নেমন্তন্ন বিভ্রাট

নেমন্তন্ন বিভ্রাট

বিনিকে মনে আছে তো?সেই বিনির মা, মানে আমার শ্যালিকা বীথি, তখন ভুপাল, মধ্যপ্রদেশে পোস্টেড – অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, ট্রাইবাল ডেভেলপমেন্ট পদে, অনেকবার আমাদের বলেছে ভুপাল আসার জন্যে ৷ প্রতি বছরের মতো ডিসেম্বর মাসে আমরা মস্কো থেকে ইন্ডিয়া এসেছি ছুটি কাটাতে, এই সময় মস্কোতে কোনো কাজকর্ম একরকম হয় না বললেই চলে, সবাই ক্রিস্টমাসের আনন্দে মশগুল থাকে, সবাই ক্রিস্টমাসের ব্যবস্থায় ব্যাস্ত থাকে, এমনিতেও এই সময় মস্কোতে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে, তাই আমরাও এই ডিসেম্বর মাসটা ছুটি কাটাতে ইন্ডিয়া চলে আসি ৷ওখানে অবশ্য মে, জুন আর জুলাই বাদে সারা বছরই ঠান্ডা থাকে ৷ সেবার ঠিক করলাম ইন্ডিয়া এসে আমরা ভুপাল যাবো, আমরা এই সময়টা ইন্ডিয়া এসে খুব ঘুরে বেড়াই, আমার ভাইরা, শ্যালক রা সবাই সঙ্গে থাকে ৷

তবে ওরা কেও ভুপাল যাবে না,কারণ রাজধানী হওয়ার জন্যে কাজের সুবাদে ওদের প্রায়ই ভুপাল যেতে হয় ৷
রায়পুরে আমার স্ত্রীর কাকু থাকেন, ওঁর মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে ভুপালে, কাকু বললেন ভুপালে যেন আমরা পাত্রের বাড়ি গিয়ে ওর আর ওর বাবা মায়ের সাথে আলাপ পরিচয় করে আসি৷সেই মতো উনি হবু বর, প্রভাসের বাবাকে ফোনে সব জানিয়ে দিলেন, আমাদের ফোন নম্বরও ওঁকে দিলেন ৷ আমরা ভুপাল পৌঁছুলাম, বীথি আর ওর বর দ্বিজেন, স্টেশনে এসেছিলো আমাদের নামাতে, ওরা খুব খুশি ৷ ভুপালে নেমে প্রথমে আমরা ফেরার রিজারভেশন করে নিলাম যাতে এই কাজের জন্যে অন্য কোথাও যেতে না হয় বা ফেরার সময় ঝামেলা না হয়, কারণ তখনও অন-লাইন রিজারভেশনের ব্যবস্থা ছিল না ৷ আমরা স্টেশন থেকে বীথি আর দ্বিজেনের সাথে ওদের সরকারি বাঙলোতে উঠলাম ৷

ভুপাল পৌঁছে আমার বৌ ফোন করল প্রভাসের মাকে, বললো আমরা কাল বা পরশু সন্ধ্যে নাগাদ ওদের বাড়িতে যাবো, ফোন করে জানাবে, আমরা খানিক্ষন বসে আলাপ পরিচয় করবো, গল্পোটল্প করবো আর কি ৷ প্রথম দিন আমরা কোথাও গেলাম না, ভুপাল শহরেই ঘুরলাম, আমাদের সাথে বিনি আর ওর দাদা বাপি গেলো, বীথি আর দ্বিজেন অফিস থেকে কয়েক দিনের ছুটি নিয়েছিল আমরা আসবো বলে ৷ বিনির তখন কতই বা বয়স, হয়তো ৬-৭ হবে, ওর খুব ইচ্ছা করে হোটেলে খাবার – বিশেষ করে ইন্ডিয়ান কফি হাউসে, এই বয়সের ছেলে মেয়েদের যা হয় আর কি, আমার বৌ বললো ঠিক আছে আমরা একদিন নিশ্চয় ইন্ডিয়ান কফি হাউসে যাবো বিনিকে নিয়ে ৷

ভুপালের আসেপাশে অনেক জায়গা দেখার আছে, এবার আমরা ঠিক করেছিলাম সাঁচী স্তূপ দেখতে যাবো; ভুপাল থেকে ভীমবেটকা বলে একটা ঐতিহাসিক গুহা আছে, সেখানে দেওয়ালের গায়ে চিত্র আঁকা আছে, সেখানে যাবো, আর উপজাতিদের গ্রামে যাবো ওদের জীবন যাত্রার ধরণ ধারণ দেখতে, বীথি আর দ্বিজেন খুব খুশি, চার পাঁচ দিন ধরে ওরা সব ঘুরিয়ে দেবে বললো ৷

পরের দিন আমরা সাঁচী স্তুপ দেখতে যাবো, ফিরে এসে প্রভাসদের বাড়ি যাবো, সেই মতো বীথি প্রভাসের মাকে জানালো, ভদ্রমহিলা বললেন ওঁদের বাড়িতে রাতে ডিনার করে যেতে, বীথি বললো এসব অসুবিধা আবার কেন করবেন, প্রভাসের মা বললেন না না এতে অসুবিধার কি আছে, এখানে নিশ্চয় রাতের ডিনার সেরে যাবেন, বীথি বললো সেসব দেখা যাবে এখন, আগে তো আপনাদের বাড়ি যাই ৷ সাঁচী থেকে ফিরতে পাঁচটা বাজলো, সারাদিন সাঁচী ঘুরে আমরা খুব ক্লান্ত, রাতে প্রভাসদের বাড়িতে ডিনার করবো তাই তাড়া নেই, বিনি ধরে বসলো কফি হাউস যেতে, আমরা বললাম ঠিক আছে সবাই মিলে নিশ্চয় একদিন ইন্ডিয়ান কফি হাউসে যাবো ৷

আমরা ঘরে চা খেয়ে, মুখ হাত ধুয়ে প্রভাসদের বাড়ি গেলাম, প্রভাসের মা বাবার সাথে আলাপ হলো, আমরা এসেছি বলে ওরা খুব খুশি, ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোক বেশ ভালো, অনেক্ষন গল্প করলেন আমাদের সাথে, আমরা প্রভাসের কাজ নিয়ে অনেক্ষন কথা বললাম, ওদের অবস্থা বেশ ভালোই মনে হলো । এখানে ডিনার করে যাবো ভুপাল লেক দেখতে, রাত্রে আলোতে খুব সুন্দর দেখায় লেকটা । রাত ন’টা বাজলো, আমার ক্ষিদেও পাচ্ছে, সেই দুপুরে সাঁচীতে লাঞ্চ করেছি, বিকেলে শুধু চা খেয়েছি ।

আমরা প্রেসার কুকারের হুইসেলের আওয়াজ শুনছি, নিশ্চয় মাংস হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রভাস কোনো কাজে ভেতরে গেলো, প্রভাসের বাবা মা ও কাছে পিঠে নেই, নিশ্চয় আমাদের খাবারের জোগাড় করতে ভেতরে গেছেন, আমার পাঁচ-ছ’বার প্রেসার কুকারের হুইসেলের আওয়াজ শুনলাম, শুনে ক্ষিদে যেন আরো বেড়ে গেলো, নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে আলোচনা করলাম নিশ্চয় পাঁঠাটা খুব বুড়ো ছিল, ইতিমধ্যে আবার প্রেসার কুকারের হুইসেলের আওয়াজ, এবার আমার ভয় করলো ওটা ছাগল তো ! প্রভাসের বাবা ঘরে এলেন, আমি ভাবছি নিশ্চয় এবার আমাদের খেতে ডাকবেন, এমন সময় প্রভাসের মা ঘরে এলেন কতকগুলো প্লেট আর চামচ নিয়ে, প্রভাসকে ডেকে বললেন রান্না ঘরে রসগোল্লা আর সিঙ্গাড়া গুলো আছে নিয়ে আসতে ।

এমনিতেও আমি সিঙ্গাড়া খাই না, কেবল সিঙ্গাড়ার ‘বারান্দা’ ‘ব্যালকনি” গুলো ভেঙে খেয়ে নিই । এখন রাত্তির ন’টা বেজে গেছে, এখন সিঙ্গাড়া রসগোল্লা খেলে আর রাত্রে খেতে হবে না । আমরা মাংস ভাতের অপেক্ষা করছি এরকম সময় এগুলো আমরা একে অন্যের দিকে বেশ অবাক হয়ে তাকালাম, প্রভাসের মা একেকটা প্লেটে রসগোল্লা সিঙ্গাড়া সাজিয়ে প্লেটেগুলো আমাদের হাতে দিলেন, বললেন আমরা আবার কবে ভুপাল আসবো, নিশ্চয় যেন ওঁদের ঘরে আসি ইত্যাদি ইত্যাদি ।

রসগোল্লা সিঙ্গাড়া দেখে আমি বুঝেছিলাম মাংস ভাতের কোনো আশা নেই, এখন ভদ্রমহিলার এইসব কথা শুনে আমি নিশ্চিত হলাম ! আমার প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো, কি জানি ক্ষিদে পেলে বোধহয় রাগ বেশি হয় !
কি আর করা যাবে, আমরা ভদ্রতার খাতিরে ওগুলো খেলাম, আমি বললাম এবার আমাদের উঠতে হবে, বীথি ওর অফিসের কোন কলিগের বাড়ি যাবে কি একটা চাবি দিতে, বেশি দেরি হলে উনি আবার ঘুমিয়ে না পড়েন, এই বলে আমরা বাইরে এলাম, আমাদের গাড়ি ছিল, প্রভাসও আমাদের এগিয়ে দিতে বাইরে এলো ।

বাইরে এসেই বিনি বললো এবার তো কোনো উপায় নেই, আমাদের কফি হাউস যেতেই হবে, প্রভাস বললো হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই তো এই মোড়ের শেষে গেলেই একটা ভালো ইন্ডিয়ান কফি হাউস আছে ওখানকার ইডলি খুব ভালো, আপনারা ওখানে যেতে পারেন এবার আমার সমস্ত রাগটা গিয়ে পড়লো প্রভাসের ওপর, মাংস ভাত চুলোয় গেলো এখন বলে কিনা এই কফি হাউসের ইডলি ভালো, অমুকের তুসুক ভালো ! শা !! যত্তসব সব !! শেষ পর্য্যন্ত আমরা ঘরে এসে রাত এগারোটার সময় খিঁচুড়ি চাপলাম !

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত