আমার সংসার

আমার সংসার

আমি কালো, মাথায় চুলের উপস্থিতি একদমই নেই। সকলের নজরে পড়ার মতো আমার না আছে কোনো গুণ। গোবেচারা চেহারার এই আমি অঙ্গনা.. স্কুলে থাকা অবস্থায় এক স্যার রসিকতা করে বলতো অঙ্গনা অর্থ সুন্দরী। আর তোর নামই কিনা অঙ্গনা! তোর এই নাম কে রেখেছেরে? সে কি টিনের চশমা পড়ে তোকে দেখেছিল? একথা শুনে ক্ল্যাসের সবাই হাসতো, আমিও হাসতাম। খুব হাসতাম, হেসে কুটিকুটি হতাম। হাসির চাপে কখনো কখনো চোখটা ভিজে উঠতো। স্কার্ফের কোণা দিয়ে দ্রুত চোখ মুছে আবারও হাসির খেলায় নেমে পড়তাম। আমার এই কান্ড দেখে অনেকেই আমায় পাগল বলতো। তবে কে কানে নেয় সেসব? একমাত্র হাসিই তো আমার জীবনের একমাত্র সম্বল যাকে সময় অসময়ে সবসময় কাছে পাই আমি..

স্কুল পাশ করে কলেজে উঠলাম। আমাদের পাঁচ ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ চালাতে বাবা হিমশিম খেতে লাগলো। বাবা ঠিক করলেন বড় আপাকে আর পড়াবেন না। মধ্যবিত্তদের এই এক সমস্যা! তারা চাইলেও অভাবের তাড়নায় বেশি কিছু করে উঠতে পারে না। এরই মাঝে হঠাৎ বড় আপার বিয়ের প্রস্তাব এল। বড় আপা আমার মতো কালো নয়। তার গায়ের রং সাদা। তার এই সাদা গায়ের রঙের জন্য তাকে কখনো স্কুলে রসিকতার স্বীকার হতে হয়নি। না হতে হয়েছে আপনজনদের কাছে বোঝা.. আমাদের জীবনটা অদ্ভুত! মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় সকলের নজরের বাইরে যেতে। কালো সাদার দেয়াল টপকে ওপারে গিয়ে দেখতে সকল নিয়ম ভাঙ্গার গল্প।

একসময় বড় আপার বিয়ের পর্ব চুকে গেল, আমার ইন্টার শেষ হয়ে এল। আমি ছাত্রী ভালো ছিলাম না। কোনোমতে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও পাশ নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলাম। বাবা এক সকালে আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন আমার আর পড়াশোনার ইচ্ছে আছে কিনা। আমি হ্যাঁ না কিছু বললাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলাম বাবার উদ্বিগ্ন মুখের দিকে। ধীরেধীরে সময় গড়িয়ে গেল। রেজাল্ট বেরুলো। থার্ড ক্লাস পেয়ে পাস করলাম। তবে বাবার মুখে চিন্তার ছাপ কমলো না। বরং দিনকে দিন তা বাড়তে লাগলো। আমি বিষয়টি বুঝলাম না তবে কিছু বললামও না।

অনার্সে ভর্তি করানোর পরিবর্তে বাবা আমার বিয়ে নিয়ে ভাবলেন। আমার মতামত চাইলো না। তবে কালো মেয়েদের কী এতসহজেই বিয়ে হয়? হয় না.. আমারও হচ্ছিল না। বাবা ঘটক ধরে একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আনলেও আমার চেহারা দেখে ভ্রু কুঁচকে তারা বিদায় হতো। তবে তা নিয়ে আমি চিন্তিত ছিলাম না। বিয়ে নিয়ে, সংসার নিয়ে আমি কখনো ভাবিনি। কারণ আমার ভেতরের প্রতিটি শিরা উপশিরাই জানতো আমার মতো কুশ্রী চেহারার মেয়ের কপালে এসব নেই…

তবে আমার ভাবনা পাল্টে দিয়ে মাস পাঁচেক না যেতেই আমার বিয়ে হয়ে গেল। মহেশখালীর তালুকদার বাড়ির ছোটো ছেলে রেদোয়ান। পড়াশোনা করেছে ইন্টার পর্যন্ত। তারপর নানান ব্যবসায় নিজেকে জড়িয়ে লসের উপর লস খেয়ে প্রচুর ঋণে জড়িয়ে পড়েছিলো। যা শোধ করতেই শেষমেশ তাকে শরণাপন্ন হতে হলো বিয়ের। কালো কুশ্রী চেহারার আমাকে বিয়ের পরিবর্তে তাকে দেয়া হয় যৌতুক হিসেবে ৪ লাখ টাকা। কোথায় পেল বাবা এত টাকা? লোন নিয়ে নাকি বাড়ি বিক্রি করে? উত্তর আমি পেলাম না। তবে আমার বিদায় বেলায় বাবার চোখের কোণায় চিকচিক করা পানি বলছিল বাবা বাড়ি বিক্রি করেছে…

লোকটি সুন্দর। হঠাৎ করে তাকে দেখলে যে কেউ তাকে বলিউডের অন্যতম পরিচিত নায়ক গোবিন্দ ভেবে ভুল করবে। আমিও করেছিলাম। খানিকক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল এসব আমার স্বপ্ন নয় তো? ঘুম ভেঙে উঠে দেখবো না তো দু’পাশে দুই ভাইবোনকে নিয়ে আমি শুয়ে রয়েছি আমার বিছানায়? তবে স্বপ্ন নয় সত্যি ছিল এসব। প্রথম দিন দুয়েক আমার থেকে দূরে দূরে থাকলেও তৃতীয় দিনে লোকটি আমার কাছে এসেছিলো। আমার মাঝে অদ্ভুত এক ছটফটানি জাগিয়ে তুলে অপূর্ব সুন্দর এক জগতে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আমায়…

নতুন স্বপ্ন নিয়ে আমার একেকটা দিন কেটে যাচ্ছিলো। কেন জানিনা সময়ের সাথেসাথে হঠাৎ করে রেদোয়ানের প্রতি আমার ভালোলাগার সৃষ্টি হচ্ছিলো। অনুভব করছিলাম তাকে সময়ে অসময়ে। আমি কথা খুব কম বলতাম, এক-দুটি যাই বলতাম গুছিয়ে বলতে পারতাম না। দিনশেষে রাতের মধ্য প্রহরে যখন রেদোয়ান বাড়ি ফিরতো তখন আমার বুকের ভেতরটায় উথালপাতাল শুরু হয়ে যেতো। নীরবে তাকিয়ে দেখতাম তার ক্লান্তি মাখা মুখটি। ইচ্ছে করতো শাড়ির আঁচল দিয়ে তার ঘামে ভেজা মুখ মুছে দিতে। তবে সাহস করে উঠতে পারতাম না..

নতুন নতুন অনুভূতি নিয়ে বেশ ভালোই যাচ্ছিলো আমার সংসার। এরই মাঝে হঠাৎ একরাতে প্রচুর মেঘ ডাকায় আমার শাশুড়ী রেদোয়ানকে দ্রুত বাড়ি ফেরার আদেশ দেয়ায় সেদিন দ্রুত বাড়ি ফিরলো সে। ফ্রেশ হবার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে আমাকে ঘরে খাবার আনার আদেশ দেয়ায় আমি রান্নাঘরের দিকে ছুটলাম। লেবু দিয়ে কচু শাক ভাজি উনার প্রিয় খাবার। তাই কচু শাক বাটিতে বেড়ে ফ্রিজ থেকে লেবু বের করে তা কেটে দ্রুত পায়ে ঘরের দিকে এগুলাম। তবে দরজার পাশে আসতেই পা থেমে গেলো আমার। ফোনে কারো সাথে কথা বলছে রেদোয়ান। ধীর গলায় বলছে, আরে রাখ ওসব! আমি যে কাকে নিয়ে থাকি তা আমি জানি। রোজ রাত করে বাড়ি ফিরি যেনো ওর মুখ দেখতে না হয়।

কালো কুটকুটে বিশ্রী এই মুখ যেনো আমার চোখে না পড়ে তার জন্য ভোরে ও উঠার আগেই বেরিয়ে পড়ি বাড়ি থেকে। বাদবাকি রইলো সেক্স! নিজেকে কন্ট্রোল কর‍তে না পেরে করতে বাধ্য হই। তবে শালীর মাঝে কোনো কোনো ফিলিংস নেই মনে হয়! লোহার মতো শক্ত হয়ে পড়ে থাকে বিছানায়! আরে ধুর! লাইট জ্বালিয়ে ওর সাথে সেক্স তো দূরের কথা দেখলেই সেক্সের ইচ্ছা বমিতে পরিণত হবে। শোন.. পারলে তুই একদিন লাইট জ্বালিয়ে ওর সাথে থেকে দেখ। পারবি? ঠিকাছে যা বাজি! পুরো শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো আমার। চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনাপানির ধারা। দৌড়ে আমি ফিরে এলাম রান্নাঘরে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে দুই হাটুর মাঝে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলাম। পৃথিবীতে কালো মেয়ে হয়ে জন্মানো পাপ হলে কেনো উপরওয়ালা এই পাপকে পৃথিবীতে আনে?

সময় তার নিজস্ব গতিতে বাড়তে থাকলো সাথে আমার ধৈর্য্যও। রেদোয়ানের মনের ভেতরে আমাকে নিয়ে যাই থাকুকনা কেনো আমি বাড়ি ছাড়লাম না। না রাগ, অভিমান দেখিয়ে তাকে দূরে ঠেলে দিলাম। আমরা যাকে ভালোবাসি না তার করা অভিমান আমরা অনুভব করতে পারিনা। মাঝেমাঝে পারলেও তাতে আমাদের কোনো যাইআসে না। কারণ আমরা মানুষ। আমরা সব পারি.. সব।

এরই মাঝে একদিন শুনতে পেলাম বাবা বাড়ি ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে উঠেছে। বুকের ভেতরটা ফেটে গেলো আমার। সেদিন রাতভর আমি কাঁদলাম.. প্রচুর কাঁদলাম। যে মেয়েকে ভালো রাখতে তুমি নিজের মাথার উপর ছাদ হারালে তোমার সেই মেয়ে আজ ভালো নেই। তুমি কি শুনতে পাচ্ছো বাবা? ও বাবা..

-তোমার আব্বা শুনলাম ভাড়া বাড়িতে থাকে। তোমাদের আগের বাড়িও কি ভাড়া বাড়িই ছিল? আমাদের মিথ্যা বলে বিয়ে দিয়েছে তোমারে?

-না.. ওটা আমাদের নিজস্ব বাড়িই ছিল। আমাকে বিয়ে দেবার সময় ওটা বিক্রি করতে হয়েছে।
-রাখো ওসব মিথ্যা কথা। তোমার কি মনে হয় আমরা ফিডার খাই? কিছু বুঝি না? আমার শাশুড়ীর কথার প্রতিত্তোরে আমি কিছু বললাম না। মেঝেতে দৃষ্টি আবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপচাপ।

-আর তোমারেও বলি! বিয়ের তো একবছর হয়ে এল। বাচ্চা হয় না কেন? মেয়ে মানুষ হইছো কোন কাজে? একটা কথা সত্যি করে বলো তো! তোমরা কি চেষ্টা করো না? পিল টিল খাও? ঢোক চেপে শাড়ির আঁচল আঁকড়ে ধরলাম আমি। মাথা নেড়ে বললাম,

-চেষ্টা করছি..
-চেষ্টা করলে আবার হবে না কেন?

কাল আমার সাথে ফকির বাবার কাছে যাবা। পড়া পানি এনে খাওয়াবো। বাচ্চা আবার হবে না! বাচ্চারও বাচ্চা হবে! পরদিন আমার শাশুড়ির কথামতো তার সঙ্গে ফকির বাবার বাড়িতে গেলাম। ফকির বাবা আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমার শাশুড়ীকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলেতেই তিনি বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। একা আতংকে আমি কুঁকড়ে গেলাম। ফকির বাবা দুয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করে খপ করে ধরলেন আমার হাত। ধীরেধীরে সে হাত ক্রমেই আমার শরীরের বিভিন্ন অংশে ঘুরঘুর করতেই আমার শরীর কেঁপে উঠলো। আমি পেছন ফিরে আম্মা বলে ডেকে উঠতেই আমার শাশুড়ী ঘরে ঢুকলেন। আমার দিকে ক্রোধিত চোখে তাকিয়ে বললেন,

-কি হয়েছে? চুপচাপ বসে থাকো। যেনা আমার কাইল্যা কুটকুটে শরীর! তাতে যে বাবা হাত দিয়েছে তাতেই শুকরিয়া আদায় করো।

কালো জগতের আলো হলেও আমার ক্ষেত্রে তা মিথ্যে। দিনেদিনে আমি তা আরও ভালোভাবে অনুভব করলাম। মাঝেমাঝে দম বন্ধ হয়ে আসতো আমার। থাকতে ইচ্ছে হতো না জাহান্নাম সমতুল্য এই বাড়িতে। তবে যাবো কোথায়? বাবার বাড়িতে? যারা আমার কারণে আজ ভবঘুরে হয়ে জীবন কাটাচ্ছে তাদের ঘাড়ে আবারও বোঝা হয়ে চেপে বসবো? মন চাইলেও কিছু করার ছিল না আমার। তবে সবকিছুর মাঝেই একসকালে আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ায় একটি সুসংবাদ এলো। আমি মা হচ্ছি। খুশিতে ফেটে পড়ার মতো একটি খবর হলেও আমার মনের ভেতরটায় অদ্ভুত এক ভয় জড়ো হলো। পৃথিবীর বুকে নতুন এক প্রাণের জন্ম হবে অথচ সেই প্রাণের স্পন্দন যে একেবারেই নীরব…

ছয়মাস চলছিলো তখন আমার। প্রেগন্যান্সিতে মেয়েদের নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আমিও এই সমস্যাগুলোর বাইরে ছিলাম না। প্রচুর ক্ষুধা পেত আমার। ঘন্টা না যেতেই পেটের ভেতরটায় ইদুর দৌঁড়াতো। মাঝেমাঝে হাসতাম.. পেটে হাত বুলিয়ে বলতাম এত ক্ষুধা পায় রে কেন তোর? একদন্ডও বসতে দিস না। তার আগেই ক্ষুধায় দিশাহারা হয়ে লাথালাথি শুরু করিস। বিচ্ছু একটা! সেসময় ভালোভালো সব খাবার খেতে ইচ্ছে হতো আমার। তবে মিষ্টির প্রতি ঝোঁকটা ছিল আমার প্রবল। যে আমি কখনো মিষ্টি নাকের কাছেই নিতে পারতাম না সেই আমার প্রেগন্যান্সিতে মিষ্টির জন্য বুকের ভেতরটা জ্বলতো। রেদোয়ানের আমার প্রতি কোনো দায়দায়িত্ব ছিল না। আর না আমি কখনো তার কাছে কিছুর প্রত্যাশা করতাম।

তাই যখনি মিষ্টির জন্য বুকের ভেতর জ্বলতো রান্নাঘরে ঢুকে চিনির বয়োম খুলে এক মুঠ চিনি খেয়ে নিতাম। খারাপ ভালো মিলিয়ে বেশ চলছিল আমার প্রেগন্যান্সির দিনগুলো। নিজের মাঝে বেড়ে উঠা নতুন এক অস্তিত্বকে নিয়ে আমার দিন কাটছিলো যথেষ্ট সুন্দরভাবে। যখন নিজেকে খুবই একা অনুভব করতাম পেটে হাত বুলাতাম। একা বসে বিচ্ছুটার সাথে গল্প করতাম। রাতে যখন কখনো পা কখনো পিঠের ব্যথায় ঘুম হতো না তখন বেরিয়ে পড়তাম দরজা খুলে। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম থাকতাম আকাশপানে। রাতের আকাশ ভয়ংকর সুন্দর! আঁধারে দাঁড়িয়ে অসুন্দর আমি ভয়ংকর সৌন্দর্য উপভোগ করতাম।

যৌথ পরিবারে হওয়ায় আমাদের রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়া হতো একইসাথে। তবে বাড়িতে আত্মীয় স্বজন কিছু নিয়ে আসলে তা ভাগ করে খাওয়ার নিয়ম আর দশটি যৌথ পরিবারে থাকলেও এই পরিবারে ছিল না। একদিন আমার বড় জা’র ভাই বেড়াতে আসায় সঙ্গে মিষ্টি নিয়ে এসেছিল। সন্ধ্যায় আমি আমার শাশুড়ীর পান বের করতে ফ্রিজ খুলতেই মিষ্টির প্যাকেটে চোখ পড়লো আমার। পেটের ভেতরটা চো চো করে উঠলো! বিচ্ছুটার অত্যাচার দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে! তার পছন্দের জিনিস দেখলেই আর নিস্তার নেই তার। একদম নিস্তার নেই! মৃদু হেসে একদন্ড ভেবে প্যাকেট খুলে একটি মিষ্টি মুখে পুড়তেই পেছন থেকে উঁচু গলায় ডেকে উঠলেন আমার শাশুড়ী।

-তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হই! কোন সাহসে খেলে তুমি এই মিষ্টি? এটি কি তোমার ভাই এনেছিল? অবশ্য তোমার ভাই আনবে কী করে? মিথ্যা বলে বিয়ে দিয়ে তো এখন তারা পথের ভিখারি। তারা কি কখনো এসব চোখে দেখেছে? চাবানোর পরিবর্তে মুখ ভর্তি মিষ্টি নিয়ে আমি অবাক চোখে সেদিকে চাইতেই পাশ থেকে বড় ভাবি বললেন,

-মানুষ এত খাদক হয় কী করে? এই আটটা মাস কত কী খেয়েছো সেসব হিসেব রাখো? জামাই তোমার কত ঢালে এই সংসারে যে এত খাবার সাহস পাও তুমি?

-আহা বৌমা! ওসব রাখো।
-ওসব কেনো রাখবো মা? চান্দি আমার গরম হয়ে আছে! ফকিরের বাচ্চার সাহস হয় কী করে আমার অনুমতি ছাড়া আমারই ভাইয়ের আনা মিষ্টির প্যাকাটে হাত দেয়ার? বাপমা কখনো খাওয়ায়নি তোমাকে?

-খাওয়াবে কী করে? এসব ওরা চোখে দেখেছে কখনো? ছোটলোকের ঘরের ছোটলোক! কোন কুক্ষণে যে এই কালিকে ছেলের বউ করে এনেছিলাম কে জানে! যেমন খাচ্ছেদাচ্ছে দেখা যাবে জন্মও দিয়েছে কালীচরণ কোনো ভুটকিকে।

আমি আর একদন্ড দাঁড়ালাম না সেখানে। চোখভর্তি জল নিয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে এসে দরজা আটকে বসে পড়লাম। কম-বেশি আমার করা সকল কাজ নিয়েই কথা শোনাতো আমার শাশুড়ী। তাই বলে সামান্য একটি মিষ্টি নিয়ে এত কথা কিভাবে শুনালেন তিনি? মন নেই তার? অন্তর কাঁপে না তার খাবার নিয়ে কথা শোনাতে? ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার ফলে কাশির চোটে মুখ ভর্তি মিষ্টির দানাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো মেঝেতে।

সে রাতে রেদোয়ান বাড়ি ফিরলো জলদি। ফ্রেশ হয়ে না খেয়েই শুয়ে পড়লো বিছানায়। আমিও কিছু বললাম না। চুপচাপ ঘরের আলো নিভিয়ে অপরপাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। আমি কম করিনি এই পরিবারের জন্য। এই পরিবারে রেদোয়ান কম টাকা দেয় বলে রান্না থেকে শুরু করে ছোটোখাটো প্রায় কাজই আমি করি। ভুলে কখনো কিছু উপর নীচ হলে সকলে মিলে আমায় কথা শোনালেও আমি চুপচাপ সব শুনি। কারণ আমি কুৎসিত। আমার নিজের কোনো মুখের ভাষা নেই..

-অঙ্গনা? রেদোয়ানের ডাকে খানিকটা কেঁপে উঠলাম আমি। এর আগে তো কখনো এভাবে ডাকেনি আমায় ও। তাহলে আজ কেনো ডাকলো?
-হাটতে যাবে? চলো রাস্তা দিয়ে খানিকক্ষণ হেটে আসি..

রেদোয়ানের কথার অর্থ বুঝলাম না আর না বোঝার চেষ্টা করলাম। রোবর্টের মতো উঠে তার পিছুপিছু বেরুলাম হাটতে। এই প্রথম রাস্তায় একই সঙ্গে বেরিয়েছি আমরা। হাটছি দুজনে সমান তালে। মনের চাওয়া কি কখনো কখনো এই পৃথিবীতেই পূর্ণ হয়?

-সামনে সুভল চাচার মিষ্টির একটি দোকান আছে.. মিষ্টি খাবে?
চোখভর্তি বিস্ময় নিয়ে আমি রেদোয়ানের দিকে তাকাতেই রেদোয়ান আবারও বললো,
-তোমার কিছু খেতে ইচ্ছে হলে আমায় বলবে। আমি এনে দিব। আর রাতে না খেয়ে কখনোই ঘুমোবে না। আচ্ছা.. বিরিয়ানি কেমন লাগে তোমার?

বুকের ভেতরটায় আমার হু হু করে উঠলো। রাস্তায় লোকজনের উপস্থিতি উপেক্ষা করেই আমি জড়িয়ে ধরলাম রেদোয়ানকে। প্রিয়জনের মুখের সোহাগরমাখা একটি কথাতেই যে এতটা শান্তি অনুভব হয় তা সেদিন প্রথম জেনেছিলাম আমি বিছানায় আমাকে কাছে টানলো রেদোয়ান। এই প্রথমবারের মতো তার বুকের স্থান পেলাম আমি। আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সে ধীর গলায় বললো,

-আমাদের এই পৃথিবীতে সবাই সুন্দর চেহারার মানুষ খোঁজে.. কিন্তু কেউ সুন্দর মন খোঁজে না। আমিও খুঁজতাম..
-খুঁজতেন?
-হুম.. তোমার মনের ভেতর কতটা সুন্দর তুমি জানো? আমি কিছু বললাম না। চোখজোড়া বুজে গুনতে লাগলাম রেদোয়ানের স্পন্দনগুলো…

-আমি এযাবৎ তোমার প্রতি কোনো কর্তব্য পালন করিনি। কেনো করিনি জানিনা.. তবে আজ থেকে করতে ইচ্ছে হচ্ছে। করতে দেবে আমায়? এবারও আমি জবাব দিলাম না। গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরলাম রেদোয়ানকে। ভালোবাসা তারা ভরা আকাশের মত সত্য, শিশির ভেজা ফুলের মত পবিত্র। তবে এটি কখনো সময়ের কাছে পরাজিত কখনোবা বাস্তবতার কাছে অবহেলিত..

সকাল থেকেই আমার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো। ছটফট করছিলো বুকের ভেতরটা। তবে এখন তো আমার সুখের দিন। আমার সবচেয়ে কাছের মানুষটি আজ সম্পূর্ণ বদলে গেছে। কিছুদিন হলো তার প্রতিটি বিষয়ে আমি তাকে নতুন করে আবিষ্কার করছি। অনুভব করছি তার জন্য আমার মনের গহীনের বিশাল এক জায়গাকে। তাহলে কি আমার জীবনে অবশেষে সুখ এল? হঠাৎ পেটের চারিপাশে হালকা ব্যথা অনুভব করলাম। ক্রমেই তা বাড়তে থাকায় আমি জোর গলায় ডেকে উঠলাম আমার শাশুড়ীকে..

-ও আম্মা। আমার পেটে চারপাশটা ব্যথা করছে। বারান্দা থেকেই উঁচু গলায় তিনি বললেন,
-এসব একটু আকটু হয়। ব্যপার না। সময় হয়নি এখনো তোমার। খানিকক্ষণ নীরবে বসে থাকার পর ব্যথা না কমায় উঠে খানিকক্ষণ হাটলাম। তবে সময়ের সাথেসাথে ব্যথা ধীরেধীরে সহ্যের সীমানা অতিক্রম করাতে রেদোয়ানের নাম্বারে কল দিলাম। তবে তার ফোন বন্ধ পাওয়ায় কোনো উপায় না পেয়ে দেয়াল আঁকড়ে ধরে আমি শেষমেশ এগুলাম শাশুড়ীর ঘরের দিকে।

-আম্মা আমার মনে হচ্ছে ডেলিভারি পেইন উঠেছে।
-তুমি ডাক্তার? তুমি কিভাবে বুঝলে এটাই ডেলিভারি পেইন? আমি ধরা গলায় জবাব দিলাম,
-আমার মনে হচ্ছে।
-যাও তো। নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো। কাজ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না বললেই পারো। এসব ধানাইপানাই করো কেন? তাছাড়া আমরাও বাচ্চাকাচ্চা জন্মিয়েছি। আমরা বুঝি এসব কয়েক কদম এগিয়ে আমি বসে পড়লাম মেঝেতে। আমার শাশুড়ীর পা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বললাম,

-আপনার দুই পায়ে পড়ি আম্মা। আমাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যান। আমি সহ্য করতে পারছি না। আর বাবু.. ও নড়াচড়া করছেনা আম্মা। ঠিক এসময়ই বড় ভাবি প্রবেশ করলো ঘরে। চোখমুখে একরাশ আতংক ফুটিয়ে বললো,

-ও আম্মা! বড় বাজারর আগুন লাগছে। রেদোয়ানের দোকান পুরে ছারখার হয়ে গেছে আম্মা! রেদোয়ান বেরুতে পারেনি মাথা ঘুরে উঠলো আমার। আর কিছু ভাবতে পারলাম না আমি। লুটিয়ে পড়লাম মেঝেতে…

আমার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি শুয়ে রয়েছি আমাদের ঘরে। আমাদের বিছানায় যে বিছানায় রেদোয়ানের বুকে শুয়ে আমি বুনতে শুরু করেছিলাম নতুন স্বপ্ন। খানিকটা সময় নিলাম আমি। ধীরেধীরে আমার কানে বাইরের কোলাহল স্পষ্ট হতেই আমার বুকের ভেতরটা টিপটিপ করে উঠলো। দ্রুত বেগে উঠে পড়ার চেষ্টা করতেই পেটে সামান্য চাপ অনুভব করলাম। তবে সকল ব্যথা উপেক্ষা করে আমি উঠে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ধীরেধীরে পা উঠিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই আমার নজরে এল উঠানে সাদা কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা দু’টি লাশ। ঢোক চেপে চোখজোড়া আমার পেটের দিকে দিতেই দম বন্ধ হয়ে এল আমার।

ছেলে হয়েছিল আমার। ফর্সা টুকটুকে ছোট্ট সেই ছেলেটির জন্মের পর থেকেই বাবার কাছে রয়েছে। মায়ের কাছে কী একদন্ডের জন্য আসতে ইচ্ছে হয় না তোর? ইচ্ছে হয় না এই মায়ের বুকে মুখ গুঁজতে? গাল বেয়ে বইতে শুরু করলো আমার নোনাপানির ধারা। আজকের এই দিনে আমি হারিয়েছিলাম আমার হয়েও না উঠা সংসারকে। হারিয়েছিলাম ফুটফুটে একটি শিশুকে। হারিয়েছিলাম আমার দায়দায়িত্ব নেয়া রেদোয়ানকে। বড় অবেলায় পেলাম তোমায় রেদোয়ান.. গেলে তো তখনি হারিয়ে! কী করে বল আমি রব একলা, ফিরে দেখ আছি দাঁড়িয়ে..

বুকচিরে বেরিয়ে আসা একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। চোখজোড়া মেলে তাকিয়ে রইলাম তারা ভরা আকাশের দিকে। সেদিন জানাজা হবার সাথেসাথেই ওরা আমায় বের করে দিয়েছিল ওই বাড়ি থেকে.. যে বাড়িতে এখনো আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস খুঁজে বেড়ায় আমার সংসারকে..

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত