বৃষ্টির গাথা

বৃষ্টির গাথা

অঝোর ধারায় অবিরাম বৃষ্টি হয়েই চলেছে সেই সকাল থেকে। থামার কোনো নাম নেই, মাঝে মাঝে ঝির-ঝির, মাঝে মাঝে টুপ-টাপ, মাঝে মাঝে টাপুর-টুপুর, আবার কখনো কখনো বা মুষলধারে বৃষ্টির ধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। ভিজে চলেছে গাছ পালা, ভিজে চলেছে মাটি, ভিজতে ভিজতে স্কুলে চলেছে বাচ্চাদের স্কুল ভ্যান; কাজের মাসীরা কোনোরকমে ফুটো ছাতার নিচে মাথা বাঁচিয়ে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে চলেছে এই বাড়ি থেকে ওই বাড়ি। কয়েকটা কুকুর কোনোরকমে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে গাড়িগুলোর তলায়।

কিছু কিছু বাচ্চা আবার খালি গায়ে , ঝাঁপিয়ে পড়ছে ডোবার জলে , দূরে একটা ঝাপসা হয়ে যাওয়া মাঠের মধ্যে ফুটবল নিয়ে লাথালাথি করছে আর একটা দল। এইরকম দিনে কিছু না করে চুপ করে জানলার ধারে বসে থাকতে হয়। সাথে যদি থাকে একটা বই আর সামনে যদি থাকে ধোঁয়া ওঠা চা বা কফি , জাগতিক সব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য – হয়ে যায় ফিকে তার সামনে ! একটু আগেই কোথাও একটা চলছিলো ভীষণ পছন্দের সেই গানটা – “আমার সারাটা দিন, মেঘলা আকাশ

বৃষ্টি – তোমাকে দিলাম….”

গানটা শেষ হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ, রয়ে গেছে তার রেশ এখনো। গুণগুণ করতে করতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মিতুল। আজ আর বসে থাকলে হবে না, মিতুলকে আজ বেরোতেই হবে। মিতুল বেরোনোর আগে আকাশের দিকে তাকালো , নাহ, আজ মনে হয় না বৃষ্টি আর থামবে , আকাশের আজ মুখ ভার হয়ে আছে। গাড়িটা বের করলো মিতুল। অনেকমাস পরে আজ আবার গাড়ি বের করেছে মিতুল। সেই, সেই ঘটনার পর থেকে, ও গাড়ি বের করেনা খুব একটা। তবে আজ আর কোনো গতি নেই, রাস্তায় অনেক জল, হেঁটে যাওয়া যাবে না।

আর ক্লায়েন্ট আজকেই ডেকে পাঠিয়েছে কনট্র্যাক্ট পেপারে সই করতে। এই কনট্র্যাক্ট এর জন্য কতদিন চেষ্টা করছিলো ওরা সবাই মিলে, কত লড়াই, কত ‘ঘুষ’এটা হয়ে গেলে ওদের ব্যবসায় অনেকটা মুনাফা আসবে। আর যেহেতু এই প্রোজেক্ট ও প্রথম থেকে দেখছিলো , ওর বস – মুলচন্দানি ওকেই দায়িত্ব দিয়েছে। এটা ঠিকভাবে হয়ে গেলে, একটা বড়ো প্রোমোশন ও হবে ওর। আজ অন্যরা আবার সব ছুটিতে আছে।

গাড়িতে বসে পছন্দের গান চালিয়ে , এসির ঠান্ডা হাওয়াতে চালু করলো গাড়িটা। গাড়িটা কয়েকমাস আগেই কিনেছে ও। তারপর থেকে, পড়েই ছিল নিচে। ধীরে ধীরে গাড়িটা ড্রাইভ করে, রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে আসে মিতুল। সামনের রাস্তায় জল থৈথৈ করছে। রাস্তার মাঝখান দিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে ও। কে জানে কোথায় গর্ত আছে ? গাড়ির চাকার ধাক্কায়, জল ছড়িয়ে পড়ছে আসে পাশে। এটা যদি সেই আগের মিতুল হতো, তাহলে ও স্পিডে বেরোতো , আসে পাশে উঁচু হয়ে ফোয়ারার মতো ছিটিয়ে পড়তো জল, মানুষজনকে ভিজিয়ে দিতো। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে লোকজন ওর দিকে তাকিয়ে করতো শাপশাপান্ত, আর ও হাসতে হাসতে বেরিয়ে যেতো ওদের দিকে ‘মিডিল’ ফিঙ্গার দেখিয়ে। কিন্তু এখন…

আরো কিছুক্ষন চালানোর পরে দেখলো আগে রাস্তা বন্ধ। ওর চেনা রাস্তাটা বন্ধ দেখে, এদিক ওদিক তাকালো মিতুল। কর্পোরেশনকে খিস্তি-গালাগালি দিতে দিতে, মোবাইলে ম্যাপ বের করলো মিতুল। মোবাইলের দেখানো অন্য আরেকটা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললো মিতুল ওর গন্তব্যের দিকে। যে হোটেলটায় ক্লায়েন্ট আছে সেটা আরো ঘন্টাখানেকের রাস্তা। বেশ বৃষ্টিটা ধরে এসেছিলো – ঝিরঝির করে পড়ছিলো। হঠাৎ দূরে কোথাও প্রচন্ড জোরে বাজ পড়ে। আর তার সাথে সাথে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। একই সাথে ঝোড়ো হাওয়া, মেঘের গর্জন ! এতো জোরে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে, যে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। মিচারদিকে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেছে জলের কণায় । মিতুল ভাবে, কি করবো ? পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করবো ? কিন্তু আশে পাশে তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না ! আর একটু এগিয়ে যাই ধীরে ধীরে, যদি কোনো দোকান বা কিছু দেখা যায় !

গাড়ি ফার্স্ট গিয়ারে রেখে – দশের গতিতে, আরো কিছুদূর এগিয়ে গেলো মিতুল। প্রচন্ড শব্দ করে সামনে থেকে ছুটে এলো একটা ভারী ট্রাক, হর্ন দিতে দিতে বেরিয়ে গেলো পাশ দিয়ে। বুক কেঁপে উঠলো খুব জোরে মিতুলের, আর একটু হলেই ওর গাড়ির ওপর দিয়ে ওকে পিষে বেরিয়ে যেতো ট্রাকটা। তাড়াতাড়ি স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে রাস্তার এক পাশে এসে গাড়ি নিয়ে দাঁড়ালো মিতুল। এখনো বুক কাঁপছে প্রচন্ড জোরে জোরে। কপালের ওপরে জমে থাকা ঘাম মুছে, কোনোরকমে হাতড়ে হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করলো মিতুল। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি – হয়েই চলেছে। তার সাথে পড়ছে বাজ , মনে হচ্ছে যেন মহাপ্রলয়ের তাণ্ডব শুরু হয়েছে। হঠাৎ ওর গাড়ির জানলার কাঁচে ধাক্কার শব্দ। চমকে উঠে তাকায় মিতুল বাঁ দিকে। একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে বাইরে , শাড়ি পরে। কোনোকিছু না ভেবেই মিতুল দরজা খুলে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “উঠে আসুন তাড়াতাড়ি। ”

মেয়েটি উঠে আসে ভেতরে। এসে বসে পড়ে তাড়াতাড়ি। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছতে থাকে মুখের ওপরে লেগে থাকা বৃষ্টির জল , মাথার চুল ও গেছে ভিজে। চুলের লম্বা লম্বা কিছু গোছা এসে পড়েছে মুখের ওপরে , তার শেষ প্রান্ত দিয়ে জল পড়ছে নিচের দিকে টুপটুপ করে। বৃষ্টিতে ভিজে সারা শরীর চপচপে, শাড়িটাও সারা শরীরের সাথে লেপ্টে গিয়ে আরো ভালোভাবে প্রকাশ করছে মেয়েটির সারা শরীরের ভাঁজগুলোকে। ঠোঁটে লাগানো গোলাপী রঙের লিপস্টিক , চোঁখ কাজল , কপালের ওপরে একটা টিপ্ , স্লিভলেস হলুদ রঙের ব্লাউজ, শরীর ঢেকে রাখা কালো সিল্কের শাড়ি – অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে। মেয়েটি কিছু আন্দাজ করতে পেরে হেসে তাকায় মিতুলের দিকে। তাড়াতাড়ি কোনোরকমে বুকের ওপর থেকে খসে পড়া আঁচল কোনোরকমে ঠিক করে, মুখের ওপরে নেমে আসা চুলগুলোকে হাত দিয়ে পেছনের দিকে নিয়ে গিয়ে বলে ওঠে, “কি কান্ড দেখুন তো ! হঠাৎ করে এতো জোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো..যে; ইসসস, আপনার গাড়ির ভেতরটা পুরো জলজল হয়ে গেলো আমার জন্য। ”

মিতুল সামনের দিকে মুখ সরিয়ে নিয়ে বলে, “না না ! ঠিক আছে। আপনি, আপনি নিজেকে একটু ঠিক করে নিন। আমি এসি বন্ধ করে দিচ্ছি , আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে না হলে। ” এসি বন্ধ করে দেয় মিতুল। মেয়েটি রহস্যময়ী একটি হাসি হেসে জিজ্ঞেস করে , “আপনি কি রাস্তায় যে কোনো মেয়েকেই এভাবে লিফ্ট দেন ? ”

রেগে যায় মিতুল, বলে, “দেখুন, আপনার জায়গায় কোনো ছেলে থাকলে, তাকেও আমি লিফ্ট দিতাম আজকের দিনে। বাইরের অবস্থা দেখেছেন একবার ও ? আপনি নিজেও তো বিপদে পড়ে “সরি সরি ! মানে আমি, ঐভাবে বলিনি। আসলে আমি অপেক্ষা করছিলাম একজনের জন্য এখানে। আর তারপর হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো, কোনোরকমে গাছের তলায় দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু দেখছেন তো, কি অবস্থা হয়েছে আমার ! ”

আবার চুপ করে যায় দুজনেই। কেটে যায় বেশ কিছু মুহূর্ত। মিতুল এর মনে পড়ে আগের কথা – না কি আগের জন্মের কথা ? আজ যদি সেই মিতুল থাকতো , তাহলে মেয়েটি হয়তো…একটা হাসির রেশ খেলে যায় মিতুলের মুখে। হঠাৎ মেয়েটি চেপে ধরে মিতুলের হাত, মিতুল তাকায় মেয়েটির দিকে। মেয়েটি বাইরের দিকে তাকিয়ে , দূরে কোথাও হাত দিয়ে দেখিয়ে ইশারা করছে, “ওটা কি একটা চায়ের দোকান ? চলুন না, একটু গরম গরম চা যদি খাওয়া যায় ! খুব ঠান্ডা লাগছে আমার। ”

মিতুল দেখলো বাইরের দিকে, বৃষ্টি অনেকটা কমেছে আগের থেকে। এখন রাস্তায় দেখা যাচ্ছে মোটামুটি। ও স্টিয়ারিং এ হাত দিয়ে স্টার্ট করলো গাড়ি আবার। বেশ কিছুটা গিয়ে, রাস্তার একধারে ছোট্ট একটা ঝুপড়ি মতো দোকান। সাধারণতঃ এইরকম দোকানে মিতুল দাঁড়ায় না , তবে আজ ওর নিজের ও ভীষণ চা খেতে ইচ্ছে করছে। কে জানে কেন ? মেয়েটি গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেছে , তাকিয়ে আছে ওর দিকে ভেতর থেকে। এক অদ্ভুত আকর্ষণে,মিতুল ও নেমে আসে গাড়ি থেকে। উনুন জ্বলছে একটা, তার ওপরে বসে আছে একটা কেটলি। কেটলির মুখ থেকে বেরোচ্ছে ধোঁয়া। বাঁশ, ত্রিপল আর খড়ের ছাউনির নিচে ঢুকে এলো মিতুল। কাউকে না দেখতে পেয়ে, মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলে ও , “কোথাও তো কেউ নেই ! ”

হঠাৎ ভেতরের অন্ধকার থেকে, এক বুড়ো একগাল হেসে বেরিয়ে এলো ওদের সামনে। যেন অনেকদিনের চেনা , মিতুলকে বললো, “এই তো আমি আছি বাবু। অপেক্ষায় ছিলাম গো ! কি খাবে ? চা ? ” কারোর উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে ওঠে বুড়ো , “বাবু, খুব ভিজে গেছেন তো, বসেন বসেন এখানে , এই কে আছিস, একটু গামছাটা নিয়ে আয় না ! বাবু, চা খাবেন তো ? আদা দিয়ে বানানো ? এই বৃষ্টিতে খুব ভালো লাগবে গো। আর সাথে আলুর চপ ? চলবে ? একদম গরম গরম ? ”

মিতুল বুড়োর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করো, কি খাবে ! আমাকে শুধু চা। ” “ম্যাডাম ? কোন ম্যাডাম ? অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বুড়ো ওর দিকে। মিতুল তাকায় পাশে , প্রায় চমকে লাফিয়ে ওঠে, পাশে কেউ তো নেই বসে ! আরে ? মেয়েটি কোথায় গেলো ? বুড়োটা হাসতে হাসতে ভেতরে গিয়ে চা ঢালতে ঢালতে বলে ওঠে, “তা বাবু মাঝে মাঝে এরকম মনে হয় ! এ আপনার ভুল নয় গো ! যা বৃষ্টি , মাথা ঠিক রাখাই দায়। ”

ভেতর থেকে কেউ একজন গামছা নিয়ে আসে, এসে বাড়িয়ে দেয় মিতুলের দিকে। ভাঙা চেয়ারটার ওপরে বসতে বসতে মিতুল হাত বাড়িয়ে গামছাটা নিয়ে মাথা মুছে নিলো ভালো করে। এবার ভালো করে দেখলো দোকানটা। একটা ছোট্ট দোকান ভেতরে প্রায় দশজন মতো দাঁড়িয়ে-বসে! সবাই ওকেই দেখছে। একটু আগে তো পুরো দোকান খালি ছিলো ? এরা সব এলো কোথা থেকে ? একটা অদ্ভুত ভয় জেগে ওঠে ওর ভেতরে। এখান থেকে বেরোতে হবে ! মেয়েটাই বা কি হলো কি? সবাই আমাকে দেখছে কেন? এরকম ভাবে কেন দেখছে আমাকে? মনে পড়ে যাচ্ছে কেন সেই দিনের কথা? সেটাও তো এরকমই একটা ছোট দোকান ছিলো! সেদিন, সেদিন কি করে যে হঠাৎ বুড়োটা ভেতর থেকে ছুটে এলো চিৎকার করে :

-বাবু, বাবু সামলে , সামনে দেখেন , সরে আসেন ওখান থেকে , না নাআআআ !

চমকে সামনের দিকে তাকায় মিতুল। একি, এটা কি হচ্ছে ? কোথা থেকে একটা গাড়ি ছুটে আসছে রাস্তা দিয়ে প্রচন্ড গতিতে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সরাসরি দোকানের দিকেই ধেয়ে আসছে একটা মত্ত হাতির মতো। এতো আমাকে, এই দোকানটা, সবকিছুই পিষে বেরিয়ে যাবে ! প্রাণ বাঁচানোর জন্য সামনের দিকে ঝাঁপ দিলো মিতুল।

কিছুক্ষণ চুপ করে মাটিতে পড়ে থাকার পরে চোখ খোলে ও। বাইরে বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে অবশেষে। গাড়িটা , গাড়িটা কোথায় গেলো ? যাক, মনে হয় বেরিয়ে গেছে কোনোভাবে। উহঃ, জোর বাঁচান বেঁচে গেছি আজ। উঠে দাঁড়ায় মিতুল , জামা কাপড় ঝেড়ে তাকায় দোকানের বাকিদের দিকে।

সবাই এখন ওকে দেখে হাসছে , হাসতে হাসতে ওদের মুখ, চেহারা সব কিরকম পরিবর্তিত হচ্ছে , গায়ের চামড়া গুলো গলে গলে পড়ছে মোমের মতো, মাথার চুল পুড়ে বেরিয়ে আসছে মাংস, তারপরে মাথার খুলি, চোখ যেন ফেটে বেরিয়ে আসছে ওদের। পাশে একটা হাতের টোকা খেয়ে তাকায় , ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে সেই বুড়ো, সারা শরীর আগুনে পুড়ে ভীষণ বাজে একটা মাংস পোড়ার গন্ধ আসছে ওর থেকে। কঙ্কালসার চেহারাটা বলে ওঠে, “সেদিন ও আমরা এভাবেই ভয় পেয়েছিলাম বাবু , আপনিতো মত্ত অবস্থায় সেই মেয়েটাকে নিয়ে ফুর্তি করতে করতে….”

“না, নাআআআ , এ হতে পারে না। ” চেঁচিয়ে ওঠে মিতুল। এদিক ওদিক তাকায় ও। ওই তো গাড়িটা , ওই তো দাঁড়িয়ে। ওখানে যেতেই হবে কোনোভাবে আমাকে। উঠতে যায় মিতুল। কিন্তু কেউ যেন ওকে ধরে রেখেছে শক্ত করে মাটির সাথে। একটুও নড়তে পারছে না ও। আর্তনাদ করে দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বসে পড়ে ও । মনে পড়ে যাচ্ছে আবার সেই দিনের কথা।

কয়েকমাস আগের কথা। এক সন্ধেতে , ও গাড়িতে করে ফিরে আসছিলো অফিসের একটা পার্টি থেকে। পার্টিতে মদ্যপান করে হয়ে গিয়েচিলো মত্ত। তবুও মিতুল, কারোর নিষেধ না শুনে বেরিয়ে এসেছিলো মনামীকে সাথে নিয়ে – পাটি থেকে বাড়ি যাবে বলে। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে প্রচন্ড গতিতে চালাচ্ছিল সেদিন গাড়ি ও। মনামি পাশে বসে, ওর সাথে করে যাচ্ছিলো বিভিন্ন ধরণের খুনসুটি।

মনামী, ওর জুনিয়র। সেদিন সারা রাত ওরা একসাথে কাটাবে ঠিক করেছিলো। মনামী ভালোবেসেছিলো মিতুলকে। বিয়ে করতে চাইছিলো। কিন্তু মিতুল এর কাছে মনামী ছিলো শুধুই একটা শরীর। মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে ওকে রাজী করিয়েছিলো সেই রাত ওর সাথে কাটানোর জন্য। পার্টিতে সবার সামনে বলেছিলো ও বিয়ে করবে মনামীকে কয়েকদিনের মধ্যে। মনামী পাশে বসে মিতুলের মাথার চুলে হাত দিয়ে, ওর ঠোঁটের ওপরে আঙ্গুল রেখে, কখনো বা মিতুলের কোমরের নিচে হাত রেখে করছিলো খেলা। হঠাৎ মনামী শুয়ে পড়ে গাড়ির সিটের ওপরে, নামিয়ে আনে ওর মুখ মিতুলের কোমরের ওপরে।

আবেশে মত্ত মিতুল – নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তা দিয়ে নেমে আসে গাড়ি নিয়ে সজোরে। ধাক্কা মারে একটা চায়ের দোকানে। কোনো রকমে নিজেকে সামলে, গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে মিতুল। মনামি তখন ও আটকে ভেতরে। জোরে স্টিয়ারিং এর সাথে ধাক্কা খেয়ে ওর মাথা থেকে বেরোচ্ছিল রক্ত গলগল করে. অসহায় ভাবে তাকিয়েছিলো ওর দিকে , হাত দিয়েছিলো বাড়িয়ে। মিতুল ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে, নিজেকে বাঁচিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসে। ইঞ্জিন থেকে বেরোচ্ছিলো ধোঁয়া, আর তার একটু পরেই – প্রচন্ড জোরে বিস্ফোরণ। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে ছোট চায়ের দোকানটা আর সাথে ওর গাড়িটা। দোকানের ভেতরে সেইসময় ছিলো বেশ কয়েকজন। তারাও সেই বিস্ফোরণে , জ্বলে পুড়ে সাহস হয়ে যায়। ওদের মধ্যে কয়েকজন দৌড়ে কোনোরকমে বেরিয়ে এসেছিলো বাইরে। দাউদাউ করে জ্বলতে জ্বলতে অসহায়ের মতো দৌড়োচ্ছিলো ওরা। আর সেভাবেই ধীরে ধীরে পড়ে যায় মাটির ওপরে। মিতুল দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছিলো সবকিছু।

ও তার পরে জানার চেষ্টাও করেনি কি হয়েছিল ওখানে। নিজের প্রভাব খাটিয়ে , অনেক টাকা পয়সা একে ওকে খাইয়ে, ওর কেসটা ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছিলো তখন মিতুল। হাত সরিয়ে নেয় মুখ থেকে মিতুল। একি, ওরা সবাই আমার দিকে এগিয়ে আসছে কেন ? এরকম ভাবে তাকিয়ে, সবাই আমার দিকে কেন এগিয়ে আসছে? এ, এটা কি সেই জায়গা ? সেই দোকান ? আমি, আমার ভুল হয়েছে , আমি স্বীকার করছি, কিন্তু তবুও এরা আমাকে ঘিরে ধরেছে কেন চারদিক থেকে ?

বুড়োটা , বুড়োটা কি নিয়ে আসছে ওর হাতে করে ? এতো একটা জ্বলন্ত মশাল ! পাশে , পাশে ওই মেয়েটা…ও, ও তো মনামী ! মনামী এখানে , কি করে ? ওহঃ , এতো গরম কেন, এই পোড়া গন্ধ কিসের? মনামী হাসছে, কি বীভৎস ওর হাসি, ও চেপে ধরেছে ওই মশাল আমার কোমরের নিচে ! ওহঃ, কি অসহ্য গরম, আমি, আমার হাত, আমার পা , এতো জ্বালা জ্বালা করছে কেন ? এই কটু পোড়া গন্ধ…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত