রোদ্দুরের ইচ্ছেগুলো

রোদ্দুরের ইচ্ছেগুলো

“কি ব্যাপার রোদ্দুর তোমার?কদিন ধরেই লক্ষ্য করছি পড়াশুনোয় কোনো মন নেই।এত অন্যমনস্ক কেন? বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখছি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বসে আছ চুপচাপ।স্কুলে কেউ কিছু বলেছে তোমাকে নাকি টিফিনবেলায় খেলার মাঠে কোনো ঝামেলা হয়েছে? কোনো কিছু না লুকিয়ে আমাকে খুলে বল তাহলে দেখছি কি করা যায়”, পঞ্চম শ্রেণীতে পাঠরত একমাত্র সন্তান রোদ্দুরের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে ওর মা চূর্ণী।
মায়ের কথাতে ভাবনার জগত ছেড়ে বেরিয়ে একটু চমকে উঠে রোদ্দুর বলে,”না মা ও কিছু নয়,এইতো পড়ছি।”

__”এইতো আমার সোনা ছেলের মত কথা।টাস্কগুলো ঝটপট শেষ করে ফেল। আমি তোমার জন্য দুধ গরম করে নিয়ে আসছি”, রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলে চূর্ণী। মায়ের হাতদুটো খপ করে জড়িয়ে ধরে রোদ্দুর বলে,”আচ্ছা মা তুমি তো জানো দুধ খেতে আমার একদম ভালোলাগেনা। বেশি কিছু নয় আমার ভাগের দুধ আর কয়েকখানা বিস্কুট যদি বটতলায় ওদের কাছে পৌঁছে দাও কত্ত ভালো হয়।এই শীতের রাত্রে ওর ছোট্ট বাচ্চাদের ছেড়ে আর কোথাও খাবার খুঁজতে যেতে হবেনা কালুকে।”

__”উফফ তুমি আবার লেখাপড়া ছেড়ে ওদের কথা শুরু করলে। ভালো করে জানো তো তোমার বাবা অফিস থেকে ফিরে যদি শোনে তুমি ঠিকমত পড়াশুনো করছ না তাহলে কতটা রাগ করবে।তুমি ঘুরতে যেতে ভালবাস বলে সামনে বড়দিনে স্কুল ছুটি পড়লে বলেছি দার্জিলিং নিয়ে যেতে।তোমার জন্মদিনটা এবার ওখানেই কাটাব আমরা।ম্যালে ঘুরব,ঘোড়ার পিঠে চড়বে তুমি,গ্লেনারিজে কফি খাব, আর মাঝ রাত্তিরে কেক,মোমো দিয়ে তোমার জন্মদিন পালন করব। কিন্তু সবটাই এখন তোমার উপর। ঠিকমত লেখাপড়া না করলে আমি তোমার বাবাকে বলে ট্যুর বাতিল করে দেব। নাও আর কথা না বাড়িয়ে এবার টাস্ক করে ফেল ঝটপট। আমি যাই…”রোদ্দুরের হাত ছাড়িয়ে দুধ আনতে যায় চূর্ণী।

জানলা দিয়ে বাইরের জমাট বাঁধা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরে একরাশ কান্না দলা পাকিয়ে ওঠে রোদ্দুরের।কে জানে এখন কালু আর ওর বাচ্চারা কি করছে এই ঠান্ডায়।রোদ্দুর বা ওর অন্য বন্ধুরা যখন নিশ্চিন্তে ঘরের খাটে নরম বিছানায় কম্বল,চাদরের ওমে ঘুমায় ওরা তখন খোলা আকাশের নীচে জবুথবু হয়ে কোনমতে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু ওই মনকেমনই সার! বয়সটা যে ছোট রোদ্দুরের চাইলেও বা কতটা করতে পারবে ওদের জন্য। তবুও মাঝেমধ্যে স্কুল যাবার পথে টিফিনবক্স খুলে কিছু খাবার বের করে দেয় ওদের। ভারী খুশি হয় ওরা।আনন্দে চোখগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওদের, আনন্দসূচক আওয়াজ করে বলে,”ভৌ,ভৌ।”রিকশাচালক শ্যামলকাকুকে বারণ করেছে রোদ্দুর বাড়িতে এই ব্যাপারে কিছু না জানাতে। যদি জানাজানি হলে ওইটুকু বন্ধ হয়ে যায় এই ভয়ে।

এইতো আজও ওইবেলা প্রতিদিনের মত শ্যামলকাকুর সাথে স্কুল যাবার পথে দেখেছিল বটতলার মোড়ে চারমূর্তিকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিল রোদ্দুর।ঠান্ডায় একেবারে কুঁকড়ে কোনমতে একফালি চটের টুকরোতে শুয়ে আছে তিনটে ছানা মায়ের কোল ঘেঁষে।বড্ড মায়া জাগে রোদ্দুরের মনে,বাড়িতে কত জায়গা তো খালি পড়ে আছে ওদের। বিশেষ করে দক্ষিণের গাড়ি বারান্দায় একপাশে জায়গা করে দিলে কারুর কোনো অসুবিধা হবার কথাই নয় কিন্তু ঠাম্মির যা খুঁতখুতানি বাতিক ওদের আনার কথা বললেই যদি কুরুক্ষেত্র বাধায়।সেইজন্য রোদ্দুর ওর মাকে বললেও মা চুপ করে থেকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে ওর কথাগুলো।

এই ঘটনার দিনদুই পরে সকালবেলা চোখ মেলতেই রোদ্দুরের কানে আসে দক্ষিণের বারান্দা থেকে কুকুরছানাদের আনন্দে মাখা কুইকুই শব্দ।একছুট্টে ওখানে পৌঁছে ও দেখে কালু ওর বাচ্চাদের নিয়ে ছোটাছুটি করছে গোটা বারান্দা জুড়ে।ঠাম্মি মণিমালাদেবী মিটিমিটি হাসছেন আর বলছেন,”আর কিছুদিন পরেই তোমার দশবছরের জন্মদিন দাদুভাই।কেমন লাগল এই বুড়ির তরফ থেকে তোমার এই আগাম জন্মদিনের উপহার?”

__”কিন্তু তুমি কি করে জানলে আমি ওদের এত ভালোবাসি?”;রোদ্দুর বলে ওর ঠাম্মির গালে হামি দিয়ে।

__”তোমার শ্যামলকাকু আমাকে সব বলেছে যে বাচ্চাগুলোকে দেখার পর থেকে তুমি ওদের ব্যাপারে কত ভাবছ।ঠাম্মি হয়ে নাতির মনের সাধ অপূর্ণ রাখি করে? ফাঁকাই তো পড়ে আছে জায়গাটা ওরা থাকলে ভালোই হবে।শ্যামলকে দিয়ে কিছু কাঠের বাক্স আনিয়ে নিয়েছি যাতে শীতে কষ্ট না হয় ওদের”মণিমালা বলেন।

_”বড়দিনের আগেই এবার তাহলে তুমিই সান্টাক্লজের মত আমার মনের কথা জেনে এত বড় উপহার দিয়ে আমার ইচ্ছেপূরণ করলে।আই লাভ ইউ ঠাম্মি।এবার আমার বন্ধুরা চলে এসেছে এই বাড়িতে।পড়াশুনোতে আর কোনো ফাঁকি দেবনা। তোমরা দেখে নিও”;এই বলে কালু আর ছানাদের দিকে পা বাড়ায় রোদ্দুর।ওরাও পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে ওকে।ততক্ষণে মণিমালার পুত্র আর পুত্রবধূ অংশু আর চূর্ণী এসে দাঁড়িয়েছে।

মণিমালা ওদের উদ্দেশ্যে বলেন,”তোরা দেখ ওর নাম রাখা সার্থক।যে রোদ্দুর তার কাজই তো উষ্ণতা ছড়ানো।”।শীতের কুয়াশার জাল ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ে একরাশ উষ্ণতা। কালু আর ওর বাচ্চাদের সাথে খেলায় মেতে ওঠে রোদ্দুর।।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত