আপদ

আপদ

“বসিয়ে খাওয়াব নাকি? এত বছর ধরে খাইয়ে পড়িয়ে মানুষ করলাম। এত খরচ করলাম। আপদ আর কাকে বলে? জন্মে তো মাকে খেয়েছে। আমাদের খেতে এবার বাকি?” রমলা মেয়েকে আবার শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসতে দেখে রাগে ঝাঁঝিয়ে উঠলো। সৎ মায়ের কথায় নৃপা মাথা নিচু করে বলল “আর কত মানিয়ে নেব মা? আমি আর পারছি না। এই মানিয়ে নিতে নিতে আমি শেষ হয়ে যাব কোনদিন।” “পটের বিবি আমার। মোমের পুতুল, সোহাগী। এত ঢং আর সহ্য হয় না। পান থেকে চুন খসলেই মেয়ে গোসা করে চলে আসেন। বাপ তো আছেন বসিয়ে খাওয়াবেন। আসুন। বাপ সোহাগী মেয়ে। বাপ তো কিছু বলবে না। বরং মাথায় নিয়ে নাচবে।”

নৃপা বলে “আমি কি সাধে আসি। প্রতিবার যখন আসি দেখ তো আমার অবস্থা। তাছাড়া আমি তো মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছি প্রথম থেকেই।” রমলা ঝাঁঝিয়ে বলল “মেয়ে মানুষের এত নাটক কিসের? ও সব বাড়িতেই এমন হয়। কিন্তু তা বলে ঘন্টায় ঘন্টায় বাপের বাড়ি এসে সোহাগ করে কোন মেয়ে রে?” নৃপা বলল “তুমি যদি আমার নিজের মা হতে কখনোই এ কথা বলতে পারতে না।”

রমলা ঝাঁঝের সাথে বলল “হ্যাঁ, আমি বাজা সেটা তো শোনাবিই। সে না বললে তোর শান্তি হবে। সাধে তোকে দেখতে পারে না শ্বশুরবাড়ির লোক।” নৃপা কথা বাড়ায় না। সারা শরীরে ক্লান্তি। দেহের ভারটাও রাখা মুশকিল। গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। বাড়িতে বিশেষ করে নিজের বিছানায় একটা গভীর প্রশান্তি। একটা আলাদা নিরাপত্তা। না কেউ তাকে জ্বালাবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই হঠাৎ বাবার গলায় ঘুমটা ভাঙে। রমলাকে ধীরে ধীরে বলছে “খেয়েছে কিছু? দুদিন অন্তর ছুটে আসে। বলেও তো না সেভাবে কিছু। শুধু ভালো নেই আমার মেয়ে সেটা বুঝেছি। কি করি বলো তো।” রমলা জোরেই খেকিয়ে ওঠে “কি আর করবে ঘাড়ে বসিয়ে খাওয়াও। এরপর ওরাও আর ঘরে তুলবে না। এমন ধিঙি মেয়ের বোধ বুদ্ধি নেই‌। কোন বড়োলোকের মেয়ে যে দেমাকে পা পড়ে না। শ্বাশুড়ী ,ননদ নিয়ে ঘর করতে পারবে না।”

নৃপার বাবা নরেন আস্তে ধমকে ওঠে “আহ, রমলা মেয়েটা ঘুমাচ্ছে।” রমলা আর কিছু না বলে মুখ গোমড়া করে চলে গেল। নৃপা উঠে বাথরুমে গেল। স্নান করলে যদি ভালো লাগে। আগে একটা কাজ জোগাড় করতে হবে। এভাবে কদিন চলবে। আর সত্যিই তো এত টাকা দিয়ে বিয়ে দিয়ে বাড়িতে বসে বসেই বা খাবে কেন? একটু হলেও তো শিক্ষত সে।

সাদামাটা একদম ছিমছাম নৃপা। ছোট থেকেই অভাবের সংসারে মানুষ। শ্যামলা, দেখতে মোটামুটি চলন সই। পড়াশোনাতে সাধারণ। ঐ যেমন হলে আর কি সহজে ভিড়ে মেশা যায়। কেউ খেয়াল করে না। তবে গুণ আছে বৈকি।যদিও ওগুলোকে এখন গুণের চেয়ে লোকে দোষ বেশি বলে। প্রচণ্ড জেদী, সৎ, আত্মসম্মান সবার আগে নৃপার কাছে। নিপুণ কাজ করে কিন্তু নিঃশব্দে। বেশি কথা বলা মোটে পছন্দ নয় নৃপার।পড়ার বইয়ের চেয়ে গল্পের বইয়ে বেশি মনোযোগী।

তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঠকে। আসলে নিজের মধ্যে একটা কল্পনার জগত তৈরী করে রেখেছে গল্পের বই পড়তে পড়তে। ছোট্ট থেকে মা মরা মেয়ে নিজেই নিজেকে দেখে রাখে। সৎ মা কখনও খাওয়া পড়ার অভাব রাখে নি। তবে উঠতে বসতে নৃপা যে তার মেয়ে নয় সেটা বুঝিয়ে দেয়।

সৎ মায়ের উদ্যোগেই উচ্চ মাধ্যমিক দিতে না দিতেই নৃপার বিয়ে ঠিক হয়। বিশাল বড় পরিবার। শ্বাশুড়ি, দেওর, ননদ। বড় লোক হলে কি হবে যেমন কিপটে তেমনি নিচু মানসিকতা। উঠতে বসতে নৃপাকে বুঝিয়ে দেয় তারা দয়া না করলে নৃপার গতি হত না। এমনিতেও নৃপা একটু ধীরস্থির। পরিবারের পাঁচজনের পাঁচরকম উপদেশ, খোঁচা মারা কথা তার সাথে নিষেধ। এখানে যাবে না, ওর সাথে কথা বলবে না, এভাবে চলবে না, এভাবে হাসবে না। নৃপা হাঁপিয়ে ওঠে।

বিয়ের আগে ভেবেছিল একটা নিরাপদ জায়গা হল। স্বামীটা তো আপন। কিন্তু বৌভাতের রাতেই স্বামীর বর্বরতা বুঝিয়ে দিয়েছে নৃপা তার স্বামীর কাছে শুধু শরীরের খিদে মেটানোর একটা যন্ত্র। আদিম রিপুর পাশবিকতা বুঝি পশুকেও হার মানায়। একান্নবর্তী বাড়িতে প্রতিবাদ করা যায় না। বিয়ে করা বৌ। তার আবার ইচ্ছা অনিচ্ছা কি?

এমনকি বিশেষ সময়ে যখন নিজের পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করে তখনও নিবৃত্ত হয় না নৃপার স্বামী। ফুটে ওঠে শরীরে সমস্ত পাশবিকতার চিহ্ন। কিন্তু এ তো স্বাভাবিক।দেখেও দেখে না কেউ। বরং একটু দেরী করে উঠলে, কোন কাজ পড়ে থাকলে তাকেই শুনতে হয় ” নবাবের বেটি। আমরা তো দাসীবাদী ওনার। উনি এখানে বিশ্রাম নিতেই এসেছেন।”

সত্যিই তো বিয়ে করা বৌ। শারীরিক চাহিদা মেটাবে না। এ কেমন কথা। নৃপার ইচ্ছা অনিচ্ছা এটা একটা কথা। হাসাহাসি করবে সবাই জানলে। নৃপাও বলে না কিছু। কিন্তু তীব্র প্রতিবাদ করে স্বামীর আচরণে। ফল হয় মারাত্মক।

কিছু দিনেই বাপের বাড়ি খবর যায় স্বামীর সাথে সহবাস করে না নৃপা, গোপনে প্রেম করে, নিশ্চয়ই কিছু গোপন রোগ আছে, আগে কারো সাথে সম্পর্ক ছিল লুকিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। নৃপা এমনিতে খুব শান্ত কিন্তু নিজের চরিত্রের উপর এমন দাগ সহ্য হয় না। তাছাড়া তার বাবাকে ডেকেও অপমান করা হয়। সেদিনি প্রায় জোর করে বাবার সাথে চলে আসে নৃপা বাপের বাড়ি। বড় বাড়ির বৌ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, অপমানটা সহ্য হয়না নৃপার শ্বশুরবাড়ির লোকের বুঝিয়ে আবার নিয়ে আসে বাপের বাড়ি। তারপর চলে অত্যাচার সবাই মিলে। এবার গালিগালাজ থেকে গায়ে হাত দেওয়া।

নৃপা চুপ করে সহ্য করে। জানে প্রতিবাদ করলে আরো বেড়ে যাবে এদের প্রতিহিংসার আগুন। বাড়িতে বাবাকে নিয়ে যাবার জন্য চাপ দেয়। নৃপার বাবা শ্বশুরবাড়িতে বললেও তারা না করে দেয়। বাড়ির বৌয়ের এত ঘনঘন বাপের বাড়ি যাওয়া কেন? নিশ্চয়ই প্রেমিকের সাথে দেখা করতে যায়। এবারেও অত্যাচার চরম আকার ধারণ করেছে। এমকি পুড়িয়ে মারার হুমকি দেয়। বাধ্য হয়ে নৃপা লুকিয়ে পালিয়ে আসে। ফোনটা আসল সকাল নটায়। নৃপার শ্বশুরবাড়ির ক্লাবের থেকে কেউ করেছে।

“হ্যালো মেসোমশাই। আপনি নৃপাদির বাবা তো। আমায় দিদি লুকিয়ে নম্বর দিয়েছিল আপনার সাথে যোগাযোগ করার জন্য । কদিন ধরেই তো খুব অশান্তি চলছিল। আমরা ক্লাবের ছেলেরা গিয়ে ধমকেও এসছিলাম।নৃপাদিকে ওরা হাসপাতালে নিয়ে গেছে। পুরো দেহ পোড়া।কি চিৎকার করছিল। দেহে আর কিছু নেই। আপনি শিগগিরই এখানকার জীবন নার্সিংহোমে আসুন। আমরা পুলিশে খবর দিয়েছি। আমরা আসতে আসতে ওরা সব পালিয়েছে হাসপাতালে নিয়ে আসতে আসতেই। এমনকি হাসপাতাল থেকে বলেছে “আপনারা অপেক্ষা করুন। এটা পুলিশ কেস। ওরা সেই শুনেই বোধহয় পালিয়েছে।”

হাত থেকে ফোনটা খসে পড়ে নরেনের। এই তো মেয়েটা পরশুও ঘুমাছিল বিছানায়। এবার বেঁকে বসেছিল ফিরে যাবে না। একটা চাকরী জুটিয়ে নিজের মতো থাকবে। কিন্তু মেয়ে মানুষ একটা ভবিষ্যৎ আছে। এভাবে একা কি করে চলবে? বয়স হলে কে দেখবে? তাছাড়া একজন স্বামী পরিত্যক্ত মেয়ের চরিত্র নিয়ে সবাই কানাকানি করবে। কত কি বুঝিয়ে নিজে গিয়ে দিয়ে এসেছিল নরেন মেয়েকে। মেয়ে কেঁদে বলেছিল “আর যাবো না তোমাদের বাড়ি। আর মুখ দেখবো না তোমাদের।” তীব্র রাগ আর অভিমানে একটা চড় মেরে এসেছিল নরেন মেয়েকে।

কথাটা এভাবে ফলবে ভাবি নি। না আত্মহত্যা করে নি। গায়ে আগুন নিয়েও চিৎকার করেছিল নৃপা
“বাঁচাও বাঁচাও। তীব্র আকুতি ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু বাঁচাতে আসেনি কেউ।” আসলে হয়তো পরিণামটা জেনেও নরেন নিজেই মেয়েকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিয়েছিল। “যদি সব ঠিক হয়।” “লোকে কি বলবে?” “মানিয়ে নে।” কে দেখবে এরপর বয়েস হলে?” হ্যাঁ এই প্রশ্নগুলোতে চাপা পড়ে গেছিল নৃপার বেঁচে থাকার অধিকার। মেয়ে মানেই তো আপদ। তাই বিয়ে দিয়েই বাবা মা নিজের কাঁধের বোঝা নামিয়ে মুক্তির আকাশ খোঁজে।

নরেনের চোখে জল আসে না। আসলে আগুনটা ওরা লাগালেও দাহ্য বস্তু তো সেই যোগান দিয়েছে। ভালো থাকার অজুহাতে “ভালো আছিস” সেটা জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছে। জিজ্ঞেস করলেও, জানলেও ভালো নেই। কি বা বলতো “মানিয়ে নে। সব ঠিক হয়ে যাবে।” “যাক গে। আপদ চুকেছে।” মেয়ের গলিত, জ্বলন্ত, বিকৃত লাশ দেখে নিজের মনেই বিড়বিড় করে অপ্রকৃতিস্থ নরেন “আপদ, আপদ, আপদ আপদ মরেছে।” বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে মেয়ের শবদেহের দিকে তাকিয়ে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত