্ট দেয় নি। ফোন রাখতেই দেখি আপু কেমন অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,,আমি ফোন রুমে রেখে বারান্দায় চলে গেলাম।
২ দিন পর হঠাৎ দেখি আপু কাদঁছে,, আমি অবাক হয়ে গেলাম, ও তো সামান্য কিছুতে কাদেঁ না,, ওর কান্না আমি একদম সহ্য করতে পারি না, দৌড়ে গিয়ে আপুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “আপু কি হয়েছে তোর? কাদঁছিস কেন? বল আমায়..!” আপু যা বললো তা শুনে আমার হৃদয়ে দহন হতে লাগলো,, হিমেল নাকি আপুকে প্রপোজ করেছে,, আমায় নাকি হিমেলের আর ভালো লাগে না,, আপুকে নাকি কু-প্রস্তাবও দিয়েছে।
হ্যাঁ আমি হিমেলকে খুব ভালোবাসি তবে আমার আপুর চেয়ে বেশি নয়, তৎক্ষণাৎ আমি ওকে ফোন দিয়ে অনেক বকাবকি করলাম,, ও বারবার বলছিলো ও এমন কিছু করে নি কিন্তু আমি মানতে নারাজ ছিলাম, আমার আপু এতো অশ্লীল বাজে কথা বলতে পারে এটা হতে পারে না,, এক পৃথিবী রাগ আর অভিমান নিয়ে হিমেলের সাথে ব্রেক-আপ করে দিলাম, এর আগে আপুর জন্য ঝগড়া হয়েছে কিন্তু এভাবে ব্রেক আপ হয় নি,, ফোন রাখার সময় হিমেল শুধু একটা কথাই বললো “দেখে নিও রিনী, তোমার এই আপুর জন্যেই একদিন তুমি শেষ হয়ে যাবে, অনেক সহ্য করেছি তোমার এই অশান্তি, আর নয়, এরপর তুমি চাইলেও আমি আর কখনো ফিরবো না” ফোনটা রেখে অঝরে কাদঁতে শুরু করলাম,, আমার শেষ আশ্রই টুকুও রইলো না,, রাতের বেলা হঠাৎ দেখি আপু আমার পাশে এসে বসলো,, আমি বললাম “আপু একটু বুকে নিবি আমায়, খুব কষ্ট হচ্ছে, তুই হিমেলকে মাফ করে দিস!”
আপু ঈষৎ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, “মানে কি? হিমেলকে আবার কি মাফ করবো? ও তো আমায় কিছুই বলে নি! আমি তো সেদিন আরফানের অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য একথা বলেছি” আপুর কথা শুনে আমার দুনিয়া আঁধার হয়ে গেলো, কি বললো আপু এটা..! আমি চিৎকার করে কাদঁতে লাগলাম, পাগলের মতো কাদঁতে কাদঁতে হিমেলকে ফোন দিলাম,, ওর ফোন অফ,, মেসেঞ্জারে আমি ব্লক,, ওর আইডির মেসেজ অপশনও হাইড করা,, ওকে আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না,, পাগলের মতো সারা শহর খুঁজেছি ওকে, নির্লজ্জের মতো সারাদিন ওর বাসার সামনে বসে থেকেছি, ওকে পাই নি..২ টা মাস কেটে গেছে,, আমি কাদঁতে কাদঁতে পাগলপ্রায়। একদিন হঠাৎ ওর এক ফ্রেন্ডের থেকে জানলাম,, ও বিয়ে করে নিয়েছে খুব সাদামাটাভাবে,, আর বউকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে। পৃথিবী থমকে গেলো আমার।
তারপর থেকে যেন আমি আর আমাতে নেই,, বাবা আমার এই অবস্থা দেখে আমায় ডক্টর দেখালো, যত্ন নিলো, তারপর হঠাৎ কি হলো জানিনা,, বাবা আমায় আর দেখতে পারে না। আপুই হয়তো উল্টো পালটা বুঝিয়েছে, আজকাল সবই আন্দাজ করতে পারি,, অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি,, আমার জীবন থমকে গেছে, মায়ের ছবি বুকে নিয়ে
আমি এতিমের মতো সারাদিন ঘরে পড়ে থাকি। কিছুদিন পর দেখি আপুর মনটা আবার খারাপ, এবার আর এমনি নয়,, সত্যিই সারা সকাল, বিকেল, সন্ধ্যায় মন খারাপ দেখি, জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারি আরফান ভাইয়ার সম্পর্কে আপু সব জেনে গেছে, কিন্তু আরফান কিছুতেই আপুর পিছু ছাড়ছে না। ব্যাপারটা বাবাকে জানালাম,, বাবা পুলিশে কেইস করায় পুলিশ আবার আরফানকে জেলে নিয়ে গেলো।
৩ মাস পর আরফান জেল থেকে ছাড়া পেলো, একদিন আমি বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ দেখলাম আরফান, আপুর হাত ধরে টানাটানি করছে,, অন্য হাতে চাকু,, আমি আঁতকে উঠলাম, আগুন জ্বলে উঠলো আমার চোখে, এক দৌড়ে নিচে নেমে এলাম,, আরফানের হাত থেকে চাকুটা টেনে নিতে ধস্তাধস্তি শুরু করলাম, ততক্ষণে দারোয়ান চাচা বাবাকে ফোন করে দিয়েছে, ধস্তাধস্তি করার সময় ছুরি দিয়ে আমার হাত কেটে ছিড়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু আমি এতো সহজে হার মানতে রাজি নই,, আচমকাই আরফান ছুরিটা আমার পেট বরাবর চালিয়ে দিলো,, আমি থেমে গেলাম, সাথে আপু আর আরফানও, সেদিনই প্রথম আপুর চোখে পানি দেখেছি আমার জন্য, আমি যেন এ অসহ্য যন্ত্রনাতেও অনাবিলসুখ অনুভব হচ্ছিলো,, হঠাৎই আরফান আমায় বাদ দিয়ে আমার আপুর হাতে ছুরিকাহত করলো,, আমি এবার আর সহ্য করতে পারলাম না,, যে আপুর জন্য আমি আমার জীবনে সবকিছু ত্যাগ করেছি,, তাকে কেউ কষ্ট দিলে! আমি আরফানের হাতের চাকুটা কেড়ে নিয়ে পরপর সাতবার ওর পেটে ঢুকিয়ে দিলাম।
ও আমার চোখের সামনেই কাতরাতে কাতরাতে মরে গেলো, আমারও চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো,, আপু আমায় জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না, আমি আপুর দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছি,, মায়ের ছবি ভাসছে ওর মুখে,, আপুকে বললাম “কাদিঁস না আপু,,তুই কাদঁলে আমার খুব কষ্ট হয়,, খুব ভালোবাসি তোকে” আপু বললো “প্লিজ আমায় ছেড়ে যাস না,, আমি আর তোকে কখনো কষ্ট দেবো না,, তবু এভাবে চলে যাস না” আপুর মায়াভরা কথাগুলো শুনতে শুনতেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো, দূর থেকে অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, হয়তো বাবা আসছে খবর পেয়ে,, দূর আকাশে তাকিয়ে দেখলাম, মা আমায় ডাকছে দু হাত বাড়িয়ে, “আমি আসছি মা, তোমার মা মরা এই মেয়েটাকে কেউ আদর করে না,, তুমি আমায় তোমার বুকে টেনে নাও। ভালো থাকুক তোমার বড় মেয়েটা,, সুখী হোক আমার আপু।”