পিসি এবং একটি প্রেমপত্র

পিসি এবং একটি প্রেমপত্র

আরে দাঁড়ান দাঁড়ান এ পিসি সে পিসি নয়| মানে আমাদের বঙ্গপিসি নয়| এই পিসি আমাদের গ্রামের পাশের বাড়ির সোমনাথের আপন পিসি| আমাদের সুচিপিসি| ভালো নাম সুচরিতা| পিসির জন্ম পঞ্চাশের দশকে একটি নামীদামী পরিবারে| দাদু ছিলেন ব্রিটিশ আমলের তহসিলদার| বাবা হাইস্কুল এর হেড মাস্টারমশাই| কাকারা কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ রাইটার্সে উঁচু পদে চাকরি করতেন| গ্রামের হাইস্কুল, গার্লস ইস্কুল এই পরিবারের প্রচেষ্টাতেই স্থাপিত হয়| এহেন পরিবারে মেয়েদের একটু কড়া শাসনেই থাকতে হতো| যেমন এগারো বছর বয়স হলেই আর মাঠে ঘাটে খেলে বেড়ানো বন্ধ, বাড়ির কাজ শেখা এবং অবশ্যই মন দিয়ে পড়াশোনা করা| কলেজের গন্ডি পার করলে পর বিয়ে| তবে সুচিপিসির ক্ষেত্রে শাসনের কড়াকড়ি তেমন ছিল না| লেখাপড়া ও বাড়ির কাজে অবশ্য ছাড় ছিল না| শুনেছি জন্মের পর থেকেই খুব ভুগতো, বাঁচার তেমন আশা ছিল না| সেই কারণেই সবার একটা আলাদা মায়া ছিল পিসির ওপর|

সুচিপিসি বেশ ডাকাবুকো ছিল| মানে টমবয় টাইপ আর কি| ষাটের দশকে ছেলেদের সাথে মাঠে ফুটবল পিটিয়ে বেড়াত, সাইকেল নিয়ে টো টো করত সারা গ্রাম| সাথে লেখাপড়া, বাড়ির কাজ সমান তালে চলত| এলো সত্তরের দশক| কুড়ি একুশ বয়স তখন| বাইরের কাজও অনেক করতে হত| সুগন্ধী সাবান, তেল এবং আরো নানা শৌখিন জিনিস গ্রামের বাজারে পাওয়া যেত না| আর খানিক দূরে রেল স্টেশনের পাশে বেশ বড় বাজার ছিল| সেখানে পাওয়া যেত| কলেজ, স্বাস্থকেন্দ্র, স্টেশনারি দোকান, লন্ড্রী এসব ছিল| আবার এক বেশ বড় সিনেমা হলও ছিল| তো আমাদের সুচিপিসির ওপর ভার ছিল কেনাকাটা করার|

তখন বাস তেমন চলত না| একটাই বাস চার বার যাতায়াত করত| এই সকাল সাত টায় ছাড়ত, এগারো টা নাগাদ ফিরে আসত| আবার বারো টায় ছাড়ত, বিকেল চার টায় ফিরত| সাত সকালে তো আর দোকান বাজার খোলে না, তাই সুচিপিসি ঐ বারো টার সময়ই যেত| একাই যেত| জিনিসপত্র কেনার পর অনেকটা সময় পড়ে থাকত| তো পিসি সিনেমা হলে বাংলা বই চললে তা দেখে আসত|

বেশ কয়েকবার সুচিপিসি বাসে যাতায়াতের পথে বা বাজারে লক্ষ্য করেছে একটি লোক ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে| চোঙা প্যান্ট,বড় জুলপি| পিসি তেমন আমল দেয়নি| একদিন কেনাকাটা সেরে সিনেমা দেখতে গেছে, হঠাৎ পাশের সিট থেকে একজন লোক এক ঠোঙা বাদাম দিয়ে বলছে ‘খাও’| মুখ দেখে বোঝে এ তো সেই বাসে, বাজারে পিছু নেওয়া লোকটা| পিসি তো কিছুতেই বাদাম নেবে না| তখন লোকটি বলছে, ‘আমি তোমার দাদার বন্ধু’| পিসি দাদা কে বেশ সমীহ করেই চলত| দাদার বন্ধু দিচ্ছে আর যদি না খায়, সেই কথা দাদার কানে গেলে বেশ ভালো রকম বকুনি খাবে| দাদার বন্ধু তো দাদা’ই| এসব সাতপাঁচ ভেবে বাদাম খেয়েই নেয়|

আবার একদিন বাসে দেখা| সুচিপিসি বেশ বিরক্ত| তবে একটু নিশ্চিন্ত, কারণ সিনেমা দেখার ব্যাপার নেই| কিন্তু নিশ্চিন্ত হওয়ার কি উপায় আছে!!! সে একখানি বেশ বড় রকম খাম পিসির দিকে এগিয়ে দেয়| পিসি ভাবল দাদার জন্য কিছু লেখাপড়ার জিনিস বুঝি| অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও দাদার রক্তচক্ষুর কথা ভেবে নিয়েই নিল| বাড়ি ফিরে দেখল দাদা নেই| যাকগে, দাদা এলে দিলেই হল| তাড়া তো কিছু নেই| রাত্রিবেলা আর মনে পড়ল না দেওয়ার কথা| পরের দিন সকালে সুচিপিসি ভাবল একবার দেখা যাক ভেতরে কি আছে| খাম খুলে তো পিসির মাথায় বজ্রাঘাত| হায় ভগবান এ যে প্রেমপত্র| দাদার হাতে পড়লে কি হত সেই ভেবেই হাড় হিম হয়ে গেল| যাইহোক, নিজেকে সামলে নিয়ে পত্রখানি খুলল| ও হরি ভাষার কি বাহার!!! ” সিচরনেসু, পিওতমা ওগ, তুমি আমার পোথোম কদোম ফুল| তুমি আমার হিদয় পদ্দ| আমার পানেস্সরি| ওগ আমার সপনে দেখা রাজকন্না| সয়নে সপনে জাগোরনে সুদু তোমারেই দেখি| মাঠে ঘাটে পথে বাসে সুদু তোমার অপেকখা তে থাকি| তুমি আমার হিদএর রানি| তোমার হাত ধোরে চলে যাবে জিবনখানি|”

এরপর পিসি কাঁপতে কাঁপতে বার কয়েক হেঁচকি তুলে মূর্ছা গেল| সবাই দৌড়ে এলো| কেউ একজন মুরগী ঝাঁকা রোগ (মৃগী) হয়েছে ভেবে জুতো শোঁকালো, কেউ মুখে জল ছেটালো| অবশেষে জ্ঞান ফিরল| তবে পিসি বাক্যহারা|
এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু হলো না| উৎপাত বাড়ল| পিসিদের বাড়ি বাসস্ট্যান্ড এর পাশেই| সদর দুয়ারে বসলেই দেখা যায়| লোকটিকে পিসিদের সদর দুয়ারের দিকে মুখ করে বাসস্ট্যান্ডে বসে থাকতে দেখা গেল| পিসির তো ভয়ে বুক কাঁপে| এমনি করে কয়েকদিন কাটলো| একদিন দুপুরে পিসির দাদা খেতে বসে ঐ লোকটির বাড়়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ানোর প্রসঙ্গ তুলে পিসিকে জিজ্ঞেস করল পিসিকে কোন ভাবে লোকটা বিরক্ত করে কিনা| যদি বিরক্ত করে তাহলে মেরে তার ঠ্যাঁঙ ভাঙবে| পিসি আসন্ন মল্লযুদ্ধের দৃশ্য কল্পনা করে খালি দু’দিকে মাথা নাড়ল|

আবার পিসি একদিন বাসে চড়ে বসল| যথারীতি সেই লোকও হাজির| সে বুঝেছে কোন উত্তর পাওয়ার কোন আশা নেই| তো সে পিসিকে শুনিয়ে শুনিয়ে একজনকে বলতে লাগলো,'”জানিস তো একজন আমাকে চিঠি লিখে খালি পেম নিবেদন কচ্চে, আমি পাত্তাই দিই নি|” পিসি নির্বিকার| পিসিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোন পাল্টা জবাব কেন দেয়নি | পিসি বলেছিল “এইসব উটকো লোকেরা কথা বাড়ানোর তাল খোঁজে| জবাব পেলেই আরো কিছু বলবে| কথায় কথা বাড়ে| যার কোনো গুরুত্ব নেই তোমার কাছে তাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনবে না|” হক কথা|

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত