“ওই তো ভারি ছোট্ট পানপাতার মত একটা মুখ! তা দেখতে কতক্ষণ লাগে”? মায়ের কথার উত্তরে – “পানপাতার মত বলেই তো দেখি, হাঁড়িমুখ হলে কি দেখতাম”? বলে লিপিকার মেয়ে মায়ের গাল টিপে আদর করে, পিঠে ঢাউস ব্যাগ চাপিয়ে স্কুলবাসে গিয়ে ওঠে। লিপিকা হাত কপালে ঠেকিয়ে মনে মনে বলে ‘হাঁড়িমুখ হোক বা পানপাতা! ভগবান সবাইকে ভালো রাখুন’।
সদর দরজার ছিটকিনি লাগাতে লাগাতে লিপিকা দেখতে পায় তার ছেলেও এসে দাঁড়িয়েছে আয়নার সামনে। কলেজে যাবে বলে তৈরী হচ্ছে। চুল সেট করা তার আর হচ্ছেই না। হবেই বা কিকরে! আঙুল দিয়েই যদি চুল আঁচড়ানো যেত তাহলে তো আর চিরুনীর আবিস্কার হতোনা। চুলে কি না লাগায়! শ্যাম্পু, হেয়ার জেল, হেয়ার ক্রীম। হেয়ার ড্রায়ারের কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখেনা। স্নান না করলেও হয়তো চুলে হেয়ার ড্রায়ার চালিয়ে নেয়। শুধু তেল আর চিরুনীর সাথে সদ্ভাব নেই। ব্যাগ নিয়ে ছেলেও বেড়িয়ে পড়ে।
লিপিকা এতোক্ষণে চায়ের কাপ হাতে, একটু বসতে পেরেছে। তার ছেলের সবে সবে বয়োঃসন্ধি শেষ হয়েছে, মেয়ের সবে সবে শুরু হয়েছে তবুও আয়নার সামনে দাঁড়ানো নিয়ে কখনো কখনো দুই ভাই-বোনের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে যায়। লিপিকার মনে পড়ে কিশোরী বেলায় যখন সে বিয়ে বাড়ী যেত, অনেক রাত্রে ফেরার পড়েও আয়না দেখতে ভুলতোনা। এখন বিয়েবাড়ী যাওয়ার সময়ও দেখে কিনা সন্দেহ! সে ছেলে-মেয়েকে বারণ করেনা। আয়না দেখা বয়সের ধর্ম। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কবে কবে যে আয়নার সাথে দূরত্ব তৈরী হয় নিজেও বোঝা যায়না।
লিপিকার বান্ধবী একদিন বলেছিল “জানিস তো নিজের মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছা করে”। লিপিকা অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল “তোদের বাড়ীতে আয়না নেই”? সে হেসে বলেছিল “আয়নার মধ্যে দিয়ে না, নিজের চোখে দেখতে ইচ্ছা করে”। পাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে ওদের বন্ধু বলে উঠেছিল ” চোখদুটো কপাল থেকে খুলে হাতে লাগিয়ে নিবি, যখনই নিজের মুখ দেখতে ইচ্ছা করবে হাতটা মুখের সামনে ধরবি”। একলা ঘরে চা খেতে খেতে খূব মনে পড়ছে স্কুলের খুনসুঁটিগুলো। ছোটবেলার খুনসুঁটিগুলোই হয়তো বড়বেলার একঘেয়েমী গুলোকে দূরে সরিয়ে রাখে।
লিপিকার আজ বাবার কথাও খুব মনে পড়ছে। প্রায় তিনবছর হয়ে গেল অসুস্থতার কারণে বাবা হাঁটতে পারেনা, নিজে হাতে খেতে পারেনা। কখনো কখনো মনে হয় বাবা যেন বেঁচে নেই, মা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অসুস্থ অবস্থাতেই বাবা তার খুব প্রিয়জনকে হারিয়েছে। প্রথম প্রথম লিপিকা তার বাবার সামনে যেতে পারতোনা, তার খালি হাতদুটো বাবা কিছুতেই দেখতে পারতোনা। খুব কাঁদতো। সময়ের সাথে সাথে এখন হয়তো একটু অভ্যাস হয়ে গেছে। বারবার বাড়ী থেকে ফোন আসে। বাবার যখনই তাকে দেখতে ইচ্ছা করে সে গিয়ে দেখা করে আসে। দিদিরাও বারবার যায়। বাবার বারবার আপনজনদের দেখতে ইচ্ছা করে। আচ্ছা! বাবার নিজেকে দেখতে ইচ্ছা করেনা? লিপিকার মনটা ছটফট করে ওঠে। আর দেরী করলে হবেনা। তিনবছরে একবারও যেটা করার কথা মনে হয়নি, আজ সেটা করতে হবে।
একটা রিটার্ন টিকিট কেটে ট্রেনে চড়ে বসে লিপিকা। এই প্রথমবার সে একা একা বাপেরবাড়ী যাচ্ছে। মা খুব অবাক হবে। তাড়াতাড়িতে ভালো শাড়ীও পরেনি, হাতের কাছে যেটা পেয়েছে সেটাই পরে নিয়েছে। যখন তার নতুন বিয়ে হয়েছিল, তখন মা বারবার বলতো “এখন সাজিসনা, ভালো শাড়ী পরিসনা, দেখবি! যখন বুড়ি হয়ে যাবি তখন সাজতে ইচ্ছা করবে”। মা হয়তো ঠিকই বলতো। কত ভালো সময় সে এমনি এমনিই কাটিয়ে দিয়েছে। এখন যা আছে সে তো শুধুই খারাপ।
বাড়ী ঢুকতেই মা তাকে দেখে অবাক হয়ে বলে “একা একা এলি যে”? লিপিকা বলে “হঠাৎ করে একটা কাজ মনে পড়লো, সেটা করতেই এসেছি। বাবা অন্যদিনের মতো আজো উজালা সফেদী ধুতি-পাঞ্জাবী পরে চেয়ারে বসে আছে। বাবা এখন অনেক কিছুই বুঝতে পারেনা। মাঝে মাঝেই জামা-কাপড়,বিছানা ভিজে যায়। মা সেগুলো বিনা বিরক্তিতে কেচে দেয়। আগের মতোই নিয়ম করে ধুতি-পাঞ্জাবীতে উজালা দিয়ে দেয়। বাবা হাত বাড়ানো সত্ত্বেও লিপিকা কোন কথা না বলে ঘরে চলে যায়। ঘর থেকে একটা ছোট আয়না নিয়ে এসে বাবার হাতে দিয়ে বলে “ছেলে, মেয়ে, বৌমা, নাতি, নাতনি সবাইকে দেখতে ইচ্ছা করে, নিজের মুখখানা তিনবছরে একবারও দেখতে ইচ্ছা করেনি”! বাবা কাঁপা কাঁপা হাতে আয়নাটা নিজের মুখের সামনে ধরে। মুখের সব শিরা উপশিরা গুলো যেন মুহূর্তের মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঝরঝর করে কেঁদে ওঠে বাবা।
ছোট বাচ্চারা যখন কাঁদে, তাদের আয়না দেখালে যেমন তারা কাঁদতে কাঁদতেই হেসে ফেলে বাবাও তেমন অনেকদিন পরে আয়নায় নিজের মুখখানা দেখে হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে জড়ানো গলায় বলে “বাবার মনের কথা মেয়ে ছাড়া কেইবা জানে”? মা দূরে দাঁড়িয়ে, এই বয়সেও অভিমানের সুরে বলে “হ্যাঁ সবই তো মেয়ে জানে, মেয়ের মা তো কিছুই জানেনা কিছুই করেনা। লিপিকা মায়ের কাছে এসে মাকে প্রণাম করে বলে “মা! ছেলে – মেয়ে ফেরার আগেই আমাকে বাড়ী ফিরতে হবে”।
মা মেয়েকে মিষ্টি একটা ধমক দিয়ে বলে “ফিরতে হবে মানে! না খেয়ে যাবি নাকি”? লিপিকা বলে “তুমি তো জান সকালে আমি ভাত খাইনা”। মা মেয়ের সব আপত্তি অমান্য করে কাঁসার থালায় করে ভাত নিয়ে আসে। বলে “বিয়ের পরে সাহেব হয়েছো, আগে তো ভাতই খেতে”। লিপিকা বুঝতে পারে তার আপত্তি মা শুনবেনা। কথা না বাড়িয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো খেতে বসে। ধোঁয়া ওঠা ভাতে দানা-দানা ঘি গলে মিশে যাচ্ছে। বড়ি পোড়া দিয়ে মাখা বেগুনপোড়া আর আলু চচ্চড়ি দিয়ে ভাত মেখে, তাড়াতাড়ি করে খেয়ে টোটোতে গিয়ে বসে লিপিকা। আমগাছ, কুলগাছ, খেজুরগাছ ছাড়িয়ে টোটো ছুটে চলে স্টেশনের দিকে। অনেকদিন পরে একটা খুব সুন্দর অনুভূতিতে ভরে আছে লিপিকার মন।
ট্রেন এসে গেছে, ভাগ্যিস টিকিটটা কাটা ছিল! একলাফে সে ট্রেনে উঠে পড়ে। ফুলিয়া, হবিবপুর, কালী নারায়ণপুর, রানাঘাট, পায়রাডাঙ্গা, চাকদহ, একটা একটা করে স্টেশন ছাড়িয়ে যায়। তখনো লিপিকার মুখে বেগুনপোড়ার স্বাদ যেন লেগে আছে। শুধু বুঝতে পারেনা তাড়াহুড়োতে ভালো করে মুখ ধোওয়া হয়নি, নাকি মায়ের মমতার সাথে ছোটবেলার স্মৃতি মিশে ছিল তাই—–
সমাপ্ত