শব্দ

শব্দ

সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। একটা খুনের সাক্ষী দিব। আমার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রমাণ হবে আসামী দোষী নাকি নির্দোষ। আদালত চাক্ষুষ প্রমাণ বিশ্বাস করে। কিন্তু আমার সাক্ষ্য চাক্ষুষ নয়।

পাবলিক প্রসিকিউটর সেলিম খান আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। উকিলদের একটা স্বভাব হল তারা সহজ কথা জটিল করে প্রকাশ করে। সহজ একটা কেস, কিন্তু কেন যে ঘোট পাকাচ্ছে, আল্লাহই ভাল জানেন। সেলিম খান বললেন, ইয়োর অনার, এই কেসের একমাত্র সাক্ষী মি.জ্যাক। পাবলিক প্রসিকিউটরকে কাউন্টার করে ডিফেন্স ল’য়ার মামুন বলল, অবজেকশন ইয়োর অনার। তাকে সাক্ষী বলা সমীচীন হবে কিনা জানি না। কেন না তিনি কিছুই দেখেননি, শুধু শুনেছেন।

জজ সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, শুনেছেন মানে? গলার স্বরটা স্পষ্ট করার ভঙ্গিতে মামুন বলল, ইয়োর অনার, সাক্ষীর ভাষ্যমতে, খুন যে ঘরে হয় সেই ঘরে খুনি এবং ভিক্টিম ছাড়া কেউ ছিল না। সাক্ষী ছিল দরজার বাইরে। পাবলিক প্রসিকিউটর মামুন কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঘণ্টা পড়ে গেল। লাঞ্চের বিরতি। আমাকে পাবলিক প্রসিকিউটর তার অফিসে নিয়ে বসিয়েছেন। আমি বললাম, এখানে চা-সিগারেট খাওয়ার ব্যবস্থা আছে?

-অবশ্যই।

সেলিম খান নিজের পকেট থেকে সিগারেট বের করে দিলেন। একজনকে ডেকে চায়ের কথা বললেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী চা?

-চিনি ছাড়া র চা। সিগারেট ধরিয়ে চোখ বন্ধ করে টানছি। চোখ বন্ধ, কান খোলা। সিগারেটের তামাক পোড়ার মচমচ শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। খুবই মৃদু শব্দ, তবুও আমি স্পষ্ট শুনছি। সেলিম খান ইতস্তত বোধ করছেন। আমার পাশে এসে বললেন, আমি কিন্তু ভরসা পাচ্ছি না ভাই।

-কেন?
-না মানে, শুধু শব্দ শুনে কিভাবে আপনি নিশ্চিত হলেন যে আসামী মাসুম বিল্লাহ খুনি?
-সেটা আদালতেই প্রমাণ করি?
-আচ্ছা। আমি বাসা থেকে লাঞ্চ এনেছি। আপনিও খান আমার সাথে।
-ধন্যবাদ। আমার ক্ষুধা নেই। খাওয়ার সময় আপনার সামনে বসে সিগারেট টানলে সমস্যা নেই তো?
-না। চা চলে এসেছে। চায়ের কাপটা টেবিলে রাখতেই খট করে একটা শব্দ হল। আমি উকিল সাহেবকে বললাম, চায়ের কাপের নিচে ছোট্ট একটা ভাঙা দাগ আছে।

-দেখান তো।
-দেখাতে গেলে চা পড়ে যাবে। চা খেয়ে দেখাই। আপনি আপনার লাঞ্চ শেষ করুন।

আমি চা শেষ করে অফিসের বাইরে একটু হাটাহাটি করছি। কারও খাওয়ার সময় সামনে বসে থাকাটা বিরক্তিকর। এত বড় একজন উকিল কিন্তু সে লাঞ্চ করছে শুধুমাত্র দুইটা পরোটা আর ডালভাজি দিয়ে। টাকাপয়সা জমিয়ে এরা কী করবে? আমার পাশ দিয়ে একটা উকিল হেটে যাচ্ছে। তাকে ডেকে বললাম, ভাই শুনুন।

-জ্বি বলুন।
-আপনার জুতার সুকতলা ফেটে গেছে। যেভাবে হাঁটছেন, ঘণ্টাখানেক টিকবে কি না জানি না।

লোকটা আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মনেমনে পাগল বলে হয়তো গালিও দিচ্ছে। বাইরে থেকে সিগারেট টেনে সেলিম খানের অফিসে ঢুকলাম। সেলিম খান চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি স্মিত একটা হাসি দিয়ে বললাম, চায়ের কাপ উল্টে দেখেছেন তো?

-হুম।
-ভাঙা পেয়েছেন?
-হুম।
-গুড।
-চলেন, আদালতের কাজ শুরু হবে। জজসাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি খুনের দিন কী দেখলেন?
-আমি কিছুই দেখিনি স্যার, শুধু শুনেছি।
-কিন্তু আদালত শোনা সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না।

Eye Witness থাকা লাগবে। আর যাইহোক, Eye Witness ছাড়া কারও উপর খুনের অভিযোগ করা সম্ভব না। সেলিম খান কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, শুধুমাত্র দেখা সাক্ষ্যই যদি গ্রহণ করে আদালত, তাহলে কোন অন্ধ সুবিচার পাবে না।

-দেখুন মি. জ্যাক। আপনি অন্ধ না। আর অন্ধের সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে অভিযোগ নেওয়া হলেও তা প্রমাণ হওয়ার পর দোষী সাব্যস্ত করা হয়। জজসাহেবের সাথে তর্ক করতে বেশ ভালই লাগছে। এখন আমার সুযোগ এসেছে প্রমাণ দেওয়ার। আমি জজসাহেবকে বললাম, আগে আপনি আমার পরীক্ষা নিন। যদি আমি শব্দ শুনে সব বলে দিতে না পারি, তাহলে আপনি অভিযুক্তকে মুক্তি দিবেন।

আমাকে মোটা কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আদালতে পিনপতন নীরবতা। আমি অবশ্য কিছুকিছু শব্দ স্পষ্ট শুনছি। কারও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তার নিশ্বাস নেওয়ার ঘরঘর শব্দ। হাতঘড়ির সেকেন্ডের কাটার টিকটিক শব্দ। জজসাহেব পা নাচাচ্ছেন, সেই শব্দ। জজসাহেব বললেন, আপনার সামনে আপনার পরিচিত লোকদের আনা হবে তাদের কথা না শুনে শুধু তাদের হাটা এবং টুকটাক কাজের শব্দে আপনি নাম বলবেন।

আমি সম্মতি জ্ঞাপন করলাম। চোখ বন্ধ কিন্তু কান খোলা। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি- এই কথাটা আমার নয়। আমি বলব, কানের পাশে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। খটখট শব্দে কেউ হেঁটে আসছে। আমি বললাম, ডিফেন্স ল’য়ার মামুনের পায়ের শব্দ বুঝতে কষ্ট হল না। আমি জজসাহেবকে নাম বলে দিলাম। তারপর বললাম, অপরিচিত কাউকে আনেন। তার নাম না বললেও তার বর্ণনা দিতে পারব।

একটা নতুন শব্দ শুনতে পাচ্ছি। থপথপ করে হাঁটার শব্দ। আমি বললাম, আপনি চেয়ারে বসুন। লোকটা চেয়ারে বসল। আবার উঠে দাঁড়ালো। আমি বললাম, এবার কিছু বলুন। লোকটা বড় একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, আইনের চোখ অন্ধ। এবার আমি বললাম, আপনার উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। ওজন সত্তর থেকে বাহাত্তর কেজি। পায়ে হাফ ইঞ্চি হিলের জুতা, জুতার সাইজ আট। পরনে টিশার্ট এবং জিন্স। আপনার বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ। সবাই তাজ্জব বনে গেল। আমার চোখ খুলে দিয়ে জজসাহেব বললেন, আপনি কিভাবে বললেন?

-স্যার, আমি প্রত্যেকটা বস্তুর সূক্ষ্মতম শব্দটা পর্যন্ত শুনতে পারি। সেদিন আমি আমার পাশের ফ্ল্যাটের বাইরে থেকে খুনের সব শব্দ শুনতে পাই।
-কিভাবে খুন হয়েছিল?
-তার আগে আমি কি জানতে পারি, আমার সাক্ষ্য মূল্যায়ন করা হবে কি না?
-বিবেচনা করা হবে।

আমি একটু সময় নিয়ে বললাম, খুন হয় একটা এগারো ইঞ্চি লম্বা ছোরা দিয়ে। আসামীর পরনে ছিল প্যান্ট শার্ট, পায়ে ছিল নয় নাম্বার জুতা। সম্ভবত এপেক্স এর জুতা। এক ইঞ্চি উঁচু সুকতলা, প্রায় ছয় মাস পুরনো। আসামী কোন প্রমাণ ঘরে ফেলে গেছে।

-কী ফেলে গেছে?
-চাবির রিং জাতীয় কিছু। ওটা পড়ে ছিল ওয়ারড্রবের পিছনে।

এভিডেন্সের তালিকা থেকে জজসাহেব দেখলেন, আমার সব কিছু মিলে গেছে। আমি বললাম, ছোরা দিয়ে আঘাত করা হয়ে পেটের বাম পাশে, প্রায় চার ইঞ্চি ঢুকেছে। আদালতে আবারও পিনপতন নীরবতা। জজসাহেব রায় লিখলেন। তারপর পড়া শুরু করলেন, আদালত কোন শোনা শব্দের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ সাব্যস্ত করতে পারে না। কিন্তু যখন প্রত্যেকটা বিষয় মিলে যাচ্ছে, তাহলে আদালত এই সাক্ষ্য গ্রহণ করল। অভিযুক্ত আবু জাফরকে এই আদালত হাফিজ আহমেদকে খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছে। The case is closed.

বেশকিছু দিন মিডিয়ার চোখ এখন আমার দিকে। আমার ‘আধ্যাত্মিক’ ক্ষমতা নিয়ে তাদের বিভিন্ন গবেষণা চলছে। আর আমি আছি আমার জগত নিয়ে। আমার জগতটা আলোকিত না, তবে শব্দপূর্ণ। বিভিন্ন রকমের শব্দ। অনেক নিখুঁত শব্দ। দূর থেকে আসা ঝড়ের শব্দ কিংবা পিঁপড়াদলের মিছিলের শব্দ। সবই শুনতে পারি।

মিডিয়ার লোকদের এবং কিছু পারিপার্শ্বিক সমস্যার জন্য আমি ফ্ল্যাট ছেড়ে বাংলো বাড়িতে পড়ে আছি। বাসায় একা থাকি আমি। মনুষ্য শব্দ ইদানীং একঘেয়ে লাগছে। একা থাকলে এই শব্দ থেকে দূরে থাকা যায়। যদিও খুব একটা মুক্তি মেলে না। কফির মগ হাতে নিয়ে ড্রইং রুমে সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছি। একটা ইংলিশ মুভি চলছে। টিভির ভলিউম শূন্য। রিমোটটা হাতে নিয়ে ভলিউম বাড়ানোর জন্য টিভির দিকে ধরলাম। রিমোট টিপতেই পিরপির করে খুবই একটা সূক্ষ্ম একটা শব্দ শুনছি। রিমোটের মধ্য থেকে। সেদিক থেকে মনোযোগ দিলাম টিভির দিকে। একটা ইংলিশ মুভি চলছে টিভিতে। নাম Inception.

বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালানোর একটা দৃশ্য। গাড়ির শব্দ ঠিক আছে। কিন্তু মুভিতে দেখাচ্ছে কার, আর শব্দটা জিপের। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি ওটা ল্যান্ড ক্রুইজারের শব্দ। আর বৃষ্টির শব্দটাও কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা। একটা গাড়ি আরেকটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেলো। ধাক্কার শব্দটাও নকল। ওটা মূলত দুইটা কাঠের বাক্সের সংঘর্ষের শব্দ। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। পরবর্তী একটা দৃশ্যে মদের বোতল খোলা হচ্ছে। মদের বোতলের ছিপি খোলার টাক করে শব্দটা দারুণ লাগে। কিন্তু এই শব্দটা মুখের মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে ‘টারা’ বাজিয়ে করা।

রাত হয়েছে মাত্র। আমার বাংলো বাড়িতে সন্ধ্যার সাথে সাথেই রাত নেমে আসে। সন্ধ্যার পর আমি কিছু সফট মিউজিক শুনি। আমার প্রিয় গানের তালিকায় রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি। আর কিছু ইংলিশ সফট মিউজিকের গান। এই মুহূর্তে বাজছে টাইটানিকের বিখ্যাত গান, My heart will go on…

রান্না চড়াতে হবে। রান্না একটা শিল্প। যে যত ভাল রাঁধে সে ততই বড় শিল্পী। একা থাকার কারণে নিজেই রেঁধে খাই। বেশকিছু খাবারের রেসিপি আমি নিজে তৈরি করেছি। কার কাছে কেমন লাগবে জানি না। তবে আমার কাছে বেশ ভালই লাগে। আমার সবচেয়ে সহজ এবং মজাদার রেসিপি হল ইস্ত্রি ইলিশ। অন্য কেউ এটা করতে গেলে হয় মাছ পুড়িয়ে ফেলবে, নাহয় মাছ কাচা রেখে দিবে। কিন্তু আমি একদম পারফেক্ট রান্না করি।

প্রথমে মাছের আঁশ ছাড়াই। আঁশ ছারানোর শব্দটা খুবই সুন্দর লাগে। কেমন যেন ঘোর লাগা শব্দ। মাছের আঁশ ছাড়িয়ে মাথা এবং লেজ আলাদা করি। তারপর মাছটা সোজাসুজি দুইভাগ করি। ভাল করে ধুয়ে হালকা মশলা লাগাই। মশলার মধ্যে থাকে পাঁচফোড়ন, লবণ আর অল্প মরিচের গুড়া। এগুলো লাগিয়ে ইস্ত্রি গরম করি। খুব বেশি গরম করলে মাছ পুড়ে যাবে। দেড় থেকে দুই মিনিটে ইস্ত্রি গরম হলে মাছের উপর আলতোভাবে ধরে রাখি। মাছ সিদ্ধ হওয়ার শব্দ শুনতে পাই। হালকা সিদ্ধ হলেই মাছ রান্না হয়ে যায়। ইলিশ মাছ খুব অল্প আঁচে রান্না হয়। লবণ মাখিয়ে রোদে দশ থেকে পনেরো মিনিট রেখে দিলে মাছ রান্না হয়ে যায়। অথবা ভাত রান্না হওয়ার পর গরম ভাতের উপর দুই তিন মিনিটে ইলিশ মাছ রান্না হয়ে যায়।

আজকের মেনু ইলিশ মাছ আর খিচুড়ি। রান্নার কতটুকু হল এটা বোঝার জন্য শব্দটাই আমার জন্যে যথেষ্ট। চাল, ডাল, পেয়াজ, মরিচ, রসুন ইত্যাদি একবারেই দিয়ে দিলাম। সিদ্ধ হয়ে গেলে হালকা তেল দিলাম। অনেকে মনে করে বেশি তেল দিলে স্বাদ হয়। আসলে ব্যাপারটা তা নয়। সময়মত তেল অল্প দিলেও স্বাদ ঠিক হয়। খিচুড়ি ঢেকে রেখে দিলাম। আজ ইস্ত্রিতে ইলিশ ভাজি করব।

উল্টো করে ইস্ত্রি রাখলাম। গরম হওয়ার পর তেল দিলাম হালকা করে। তেল বেশি দিলে গড়িয়ে পড়বে। তারপর মাছ দিলাম ইস্ত্রির উপর। ছ্যাঁত করে উঠেছে। রান্না শেষ করে খাওয়াদাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়লাম। আজ খুব বেশি খাওয়া হয়েছে। লাইট নিভানোর পর কানে তুলো দিতে হয়। কারণ আলো আমার ঘুমের যতটা ব্যাঘাত ঘটায়, শব্দ তারচেয়ে বেশি। তেলাপোকার ফরফর করে উড়ে যাওয়ার শব্দেই আমার ঘুম ভেঙে যাই। যখনই তুলা দিতে যাবো তখনই দরজার বাইরে একটা শব্দ শুনলাম। ক্যামেরায় ছবি তোলার শব্দ। না, ক্যামেরার নয়, রিভলভারের কক করার শব্দ। তাহলে কি এই শব্দই আমার জীবন নিবে?

চোখ বন্ধ করে বাইরের প্রতিটা শব্দ শোনার চেষ্টা করছি। সামান্য ভয়ভয় লাগছে। ভয়ের জন্য শব্দ শুনতে সমস্যা হচ্ছে। ফিসফিস করে কথা শুনছি। তার মানে লোক একের অধিক। হঠাৎ পায়ের শব্দ শুনলাম। ভারী বুটজুতো পরা পায়ের শব্দ। তিন প্রকার শব্দ। তাহলে ওদের সংখ্যা তিন হতে পারে।

পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু পালিয়ে গেলে জানতে পারব না যে কে বা কারা আমাকে খুন করতে এসেছে। আমি ঘরের মেইন সুইচ অফ করে দিলাম। বাইরের আলো, ঘরের আলো সব বন্ধ। ওরা দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেছে। তিনজন এক সাথেই আছে। একজন আলাদা হয়ে গেছে। সম্ভবত আলো খোঁজার চেষ্টা। আমি ডাইনিং টেবিলের পাশে নিচে বসা। আমার পাশ দিয়ে একজন চলে গেল। আমি নিঃশব্দে উঠলাম। ওর পিছনদিক থেকে ঘাড় ধরে বাম দিকে মোচড় দিলাম। ক্যাচ করে একটা শব্দ। যথাসম্ভব আস্তে ওর বডিটা রেখে দিয়ে ওর হাত থেকে পিস্তল নিলাম। বাকি দুইজনের অবস্থান এখন আমার বেডরুমে। খটখট শব্দ পাচ্ছি। উঠে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। ওই ঘরের পাশের রুমে মেইন সুইচ। সেখানে পৌঁছানোর আগে আমার ওদের কাছে পৌঁছাতে হবে।

ছোট রুম। দুইজন রুমের দুই পাশে। একজন আলমারি খোলার চেষ্টা করছে। আরেকজন দেয়ালে কিছু হাতড়াচ্ছে। দুজনকে একসাথে ঘায়েল করা কঠিন হবে। আমি শব্দ শুনে দুজনের সঠিক অবস্থান বুঝতে পারছি। অপেক্ষাকৃত দূরের জনকে টার্গেট করে পায়ে গুলি করলাম। ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করে পড়ে গেল। অন্যজন অন্ধকারে আমার দিকে গুলি চালাচ্ছে। ততক্ষণে আমি মেঝেতে শুয়ে পড়েছি। ক্রোলিং করে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। তার হার্টবিটের শব্দ শুনছি স্পষ্ট। আমারও খুব জোরে হার্টবিট হচ্ছে। কিন্তু সে শুনতে পাচ্ছে না। নিকষ অন্ধকারে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। সেও স্থির দাঁড়িয়ে।

সে এটুকু বুঝতে পারছে না যে আমি তার সামনে। তার হার্ট বরাবর দুইশো কেজি ভরের একটা ঘুষি দিলাম। হার্টবিট দুই একটা মিস হয়ে গেছে মনে হল। দড়াম করে পড়ে গেল সে। তার হাত থেকে রিভলভার নিয়ে লাইট জ্বালালাম। হাঁটু চেপে একজন শুয়ে আছে। আরেকজন বুকে হাত দিয়ে পড়ে আছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার আগে পুলিশে ফোন করে জানিয়ে দিলাম। সিনেমায় ঘটনা শেষে পুলিশ আসে। বাস্তবেও তাই হল। অবশ্য পুলিশে জানানো কেউ ছিল না। আর পুলিশের শ্রবণেন্দ্রিয় আমার মত এত তীক্ষ্ণ নয় যে গোলাগুলির শব্দ শুনে হাজির হবে।

জানা গেল যারা আমাকে মারতে এসেছে তারা খুনের আসামী আবু জাফরের লোক। নিজেকে নিরাপদ রাখতে হবে আমার। আজ কপাল এবং বুদ্ধির জোরে বেঁচে গেলাম। কিন্তু কপাল এবং বুদ্ধি সবসময় সহায় হয় না। ঘুম কেটে গেছে। এক মগ কফি বানিয়ে বেলকনিতে বসা যায়। হাতে কফির মগ নিয়ে বেলকনিতে দাড়ানো- এই ব্যাপারটা সবকিছুর সাথে যায়। কেউ রোমান্টিক, সে কফির মগ নিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ চিন্তিত, এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কখনোই আমি রোমান্টিক নই, তবে চিন্তামুক্তও কখনো না। আসন্ন বিপদ নিয়ে চিন্তা করতে হলে কফির সাথে নিকোটিনের বিক্রিয়া ঘটানোই যায়।

পরদিন আমি ব্যাগপত্র নিয়ে শহরে, আগের ফ্ল্যাটে চলে এলাম। এখানে কোলাহল বেশি, তাই জীবনের ঝুঁকি কম। আমরা সবাই নিরাপত্তা চাই। একটা মশাও তার নিরাপত্তার কথা ভেবেই চড় খাওয়ার আগে উড়ে যায়। যে পারে না, সে তার আড়াইদিন জীবন শেষ হওয়ার আগেই খুন হয়। আমি মশা নই, তবে খুবই ভীতু। আর আমার নিরাপত্তারক্ষী হল আমার শ্রবণেন্দ্রিয়।

ইদানীং শব্দ আমাকে খুব টানে। মানুষের শব্দ ছাড়া সবকিছুর শব্দ শুনতে ভাল লাগে। রাস্তার পাশে বসে আছি। গাছের পাতায় বাতাস দোল খাওয়ার শব্দ, গাড়ির শাঁ শাঁ করে চলে যাওয়ার শব্দ, এমনকি পিপড়ার পিলপিল করে হেঁটে যাওয়ার শব্দ। থানায় ওসি সাহেবের সামনের চেয়ারে বসে আছি। তিনি খুবই বিরক্ত। কিন্তু কার উপর বিরক্ত এটা বোঝা যাচ্ছে না। আমি যে কয়জন ওসি বা পুলিশের বড়কর্তাদের দেখেছি, সবার চেহারায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।

-আপনি আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী? বুঝতে পারলাম তিনি আমার শ্রবণক্ষমতার উপর বিরক্ত। বিশ্বাস করতে পারছেন না।
-না। এটা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা না।
-তাহলে এটা কী যে আপনি শব্দ শুনে সবকিছু বলে দিতে পারেন?

আমার উত্তর আশার আগেই ওসি সাহেবের ফোন কেঁপে উঠল। তিনি ফোন রিসিভ করে বললেন, হ্যালো মামনি।
ওপাশের কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।

-ইয়েস পাপা।
-কী কর?
-স্কুল থেকে এইমাত্র ফিরলাম।
-ঠিক আছে। ফ্রেশ হও। লাঞ্চ করে নিও। ফোন রাখার আগেই আমি চিৎকার করে বললাম, প্লিজ ফোন রাখবেন না। ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছেন। বিরক্তিকে দ্বিগুণ করে জিজ্ঞেস করলেন, কেন মি.জ্যাক?

-আপনার মেয়ে ফ্যানের নিচে আছে। ফ্যানটা খসে পড়বে।
-আপনি ভবিষ্যৎবাণী করছেন?
-না। যা ঘটবে তাই বলছি।
-হাহাহা। আপনি বদ্ধ উন্মাদ।
-আচ্ছা, আপনি বজ্রপাত শুনে বলতে পারেন যে বৃষ্টি হবে কি না?
-হ্যাঁ, এটা বলা যায়।
-ঠিক। আর আমি এর থেকে সূক্ষ্ম শব্দগুলো শুনতে পাই। আপনি আপনার মেয়েকে সরে যেতে বলুন। নাহলে…
-আপনার ক্ষমতা নিয়ে থাকেন। এই কাগজে স্টেটমেন্ট লেখেন। তারপর ভাগেন।

আমি বিবৃতি দিয়ে চলে এলাম। ঘুম ভাঙল ওসির ফোন পেয়ে। বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ওসি সাহেব বললেন, এখনি তার বাসায় যেতে। আমি সম্মতি জ্ঞাপন করে ফোন রাখলাম। ঠোঁটে বিদ্রূপের হাসি। কারণ আমি শুধু ওসি সাহেবের কণ্ঠ শুনিনি, তার সাথে শুনেছি স্পষ্ট এক শব্দ। নিস্তব্ধ পরিবেশ। যাকে বলে পিনপতন নীরবতা। ওসি সাহেব ড্রইংরুমে বসে আছেন। তার সামনে পসরা সাজানো। সম্ভবত ওসি সাহেবের স্ত্রী, তিনি দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি তাকে বললাম, ম্যাডাম, ব্যস্ত হবেন না। আমি ওসি স্যারের সাথে কথা বলে চলে যাব।

-রাতে আমাদের সাথে খেতে হবে। কী খাবেন বলেন।

এতো বিপদ। মানুষের বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণে আমার খুব বিপত্তি। ইচ্ছা করে না। তাই আলাদা থাকি। কী করব বুঝতে পারছি না। আমি স্মিত হাসি দিয়ে চলে এলাম। ওসি সাহেবের সামনের টি-টেবিলে দুইটা বিদেশী বোতল, দুইটা গ্লাস আর একটা বাটিতে বরফের টুকরা। বোতল থেকে পানীয় ঢালতে ঢালতে আমাকে ইশারায় বসতে বললেন। ততক্ষণে ওসি সাহেবের স্ত্রী নিজের হাতে নাস্তা নিয়ে এসেছেন। নাস্তার মধ্যে আছে চিকেন ফ্রাই, নুডুলস। লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, মি.জ্যাক, আপনি কী করেন? এই প্রশ্নটা আগে করা উচিৎ ছিল যখন প্রথমবার দেখা করলাম থানায়। আমি বললাম, বলার মত কিছু করি না।

-আপনি কী করেন আর না করেন, তা নিয়ে মাথাব্যথা নাই। কিন্তু একটা কথা বলেন তো, আপনি কিভাবে জানলেন যে আমার মেয়ের উপর ফ্যান পড়বে?
-তার ব্যাখ্যা তো আগেই দিয়েছি। আর আপনার সাথে পরিচয়ের কারণও কিন্তু ওইটা। শব্দ।
-আপনি শব্দ শুনে সব বোঝেন?
-হ্যাঁ। ওসি সাহেব মদ ঢালছেন। বুদবুদের শব্দের ছন্দটা বেশ লাগছে। ওসি সাহেব আমাকে গ্লাসের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, চলবে?
-হুম। এসবে না বলতে নেই।

গ্লাসে সামান্য মদ ঢেলে একটা টুকরা বরফ অনেক উপর থেকে ছাড়লাম। অন্যরকম একটা শব্দ হল। ভ্রুকুঞ্চিত করে আরেক টুকরা বরফ নিলাম। আবারও ফেললাম গ্লাসে। এবার আরেকটা শব্দ। ওসি সাহেবের নেশা কেটে যাচ্ছে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কোন সমস্যা?

-না। শব্দ শুনছি।
-এখানে বিশেষ কী শব্দ?
-আছে। আপনি বুঝবেন না।

আমি উঠছি। মাথায় অন্যকিছু ঢুকে গেছে। ওসি সাহেবের মেয়েটাকে না দেখেই চলে এলাম। খুব মাথাব্যথা করছে। একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। রাস্তার কোলাহলের শব্দ আমাকে টানে। সেই টানকে উপেক্ষা করে ঘুমাতে হবে।

আমি ঘুমিয়ে আছি নাকি জেগে আছি বুঝতে পারছি না। চোখ বন্ধ কিন্তু কান খোলা। চোখের মত যদি কানেরও পাতা থাকতো, তাহলে ভালই হত। চোখ যেমন অনেক কিছু অগ্রাহ্য করার জন্য বন্ধ হয়, তেমনি কানও অনেক শব্দ অগ্রাহ্য করার জন্য বন্ধ হত। কী অদ্ভুত ব্যাপার! তবে দেখা এবং শোনার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হচ্ছে মস্তিষ্ক। কোন দিকে যদি আমাদের খেয়াল না থাকে, তাহলে সেই জিনিস দেখা বা সেই জিনিসের শব্দ আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি না। আমার কানে ফ্যান ঘোরার শব্দ আসছে। ট্যাপ থেকে টুপটুপ করে পানির ফোঁটা পড়ার শব্দ, বাতাসে জানালার কপাট বাড়ি খাওয়ার শব্দ। হঠাৎ করে একটা শীতল শব্দ পেলাম। মধ্যরাতে সাগরের বুকে ঢেউয়ের শব্দ যেমন, সেরকম শব্দ। এই প্রথম শব্দের ভাষা বুঝতে পারছি না। চোখ খুলব নাকি বুজে থাকব? চোখ খুললে হয়তো আমি নিজেকে অচেনা যায়গায় আবিষ্কার করব। তারচেয়ে আরও কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বোঝার চেষ্টা করি ব্যাপারটা আসলে কী?

কাঠের জানালা ধীরগতিতে খুলছে। কচকচ শব্দ। বাতাস লেগে জানালার কপাটের কচকচ শব্দটা বেশ লাগছে। বুটজুতো পরা পায়ের থপথপ শব্দ পাচ্ছি। তারমানে কেউ আমার পাশে আছে। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে দুইজন বা তিনজন। মেঝেতে খট করে একটা শব্দ হল। পুলিশের রোলার লাঠি দিয়ে মেঝেতে আঘাত করলে যেমন শব্দ হয়, সেরকম শব্দ। আর চোখ বুজে থাকার মানে হয় না। চোখ খুলেই আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম। তীব্র আলো আমার চোখে লাগছে। অসহ্য যন্ত্রণা! অন্ধের চোখ অপারেশন করার পর ডাক্তার যেমন বলে, আস্তে আস্তে চোখ খুলুন, আমিও আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। দুইশো ওয়াটের একটা বাল্ব জ্বলছে আমার মাথার উপর। সামনে একটা চেয়ারে পিছন ফিরে বসা আছে কেউ। কোন শব্দ নেই, শুধুমাত্র জানালার কপাট নড়ার শব্দ ছাড়া। আমি কিছু বলব কি না ভাবতে লাগলাম।

আমার ভাবনা শেষ হওয়ার আগে সামনের লোকটা উঠে দাঁড়ালো। এবার তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। লাইটের আলো তার বুক পর্যন্ত পড়েছে। হেঁটে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। হাঁটার ভঙ্গি দেখে বুঝতে পারলাম লোকটা আবু জাফর। খুনের আসামী। যার সাজা হয়েছিল আমার সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে। ভারী গলায় বলল, আমাকে চিনতে পারছেন মি.জ্যাক? প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেওয়ার সাথে সাথে তার মুখে আলো পড়ল। মাথায় মাফলার জাতীয় কিছু একটা পেঁচানো। মুখে চাপদাড়ি।

-হুম, চিনেছি। আবু জাফর।
-গুড। আমাকে দেখে অবাক হচ্ছেন না?
-হয়েছিলাম। এখন হচ্ছি না।
-আমি জেল থেকে বের হলাম কিভাবে জানতে চাইলেন না?
-আমার যেমন শব্দ শুনে সব বোঝার ক্ষমতা আছে, আপনার হয়তো জেল থেকে পালানোর ক্ষমতা আছে।
-হাহাহা। ভেরি ইমপ্রেসিভ। আপনার সেন্স অব হিউমার দেখে ভাল লাগল। হ্যাঁ, এটা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা কি না জানি না, তবে আমি জেল থেকে পালাতে পারি।
-আমাকে খুন করার জন্য ধরে এনেছেন?
-না, আপনার সাথে দাবা খেলার জন্য ধরে এনেছি।

আবু জাফরের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে একটা লোক একটা দাবার সেট নিয়ে চলে এসেছে। আমিও স্বাভাবিকভাবে উঠে এলাম আবু জাফরের সাথে দাবা খেলার জন্য। চুপচাপ খেলছি। দাবার গুটিগুলো বেশ ভারি। চাল দিয়ে অন্যরকম মজা। আবু জাফর বলল, আপনি খুবই বোরিং পারসন। কথা কম বলেন নাকি?

-কম বলি না। তবে অপ্রয়োজনে কথা বলতে পছন্দ করি না।
-কিছুক্ষণের মধ্যে আপনাকে খুন করব, এটা কি বুঝতে পারছেন?
-হুম। সেরকম শব্দ পাচ্ছি।
-কেমন শব্দ?
-লোহার সুচালো শিক গরম করা হচ্ছে। তা দিয়ে সম্ভবত আমার কানে ঢুকানো হবে।
-অবাক হচ্ছি। আপনি কিভাবে জানলেন?
-পাশের ঘরে এটা করা হচ্ছে। যে ছেলেটা এসেছিল, সেই করছে। ঠিক বললাম?
-হুম। আমি আবু জাফরের ঘোড়া খেয়ে দিলাম। সে আমার মন্ত্রীর পিছে পড়ে আছে। আবু জাফর আমাকে বলল, আপনি আমার বিরুদ্ধে কেন সাক্ষ্য দিয়েছিলেন?

-আমি আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেইনি। আমার সাক্ষ্য আপনার বিরুদ্ধে গেছে। আপনি কেন লোকটাকে খুন করেছিলেন?
-লোকটা আমার অনেক বড় ক্ষতি করেছে। কী ক্ষতি করেছে, তা বলতে চাচ্ছি না।
-আপনার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার।

আবু জাফর আমার মন্ত্রী খেয়ে দিয়েছে। তারপরই আমি নৌকা দিয়ে চেক দিলাম। আবু জাফর একবার আমার দিকে, একবার দাবার দিকে তাকাচ্ছে। এত সহজে হেরে যেতে চাচ্ছে না হয়তো। আমি বললাম, আপনার কী মনে হয়? আমাকে খুন করতে পারবেন? আমার এই প্রশ্ন দাবার চেকের মত কাজ করল। সে আমার নৌকা খেয়ে দিল তার মন্ত্রী দিয়ে। আমি আমার হাতি দিয়ে চেক দিয়ে বললাম, চেক অ্যান্ড মিট। আবু জাফর হা হয়ে গেল। রাজার চাল আছে একটা। সেই ঘরে গেলে আমার আরেকটা নৌকায় খেয়ে নেয়।

আবু জাফর বলল, আপনি দাবা বেশ ভাল খেলেন। তবে আপনার জন্যেও ভাল হল। মৃত্যুর আগে হেরে যাওয়াটা যথেষ্ট লজ্জার। ফাঁসির আসামীকে ফাঁসির দিনে জিজ্ঞেস করা হয়, তার প্রিয় খাবার কী। আপনাকেও জিজ্ঞেস করছি, আপনি মৃত্যুর আগে কী খেতে চান? আমি আবু জাফরকে অবাক করে দিয়ে বললাম। আজ পূর্ণিমা। জোসনা খেতে চাই। নিজেকে সামলে নিয়ে আবু জাফর বলল, দুঃখিত। আপনার এই চাওয়া পূরণ করা যাচ্ছে না। আর কিছু?

-একটা গান শোনানোর ব্যবস্থা করেন।
-কী গান?
-‘আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে’- রবীন্দ্রসংগীত।

আমাকে অবাক করে দিয়ে আবু জাফর নিজেই গান ধরল, আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে। ভোরের আল মেঘের ফাঁকে ফাঁকে পিছু ডাকে পিছু ডাকে আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে।। বাদল প্রাতের উদাস পাখি ওঠে ডাকি বনের গোপন শাখে শাখে পিছু ডাকে পিছু ডাকে। আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে।। ভরা নদী ছায়ার তলে ছুটে চলে খোঁজে কাকে পিছু ডাকে।। আমার প্রাণের ভিতর সে কে থেকে থেকে বিদায় প্রাতের উতলাকে পিছু ডাকে পিছু ডাকে আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে।।

আমি সত্যিই স্তম্ভিত। আবু জাফরকে দেখে বা তার কথা শুনে আমার কখনো মনে হয়নি সে এত সুন্দর গাইতে পারে। তার কণ্ঠের সুর এই পৃথিবীর নয়, অন্য জগতের কথা বলে। গান শুনে প্রশংসা করার মত ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। সজ্ঞানে নাকি অজ্ঞানে জানি না, আমি বলেউ ফেললাম, আপনার কণ্ঠে এত মধুর গান শুনে, আপনার হাতে মরেও সুখ লাভ হয়। আমি পৃথিবীর কাছে বলে যাচ্ছি, আমার মৃত্যু সুখের মৃত্যু।

কথা শেষ হওয়া মাত্র দেখলাম পাশের ঘর থেকে লোকটা চলে এসেছে। তার হাতে লোহার লোহিত গরম শিক। ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। এই শিক আমার এক কানের মধ্য দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হবে। মাঝপথে মস্তিষ্ককে পোড়াবে যাকে বলে ‘বারবিকিউ’। আমি কল্পনায় মস্তিষ্ক পোড়ার চটচট শব্দ পাচ্ছি। নাহ, আর বসে থাকার মানে হয় না। কিছু একটা করতে হবে। এক্ষণি।

চারিদিকে জোসনা থইথই করছে। আবু জাফর থেকে আমি এত সহজে চলে আসতে পারব- ভাবিনি। লোকটা লোহার শিক হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি ভারী দাবার গুটি তুলে দুইশো ওয়াট বাল্বের দিকে ছুড়লাম। মুহূর্তের মধ্যে ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। বিকল্প আলোর ব্যবস্থা করার আগে ভাঙা জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে বের হয়ে এলাম। অন্ধকারে জানালা খুঁজে পেতে আমার কষ্ট হয়নি। জানালার কপাটে কচমচ শব্দটাই আমাকে জানান দিয়েছে, যাও, এই পথে পালিয়ে যাও। ইচ্ছা করছে আবু জাফরের কাছে ফিরে যাই। তাকে এই জোসনা রাতে ডেকে আনি। তাকে শুনিয়ে দিই আমার গলায়, আজ জোসনা রাতে সবাই গেছে বনে আজ জোসনা রাতে সবাই গেছে বনে। বসন্তের এই মাতাল সমীরণে…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত