৮০-র দশক। বর্ষণমুখর সন্ধ্যাবেলা। ঝাপসা শহরের কোনো এক আধো অন্ধকার এঁদো গলি দিয়ে এগিয়ে চলেছে এক সদ্য বিশ পেরোনো তরুণী। ভরা যৌবনে পরিপূর্ণ তার শরীর, দেখলেই বোঝা যায় কোনো বড়লোকের আদুরী কন্যা। বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচার জন্য মাথায় ছাতা ধরা থাকলেও তা পুরো শরীরকে রক্ষা করতে পারছে না। ভিজে শাড়িটা যেন আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। রাস্তাঘাট প্রায় শুনশান। পাশ দিয়ে একটা হাতে টানা রিকশা চলে গেল। একজন মাঝ বয়সী মহিলা শাড়ির আঁচলটা মাথায় জড়িয়ে এক ছুটে রাস্তা পেরোল। রাস্তার পাশে এক দোতলা বাড়ির ব্যালকনি থেকে এক কিশোরী অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
তরুণীর অবশ্য সে দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। নির্বিকার চিত্তে সে এগিয়ে চলেছে গলির শেষ প্রান্তে অবস্থিত দোতলা ভাড়া বাড়িটার উদ্দেশ্যে। নীচের তলার কোনের দিকের আঠারো নাম্বার ঘরটাই তার গন্তব্য।এক সময় বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল সে। বর্ষায় পাশের নর্দমাটা উপচে পড়েছে। তার ময়লা জলে ঢেকে গেছে রাস্তা। কলেরা, ম ্যালেরিয়ার আদর্শ পরিবেশ। আঠারো নম্বর ঘরটা থেকে ভেসে আসছে টেপ রেকর্ডারের শব্দ। তার ভগ্নপ্রায় আওয়াজ মালিকের করুন অবস্থার কথা কিঞ্চিৎ জানান দিচ্ছে। সেই দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তরুণী। কবির সুর যেন আজকের পরিবেশটাকে এক অন্যরকম বিষন্নতায় কিংবা মায়ায় আছন্ন করেছে। “এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে বাহির হয়ে এসো বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছো অন্তরে এসো আমার ঘরে।”
দরজার সামনে এসে দাঁড়াল তরুণী। আলকাতরায় রাঙানো পাল্লায় ঘুনপোকাদের আস্তানা জানান দিচ্ছে, দীর্ঘদিন এ ঘরে কোন রকম সংস্কার হয়নি। কড়া নাড়লো তরুণী। একবার, দুবার; তিনবারের মাথায় থেমে গেল টেপ রেকর্ডারের শব্দ। মৃদু কাশির আওয়াজ। কয়েক সেকেন্ড পরে খুলে গেল দরজাটা। সামনে এসে দাঁড়াল লম্বাটে গড়ন, ক্ষয়িষ্ণু একহারা চেহারার এক যুবক। গালে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। মেয়েটিকে দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লো সে। কয়েক মূহুর্ত পর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “তুমি!”
-“হ্যাঁ আমি।” শান্ত স্বরে জবাব দিলো মেয়েটি। তারপর ছেলেটির পাশ কাটিয়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলো। “চলে এলাম, সব ছেড়ে।” এক কামরার ঘর। দেওয়াল হতে পলেস্তারা খসে পড়েছে। দক্ষিণ দিকে একটা জানালা। সেটা ছিটিকিনি দিয়ে আটকানো। ঘরের মধ্যে একটা চারপেয়ে চৌকি পাতা। তার পাশে একটা সাইড টেবিল। টেবিলের উপর মাটির কুঁজো আর একটা গ্লাস রাখা। ছেলেটা দরজা বন্ধ করে গ্লাস হাতে কুঁজো থেকে জল ঢালতে উদ্যত হয়েছিল। মেয়েটির কথা শুনে থমকে গেল।
-“চলে এলাম মানে? এসব তুমি কি বলছো অনু?!”
-“কেন? স্পষ্ট বাংলাতেই তো বললাম। তোমার তো বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়!”
-“তুমি জানো, তুমি কি বলছো?”
-“জানি অমরেশ।”
-“তা হলে এটা তুমি করতে পারো না।”
-“কি পারি না?”
-“এভাবে রাজপথ থেকে গলিতে নেমে আসতে।”
-“অমরেশ তুমি জানো যে আমি বিংশ শতাব্দীর এক শিক্ষিত শহুরে নারী। আমাকে এভাবে ক্ষুদ্র গন্ডি চেনানোর মতো হাস্যকর চেষ্টা তুমি কোরো না। তোমার মতো একজন উদারপন্থী মানুষের থেকে সে আশা করি না।”
-“তোমার বাড়ি থেকে আমাকে কখনোই মেনে নেবে না অনু। শহরের অন্যতম ধনী প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর একমাত্র মেয়ের সাথে এক অনাথ চালচুলো হীন বেকার যুবকের সম্পর্ক কোনদিনই পূর্ণতা পেতে পারে না।”
-“অমরেশ তোমার মনে আছে, আর্ট কলেজের সেই দিনগুলোর কথা? যখন কলেজের সবচেয়ে মেধাবী ইন্ট্রোভার্ট ছেলেটার দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কাছে সমস্ত দর্প চূর্ণ হয়েছিল এক সদ্য যৌবনা রমনীর। মনে পড়ে, আমার জন্মদিনে তোমায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি, সারা জীবন সাথে চলবার অঙ্গীকার? অমরেশ তোমাকে দেওয়া কথাগুলো কোনো বড়লোকের আদুরী মেয়ের খামখেয়ালিপনা নয়। তা তোমায় ঘিরে অনুরাধা সান্যাল্যের অনুভূতি।”
-“কিন্তু অভাব, দুঃখ, দারিদ্র্য ছাড়া আমি তো তোমায় আর কিছুই দিতে পারবো না।”
-“স্ত্রীয়ের মর্যাদা ছাড়া আমাকে নতুন করে দেবার মতো কিছু নেই। তোমার সবকিছুই আমার।”
-“যেদিন থেকে মারণ ব্যাধি টিউবারকিউলোসিস গ্ৰাস করেছে, মৃত্যুর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছি।
ক্ষয় রোগের কবলে পড়ে টিউশনিগুলোও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। আমার গন্তব্য সংক্ষিপ্ত। প্রতি পদক্ষেপ অনিশ্চয়তায় ভরা।”
কথা বলতে বলতে হঠাৎ তুমুল কাশি শুরু হয় অমরেশের। সে মেঝেতে পড়ে যায়। ছুটে গিয়ে তার মাথাটা কোলে তুলে নেয় অনুরাধা। বিছানায় নিয়ে শোওয়ায়।
-“আমি তোমার কাছে গন্তব্যের সন্ধানে আসিনি। তোমার প্রতি পদক্ষেপের দোসর হওয়াতেই সার্থক আমার নারীত্ব। আমরা সবকিছু ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবো অমরেশ। যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না। যেখানে গলি ও রাজপথের বিবাদটা চিরকালের জন্য অর্থহীন হয়ে যাবে। আমি জানি, আমার বাড়ি থেকে আমাদের সম্পর্কটা কখনোই মেনে নেবে না। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তাদের অনুমতি নিয়ে আমি তোমার সথে সম্পর্কে আবদ্ধ হইনি। অতএব প্রতিশ্রুতি রক্ষার সময়ে তাদের মতামত নিস্প্রয়োজন। ভালোবেসে সবকিছু ছাড়া যায়। কিন্তু কোনোকিছুর বিনিময়েই ভালোবাসাকে ছাড়া যায় না। আমি শুধু তোমার যৌবনের প্রেমিকা হয়ে থেকে যেতে চাই না। অর্ধাঙ্গিনী হতে চাই।”
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত গভীর হতে থাকে। গভীরতর হয় বৃষ্টির দাপট। অমরেশের কাশির শব্দকে ছাপিয়ে যায় আষাঢ়ে মেঘের গুরু গম্ভীর নাদ। মাঝেমাঝে বজ্রপাতের আওয়াজ কাঁপিয়ে দেয় ব্রম্ভান্ডকে। পরদিন সকালে শহরের এক এঁদো গলির শেষের দোতলা বাড়িটার ১৮ নং ঘরের দরজায় একটা জংধরা তালা ঝুলতে দেখা যায়। ঘরের বাসিন্দা এক মৃত্যু পথযাত্রী তার সঙ্গিনীর হাত ধরে পাড়ি দিয়েছে, দূরে কোথাও, কোনো নাম না জানা দেশে। গন্তব্য সংক্ষিপ্ত, চরম অনিশ্চয়তায় ভরা। হোক না! প্রিয় মানুষ সাথে থাকলে এই পথ চলাতেই জন্মান্তরের সুখ আছে যে।