বার্থডে গিফট

বার্থডে গিফট

__ ” বাবু সোহেলের ফ্যামিলি রাজি হয়েছে আজকেই ওরা কলমা কাবিন করে নিতে চাচ্ছে “। খালার এ কথা শুনে যেন আমার মুখে মাছি যাচ্ছে আর আসতেছে এই অবস্থা৷ আমি কিছু বলার আগেই বড় আপু বলল,

___ ” ছেলে দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ ভালই আর্মিতে জব করে না করার তো কোন কথাই নেই। খালা কলমা কাবিন করে ফেলেন আজকেই “। আমার মাথা যেন ভোঁ চক্কর দেওয়া আরম্ভ করেছে ততক্ষনে। কালকেই খালা বলল, কারা নাকি দেখতে আসবে আমাকে। কিছু না বলেই বিকালেই রেডি হয়ে তাদের সামনে বসলাম।

ছেলেকে তো আমি দেখতেই পারি নি খালি চোখের কোনা দিয়ে একটু খালি দেখেছিলাম হ্যাংলা পাতলা যেন ফুঁ মারার আগেই উড়ে চলে যাবে অনেক দূর। আর গায়ের চামড়া বেজায় ফর্সা আমার চেয়েও ফর্সা। দেখেই নাক সিঁটকিয়ে ছিলাম। আর এখন কি না তার সাথে আমার বিয়ে। সব ব্যবস্থার পরে যখন সাইন করছিলাম কাবিন নামায় কলিজার মধ্যে যেন কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো চিনি না জানি না এমন এক জনের সাথে কি করে সারাজীবন থাকবো। আমাদের বোনদের বিশাল একটা রুম আছে। বড় আপুর বিয়ের পর থেকেই আমি আর মিলি রুমের মালিক। হঠাৎ মিলি দেখি মানুষটাকে টানতে টানতে আমার রুমে নিয়ে এলো। শাড়ি পরার অভ্যাস একদম নেই আমার কোন মতে পরেছিলাম একটু আগ থেকে আঁচ করছি শাড়ির বেশ খানিকটা খুলে গেছে। এই মূহুর্তে মিলি উনাকে নিয়ে আসলো আমি না পারছি দাঁড়াতে না পারছি নড়তে। মিলি যাওয়ার আগে দরজা টেনে দিতে দিতে বলল,

___ ” ভাইয়া মনে রাখবেন কিন্তু আপনার কাছে আমার উধারী রইল। এই যে বউকে এনে দিলাম কাছে “। এই বলে হেসে চলে গেল। ঘরের মধ্যে পিনপতন নিরবতা আমি যে কি বলব কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। মাথা নিচু করে বসে আছি একটু পরে টের পেলাম খুব সুন্দর একটা ঘ্রান। মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম উনি একদম আমার কাছে এসে বসেছে। এবার ভাল করে তাকালাম আমি। একদম মুলা সুন্দর বলা চলে। ফর্সা দপদপ করতেছে। মাথার চুল গুলো আর্মি ছাট দেওয়া। একদম পাশে এসে বলল,

___ ” শোনো কালকেই আমি চলে যাচ্ছি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এ। হয়ত দুই মাস পরে আসতে পারবো আবার তখন যদি বলি দেখা করবে আমার সাথে? “। হঠাৎ করেই এই মানুষটার উপরে তখন অসম্ভব একটা টান অনুভব করা শুরু করলাম। খুব ইচ্ছা করছিল বলি,যাওয়া লাগবে না থেকে যান। উনি বলতে লাগলেন,

___ ” শোনো তুমি একজন আর্মি অফিসার এর ওয়াইফ এখন। অনেক কিছুই স্যাক্রিফাইস করতে হবে। আর হ্যাঁ খুব বিজি থাকি আমি প্রতি রাতে কথা হবে। খুব জরুরি দরকার ছাড়া দিনে একদমই কল করবে না। হয়ত কথা গুলো খারাপ লাগছে কিন্তু এটাই আমার রুটিন। মন খারাপ করবে না একদমই। ” উনার কথা শুনে আমার আকাশ ভেঙে যেন চোখের পানি পড়ে পড়ে পালা। ঠোঁট কামড়িয়ে কান্না আটকালাম অনেক কষ্টে। তখন সোহেল আমাকে মাথার উপরে হাত দিয়ে বলল,

___ ” আজ থেকে একজন সৈনিকের বউ তুমি আরো শক্ত হতে হবে তোমাকে বুঝেছ পাগলী একটা “।  আরো কিছু টুকটাক কথা হল। একটু পরেই দরজায় টোকার শব্দ৷ মিলি গলা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

___ ” ভাইয়া সময় যে শেষ। সবাই রওনা দিচ্ছে “। আমার মুখটা শুকিয়ে যেন আমচুরের মত হয়ে গেল। জীবনে কাউকে এতটা মিস করি নি যতটা না এই মানুষটাকে করছি। আসলেই আল্লাহর কালামের এই বুঝি শক্তি। যাওয়ার আগে উনি আমার হাত ধরলেন তখন সারা শরীরের পশম যেন দাঁড়িয়ে গেল আমার। নিজের মানিব্যাগটা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল,

___ ” শুধু আইডি কার্ডটা নিয়ে গেলাম আর বাকি সব তোমার “।

এই বলেই হনহন করে চলে গেল সে। আমার দুচোখ ভরা পানি তখন আর ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখছি আধপুরোনো একটা মানিব্যাগ আমার হাতে। আমাদের দুজনের বাসা পটুয়াখালী হলেও তারা ঢাকায় সেটেল। আজকের লঞ্চেই তারা ঢাকা চলে গেল। আর আমার জন্য রেখে গেল এক রাশ অপেক্ষার সময়। পরের দিন থেকে শুরু হল নতুন এক সময়চক্র। বেশি কিছুই বদলালো না শুধু আমার অপেক্ষার মাত্রা বদলালো। ওই দিন সারারাত কথা বলে বাসায় যেয়েই সে কুমিল্লা চলে যায়। প্রতিদিন রাতে নয়টা বা শাড়ে নয়টার দিকে কল দিত। বেশি হলে দশ পনেরো মিনিট কথার পরেই রেখে দিত। কখনও ফরমাল কথা ছাড়া কিছুই বলতনা। ভাল আছি কি না,খেয়েছি কি না,পড়াশোনার কি অবস্থা, শরীরের যত্ন নেও এসব বলেই বলত ঘুমিয়ে পড়তে। খুব ইচ্ছা করত আরো কিছু ক্ষন তার সাথে গল্প করতে কিন্তু একার ইচ্ছায় তো কিছু হয় না। সারাদিন অপেক্ষা করতাম রাতের ওই দশ পনেরো মিনিটের জন্য।

শাশুড়ী ফোন দিয়ে মাঝে মাঝেই বলতেন তার ছেলে রসকস ছাড়া পাবলিক আমি যেন একটু মানিয়ে নেই। আসলে মা তো আগে থেকেই জানে ছেলের অবস্থাটা। কিন্তু কেন জানি না এই রসছাড়া পাবলিককেই আমি এত এতটা ভালবেসে ফেলেছি। আমার বিয়ে হয়েছিল ডিসেম্বরের ২৬ তারিখে। আর জানুয়ারির চব্বিশ তারিখে আমার জন্মদিন। আমাদের বাসার অঘোষিত নিয়ম ছিল ২৪ তারিখ রাত বারোটার সবাই মিলে কেক কেটে আমার জন্মদিন পালন করা। বলি বলি করেও কেন জানি না মানুষটাকে বলা হয় নি আমার জন্মদিনের কথা। সেদিন সোহেলের দেওয়া মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে আছি আর ওর ছবি দেখছি। মিলি পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

___ ” বাবু আপু ভাইয়ারে খুব মিস করতেছ তাই না “। আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করলাম। ছোট বোন কি বলব ওকে আমি। তখন মিলি আবার বলল,

___ ” ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছিল, জিজ্ঞেস করেছিলাম আসবে কবে? ” আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
___ ” কি বলল রে? কবে আসবে সে?”
___ ” মার্চের আগে আসতে পারবে না বলল”। কথাটা শুনে আমার মুখ আরো অন্ধকার হয়ে গেল। কিছু না বলে পড়তে বসলাম। এভাবেই যাচ্ছিল দিন। সোহেল এক্কদিন কল করল আমাকে,

___ ” বাবু কি করো? ”
___ ” এই তো সব গুছিয়ে পড়তে বসবো “।
___ ” আচ্ছা শোনো আমি কিছু দিনের জন্য রাঙামাটি যাচ্ছি ওখানে নেট নেই নেট যখন পাবো তখন কল করব তুমি চিন্তা করো না। ”

___ ” কয়দিনের জন্য যাচ্ছেন? ফিরিবেন কবে? ” আমি উদিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলাম। সোহেল হেসে বলল,

___ ” এই তো দিন পনেরোর জন্য হয়ত। আচ্ছা আমি একটু বিজি পরে কথা হবে “। ফোনটা রেখেই কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। কি জন্য যে কাঁদছি নিজেও জানি না। কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেললাম। তারপরও কান্নাই থামছিল না যেন। পরের দিন কল করে দেখলাম তার ফোন বন্ধ। কিছু না বলে সারাদিন ব্যস্ত থাকার ট্রাই করলাম। ভার্সিটি কোচিং এসব করে যখন সন্ধ্যায় বাসায় এলাম দেখি বড় ভাই আর ভাবী ড্রইংরুমে বসে কথা বলছে। মেঝ ভাই আর ছোট ভাই দুইজনে টিভি দেখছে।হঠাৎ আমাদের বাসায় সবাই কেন। রুমে ঢুকতেই আমার আরেক খালাতো বোন জিমি বলল,

___ ” বাবু আপু আজকের দিনটায়ও তুমি বাইরে গেছ “।
___ ” কেন আজকের দিনে কি হইছে যে বাইরে যাওয়া যাবে না? ”

___ ” আপু তুমি সিরিয়াস? আজকে ২৩ তারিখ “। তখন আমার মনে পড়ল ও হ্যাঁ কাল তো আমার জন্মদিন। তখনই আবার কান্না চলে এলো এই ভেবে যে বিয়ের পরে এই প্রথম জন্মদিন কিন্তু তাকে জানাতেও পারছি না যে কাল আমার জন্মদিন। চোখ মুছতে মুছতে রুমে আসার পথে তাকে কল দিলাম কিন্তু নট রিচেবল। তাই সব ছেড়ে ছুড়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। রাতে সবাই যখন খেতে ডাকল, মুখটা হাড়ির মত করে বললাম খাব না আর যেন কেক না কাটতে আমাকে ডাকে। আমি কেকটেক কাটতে পারব না। কিন্তু আমার কথা শুনে কারোই কোন গায়ে লাগল না। মনে হল না খাওয়াটা যেন কমন ব্যাপার।

আমিও কিছু না বলে শুয়ে পড়লাম তার ছবিটা বুকে চেপে ধরে। রাত বারোটার একটু আগে টের পেলাম রুমের লাইট অফ কিন্তু ফিসফিস কথার শব্দ। আমি জানি সবাই এসেছে কেক নিয়ে। কিন্তু তাও চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে রইলাম। সব কিছুই বিস্বাদ আর পানসে লাগছে।ঠিক বারোটার সময় রুমের লাইট জ্বলে উঠলো। কিন্তু তখনও আমি চোখ বুজে পড়ে আছি। টের পেলাম মশারি উঁচু করে কেউ একজন ভিতরে ঢুকলো। একদম আমার মুখের কাছে এসে বলল,

___ ” হ্যাপি বার্থডে টু ইউ বাবু “। আমি তাড়াক করে লাফিয়ে উঠে চোখ খুলে যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এ তো সোহেল। এ লোক এখানে কেন। কেমনে কি।কিছু বোঝার আগে সবাই এসে হাজির। আমি তাকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত পেলাম না। কেক কাটার পর্ব শেষ উনি চোখে উঁচিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

___ ” তুমি নাকি খাও নি কি ব্যাপার “? আমার মুখ দিয়ে কথাই আসছে না খুশিতে। ভাবি প্লেটে ভাত নিয়ে আসতেই সবাই ধীরে ধীরে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সোহেল নিজের হাতে ভাত মেখে আমার মুখে উঠিয়ে খাইয়ে দিল নিজেও খেল। তারপর ফ্রেশ হয়ে সবার সাথে কথা সেরে যখন রুমে এলো প্রায় দুটো বাজে। আমি তো তখনও সারপ্রাইজের ধাক্কাই সামলাতে পারি নি। উনি ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি বের করে দিয়ে বললেন,

___ ” আজকে আমাদের প্রথম রাত এই রাতে কামিজ আর সালোয়ারে কি চলে যাও পরে এসো এটা! ” এই বলেই শাড়িটা হাতে ধরিয়ে দিলেন। গাড় নীল কালারের শাড়িটা কালো ব্লাউজে চালিয়ে দিয়ে যখন পরে বের হলাম। আমি তো লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। শাড়ি পরে সামনে আসতেই সোহেল আমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলল,

___ ” সেদিন তো ভাল করে দেখতেই পারি নি শাড়ি পরা আমার বউটাকে কেমন লাগে। শোনো তাড়াহুড়ো করে এসেছি বেশি কিছু আনতে পারি নি। মিলি কল
দিয়ে বলল আপুর বার্থডে যে করে হোক আমাকে আসতেই হবে। তাই হুট করে চলে এসেছি। বার্থডে গিফট আনি নি বলে রাগ করো না প্লীজ।” তখন আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না হঠাৎ তাকে কাছে যেয়ে জাপটে ধরে বললাম,

___ ” আমার এই জন্মদিনের সবচেয়ে বড় গিফট হলেন আপনি”। টের পেলাম একজোড়া হাত পিঠের উপর এসে আকড়ে ধরেছে আমাকে। এ যেন এক অনাবিল প্রশান্তি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত