একজন গরীব বৃদ্ধাকে নিয়ে আসলেন মিলন সাহেব। মহিলার বয়স ৭০/৭৫হবে। তিন কূলে তার কেউ নেই বিধায় রাস্তাঘাটে পড়ে মরতে হচ্ছে.. তাই মিলন সাহেব নিজ দায়িত্বে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে এলেন কারন তিনি নিজে এখনো বিয়ে করেন নি আর করবেন না বলেই মনস্থির করেছেন। আর সামান্য বেতনের স্কুল শিক্ষক, ব্যাচেলর তাই তার থাকার জায়গাটাও খুব বেশি বড় নয়।
তিনি যখন আনুষঙ্গিক কাজগুলো মিটিয়ে বৃদ্ধা আমেনা বেগমকে সেখানে ভালোভাবে রাখার বন্দোবস্ত করতেছেন ঠিক তখনি কিছু কথা কানে ভেসে আসলো। একজন ৩৫/৪০ বছরের ভদ্রলোক তার মাকে নিয়ে এসেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রমের দায়িত্বে থাকা লোকটি একটি ফর্ম ফিল-আপ করতেছেন তার জন্য। তো লোকটি ঐ ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন,
– ভাই আপনার মা কে কি রান্না করে খেতে দিবেন নাকি আমরাই তিনবেলা খাবার দিবো? মুরগী, পোলাও কি সপ্তাহে দুবার নাকি একবার? লোকটি বললেন,
– আমার মা অনেক ভালো রান্নাবান্না জানেন। উনি নিজেই রান্নাবান্না করে খাবেন। আর ওসব আমার মা খায়না তাই দরকার নেই। লোকটি বললেন,
– এসিওয়ালা রুমে টিক দেই তাইলে। লোকটি বললেন,
– না না। আমার মা সারাজীবন এসিহীন ঘরেই বাস করে এসেছেন। অতএব তার কোনো অসুবিধা হবেনা। আপনি এসি ছাড়া রুমেই দেন। এভাবে নানান ফরমালিটিজ তিনি এভাবেই চুকালেন। এই দৃশ্য দেখে মিলন সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে তার পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন,
– ভাই, আপনার মায়ের কি আপন ছেলে আপনি? লোকটি বললো,
– জ্বী। আমি আমার মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। প্রথমজন মেয়ে। ও মারা গিয়েছে অনেক আগেই।তাই এখন আমিই আমার মায়ের একমাত্র ছেলে। মিলন সাহেব হেসেই প্রশ্ন করলেন,
– তা ভাই, একমাত্র ছেলে হয়ে নিজের মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে এলেন কেন? লোকটি উত্তর দিলো,
– মা খামোখা আমার বউটার সাথে ঝগড়া করে। তাছাড়া আরো অনেক সমস্যা আছে মায়ের। এত কিছু আপনারা বুঝবেন না। মিলন সাহেব চোখে মুখে অগ্নিভাব এনে বললেন,
– তা, আপনার বউ বুঝি ননীর পুতুল? সে করেনা ঝগড়া? লোকটি সাথে সাথে উত্তর দিলো,
– না। আমার বউ ভীষণ লক্ষী। মা ইদানিং খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে। উনার সাথে কথা বললে কথা বলেনা। কিছু জিজ্ঞেস করলে ফিরেও তাকায়না। আমার কি মনে হয় জানেন? মিলন সাহেব বললেন,
– কি? লোকটি বললো,
– আমার মনে হয় আমার মায়ের মাথায় গণ্ডগোল। মিলন সাহেব চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– কেন এমন মনে হলো আপনার? লোকটি রাগী গলায় বললেন,
– আমার বাচ্চাটাকে মায়ের কাছে দিয়ে আসার জন্য একবার বউকে বলেছিলাম তারপর শুনলাম,
আমার মা নাকি কোনদিন আমার বাচ্চা ছেলেটাকে কোলে নিয়ে কামড় দিয়েছে। ভাবুন একবার? এরকম বদ্ধ পাগল ঘরে রাখা যায়? সেদিন শুনলাম, আমার বউয়ের ব্যাগ থেকে নাকি মা আড়াই হাজার টাকা চুরি করে নিয়েছে। কথাটা বিশ্বাস করতেছিলাম না তাই নিজে গিয়ে মায়ের আলমারি চেক করলাম। গিয়ে দেখি.. মায়ের আলমারিতে পাক্কা পাঁচ হাজার টাকা!
তাই দেখে আমার বউ বলেছিলো, ” দেখো আজ না হয় আমার হাতে ধরা খেয়েছিলো বলে ধরতে পেরেছি কিন্তু এর আগে কয়বার যে চুরি করেছেন কে জানে! তার প্রমাণই এটা। তোমার মা একটা চোর। ছি: ছি: ছি:! তুমি যদি এই মহিলাকে এই বাড়ি থেকে না তাড়াও তাহলে আজই আমি তোমার বাড়ি ছেড়ে আমার বাপের বাড়ি চলে যাবো। এই বললাম! “তাইজন্যই তো তড়িঘড়ি করে মাকে এখানে নিয়ে আসলাম। মিলন সাহেব কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন। তারপর বৃদ্ধার দিকে তাকালেন। মহিলার দৃষ্টি স্থির, নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। চুপচাপ শুনে যাচ্ছেন ছেলের কথা। টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করছেন না। খেয়াল করে দেখলো মিলন সাহেব, মহিলার চোখ বেয়ে জল পড়ছে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন,
– তো ভাই আপনি যখন বুঝতেই পারলেন যে আপনার মা মানসিক রোগী বা তার মাথায় সমস্যা আছে তাই উনি এরকম করতেছে.. আমার প্রশ্ন হচ্ছে,আপনি তাকে হাসপাতালে কেন নিয়ে গেলেন না? হাসপাতালে না নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে কেন নিয়ে আসলেন?? তার উপর ডাক্তার না দেখিয়ে, ননসিউর হয়ে নিজের মাকে নিজেই পাগল বলতেছেন সবার সামনে? লোকটি কিছু না ভেবেই উত্তর দিলো,
– আমার মায়ের দিকে তাকাইছেন ভাই? আজ বাদে কাল মরে ভূত হয়ে যাবে। এখন তার পিছনে আমার এত কষ্টের টাকা উড়ানোর কোনো মানে আছে? আমার বউ, বাচ্চা আছে না? আর উনার হাজবেন্ড তো সেই বারো বছর আগে মরেই খালাস। আর কতদিন দেখবো! আমার সঞ্চয় -পুঁজি বাড়াতে হবেতো নাকি? মিলন সাহেব বললেন,
– আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি আপনার মায়ের সাথে একটু কথা বলবো। লোকটি উঁচু গলায় বলে উঠলো,
– ঐ মিয়া আপনি এইখানের কে? আপনার কাছে এত ইন্টারভিউ দেওয়া লাগবে কেন? আপনি কি এই বৃদ্ধাশ্রমের দায়িত্বে আছেন? আপনি মহাপুরুষ সাজেন আমার সামনে, না? ঐতো আপনিও তো নিয়া আসছেন আপনার মাকে, দেখতে পাচ্ছি। তার বেলায় তো কিচ্ছুনা। ফালতু। মিলন সাহেব শুধু বললো,
– আমার জন্মের পর আমার মা মারা গিয়েছে। আর সাথের এই মহিলাটি আমার মা নয়, মা তুল্য কেউ একজন। যাকে শান্তি দেওয়ার জন্য এখানে নিয়ে এসেছি। এই বলে মিলন সাহেব ঐ বৃদ্ধার সাথে কিছুক্ষন কথা বলে সবটা জানতে পারেন। আসল ব্যাপারটা কি তা এখন তার কাছে পরিষ্কার। মিলন সাহেব এসেই লোকটিকে উঠতে বললেন। তারপর বললেন,
– আপনি চলে যান। এক্ষুনি চলে যান। যান্! লোকটি বললো,
– আচ্ছা। যাইতেছি। বৃদ্ধাশ্রম শুধু একটা না এই শহরে। ঠিক আছে। মা, চলেন। উঠেন। মিলন সাহবে হুংকার দিয়ে বললেন,
– আপনি যান। আপনার মা আমার কাছে থাকবে। লোকটি বললো,
– মানে? ফাইজলামি পাইছেন? মিলন সাহেব এবার রেগে গিয়ে বললো,
– ঐ বেয়াদব। তুই চলে যা। তোর মায়ের দায়িত্ব আজ থেকে আমার। আর তুই তোর মায়ের সন্তান না। তোর আজ থেকে কোনো মা নেই। যা তুই। লোকটি জিজ্ঞেস করলো,
– আপনি কি বলতে চাইতেছেন?
তারপর মিলন সাহেব বললেন, ” যে মা নয় মাস তোকে গর্ভধারণ করে হাজার-কোটি কষ্টের স্বীকার হয়ে তোকে জন্ম দিয়েছিলো, সেই মায়ের জন্য আজ তোর ঘরে জায়গা নেই! ” যে মা তোকে নিজের জায়গা-জমি, গয়নাগাটি সব বেঁচে দিয়ে তোকে বিয়ে দিয়েছিলো সেই বউয়ের জন্য তুই তোর মাকে বাড়ি ছাড়া করলি? ” যেই মা তোর পায়খানা-প্রসাব সব পরিষ্কার করেছে, তোকে নতুন জীবন দিয়েছে সেই মা নোংরা বলে তোর বউ তার কোলে তোদের বাচ্চাকে দেয়নি! আর তোর কাছে কি বলেছে?
তোর মা তোর বাচ্চাকে কামড় দিয়েছে? মেরেছে? আর তুইও এটা বিশ্বাস করলি? আরে উনিতো তোর বাচ্চা তাড়াতাড়ি হওয়ার জন্য দিনের পর দিন নামাজ পড়ে কেঁদেছিলো, কুরআন খতম দিয়েছিলো, নিজের জমানো টাকা দিয়ে মসজীদে দোয়া পড়িয়েছিলো। কারন তোদের বাচ্চা হচ্ছিলো না। সেই বাচ্চা, সেই আদরের নাতিকে একটু কোলে নিয়ে আদর করতেও দিলি না? করতেতো দিলিইনা বরং উল্টা কি অপবাদ দিলি? তোর ছেলেকে নাকি কামড় দিয়েছে! এই, তুই যখন ছোট ছিলি তখন তোকে তোর মা কামড় দিতো? আমারতো মনে হয় তোকে তখনি কামড়ে মেরে ফেলা উচিত ছিলো। স্কাউনড্রেল। তোর মায়ের জমানো কিছু টাকা ছিলো। নাতির জন্য সোনার চেইন কিনবে বলে একটু একটু করে জমাচ্ছিলো তোর বউয়ের রান্না ঘরে একদিন তোর মা ঢুকেছিলো কারন সেদিন তোর জন্মদিন ছিলো। নিজ হাতে ছেলে আর ছেলে বউয়ের জন্য পায়েস- পোলাও বানাবেন বলে প্রস্তুতি নিয়ে গেলেন। আর তোর বউ তখন কি করেছে জানিস? তোর এই বৃদ্ধা মাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে রান্না ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলো। কেন জানিস? কারন তোর মা নোংরা, চেহারা ভেঙে যাওয়ায় সে এখন কুৎসিত। তাই তোর বউ বলেছিলো,
– এই কুৎসিত,নোংরা শরীর নিয়ে আপনি আমার রান্না রুমে পর্যন্ত ঢুকে পড়লেন? ছি:! আমিতো আর ভাতই খেতে পারবোনা এই বাড়িতে। নাকি খিদা পাইছে তাই খাবার চুরি করতে আসছেন, কে জানে। দাঁড়ান আজই আমি আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেছি।
এই বলে তোর গুনবতী বউ চুরি করে নিজের ব্যাগ থেকে টাকা সরিয়ে নিয়ে তোর মায়ের আলমারিতে রেখে দিয়েছিলো। তুই আসার পর তোকে অন্যরকম কাহিনী শোনায় আর তুই ও বিশ্বাস করে তোর জন্মদাত্রী মাকে জেরাও করেছিলি। তার সম্মানের কথা চিন্তা না করে নিজে আলমারি খুলে চেক করলি; আর বউয়ের ফাঁদে পা দিয়ে নিজের নির্দোষ
-অসহায় মাকে অপমান করলি। ”
” আর কি বললি? তোর বউ লক্ষী, ঝগড়া করেনা? আরে অধম, মূক! তুই কি তোর মায়ের পিঠে, গালে মারের দাগ দেখিস নি? তোর বউ সেদিন তোর মায়ের গায়ে হাত তুলেছিলো। কারন তিনি ভুল করে নতুন তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে ফেলেছিলেন, পুরোনো/বাসি তরকারি ছেড়ে। বাসি, নষ্ট হয়ে যাওয়া তরকারিগুলোই তো উনার জন্য রেখে দেওয়া হয়। কোনোদিন খবর নিয়েছিস?
তোকে তোর মা সামান্য ইঙ্গিত দিয়েছিলো কারন তোর মা চায় না তোর গায়েও হাত তুলুক তোর বউ বা আবার এরকম কোনো গুনাহ্ করুক। কিন্তু তুই কিছুই বলিস নি। কারন তুই মনে করতি তোর মা পাগল। তাই বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলতেছে। ” এসব শোনার পর ঐ লোকটির হঠাৎ কেন যেনো খুব কষ্ট হচ্ছিলো। তার বুকে হাহাকার করতেছিলো অনুতপ্ততা আর তার মনে হতে লাগলো, তার জীবনের চেয়েও প্রিয় কিছু একটা শেষ হয়ে যাচ্ছে.. তাই হাহাকার করছে বুক, অসহ্যনীয় এক ব্যাথা করতেছে তার মাথায়.. চোখ রক্তবর্ণ হয়ে যাচ্ছে লোকটি তাড়াতাড়ি মিলন সাহেব কে বললো,
– ভাই, আপনার পায়ে পড়ি! আপনি আমার মাকে আমায় দিয়ে দিন। আমি ভুল করছি। দিয়ে দিন ভাই। আর ঐ বউ আমি আজই ত্যাগ করবো। তবুও আমার মাকে দিয়ে দিন। কোথায় আছে আমার মা?
মিলন সাহেব প্রথমে আপত্তি করলেও পরে নিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। লোকটি সেখানে গিয়ে মায়ের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নিলেন। কিন্তু তার মা কিছুই বলতেছে না। মাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন লোকটি তার মায়ের হাত স্পর্শ করলেন তখন দেখলেন নিষ্প্রাণ দুটি চোখের পলক পড়তেছেনা। হাত ছেড়ে দিতেই পড়ে গেলো.. ঝুলে পড়ে আছে দুই চেয়ারের দুটি হাতলে তার মায়ের নিষ্প্রাণ দুটি হাত লোকটার মা ইন্তেকাল করেছেন। লোকটি অজোর ধারায় কাঁদতেছেন। তার চিৎকারে পুরো বৃদ্ধাশ্রমের সব বৃদ্ধা মায়েরা চলে আসলেন। মিলন সাহেব তখন লোকটির কাঁধে হাত রেখে বললেন,
– আপনার মা বোধ হয় বুঝতে পেরেছিলেন, তার মউত অতি নিকটবর্তী। তার হাতে আর সময় নেই। তাই তিনি আমায় সব বলে গেলেন। কেন জানেন? কারন আপনার জনমদুখিনী, মৃত্যুপথ যাত্রী মা তার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আপনার মঙল কামনা করতেন। তিনি জানতেন তার বউয়ের পাপ তার ছেলের গায়েও লেগে গিয়েছে। তাই তিনি চাইতেছিলেন, তার দেহ কবরে যাওয়ার আগে আপনার অনুশোচন ও ক্ষমা চাওয়া দেখে যেতে। কারন অদৃশ্য আত্বা যে আপনারই চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে!