আকাশ ছোঁয়া

আকাশ ছোঁয়া

নিজস্ব সংবাদদাতা; ২০২২,২৩ মার্চ স্কোয়াড্রন লিডার পল্লবী বাত্রা ও আরও দুজন সহযাত্রীর সাথে চাঁদের দেশে যাত্রা করতে চলেছেন। যা প্রতিটা পৃথিবীবাসীর কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন ।ভোর চারটে 19 মিনিট 25 সেকেন্ডে যান টি চাঁদের দেশে রওনা দেবে।

—–আচ্ছা দিদু চাঁন্দ পর কেয়া ফুলের বাগ আছে ?
—–হ্যাঁ আছে তো ।
—–অউর নদী,ঝরনা, পনছি, বোট সব আছে?
—– হ্যাঁ আছে সোনা সব আছে।
—–তব তো মা পাপা উঁহা মজে মে হ্যয়। রেনু বালা লুকিয়ে চোখের জল মুছে বললো –খুব মজায় আছে দুজনে।
——তব হামকো কিউ নেহি লেকে গ্যয়া? রেনু বালা তাড়াতাড়ি নাতনি কে বুকে জড়িয়ে বলল না সোনা ওখানে যেতে নেই ওখানে গেলে কেউ ফিরে আসে না।

——না দিদু হাম যব বড়ে হোঙ্গে তব মা আর পাপাকে পাশ মিলনে জায়েঙ্গে।ফিরে আপকে পাশ লটকে আয়েঙ্গে।
এমন কথা বলিস না দিদিভাই এমন কথা বলতে নেই। রেনু বালা নাতনি কে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল ।কিন্তু রেনুবালার ঘুম আসে না ।তার এই নাতনি ছাড়া আর কেউ নেই। চারমাস আগে তার একমাত্র সন্তান বিনীতা ও জামাই অমরজিৎ এক কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। মেয়ে জামাই দুজনেই সায়েন্টিস্ট ছিলেন ।দিল্লী ইউনিভার্সিটি তে পড়ার সময় ওদের দুজনের আলাপ। তারপর দুজনেই পিএইচডি করে ইউনিভার্সিটি তে চাকরি করতো। তাদের মেয়ে পল্লবী দেহরাদুনে হোস্টেলে থাকতো। রেনুবালা নাতনিকে হোস্টেল থেকে নিজের কাছে এনে রেখেছে ।তাকে অবলম্বন করেই বাকি জীবনটা সবটা ভুলে থাকার চেষ্টা করবেন। কিন্তু আট বছরের এই একরত্তি মেয়েটা মৃত্যু কি বোঝে না। সে জানে মা-বাবা চাঁদের দেশে গেছে।

দিদু আজ মেরি স্কুল ছুট্টি আছে ।আজ আমি গুড়িয়ার সাদি দেব।আপ প্লিজ লুচি আলুরদম কর দিজিয়ে না।ওর মেরি ফ্রেন্ডস কো ভি ফোন কর দিজিয়ে। রেনুবালা নাতনির মুখে একটু হাসি দেখার জন্য সব করতে পারেন ।এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। রেনু বালার মনে পড়ে গেল ছোট বেলায় গ্রামের বন্ধুদের সাথে সেও পুতুলের বিয়ে বিয়ে খেলত। কিন্তু তখন কি আর তার মাকে সত্যি লুচির বায়না করতে পারতো ? গৃহস্থ বাড়ির হাজার কাজের মধ্যে মেয়ের খেলার পুতুল এর বিয়ের লুচির ফরমায়েশ গ্ৰাহ্যের মধ্যে আনত না ।পাতা কুচিয়ে লুচি আর নুড়ি পাথর কুড়িয়ে মাংস, আলুর দম বানানো হতো ।তবু সেসব কত আনন্দের দিন ছিল ।পড়ার অত চাপ ছিল না ।এখন তো সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত সব বাচ্চা শুধু বই খাতা ব্যাগ নিয়ে শুধু পড়া আর পড়া ।রেনু বালার নাতনির পুতুলের বিয়েতে সবাই নেমন্তন্ন খেতে এল ।বানিয়েছিল লুচি আলুর দম পায়েস ।ছোট্ট ছোট্ট মুখগুলোতে খুশি উপচে পড়ছিল। কিছুক্ষণের জন্য যাতাকল থেকে রেহাই পেয়েছে ।পুচকি গুলো হইহুল্লোড় করে মা দের সাথে সবাই বাড়ি ফিরে গেছে। পল্লবী পুতুল মেয়েকে রেখে দিদুর কাছে শুয়ে পড়লো।

—-আচ্ছা দিদু তিয়াসা বোল রাহি থি লেরকি কো সাদি কে বাদ দুসরে ঘর চলে যেতে হয়??
—– হ্যাঁ দিদিভাই একদিন এক রাজকুমার এসে তোমায় শাদী করে নিজের দেশে নিয়ে যাবে।
—– তব হম সাদী নেহি করেঙ্গে। হাম আপকে পাস আপকে সাথ রহেঙ্গে।

চেঁচিয়ে কাউকে বলল—- রাজকুমার ইহা মাত আনা। হাম কভি নেহি জায়েঙ্গে ।গলা জড়িয়ে ধরে বলল –অগর রাজকুমার ইহা আয়েগা তো হাম মার দেঙ্গে। রেনুবালা নাতনির গাল টিপে বলল—- আচ্ছা বাবা যেতে হবে না। এবার ঘুমো। পল্লবী রেনুবালার গলাটা বেশ জোরে জড়িয়ে ধরে চোখ বুঝলো।

জয়েন্ট এ পল্লবী খুব ভালো রেজাল্ট করে অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ এডমিশন নিয়েছে ।রেনুবালা তাকে একটু একটু করে স্বপ্ন বুনতে সাহায্য করেছে ।তার স্বামীর পেনশন আর মেয়ে,জামাই এর রেখে যাওয়া টাকায় নাতনিকে নিয়ে কোনদিন কোন অর্থকষ্টে পড়তে হয়নি। পল্লবী আবার হোস্টেলে চলে যাবে ।রেনুবালার এতদিনের বেড়ে ওঠা চারাগাছ আজ চারিয়ে বড় হয়ে গেছে ।তাকে আর সার জল দেবার প্রয়োজন নেই ।সে নিজেই এখন সব জোগাড় করে নিতে পারবে।রেনুবালা একটু নিঃসঙ্গ হলেও পল্লবীর স্বপ্নের পথে বাধা হতে চায় না ।

—দিদু আপ ভি চালিয়ে না মেরে সাথ।
—– না দিদিভাই এই বয়সে আর কোথাও যাবার উপায় নেই। তুমি ছুটিতে মাঝে মাঝে এসো ।পল্লবী রেনুবালা কে জড়িয়ে ধরে আদর করে বেরিয়ে গেল ব্যাঙ্গালোর।

রেনুবালা অসুস্থ।এক বার স্ট্রোক হয়ে গেছে। একজন বহুদিনের বিশ্বস্ত মহিলা ওনাকে দেখাশোনা করেন। পল্লবী ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এক বছর পাইলট ট্রেনিং নিয়ে এসেছে।হায়ার স্টাডিস এর জন্য সে একটা বিদেশী ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলারশিপ পেয়েছে।রেনুবালার কাছে কিছু দিন হল এসেছে । পল্লবী নিজের হাতে রেনুবালা কে খাইয়ে দিচ্ছিল ।

——কিরে তুই কবে যাবি বিদেশে?
—-না দিদু সোচরাহা হু জানা ক্যানসেল কর দু।
—– ক্যানসেল করে দিবি? কি বলছিস ?তোর স্বপ্নকে তুই ক্যানসেল করে দিবি ?

তো আপ ক্যয়া চাহতে হো আপকো এয়সে ছোড়কে যাউ।নেহি হোগা মুঝসে দিদু।আপ পহেলে ঠিক হো যাও ফির চলে যায়েঙ্গে।হাম ইহা কোই নকরি কর লেঙ্গে।

—–না তুমি এটা করতে পারোনা। তুমি ছোট থেকে স্বপ্ন দেখতে আকাশে উড়বে। আমার এত দিনের সাধনা তুমি নষ্ট করে দিও না। আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে। তুমি যাও নিজের স্বপ্নপূরণ করো।

চার বছর বাদে পল্লবী বিদেশ থেকে ফিরে ব্যাঙ্গালোরের ইসরো তে জয়েন করেছে। চন্দ্রাভিযান প্রজেক্ট এর বড় দায়িত্বে রয়েছে।রেনুবালা আজ আর পৃথিবীতে নেই। দুবছর আগে পল্লবী দেশে এসে ওঁর শেষকৃত্য করে গেছে ।
পল্লবীর সঙ্গে একই প্রজেক্টে কাজ করে আদিত্য যোগলেকর। মুম্বাই আই আই টি থেকে ইসরোর এটমিক রিসার্চ গ্ৰুপে জয়েন করেছে। আলাপ হওয়ার প্রথম দিন থেকে পল্লবীর ওকে ভালো লেগেছে ।বেশ হাসিখুশি সপ্রতিভ ছেলে। প্রজেক্ট এর কাজ করার দরুন ওরা আরো কাছাকাছি এসেছে ।কাজের বাইরে দুজন এদিক-ওদিক ঘুরতে যায় মাঝে মাঝে । আজ কেএফসিতে দুজনে দেখা করতে এসেছে। আদিত্য একটা রিং পল্লবীর আঙ্গুলে পরিয়ে দিয়ে বলল —(বাংলা করে লিখছি) আমার অনেক দিনের শখ ছিল বাঙালি মেয়ে বিয়ে করব। শাশুড়ি জামাই ষষ্ঠীতে নেমন্তন্ন করবে ।শালা-শালীরা হৈ-হুল্লোড় করবে। ইলিশ ভাপে আর চিংড়ির মালাইকারি খাব। সব স্বপ্ন স্বপ্ন হয়েই রইল। পল্লবী হেসে বলল —–কিন্তু আমি তো পাঞ্জাবি কুড়ি ।

—–আরে শাশুড়ি মা তো বাঙালি ছিলেন ।আর শশুর বাড়ি গেলেও শশুর জামাই আদর করতো। ছাঁচ,মকাই দি রোটি আর পালং পনির দিয়ে।সব মাঠে মারা গেল।

পল্লবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল —আমিই সেই আদর পেলাম না। আমার দিদু আমায় সব ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছে ।দিদু চলে যাবার পর আমার নিজের বলে কেউ নেই। আদিত্য পল্লবীরহাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলল—– আরে তোমার দিদু তো আমায় পাঠিয়েছেন তোমায় ভালবাসতে ।তোমার খেয়াল রাখতে ।ঠিক আছে আমার মা বাবাকে বলছি আমাদের বিয়ের ডেট ফাইনাল করতে। খুব তাড়াতাড়ি তোমায় আমার কাছে আনতে চাই ।পল্লবীর মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো। চন্দ্রাভিযানের ফাইনাল সিলেকশন চলছে।দশজন স্কোয়াড্রন লিডার সিলেক্টেড হয়েছে তার মধ্যে পল্লবী ও একজন।এক বছর ধরে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হচ্ছে। পল্লবী আশৈশব লালিত স্বপ্ন ছোঁয়ার অপেক্ষায় আছে ।আজ সে জানে চাঁদের দেশে মানুষ কেন কোন প্রাণীরই অস্তিত্ব নেই ।তবু চাঁদের মাটি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। যেন মনে হয় ওখানে গেলে তার আপন জনের সাথে দেখা হবে।

আদিত্যর সাথে সে খুব আনন্দেই সংসার করছে। আদিত্য ও তার পরিবার ওর মনের শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করে। চন্দ্রাভিযানের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যে ধকল যাচ্ছে তাতেও শ্বশুরবাড়ি ওর সম্পূর্ণ খেয়াল রাখে ।পল্লবী মনে মনে ভাবে ভগবান ওর থেকে সবটাই কেড়ে নেয় নি ভালো কিছু ও ওর জন্য ভেবেছে । অবশেষে সেই দিন এলো এনাউন্স হলো তিনজন অভিযাত্রীর নাম। তার মধ্যে একজন পল্লবী বাত্রা। আনন্দে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরল। বন্ধুদের অভিনন্দনে পল্লবীর চোখে জল এসে গেল।দিদুর কথা খুব মনে পড়ছে ওর।দিদু থাকলে দেখতো ওর হাতের মুঠোয় এখন স্বপ্ন পূরণের চাবিকাঠি। আদিত্য বলে উঠলো  আচ্ছা ওখানে যদি কোন এলিয়েন পল্লবীকে ভাগিয়ে নিজের দেশে নিয়ে যায় তাহলে কোন থানায় রিপোর্ট করব? উপস্থিত বন্ধুরা সকলে হাসিতে ফেটে পড়ল।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত