আজ আমার বিয়ে

আজ আমার বিয়ে

কলেজ থেকে ফিরে গুনগুন গান গাইতে গাইতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি এত্তো এত্তো বাজার । আমাদের মধ্যবিত্ত বাবা একসাথে এতো বাজার করেছেন কোনদিন দেখিনি । মা বাজার সামলাতে সামলাতে আমাকে বলেন- একটু পরে মিলি চলে আসবে । আর শোন তোকে আজ ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে । আগের বারের মতো যদি কিছু করিস তবে ভালো হবেনা বলে দিচ্ছি ।

ওহহো মিলি কে এটাইতো বলা হলোনা । মিলি আমার বড়বোন । পালিয়ে বিয়ে করার অপরাধে তার এই বাড়ি আসা গত তিন বছর নিষেধ ছিলো । আমার বিয়ে উপলক্ষে মানে যতোবার কোন পাত্রপক্ষ দেখতে আসে সেই উপলক্ষে আপার এই বাড়ি আসা শুরু হয়েছে । প্রথম প্রথম দুলাভাই লজ্জা পেলেও এখন লজ্জা ভেঙে যখন তখন চলে আসেন ।

মাকে আস্বস্ত করে বলি – আগের পোলাটার একটা লেঞ্জা থাকলে ডাইরেক্ট হনুমানের ভাই বলে চালিয়ে দেয়া যেতো । ওই পোলারে বিয়া কইরা বছর বছর যে লেঞ্জা ছাড়া হনুমানের পয়দা করতাম ঐগুলিরে বিয়া দিতাম কেমনে ? আমার ভবিষ্যতের চিন্তা আমার করতে হইবোনা ? মা তেজ দেখিয়ে বলেন – পুরুষ মানুষের রুপ ধুইয়া পানি খাইবি ? ঐ পোলা কতো ধনী তা জানস ?

– আইজকারটা কেমন আগে কও , তারপর আমি কি করি ওইডা আমার উপর বিসমিল্লাহ্ বইলা ছাইড়া দেও । ধনী গরীব আমার কাছে ব্যাপার না । যারে লইয়া সংসার করুম সে যদি লেঞ্জাকাডা বান্দর হয় তয় কিন্তু আগের মতো করুম ।

এইবার বলি আগেরবার কি হয়েছিলো । পাত্রপক্ষ আমাকে দেখার এক পর্যায়ে ওদের সাথে আসা কোন একজন মহিলা আমাকে দেখে বলেন – মাশাআল্লাহ্ তোমারে খুব পছন্দ হইছে মা । এইবার একটু হাইটা দেখাওতো মা । মহিলার কথা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে যায় । বসা থেকে দড়াম করে দাড়িয়ে ঘরের এক পাশ থেকে আরেক পাশ পর্যন্ত হেটে বলি – আসার সময় হেটে এসেছি তখন দেখেছেন, আবার হেটে দেখালাম । এবার আপনাদের ছেলেকে হেটে দেখাতে বলেন ।

– এ আবার কেমনতরো কথা? ছেলে হাটবে কেনো ?

– কারন তাকে আমি হাটতে দেখিনি । লেংড়া খোড়াতো আর বিয়ে করতে পারিনা ! এই যে মিষ্টার উঠুন , আমার মতো ঘরের এই কোণা থেকে হেটে এই কোণে আসুন । ঘরের চারদেয়ালের ভিতরে পাত্রপক্ষের হা হা রব উঠে গেলো । আমিও নাছোড় বন্দার মতো মায়ের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বলি – কি ব্যাপার উঠছেননা কেনো ? উঠুন উঠুন , এতোগুলো মানুষের সময় নষ্ট করছেন কেনো ?

বেচারা একবার তার মায়ের মুখের দিকে তাকায় আবার আমার দিকে তাকায় । রাগে অপমানে তার মায়ের মুখ আগুনের মতো লাল টকটকে রঙ ধারন করেছে । ছেলেকে ধমকে বলেন – আমরা নাকি লেংড়া খোড়া ছেলে নিয়ে এসেছি ! এই রাসেল হেটে দেখা । রাসেল মিয়া মায়ের আদেশ পালন করে ঘরের এই কোণ থেকে ওই কোণ হেটে চেয়ারে বসেন। আমি ভুরু নাচিয়ে তার মাকে বলি – ছেলে আপনাদের লেংড়া খোড়া না । তবে যেই ষ্টাইলে হাটলো একটা লেজ থাকলে হনুমান বলে চালিয়ে দেয়া যেতো । দুঃখিত আপনাদের ছেলে আমার পছন্দ হয়নি !

– এই মেয়ে কি বলছো ? কেমনে হাটলো ?

– কুজো হয়ে , লাফিয়ে লাফিয়ে । হনুমানের মতো , লেজছাড়া হনুমান ।

আমার কান্ড দেখে আমার মা বোন তাজ্জব বনে যান । মোটামুটি দেখতে হলেও উচ্চশিক্ষিত আর ভালো বেতনে চাকুরীজিবী একটা ছেলেকে এভাবে অপমান করে হাতছাড়া করাতে মা বেশ অসন্তুষ্ট হলেন । আমার মধ্যবিত্ত বাবার চোখ দুটো আনন্দে ঝলমল করে উঠেছিলো । মাকে ডেকে বলতে শুনেছি – এই হলো আমার মেয়ে বুঝলে ? মেয়ে বলে অপমান করে যাবে সেই দিন আর নেই বুঝলে শেলির মা ! কেমন জবাব দিয়ে দিলো আমার মেয়ে দেখলে ?

– তোমার লাই পেয়ে পেয়ে মেয়ের এতো সাহস বেড়েছে । আর লাই দিওনা , মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে মনে রেখো ।

– আরে রাখো তোমার বিয়ে , যারা মেয়েদের সম্মান দিতে জানেনা তাদের টাকার আমি খেতাপুড়ি । মেয়ে দেখতে আসে নাকি কোরবানির গরু কিনতে আসে তারাই জানে !

মিলি আপা চলে এসেছে , অফিস থেকে ফেরার পথে দুলাভাই আসবেন । দুপুরের খাওয়া শেষ করে মা রান্না চাপিয়েছেন । মিলি আপা একবার মায়ের কাছে যায় আবার আমার কাছে আসে । আপাকে দেখে মনে হয় সে খুব ব্যাস্ত । আসলে আপা ব্যাস্ততার ভাণ দেখিয়ে আমার মতি গতি খেয়াল রাখছে । আপার বদ্ধ ধারণা আমি প্রেম করি, আর সুযোগ পেলেই ওর মতো পালিয়ে যাবো । তাই দায়িত্ব মনে করে আমার খেয়াল রাখছে । আপাকে ভড়কে দিতে ইশারায় কাছে ডেকে বলি – আপা তোর মতো যদি পালিয়ে যাই কেমন হবে বলতো ?

আপা আরো গভীরভাবে আমাকে পাহাড়া দেয় , আমি মনে মনে হাসি – নারে ! তোর মতো বাবাকে কষ্ট দিতে পারবোনা বলেই আজকের নাটকটা সাজিয়েছি । আরেহ্ এতো বক বক করলাম আর আজকের নাটকের কথাটাই বলা হলোনা ! ৮ বছর আগে আমাদের প্রতিবেশি ছিলো তামিমরা । আমরা থাকি যমুনা হাউজিং এ আর তামিমরা পদ্মা হাউজিং এ ভাড়া থাকতো। একই টিচারের কাছে আমরা অংক করতাম । তামিম ছিলো আমার ৩ বছরের সিনিয়র । আমি ছিলাম স্যারের সকালের ব্যাচের ছাত্রী , তামিম ছিলো বিকেলের ব্যাচে ।

স্কুলে আসা যাওয়ার পথে দেখা হতো । কখনো কখনো দেখতাম তামিম আমাদের বারান্দার সামনের রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতে । স্কুলে যাওয়ার সময় একদিন তামিমের কাছে জানতে চাই – আমাদের বারান্দার সামনে হা করে কি দেখো ? কোন ভণিতা না করে বলে – যদি বলি তোমাকে ?

– আগে বড় হয়ে লেখাপড়া শেষ করে তোমাদের বাসা থেকে যখন প্রস্তাব পাঠাতে পারবে তখন ভেবে দেখবো ।

তামিমরা আমাদের এলাকা ছেড়ে গেছে ৮ বছর আগে । ততোদিনে তামিমের কথা ভুলে গেছিলাম । ফেসবুকের কল্যাণে আবার তামিমের সাথে যোগাযোগ হলো । ফেবুতে নিজের পছন্দের একটা পেজে গল্প পড়ছি , টুং করে একটা এড রিকো এলো । রিকোদাতার প্রোফাইলে গিয়ে তামিমকে চিনতে পেরে এড করি । নতুন করে আমরা আমাদের ফিরে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হই । প্রথমে লাইক কমেন্টে সিমাবদ্ধ থাকলেও আস্তে আস্তে আমাদের চ্যাটিং শুরু হয় । এক সময় তা মিনিট গড়িয়ে ঘন্টার কাটা পার হওয়া শুরু করে ।

তামিম ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরী খুঁজছে, ওর চাকরী না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে । ওর চাকরী হলো সেই সাথে শেষ হলো আমাদের অপেক্ষার পালা । আমার সাথে কথা বলে আমাদের পাশের বাসার কাউসার চাচাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠিয়ে আজ ওরা আমাকে দেখতে আসবে ।

মিলি আপা পালিয়ে বিয়ে করায় বাবা যেই কষ্টটা পেয়েছেন এই কষ্ট দিতে চাইনি বলে এই নাটক সাজিয়েছি । তামিমরা প্রস্তাব পাঠানোর আগের সব প্রস্তাবের বিয়েগুলো নানা ছুতা ধরে ভেঙে দিয়েছি । তামিমের চাকরী হওয়ার আগ পর্যন্ত আমার বিয়ে এভাবেই আটকে রেখেছি । রান্নাঘর থেকে হাতের তেল কালি আঁচলে মুছতে মুছতে মা আমাকে আবারো মনে করিয়ে দেন – মিলিরে কি কইছস ? খবরদার মিলির মতো কাম কইরা তোর বাপেরে আর কষ্ট দিসনা । শোনলাম এই পোলারা আগে এই এলাকায় ভাড়া থাকতো । এহন বারিধারায় বাড়ি কইরা থাকে । উল্টা পাল্টা কিছু কইরা এই পোলা হাত ছাড়া করিসনা !

– আমারে যদি হাইটা দেখাইতে কয় তয় কি ছাইড়া দিমু ? আগেরটারে মানে মানে ছাইড়া দিছি । এইবার হাটতে কইলে পোলারে লেঞ্জা লাগাইয়া বান্দর বানাইয়া ছাইড়া দিমু কইলাম ।

– বাপের আস্কারা পাইয়া তুই যে লেঞ্জাছাড়া বান্দর হইছস এইডা বুজস ? আইজ এমন করিসনা মা !

– পোলা পছন্দ হইলে ভাইবা দেখুম ।

তামিমরা রাত ৮ টার মধ্যে চলে এলো । মিলি আপা আমাকে সাজতে তাড়া দিয়ে বসার ঘরে পাত্রপক্ষের নাশতা দেয়ার আগে আবার মনে করিয়ে দিয়ে গেলো – দোহাই লাগে শেলি , বাবার কথা মনে কইরা হইলেও উল্টা পাল্টা করিসনা । আজ আমার উল্টা পাল্টা করার দিন , আজ যদি বিয়ের কথা তামিমরা না বলে তবে মনে হয় আমিই বলবো ! তামিমের বাবা আমার বাবার বুকে বুক মিলিয়ে বলেন – আর দেরী কেনো বেয়াই সাহেব ? কাজী ডাকেন , শুভস্য শীঘ্রম ।

আমার বুকে আনন্দে দ্রিম দ্রিম ড্রামের শব্দ যে কেউ কান পাতলে শুনতে পাবে । সবার সামনে টুপ করে দুই ফোটা আনন্দ অশ্রু ঝরে পড়লো। লুকোতে গিয়েও মিলি আপার কাছে ধরা পরে গেলাম । তামিমের মা কি বুঝলেন জানিনা , তিনি আমার চোখের পানি মুছে বলেন – কাঁদেনা মা ! শুভক্ষণে কাঁদতে নেই ! বড় হলে সব মেয়েরা বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি যেতে হয় ! এটাই জগতের নিয়ম ! রাত ১০ টায় কাজী ডেকে আমার বিয়ে হলো -বলো মা বিসমিল্লাহ্ কবুল ।

– বিসমিল্লাহ্ কবুল । বাসর ঘর ছেড়ে সবাই চলে গেলে তামিমকে কানে কানে বলি – তুমি কি আমার লেঞ্জাছাড়া হনুমান হবে ?

– হুম , হবো । সারাজীবন আমরা বান্দরের মতো ডালে ডালে ঝুলে ঝুলে গান গাইবো – কতোযে তোমারে বেসেছি ভালো…..

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত