আজ বড়দিন। সকাল থেকেই নানা লোকজনের সমাগমে “চ্যাটার্জিভিলা” জমজমাট।কারণটা অবশ্য শুধু বড়দিন নয় সেইসাথে এইবাড়ির বড়কর্তা অমলকান্তিবাবুর একমাত্র নাতনি মেহুলের আজ দশবছরের জন্মদিন মানে একসঙ্গে ডবল খুশি যাকে বলে আর কি!কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই মেহুলকেই কোত্থাও খুঁজে পাওয়া যায়না।ওর মা কান্নাকাটি শুরু করেন,খাটের উপরে ওর জন্য নতুন কেনা গোলাপী রঙের জামাটা লুটোপুটি খাচ্ছে।সুদৃশ্য কেক, বাটিতে নলেন গুড়ের পায়েস সাজিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে মেহুলের জন্য।কোথায় যে গেল মেয়েটা সকলের চোখ এড়িয়ে।চিন্তায় যখন সকলের মাথায় হাত পরেছে, খোঁজাখুঁজি চলছে পুরোদমে ঠিক এমনসময় মেহুল বাড়ি ঢোকে একদল ছেলেমেয়েকে নিয়ে ওদের কারুর পরনে ছেঁড়া সোয়েটার কারুর পা রংচটা প্যান্ট।
দিদিভাই এরা কারা?”,জিজ্ঞাসা করেন অমলকান্তিবাবু ওনার নাতনিকে।মিষ্টি হেসে ও বলে,”ওরা সবাই আমার বন্ধু,সামনের বস্তিতে থাকে।প্রতিদিন স্কুল আসাযাওয়ার পথে ওদের সাথে দেখা হয় আমার।শুধু দিনটা নামে বড় হলে হবে দাদুভাই? স্কুলে ম্যাম বলেন যে কোনো খুশি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিলে অনেক বড় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।”অতিথিদের মধ্যে এতক্ষণ যারা বাচ্চাগুলোর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছিলেন তারা তখন চুপ।বয়স ছোট হলে কি হবে আদতে ঠিকই তো বলেছে ও।আলো,আশা,ভালোবাসা মিশিয়ে জমে ওঠে ওদের খুশির বড়দিন।মেহুলকে কেন্দ্র করে বাচ্চাগুলোর মেতে ওঠে লাল,নীল,সবুজের মিলন মেলায়।ওদের বিছানার কাছে সান্টাদাদু উপহার না দিলেও ওদেরই এক ছোট্ট বন্ধু মেহুল আজ সান্টারূপে ফিরিয়ে দেয় একরাশ আনন্দ।
কই এখনও তো এলোনা ওরা।এদিকে ঘন ঘন শঙ্খ আর উলুধ্বনি আর বাড়িতে উপস্থিত মহিলাদের উচ্ছ্বসিত কলরব জানান দিচ্ছে বর এসে গেছে বরযাত্রী সহ।আর কিছুক্ষণের মধ্যে মুনিয়াকে ওরা বিয়ের মণ্ডপে নিয়ে বিয়ে দিয়ে দেবে।কিন্তু ওর এখন নবম শ্রেণী, দু চোখ ভরা আগামীর স্বপ্ন।পড়াশুনো শিখবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, উপার্জন করবে। অভাবের সংসারে বিধি বাম।ওর বাবা সুখেন হাঁসদা রাজমিস্ত্রির কাজ করে আর ওর মা অতসী গ্রামের ক্ষেতে মজুরের কাজ করে। মুনিয়ার পরে আরো দুই ভাইবোন আছে।
একটা পেট কমে গেলে সংসার খরচ কমবে এমন আশায় ওদের গ্রাম থেকে দুই গ্রাম পেরিয়ে এক পাত্রের সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছে ওর বাবা,মা। মুনিয়া তাই ওর এক বন্ধু কেকার মারফত ওই এলাকার বিডিও অহনা বসুকে খবর পাঠিয়েছিল।লোকমুখে ও শুনেছে তিনি নাকি অসম্ভব কড়া ধাঁচের মানুষ। কোনো অপরাধ বিশেষ করে মেয়েদের যে কোনো বিপদে আপদে ছুটে যান। তাহলে মুনিয়ার কথা শুনেও উনি এতক্ষণ কেন এলেন না? তবে কি খবরটা ওনার কানে পৌঁছায়নি? ওর সব স্বপ্ন কি এখানেই শেষ হবে?ভরা শীতেও এইসব কথা ভেবে যখন কুলকুল করে ঘামছে মুনিয়া ঠিক এমনসময় থেমে যায় সমস্ত কোলাহল।
কি হল দেখতে যাবে বলে ভাবছে ও এমনসময় দরজা টোকা পরে,”নাবালিকা বিবাহ অবিলম্বে বন্ধ হোক।আর তুমি নিশ্চিন্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এসো মুনিয়া।আমি থাকতে কোনো ভয় নেই তোমার।আমি শ্রীমতী অহনা বসু,তোমাকে নিতে এসেছি।জোর করে যারা তোমার বিয়ে দিতে চায় তাদের উপযুক্ত ব্যবস্থা আমি নেব।তোমার যতদিন ইচ্ছা কোনো হোমে থেকে পড়াশুনো চালিয়ে যাবে।”
সেই গলার কণ্ঠস্বরে কি এমন ছিল তাতে ভরসা পেয়ে বাইরে আসে মুনিয়া।আসমানী রঙের শাড়িতে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক মহিলা সাক্ষাৎ যেন ইচ্ছেপূরণের দেবী।শহরে নাকি খুব ঘটা করে বড়দিন উৎসব পালন করা হয়। সান্টাক্লজ বলে একজন নাকি সকলের মনের ইচ্ছা অনুযায়ী উপহার দেন।মুনিয়ার কাছে আজ বিডিও অহনা দিদিই ওর খুশির সান্টা তাইতো একটি সাধারণ মেয়ের মনের কথা শুনে সব কাজ ফেলে ছুটে এসছেন এভাবে।
“মা বাবাই কখন আসবে অফিস থেকে। আমরা সবাই মিলে সাজাবো ঘরটাকে ক্রিসমাস ট্রি,বেলুন, রিবন আর সান্টাক্লজ দিয়ে”রান্নাঘরে রাতের খাবার বানাতে ব্যস্ত তৃষার শাড়ির আঁচল ধরে বায়না করে ওর বছর পাঁচেকের মেয়ে ইমলি। মধ্যবিত্তের সংসারে আবার বড়দিন পালন!জোয়াল টানতে টানতে অনিমেষের বেহাল অবস্থা।তবুও ছোট্ট মেয়ের বায়না রাখতে বাবাকেই তো সান্টা সেজে ইচ্ছেপূরণ করতে হয় তাওয়াতে রুটি সেঁকতে সেঁকতে ভাবে ও আর মুখে বলে,”এইতো চলে আসবে এক্ষুণি।
তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পরো লক্ষ্মী মেয়ের মত। কাল সকালে উঠেই দেখবে সান্টা তোমার বার্বি ডল দিয়ে গেছে সাথে চকোলেট আর ভ্যানিলা কেকও দেবে।”খানিকক্ষণ পর আর জেগে থাকতে পারে না ইমলি। বাড়ি ফিরে অনিমেষ ঘুমন্ত মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে গিফটগুলো সাজিয়ে রেখে ঘর থেকে বেরোতে যাবে এমনসময় ওর নজরে আসে একটা সোনালী কাগজে মোড়া উপহারের প্যাকেট। উপরে ওর নাম লেখা।অদ্ভুত তো কে দিল এমন উপহার? কৌতুহলের বশে প্যাকেট খুলতেই ও দেখে একটা বটল গ্রীন রঙের টি শার্ট আর ওর পছন্দের পারফিউম।
কদিন আগে তৃষার এক খুড়তুতো বোনের বিয়ের জন্য কেনাকাটা করতে গিয়ে এমন একটা টি শার্ট দেখেও না দেখার অভিনয় করে শেষমেশ দামের কথা ভেবে পছন্দ হয়নি বলে না নিয়ে চলে এসছিল অনিমেষ। তার মানে ঘটনাটা তৃষার নজর এড়িয়ে যায়নি।ওই এসব কিনে এনেছে বোধয় সংসার খরচের টাকা থেকে। সত্যি কি যে করে পাগলিটা।মাসের শেষে অনিমেষ কি দোকানে ধারবাকি করতে বসবে? মধ্যবিত্তের টাকা থাকুক না থাকুক অন্তত সম্মানটুকু তো আছেই।ঋণ করতে বড্ড আত্মসম্মানে আঘাত লাগে ওর।
__”মেরি ক্রিসমাস অনি।কেমন লাগল সারপ্রাইজটা? যে মানুষটা সারাবছর আমাদের সবার ইচ্ছেপূরণ করে সান্টাক্লজের মত তার জন্য এটুকু তো করাই যায় তাইনা?”
__”সবই তো বুঝলাম।কিন্তু তৃষা বুঝতেই পারছ . অযথা এসব খরচ করার কি দরকার..”,কাঁচুমাচু মুখে বলে অনিমেষ।
__”আমি বুঝেছি তুমি ঠিক কি বলতে চাও। তাহলে এবার পুরো গল্পটা খুলেই বলি। বিয়ের আগে তো সেলাইয়ের কাজ জানা ছিলই আমার। আর এখন ইমলি একটু বড় হয়ে গেছে।তাই ভাবলাম নবরূপে ফিরে আসি আমি।কদিন হল তাই ক্রুশের সোয়েটার টুপি বোনা শুরু করেছি। ইমলির স্কুলে কিছু বাচ্চার মাও আমার কাছে অর্ডার দিয়েছে নানা জিনিসের।সেই রোজগার দিয়েই তোমার জন্য এগুলো কেনা”;স্বামী অনিমেষের বক্ষলগ্না হয়ে বলে তৃষা। বাইরের ঠান্ডাকে হার মানিয়ে উষ্ণতার আঁচে জমে ওঠে ওদের সুখী দাম্পত্যের জলছবি।রোজগার জীবনযুদ্ধে এক নাগাড়ে ছুটে অনিমেষের কাছে আজ ওর বউ তৃষা একঝলক ইচ্ছেপূরণের সান্টা।
আসলে সান্টাক্লজ বলে কিছু থাকুক বা নাই থাকুক আমাদের মনের কোণে জমে থাকা ইচ্ছেগুলো যার মাধ্যমে পূরণ হয় সেই প্রকৃত অর্থে সান্টাক্লজ।যারা অন্যের মুখে হাসি এনে দিতে নিজে প্রতিনিয়ত ছুটে চলেন কাজের তাগিদে। তাই এবারের বড়দিন জিঙ্গেল বেল বেজে উঠুক আমাদের আশপাশে ছড়িয়ে থাকা এরকম অসংখ্য চেনা অচেনা সান্টা যারা খুশি বিতরণের সাথে সাথে নিজেরাও প্রিয়জন মারফত খুঁজে পান খুশির ছোঁয়া।হৃদয়মাঝে বাজতে থাকুক রবিঠাকুরের লেখা চিরন্তন সেই সুর,”বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা”।।।