সেই অভিশপ্ত রাত

সেই অভিশপ্ত রাত

কোথা থেকে যেন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে ঘরে প্রবেশ করল রফিকুল । চোখমুখ লাল । ঘোলাটে আর্তনাদ আর ঘন নিশ্বাসের আওয়াজে শোনা গেল-সবশেষ হয়ে গেল । সব শেষ ।

-কি হয়েছে তোমার ? এত হাপাচ্ছ কেন ? সেই তো সকালে বেড়িয়েছিলে । সারাদিন কোথায় ছিলে ?
উতকন্ঠিত গলায় প্রশ্ন শাকিলার । বছর দুয়েক হল পাড়ার ছেলে রফিকুলের সাথে বিয়ে হয়েছে শাকিলার । রফিকুল পাড়ায় পাড়ায় হকারের কাজ করে আর শাকিলা কমবেশি করে বাড়িতে বিড়ি বাঁধে । এই নিয়েই টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে সংসার চলে তাদের ।

-আমাকে একা থাকতে দে । চলে যা এখান থেকে । বিরক্ত করিস না । শাকিলার মনের ভেতর কেমন যেন একটা অস্থিরতা কাজ করতে লাগল ।
-কি হয়েছে ? বলবে তো ।

এমনিতেই মাঝে মধ্যে যথেষ্ট ঝামেলা পোহাতে হয় শাকিলাকে । বিয়ের দুবছর পরেও কোন সন্তান হয়নি তাদের । এই নিয়ে পাড়ায় কেউ কিছু বললে রফিকুল মেজাজ হারিয়ে ফেলে । আর বাড়িতে এসে ঝগড়া শুরু করে দেয় । শাকিলার কোন প্রশ্নেরই জবাব দিল না রফিকুল । কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে বলল

-হাকিমের সাথে কি সম্পর্ক তোর ?
-কে হাকিম ? পাল্টা প্রশ্ন শাকিলার ।
-তোর মামাতো ভাই ।

আজ নামাজ শেষে আব্দুল চাচার চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়ার সময় হঠাৎ দেখা হল ওর সাথে । তিন বছর পর । সেই নিরুদ্দেশ হওয়ার পর । নামটা, মাথার ভেতর কোথাও যেন ভুলে যাওয়া স্মৃতি জাগিয়ে তুলল শাকিলার । শাকিলা চুপ করে থাকল । অবশ্যই রফিকুলের অত্যন্ত সন্দেহজনক ও অবিশ্বাসী প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না শাকিলা ।

-তুই মিথ্যাবাদী । তুই আমার সাথে চিটিং করে শাদী করেছিস । তুই খারাপ মেয়ে । তোর সাথে অনেকের সম্পর্ক হয়েছে । তুই আমাকে জানাস নি । তুই আমার জীবনটাকে নষ্ট করে দিয়েছিস ।

তীব্র স্বরে উচ্চারিত রফিকুলের প্রতিটা শব্দ যেন সরাসরি শাকিলার মস্তিষ্কে আঘাত করতে লাগল । এমন সময় সমস্ত অস্তিত্ব কাঁপিয়ে শাকিলাকে মনে করিয়ে দিল সেই অভিশপ্ত রাতের কথা । সেই পুরনো চুড়িদারের ভাজে গুঁজে দেওয়া হাকিমের কুড়ি টাকার কথা । রফিকুলের এক ঝাঁকুনিতে বাস্তবে ফিরল শাকিলা । কিছুক্ষণের জন্য নিজের তিক্ত অতীতে চলে গিয়েছিল শাকিলা ।

-তুই আমার বিশ্বাসকে মেরে ফেলেছিস । দাফন জানাজা ছাড়া কবর দিয়েছিস আমাদের সম্পর্ককে । এরপরেও তুই চুপ আছিস । কিভাবে ভাবছিস যে তোর সাথে আর সংসার করব ?

সমস্ত ঘটনার ছাপ যখন একেবারে অস্পষ্ট, স্মৃতি যখন একেবারে অতীত, ঠিক তখন শাকিলার সংসারে এক ফাটল ধরার শব্দ শোনা গেল রফিকুলের গলায় । সংসারে আবারও এক ছন্দপতন ঘটলো । বুঝতে পারল গোলমালটা কোথায় । হাকিম হয়ত নাড়ি নক্ষত্র সবটাই বলে দিয়েছে । তাই পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই দৌড়ে ছুটে গিয়ে রফিকুলকে জড়িয়ে ধরল শাকিলা ।

-আমার কোন দোষ নাই । সবটা বলছি তোমাকে । একটু সময় দাও । এক অদ্ভূত হতাশা নিয়ে গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল শাকিলা ।

– দু বছর তো হয়ে গেল বিয়ে হওয়া । আর কত সময় নিবি । আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা । নাহলে মেরেই ফেলব তোকে । এমনিতেই মাথাটা খুব গরম হয়ে আছে ।

এই বলে শাকিলার গলাটা টিপে ধরল রফিকুল। আপ্রাণ ধস্তাধস্তি করে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল শাকিলা । ভয় ও তীব্র আতঙ্ক ততক্ষণে গ্রাস করে ফেলেছে শাকিলাকে । শরীরের শিহরণ ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে । পা ধরতে যাবে এমন অবস্থায়, রফিকুল বুকে সজোরে একটা লাথি মেরে ছিটকে কয়েক মিটার দূরে ফেলল শাকিলাকে ।

-এত্ত দিনে বুঝতে পারলাম তোর ছ্যালা-পিলা ক্যানে হয় না । তুই বাঁঝা আছিস । আমাদের শাদীর আগে তোর একটা বেটি হয়েছিল । সেটাকে তুই মেরে ফেলেছিস । সেই পাপের ফল এখন আমি ভুগছি । ওই লেগে তো তোর আর ছ্যালা-পিলা হয় না । তোদের বিচার সালিশির কথাও বলেছে হাকিম । প্রচন্ড ব্যথায় কুঁকড়ে গেছে শাকিলা । কৌতুহল চোখে সেই অকাল প্রসবের কথা ভাবতে ভাবতে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল শাকিলার । কতক্ষণ কেটে গেছে কোন হুশ নেই শাকিলার । রাতের ব্যথার ঘোর তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি শাকিলা । কোনরকম চোখ খুলতেই দেখল এক কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন সে । গ্রামের মৌল্লা মৌলানারা এসে হাজির ।

রফিকুল পুরো ঘটনা বর্ণনা করল মোল্লা মৌলানাদের সামনে । কিছু প্রশ্নের উত্তর তখনও বাকী ছিল । সব হারানোর দুঃখের চাইতেও সম্পর্ক ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল শাকিলা । কিন্তু পারল না । গত রাতই হল শাকিলার শ্বশুরবাড়িতে শেষ রাত । বিচার সালিশির পর তালাক নামায় শাকিলার দ্বিতীয় পর্বেও বিচ্ছেদ ঘটল । বছর তিনেক পরে আবারো এক হৃদয় বিদারক ঘটনার সাক্ষী থাকল শাকিলা । কোন দিকে যাবে সে এখন ? একদিকে বাপের বাড়ি । আর অন্য দিকে সামনের অসীম পথ । যেন মরুভূমিতে মরীচিকা খোঁজার চেষ্টা । এমন অবস্থাই শাকিলার ঠাঁই হল সেই বাপের বাড়িতেই । বছর খানেক হল বাপের ইন্তেকাল হয়েছে । মা বেচারী আগের মতই পরের বাড়িতে ঝি-চাকর খেটে কোনোক্রমে সংসার চালায় ।

কয়েকদিন কেটে গেল কেঁদে কেঁদে বালিশ ভেজানোর মধ্য দিয়ে । লোকের গালাগালি, টোন-টিটকারি, আর দেখে মুচকি মুচকি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মধ্যে গ্রামের মধ্যে আর থাকতে পারল না শাকিলা । হঠাৎ একদিন কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল । কোমলতার চাইতেও কয়েকগুন বেশি কঠিন । একটা ছোট্ট চিরকুটে মায়ের উদ্দেশ্যে কিছু লিখে রাতের এক গভীর অন্ধকারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল শাকিলা ।

-জীবন আমার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমি জানিনা মা । তুমি যেভাবে পরের দুয়ারে কাজকর্ম করে সংসার চালাচ্ছো, চালিয়ে যাও । তুমি ভালো থাকো । আর আমার কোন খোঁজ করিও না । কেননা খোঁজ করলেও হয়তো আমাকে আর পাবে না । কারণ আমি যেখানে চলে যাচ্ছি, সেখানে আলো কখনো পৌঁছাতে পারবে না । এতটাই ঘন অন্ধকার যে কেউ কখনো সেই জায়গাতে আলো জ্বালাতেও পারেনি । বছর তিনেক আগে সেই যে অভিশপ্ত রাতে রফিকুলের দেওয়া কুড়ি টাকা চুরিদারের ভাঁজে থেকে গিয়েছিল, সেই কুড়ি টাকা নিয়েই চলে গেলাম অনেক দূরে । জীবনকে বাঁচানোর জন্য আর এক অন্য জগতে । এখানে কোনরকম ব্যঙ্গ বিদ্রুপ নেই, নেই কোন তালাকনামাও , এখানে সংসার করার কোন আশা প্রত্যাশাও নেই । এখানে দিনরাত বাবুরা আসেন আর এইরকম শ’য়ে শ’য়ে কুড়ি টাকা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে যায় ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত