-হ্যালো মধুবনী? আজ ক’টা নাগাদ অফিস থেকে বেরোতে পারবে বলো তো?
-এই কেনো গুঞ্জন? এই তো সেদিন দ্যাখা করলাম। আজ আর না।
-আরে তোমায় বলেছিলাম না মা দেখতে চেয়েছে, নিয়ে যাবো একদিন? মা ক’দিন ধরেই বলছে জানো! আজ আমি কথাও দিয়ে ফেলেছি তোমায় বাড়ি নিয়ে যাবো। মা’ও কি সব চিড়ের পোলাও, রসবড়া বানাচ্ছে শুনলাম। তোমার অসুবিধে থাকলে সে না হয় আমি মা’কে বুঝিয়ে বলে দেবো।
-আরে না না! অসুবিধের কথা কখন বললাম? আমি দেখছি। তোমায় একটু পরে ফোন করে জানাচ্ছি।
ফোনটা রেখে আবার ল্যাপটপে মনোনিবেশ করতে চাইলো মধুবনী। কিন্তু নাহ্! একটু টেনশন হচ্ছে এবার। প্রথমবার ও বাড়িতে যাওয়া! রিভল্ভিং চেয়ারটা টেনে পাশের চেয়ারের সোহিনীর গা ঘেঁষে বসলো। সোহিনী। মধুবনীর সব সমস্যার একমাত্র রেফারেন্স বুক।
-এই শোন না! বলছি কি! আজ আমায় একটু আগে..
-বুঝে গেছি ম্যাডাম। তুমি নিশ্চিন্তে যাও। আমি এদিকে সামলে নেবো। ওই টেকো বস কে ম্যানেজ করতে হবে তো? ও আমার দায়িত্ব।
-লাভ ইউ সোহিনীর! লাভ ইউ সো মাচ। জাপটে গলা জড়িয়ে ধরলো মধুবনী সোহিনীর।
-আরে ছাড় ছাড়। মরে গেলে তোর বিয়েতে খাওয়া হবে না যে! নিশ্চিন্ত হয়ে এবার গুঞ্জন কে ফোন করে মধুবনী।
-হ্যালো! শোনো না গুঞ্জন। সাড়ে চারটে নাগাদ বেরোতে পারবো। কিন্তু একটা সমস্যা আছে।
-বলা হোক।
-আমি তো আজ জিন্স আর কুর্তিতে আছি। মায়ের সাথে প্রথমবার দেখা হবে! শাড়ি হলে ভালো হতো মনে হয়!
-আচ্ছা সে না হয় বুঝলাম। এটা নিয়ে পরে বলছি। আগে কি সমস্যার কথা বলছিলে সেটা বল!
-আরে ধুর! এটাই তো সমস্যা। বোঝো না তুমি!
-এটা তো কোনো সমস্যাই নয় মধুবনী। মা তো তোমার থেকেও মডার্ন। মা কি তোমার ড্রেস দেখতে ডেকেছে?
দেখবে তো তোমায়! বুঝবেও তোমাকেই। তুমি ভেবো না। আমি ঠিক সাড়ে চারটে নাগাদ অফিসের মেন গেটে থাকবো। ফোনস্ক্রীনে চট করে নিজেকে একটু দেখে নিল মধুবনী। চোখের কাজল একটু ঘেঁটেছে। তা ঘাঁটুক। জীবনটাই তো ঘেঁটে যেতে বসেছিল পুরোপুরি। সেদিন যদি অনন্ত অ্যাসিড ভরা বোতল টা ওর মুখে শরীরে ঢেলে দিতে সমর্থ হতো তাহলে আজ ভাবলেও গা শিউরে ওঠে ওর। ছোট্ট মেয়েটার কথাও ভাবলো না একবার বাবা হয়ে? কোলেই তো ছিল তখন বিহু! ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছিল মেয়ে কে বুকে জড়িয়ে। সত্যিই জীবনের সেই অন্ধকার অধ্যায় টা পেরিয়ে আসতে পেরেছে আজ হয় তো শুধু গুঞ্জনেরই ম্যাজিকে। নাহ্! চারটে সতেরো! ফাইলটা গুছিয়ে সোহিনীর টেবিলে দিয়ে লিফ্টের দিকে এগোলো মধুবনী।
অফিসের মেন গেটের সামনে হাসি হাসি মুখ করে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গুঞ্জন। মধুবনী কে দেখেই প্রশ্ন “টিফিন শেষ করেছো? বোতলে কতটা জল আছে দেখি?” “খেয়েছি গো! সবটুকু খেয়েছি। জল ও প্রায় শেষ। খাইয়ে খাইয়ে মোটা করে দাও আমায়। ভাল্লাগে না এতো শাসন।” কৃত্রিম অভিমান করে মধুবনী। প্রতিবারের মতো গোলাপী হেলমেট টা মধুবনীর হাতে ধরায় গুঞ্জন। “নাও পরে নাও। আর দেরি করবো না” কংক্রিটের শহরটার রাজপথ অলিগলি ঘুরে, ব্যস্ততা কোলাহলের কত শত কোলাজ পেরিয়ে এগিয়ে চললো সদ্য সদ্য রূপকথা বুনতে শেখা একজোড়া কপোত-কপোতি।
-এই এই গুঞ্জন! এদিকের রাস্তায় মুড়লে যে! তুমি তো বলেছিলে তোমার বাড়ি ক্যামাক স্ট্রীটে!
-হ্যাঁ! ঠিকই তো বলেছি। এখনো ক্যামাক স্ট্রীটেই আছে। ঠিকানা বদলাই নি ম্যাডাম।
-তবে?
-আরে! আমি তো যাচ্ছি তোমার ফ্ল্যাটে আমাদের মেয়েকে আনতে। মা কি শুধু বউমার সঙ্গেই পরিচয় করবে? নাতনীর সঙ্গে নয়? তুমি বরং তোমার যমুনা দি কে কল করে বিহু কে রেডি করিয়ে দিতে বলো তাড়াতাড়ি। আমরা দশ মিনিটে পৌঁছচ্ছি।
আলতো করে গুঞ্জনের দায়িত্বশীল চওড়া কাঁধে চাপ দিল মধুবনী। পরম শান্তির এই সঙ্গ। সবটুকু ভয় উৎকন্ঠার উবে যাওয়ার মুহূর্ত। একটা বেলুন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে দুরে। ফুলের পসরা সাজিয়ে নিয়ে বসেছে নেপালী মেয়ে। পাখীরা বাসায় ফিরছে দল বেঁধে। কি ভীষণ সুন্দর একটা হলুদ বিকেল একটা স্বপ্নালু বাস্তব একটা জাগ্রত জীবন ছুঁয়ে যাচ্ছে মধুবনীর অনেকদিনের দমবন্ধ করা স্যাঁতস্যাঁতে মনের আনাচ-কানাচ।।