খাওয়ার টেবিলে একটা বৈঠক বসেছে বোঝাই যাচ্ছে।নিজেদের মধ্যে একটা আলোচনা চলছে, সীতা এসে চেয়ার টেনে বসতেই তাপস বললো― মা ইতুদের বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে, বিয়েটা যখন হবেই তো দেরী করে লাভ কি? সিদ্ধান্ত যখন নিয়েই ফেলেছো, তো আমাকে আর বলছ কেন যা ভালো বোঝ করো। তবে কবিতার কথা কিছু ভেবেছো ? ও কি কথা বৌমা ! কবিতার কথা আবার ভাবার কি আছে ?
বৌ থাকতে কেউ যেন আর দ্বিতীয় বিয়ে করে না ! ও থাকবে, বাড়িতে তো কাজের লোকের দরকার হয়ই । তাপসের ঠাকুমা খুব সহজেই বললো কথাগুলো। মা আমি আমার ছেলেকে প্রশ্নটা করেছি। কি বলবে তোমার ছেলে ঐ বাজা মেয়েমানুষটার হয়ে ! যেটা মা হয়ে তোমার করা উচিৎ ছিল ,তা তুমি করোনি। আমি তো বলবো দাদুভাই একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মা হয়ে আমি আমার ছেলেকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি, এর থেকে বড়ো লজ্জার তো আর কিছু হয়না । তাই কি আমার উচিৎ ছিল আর কি উচিৎ ছিলনা সেটা বলে লাভ নেই। আপনাকে শুধু বলবো আপনি আমার গুরুজন বলেই সবসময় আপনাকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয়তো আমি পারবো না, যদি কথায় কথায় কবিতাকে সবসময় এইভাবে অসম্মান করেন। মা না হতে পারার যন্ত্রণাটা কতো সেটা একটু উপলব্ধি করুন।ওকে সমবেদনা জানাতে না পারেন মাতৃত্ব নিয়ে অপমান করবেন না। আজকে যে সমস্যাটা কবিতার, সেটা যদি তাপসের হতো।তাহলে তাপসকে নিয়ে যে ভাবনাটা আপনারা ভাবছেন, পারতেন কবিতাকে নিয়েও ঐ একই ভাবনা ভাবতে ! বৌমা!
চিৎকার করে সত্যিটাকে ঢাকা যায়না মা। কবিতার পেছনে দাঁড়ানোর মত ওর কেউ নেই বলে ভাববেন না ও একা। আইনের পথে গেলে ও কিন্তু জিতে যাবে আমি সেটা চাইছি না কারণ কারো মনে যদি জায়গা না হয় তাহলে বাজ্যিক অধিকার দেখিয়ে লাভ কি! সেটা যাদের মনুষ্যত্ব আছে তাদের সেই মনুষ্যত্বকে অপমান করা হয়। তাই কবিতাকে নিয়ে যা ভাবার আমাকেই ভাবতে হবে,আর ভেবেছিও । তা জানতে পারি কি তুমি তোমার বৌমাকে নিয়ে কি ভাবছো ? নিশ্চয়ই ।আমি কবিতার বিয়ে দেবো ভাবছি। দেখো বৌমা তুমি চিরকাল তোমার স্বাধীনচেতা স্বভাব দেখিয়ে এসেছো,এ নিয়ে তো সংসারে কম অশান্তি হয়নি।আমার ছেলেটা কোনোদিনই তোমাকে নিয়ে সুখী ছিল না। কিন্তু সবকিছু আমরা মেনে নেবোনা।বাড়ির বৌকে আবার বিয়ে ! তার স্বামী বেঁচে থাকতে, তাও আবার এই বাড়ির থেকে !
স্বামী ! বাড়ির বৌ ! হাসালেন মা।শুধুমাত্র দু’টো খাওয়া-পরা দিলেই কি কেউ বাড়ির বৌ হয়ে যায় ! বৌয়ের প্রাপ্য সম্মানটুকু যদি না থাকে তবে কিসের বৌ ? যদি বৌকে রেখে তার স্বামী দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারে তবে কবিতা কেন পারবে না ? ওর বিয়েতে চাহিদা মত যৌতুক পাননি বলে ওকে আপনারা প্রথম থেকে পছন্দ করতেন না তার সঙ্গে যোগ হলো ওর মা না হতে পারা। তবে ওকে ছেড়ে দেবেন না কেন ? আসলে বিনা পয়সায় একটা কাজের লোক হাতছাড়া করতে চান না। সত্যিই যদি বাড়ির বৌকে নিয়ে ভাবতেন, তাহলে আমার কথাটা রাখতেন । আমি তো বলেছিলাম একটা বাচ্চা দত্তক নিতে। একটা অনাথ বাচ্চা তার বাবা-মা পেতো, আর ওরাও চুপ করো বৌমা, তোমার রুচিবোধ দেখে অবাক লাগে।তুমি কিনা শেষে জাত ক্ষোয়াতে বলছো ! ঐ অনাথ আশ্রমে জাত,ধর্ম ঠিক থাকে ? বেজম্না সব–
মা ! মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবেই স্বীকৃতি দিন। জার জন্ম হয়েছে সে বেজম্না কিসের। জাত,ধর্ম এগুলো ধুঁয়ে কি জল খাবেন। যাকগে আপনাদের মন অত্যান্ত অন্ধকারে ঠাসা ওখানে আলো কোনদিনই পৌঁছাবে না। যেমন আমার ছেলের আকশটা মেঘে ঢাকা, সূর্যের আলো তাই পৌঁছালো না ওর জীবনে।সঠিক শিক্ষাটা ও পেলোনা। থাক এ নিয়ে আমি আপনাদের সাথে তর্ক করতে চাইছি না। খাওয়া শেষ না হতেই হাত গোটাতে গোটাতে সীতা বললো― শোনো তাপস, তুমি উকিল বাবুর সঙ্গে কথা বলে কাগজপত্র রেডি করো ইমিডিয়েটলি। তোমাদের ডিভোর্সটা হয়ে যাক খুব তাড়াতাড়ি আমিও তাই চাইছি। কবিতার বিয়ের পাকা কথা আমি দিয়ে ফেলেছি, শুধু ডিভোর্সের অপেক্ষা। কাজের মেয়ে আর কবিতার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই এ বাড়িতে। তাই কাজের মেয়ের সাথে সাথে কবিতাও রান্নাঘর থেকে খাবার সার্ভ করছিল।এতক্ষণে সে কথা বললো―মা তুমি কি বলছো ? কেনরে তোর মায়ের প্রতি তোর ভরসা নেই ! সে কথা নয় মা।
তবে কি কথা! এ সংসার তোকে কি দিয়েছে ? তোর স্বামী তোর একটা অক্ষমতাকে মেনে নিতে পারে নি।সম্মান জানাতে পারলোনা তোর ভালোবাসাকে। তুই কোথায় থাকিস, কি খাস তার কোনো খোঁজ রাখেনা। সারাক্ষন অপমান, অবহেলা এই কি তোর প্রাপ্য ! আর এই বাড়ির মানুষেরা তোকে কাজের লোক ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। মাথার উপর ছাদ আর চারটে দেয়াল হলেই সেটা ঘর হয়না কবিতা। শুধু মাত্র কয়েকটি মন্ত্র উচ্চারণ করলেই কেউ কারো বৌ হয়ে যায়না। এই সম্পর্কটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যারা এর দাম দিতে জানেনা ,সেখানে জীবন বিকিয়ে কি লাভ ! তোর বাবা মা বেঁচে থাকলে আজ আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওনারাও এই একই সিদ্ধান্ত নিতো। সামনে তোর জীবন পড়ে আছে, এতো বড়ো জীবনের জার্নি একা চলা যায়না।
দুটো মানুষ পাশাপাশি থেকেও অনেক সময় স্বামী স্ত্রী হয়না, হয়তো সংসারের নিয়ম মেনে উপর থেকে দেখলে মনে হয় সবই ঠিক আছে।কিন্তু মন থেকে যদি দূরত্বটা এক আলোকবর্ষ হয় তবে যে ক্ষত মনের মধ্যে তৈরী হয় তা দিন দিন কমে না বরং বাড়তেই থাকে। আর এর যন্ত্রণা যে কতোখানি তা আমি জানি।তাই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি একা থাকা যায় না, একাকিত্ব আর মারনব্যাধির একই রূপ। দুটোই মানুষকে কুরে কুরে খায়।মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। জীবনের এতো কান্না যদি কাউকে জড়িয়ে ধরে না কাঁদতে পারিস তবে এতো কান্না রাখবি কোথায় মা।
কবিতা আমি তোর মা, আমি তোর অমঙ্গল চাইবো না। রূপম আমার বান্ধবীর ছেলে।ওর বৌটা গতোবছর ডেঙ্গুতে মারা গেছে।ওদের তিন বছরের একটি বাচ্চা আছে। ছেলে নাতিকে নিয়ে আমার বান্ধবীর নাজেহাল অবস্থা, ও তোর কথা শুনে বলেছে তুই যদি ওর সংসারের হালটা ধরিস তোকে ওরা মাথায় করে রাখবে। রূপম শিক্ষায় দীক্ষায় রুচিতে ওর মায়ের সবটুকু পেয়েছে। সত্যি কারের খাঁটি মানুষ তৈরী হয়েছে।গর্ব করার মতো ছেলে। কলিং বেলের শব্দ হতেই সীতা দরজার দিকে বললো― ঐ বোধহয় রূপম এলো ,আজকে আসবে বলে ফোন করেছিল সকালে ।তুই আমার ঘরে যা,আমি ওকে নিয়ে আসছি। দরজা খুলতেই রূপমের ছেলেটা বলে উঠলো―দিদুন তুমি যে বলেছিলে আমার মা থাকে এখানে কোথায় আমার মা ? আছে চলো আমার সঙ্গে, আয় রূপম। নিজের ঘরে গিয়ে কবিতাকে দেখিয়ে সীতা বললো―ঐ তোমার মা। বাচ্চাটা এবার সীতার হাত ছেড়ে দিয়ে কবিতাকে জাপটে জড়িয়ে ধরে বললো―মা তুমি কেন এখানে থাকো ? কেন আমাদের সঙ্গে থাকোনা !
কবিতা এবার মেঝেতে বসে পড়ল,দ’হাত দিয়ে বাচ্চাটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল ।বাঁধ ভাঙা নদীর মতো তার অন্তরের সমস্ত মাতৃত্বসুধা উৎলে উঠল, যেন কতকালের হারিয়ে যাওয়া ধন কুড়িয়ে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পাগল প্রায় অবস্থা। কান্না বিগলিত কন্ঠে কোনমতে উচ্চারণ করল― এই যে তুমি আমাকে নিতে চলে এসেছো, এখন থেকে আমি তোমার কাছেই থাকবো সোনা।
সীতা কাছে এগিয়ে এসে কবিতার মাথায় হাত রেখে বললো― চুপকরো। আমি বলেছিলাম না কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে না পারলে কান্না পরিপূর্ণতা পায়না। ওখানে ওবাড়িত সবাই তোর বড়ো আপনার লোক, প্রিয়, আর খুব নিজের।দেখবি তুই খুব সুখী হবি।চলো দাদুভাই আমরা ছাদের থেকে ঘুরে আসি।বাবা মা একটু কথা বলে নিক।
সীতা চলে গেলে রূপম আস্তে আস্তে বললো― আমি আপনার সমস্ত কথা আন্টির কাছে শুনেছি কবিতা দেবী। আমার বাবা নেই, মা আর ছেলেকে নিয়ে থাকি। আমার জীবনেও একটা ঝড় বয়ে গেছে আপনি শুনেছেন হয়তো। তবে জীবনের পথটা তো লম্বা, আর পৃথিবীটাই পরিবর্তনশীল। প্রতিনিয়ত সবকিছু পরিবর্তন হয়ে চলেছে। সকাল সারাক্ষণ স্থায়ী থাকছে না, দুপুর হচ্ছে, সেও আবার বিকালে পরিনত হয়ে রাত হয়ে যাচ্ছে। যেমন ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে একটা ঋতুর পর আর একটা। ছোট ছোট গাছ বৃক্ষে পরিনত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মানুষের জীবনেও হয়তো পরিবর্তন আসে। আর এই পরিবর্তন আসে বলেই হয়তো মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। দেখুন আমি রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, সবসময় হয়তো ঠিক করবো না কিছু ভুল ভ্রান্তি আমারও হতে পারে। আপনি পারবেন না সেগুলো সুধরে দিয়ে আমাকে ক্ষমা করে দিতে। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি আপনার জীবনের সমস্ত সুখ দুঃখ ব্যথা হাসি কান্না আনন্দ সবকিছু আমি ভাগ করে নেবো যদি সে অধিকার আমাকে দেন তবে সবকিছুর সমান অংশিদার হতে পারি।
কবিতা হাজারো চেষ্টা করে চোখের জল আর আটকে রাখতে পারছে না।বাবা মাকে হারিয়ে দাদা বৌদির সংসারে জঞ্জালের মত পড়েছিল, শাশুড়ি মায়ের দয়ায় শশুর বাড়ি জুটেছিল কপালে কিন্তু সুখ জোটেনি। সেই ছোট্ট থেকে মানুষের অবহেলা দেখেছে সে ভালোবাসা কি সে কখনোই বুঝতে পারেনি। তাই সেই ভালোবাসাকে এতো কাছে পেয়ে অশ্রু কি আর ধরে রাখা যায়!
রূপম আরো কাছে এগিয়ে এসে দু’হাতে যত্ন করে মুখটা তুলে ধরে অশ্রু প্লাবিত চোখের দিকে তাকিয়ে বলো―আমি যে বললাম, জীবনের সমস্ত সুখে দুঃখে পাশে থাকবো তার বিনিময়ে তুমি যদি এতো মুক্তরদানা আমাকে দাও তবে এ জীবনে এতো ঋণ শোধ করবো কি করে আমি বলো। এবার কবিতা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলনা,রূপমের বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলো। রূপম কবিতার কপালে পরম মমতায় স্নেহের চুম্বন দিয়ে আরো জোরে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো। কবিতা জীবনে এই প্রথম বুঝলো বিশ্বস্ত কাউকে জড়িয়ে ধরে তার বুকের মধ্যে মাথা রেখে কাঁদতে পারা কতটা শান্তির সে কান্না।