তখনো আমি শুভ্র কে সন্দেহ করিনি,যখন নীলু আমায় ফোন করে বলেছিল-
-নীরা আপা,তুই অনেক লাকি রে।দুলাভাই তো জানে না ফেইসবুকে আমার পেইজ আছে।না জেনেই আমার পেইজে তোর জন্য ২টা শাড়ি অর্ডার করেছে।খুবই সুন্দর।তোকে ছবি পাঠাবো?
-কি বলিস?আমার জন্মদিন তো দেরী আছে,আর এনিরভার্সারি ও গেলো কিছুদিন আগে।হঠাত আবার শাড়ি কেন?
-আরে কপাল করে এসেছিস আরকি।আচ্ছা,তোকে ছবিগুলো দিচ্ছি।
নীলু আমাকে ছবিগুলা পাঠানোর পর দেখলাম ২ টাই পাতলা নেটের পার্টি শাড়ি যেগুলা আমি পরি না।তারপরও কিছু আর ভাবলাম না।অপেক্ষা করতে লাগলাম কবে সে সারপ্রাইজ দিবে। তারপর দিন গিয়ে মাস গড়ালে ভুলেই গিয়েছিলাম শাড়ির কথা। হঠাত নীলু আবার ফোন করল,
-আপা,দুলাভাই আজকে খুব সুন্দর দামী একটা নেকপিস অর্ডার করেছে।আর আমার পেইজের শাড়ি দুটো কেমন লাগলো বললি না তো?
তখন মনে পরল,শুভ্র তো আমাকে কোনো শাড়ি ই দেয়নি। আমি ভালো হ্যাঁ,হুম বলে ফোন রেখে দিলাম। ভাবতে লাগলাম শুভ্র শাড়ি,নেকপিস এসব কাকে দিচ্ছে?আমায় তো দেয়নি,কিছু বলেও নি। রাতে শুভ্র বাসায় আসার পর একসাথে ডিনার শেষ করেই সে ল্যাপটপ নিয়ে বসে অফিসের কাজ শেষ করতে।
আমি আমার বানানো নতুন ডেজার্ট নিয়ে এসে পাশে বসে ২জন খাই,আর গল্প করি।। গল্প বললে ভুল হবে,আমি একাই বকবক করি,শুভ্র ল্যাপটপে কাজ করে আর আমি খাইয়ে দিই।ইদানিং খুব ব্যস্ত হয়ে গেছে সে কাজে।
-নীরা,ঘুমিয়ে পরো,যাও। রাত জেগো না আমার জন্য।আমার কাজ শেষ করে ঘুমাতে দেরী হবে।ও আচ্ছা,আমার মোবাইল টা চার্জ থেকে একটু দিয়ে যেয়ো তো। বেডরুমে গেলাম মোবাইল আনতে,মোবাইল টা হাতে নিতেই একটা টেক্সট এলো অপরিচিত নাম্বার থেকে- “লেইট নাইট এ ভিডিও কলে এসো,একা একা লাগছে।”
ম্যাসেজ টা পড়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো,ধপ্পাস করে খাটে বসে গেলাম।কি হচ্ছে এসব বুঝতে পারছিলাম না।মোবাইলের স্ক্রিন টা লক করে মোবাইল টা নিয়ে শুভ্রের কাছে দিতেই সে মোবাইল টা পাশে রেখে আমার হাত ধরে টেনে আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল-যাও ঘুমিয়ে পরো লক্ষীটি। গুড নাইট। চলে যাচ্ছিলাম,হঠাত পিছন থেকে শুভ্র ডাক দিল, নীরা,নেক্সট উইকেন্ড পর এক্সট্রা ২ দিন বন্ধ আছে।আর উইকেন্ড ২ দিন।মোট ৪দিন,কোথাও ঘুরতে যাবে?চাইলে মালদ্বীপে যেতে পারি প্যাকেজে,কি বলো? হুম,যাওয়া যায়।দেখো সব ঠিকঠাক হলে বুকিং দাও। আচ্ছা,যাও,কালকে রাতে এ ব্যাপারে কথা হবে।গুড নাইট।
সারারাত ঘুমাতে পারি নি,কান্না করে করে বালিশ ভিজিয়েছি।হঠাত ই বুঝলাম শুভ্র রুমে আসছে,তখনি ওর মোবাইলের রিংটোন টা বেজে উঠলো সাথে সাথেই থেমে গেলো আওয়াজ।শুভ্র পাশে এসে শুয়ে ঘুমিয়ে গেলো। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই।কত ভালবাসি এই শুভ্র কে আমি,আর শুভ্র যে আমায় কত ভালবাসে এতদিন বড়াই করে বলেছি সবাইকে।সবাই আমাদের ভালবাসা দেখে হিংসা করত।
তবে হ্যাঁ,আমাদের বিয়ের ৫বছর হলেও কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই আমাদের।সমস্যা টা আসলে আমাদের কারোর ই না,আবার দুইজনের ই অল্প বিস্তর সমস্যা আছে।কিন্তু বাচ্চা হবে না এমন কথা কোনো ডাক্তার ই বলেন নি।
বাচ্চা হচ্ছে না বলে শুভ্রের মনে কখনো আফসোস দেখিনি,আমি মন খারাপ করলেই আমাকে ঘুরতে নিয়ে যায় দেশের ভিতরে,বাইরে।অনেক জায়গায় ঘুরেছি আমরা একসাথে।আমাকে কখনোই মন খারাপ করে থাকতেই দেয় না, সেই শুভ্র কিভাবে অন্য নারীর সাথে সম্পর্কে…. না না,আর কিছু ভাবতে চাই না।আমি একা থাকতে চাই কিছুদিন,কিন্তু এই অবস্থায় শুভ্র কে একা বাসায় রেখে যেতেও কেমন লাগছে। না,এভাবে ভেঙে পরলে চলবে না,আমি আমার জায়গা ছেড়ে দিব না।ভাবতে ভাবতেই সকাল হয়ে গিয়েছিল। সকালে শুভ্র অফিসে যাবার আগে বলে গেলো আজ সন্ধ্যায় কিছু গেস্ট নিয়ে আসবে,অফিসের বস ও আসবে কিছু যেন রান্নাবান্না করে রাখি রাতের জন্য আর যেন সুন্দর কোনো শাড়ি পরে রেডি হয়ে থাকি।
সারাদিন ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকার পর বিকালে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালাম।গায়ের রঙ টা মনে হয় আরেকটু ফর্সা হয়েছে।দেখতে খুব ফর্সা ছিলাম না আমি,উজ্জ্বল শ্যামবর্নের রঙ ই শুভ্রের খুব পছন্দ ছিল।একটু মোটা মোটা লাগছে,চোখের নিচ টা কালো কালো লাগছে।আলমারি থেকে কালো রঙের একটা শাড়ি বের করে পরলাম,চোখে মোটা করে কাজল দিলাম। বিল্ডিং এর নিচেই ফুলের দোকান,দারোয়ান কে দিয়ে বেলী ফুলের মালা এনে হাতে জড়ালাম। টিং টং কলিং বেল বাজতেই,শাড়ি সামলে,হিজাব ঠিক করে দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে তাকিয়ে সালাম দিব ভেবে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম,এ কি দেখছি আমি!? দরজা খুলার পর দেখি শুভ্রের সাথে ২ জন ছেলে কলিগ আরেকজন মেয়ে কলিগ দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটির গায়ের শাড়িটি খুব বেশি পরিচিত লাগছিল,ক্ষণিকেই মনে পরে গেলো শাড়ি টা নীলুর পেইজের সেই শাড়ি যা শুভ্র আমার জন্য অর্ডার করেছিল ভেবেছিলাম!
-এই নীরা,কি হয়েছে তোমার?আর কতক্ষণ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে?ভেতরে এসো,সবাইকে জিজ্ঞেস করো।
-ওহ,সর্যি।আসছি।
-তোমার কি শরীর খারাপ?
-না না,ঠিক আছি আমি।চলো।
ভেতরে গিয়ে দেখি সবাই বসে গল্প করছে।আমি ভিতরে ঢুকতেই শুভ্রের মেয়ে কলিগ টা উঠে এসে আমাকে ধরে বলল-বাহ,ভাবী তো অনেক প্রিটি।অনেক সুন্দর লাগছে তো ভাবী কে কালো শাড়িতে।আমি জোড় করে যেন পানসে হাসি দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকাতেই দেখি শাড়িটা এত পাতলা তার ব্লাউজের বড় গলা ভেদ করে শরীরের অনেকাংশ দেখা যাচ্ছে।
-নীরা,উনার নাম সুবাহ।তোমার রান্নার অনেক সুনাম করি,তাই আজকে তোমার কাছে রান্না শিখতে ও টেস্ট করতে নিয়ে এসেছি।কি?ভালো করেছি না? আমি শুধু পানসে হাসি দিয়েই যাচ্ছি।রাতে সবাই একসাথে ডিনারের পর ডেজার্ট খেতে খেতে গল্প করছিলো সবাই।আমি সুবাহ মেয়েটার আচরণ দেখছিলাম,অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে,সে তেমন একটা শুভ্রের দিকে তাকাচ্ছে না বা তার পাশে এসেও ঘেঁসে বসে নি একবারো। রাতে সবাইকে বিদায় দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি খুলছিলাম,হঠাত শুভ্র পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে কাঁধে চুমু খেয়ে বলল-আজ তোমাকে কেন যেন খুব বেশি মায়াবী লাগছিল।
-কেন?অন্যদিন বুঝি খারাপ লাগে দেখতে?
-আহ!কি যে বলো না।আমার বউ কে কখনোই খারাপ লাগে না।তবে আজ একটু বেশি ই সুন্দর লাগছিল।আচ্ছা,কাল তো শুক্রবার,চলো আজ হরর মুভি দেখি কোনো।
আমার খুব ক্লান্ত লাগা সত্ত্বেও রাজি হয়ে গেলাম।আমি চাইছিলাম শুভ্রের সাথে বেশি বেশি সময় কাটাতে,ব্যাপার টা বুঝতে।কিন্তু আজকে অফিসের কলিগ ই যে সেই মেয়েটা তাতে কোনো সন্দেহ নেই,কিন্তু মেয়েটার আচার ব্যবহারে খুব বেশি কিছু বোঝা গেলো না। শুভ্র ওয়াশরুমে যেতেই আমি ওর মোবাইল চেক করা শুরু করি,কোনো ম্যাসেজ নেই।এমনকি সেদিনের আনসেইভড নাম্বারের ম্যাসেজ টা ও নেই।সন্দেহ টা আরো যেন বেড়ে গেলো। তবে কি শুভ্র আন্দাজ করতে পারছে যে আমি জেনে গেছি ব্যাপারটা? খাটের উপর শুভ্রের শার্ট টা নিয়ে লন্ড্রি বাস্কেটে রাখতে যাবো,হঠাত দেখি শার্টের কাঁধের পাশে এক জায়গায় একটুখানি লাল রঙ,লিপ্সটিকের রঙ!
চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পরল শার্টে। এমন সময় ই ওয়াশরুম শুভ্রর থেকে বের হবার শব্দ শুনে চোখ মুছে অন্য রুমে কাজ গোছাতে চলে গেলাম। রাতে হরর মুভি দেখলেই আমি শুভ্রের কোলে মাথা রেখে কাঁথার নিচে শুয়ে শুয়ে দেখি,বেশি ভয়ঙ্কর সিন আসলেই কাঁথার নিচে মুখ লুকাই। আজকে আর শুভ্রের কোলে মাথা রাখার রুচি হয়নি আমার,কিন্তু হঠাত ওর ফোনের রিংটোনে ঘুম ভেঙে দেখি আমি ওর কোলেই শুয়ে ছিলাম।আমার মাথা টা আস্তে করে বালিশে রেখে মোবাইল টা নিয়ে একটু দূরে গেলো। আমি আড়ি পেতে শুনতে লাগলাম তাদের কথপোকথন।
-হ্যালো,পৌঁছেছো? হ্যাঁ,ও তো ঘুমাচ্ছে। হা হা হা,আচ্ছা,তাই নাকি? ওকে,নীরা জেগে যাবে,পরে কথা হবে।বাই।
আমি চুপটি করে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকলাম,ও এসে আবার আমার মাথায় হাত দিতেই চোখ খুলে বললাম-মুভি এখনো চলছে?দেখি কয়টা বাজে বলে ওর মোবাইল টা হাতে নিয়ে কল লিস্টে ঢুকে দেখি একটু আগে সুবাহর নাম্বার থেকেই কল টা এসেছিল। এভাবে আমার সন্দেহের উপরই দিন চলে যাচ্ছিল,মনের ভেতরে আমি পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিলাম।কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছুই বলতে পারছিলাম না কাউকে। হঠাত একদিন শপিংমলে একা একা কেনাকাটা করে ক্লান্ত হয়ে ফুডকার্টে জুস খেতে গিয়ে দেখি,শুভ্র আর সুভা ২ জন জুস খাচ্ছে আর বসে গল্প করছে। আস্তে করে নেমে গিয়ে,শুভ্রকে কল দিলাম।
-কোথায় তুমি?
-আমিতো একটা মিটিং এর জন্য প্রিপেয়ার হচ্ছি।ক্লায়েন্ট এর সাথে মিটিং আছে।
-ও,আচ্ছা।কখন আসবে বাসায়?
-এইতো,অফিস শেষেই চলে আসবো।
-আচ্ছা,রাখি তাহলে।বাই।
শুভ্র আমাকে এভাবে মিথ্যা বলতে পারে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। আমার মাঝে কিসের কমতি যে শুভ্র আমাকে এভাবে চিট করছে! ছি!নিজেকে যে কেমন ছোটো মনে হচ্ছে তা এই দুনিয়ার কাউকে বুঝাতে পারব না। কোনোভাবে বাসায় এসে ফ্লোরে বসে অনেক্ষণ কান্নাকাটি করে মা কে কল দিয়ে বললাম কিছুদিন মা এর কাছে থাকবো।আজই আসছি। রাতে শুভ্র বাসায় এসে আমায় না পেয়ে ফোনের পর ফোন দিয়েছে নিশ্চয়ই।কিন্তু আমার ফোন ছিল বন্ধ। মায়ের কাছে ফোন এলো,মা যখন বলল আমি মা এর কাছে তখন সে রাতেই আমাকে নিতে আসতে চেয়েছিল।কিন্তু মা বলেছিল আমি অসুস্থ,তাই কিছুদিন থাকতে চাই। শুভ্র আর কথা বাড়ায়নি। আর কথা বাড়িয়েও বা কি,ওর মত মানুষের সাথে আমার আর কথা বলতেও রুচিতে বাঁধে।
এভাবে ৩দিন চলে গেলো।আমার অস্থির লাগতে শুরু করলো।শুভ্রকে ফোল ফিলাম,সে রিসিভ করল না।
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই রওনা দিলাম বাসার উদ্দেশ্যে। সকালে ফ্রি রাস্তা,৪০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম।আমার কাছে এক্সট্রা একটা চাবি ছিল,সেই চাবি দিয়ে বাসায় ঢুকে দেখি ড্রয়িং রুমের সব কিছু এলোমেলো।কেমন যেন নিজের ঘর টা কে নিজের অপরিচিত লাগছিল।এই বাসায় শুধু আমি আর শুভ্র একাই থাকি বিয়ের পর থেকেই।
বেডরুমের দরজা লাগানো,বাইরে থেকে কেমন যেন ফিসফিস আওয়াজ পাচ্ছি।আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। একটা মেয়ের গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে দরজা টা খুলেই ফেললাম। এসি ছেড়ে কম্বল গায়ে দিয়ে শুভ্র ঘুমাচ্ছে,কি যে মায়া লাগছে দেখতে।আর ফিসফিস আওয়াজ টা আসছিল বেডরুমের টিভি থেকে।টিভি ছেড়ে শুভ্র ঘুমিয়ে গেছে।যাক,বুকের মাঝে অনেক বড় পাথর বেঁধে ছিল তা সরল। কিন্তু শুভ্র তো ধোয়া তুলসী পাতা না তা তো আমি জেনে গেছি।শুভ্রকে দেখতে খুব নিষ্পাপ লাগছে,ইচ্ছা করছে পাশে গিয়ে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।কিন্তু এত ভালবাসার মানুষ টার প্রতি আমার অনেক ভয়,ঘৃণা কাজ করতে শুরু করেছে।
-আরে নীরা তুমি কখন এলে?(ঘুম ঘুম চোখে,চোখ কচলে)আমায় ডাকছো না কেন?
-এইতো মাত্র।কেমন আছো তুমি?আর একয়দিন কেমন ছিলে?
-কি হয়েছে তোমার বলোতো,শরীর খারাপ?
-হ্যাঁ,কিছুতো খারাপ।গত কয়দিন ঘুমাতে পারিনি ভালোভাবে,
আর শরীরটা এমনি ভালো লাগছে না তাই মায়ের কাছে চলে গিয়েছিলাম। কথাগুলো বলতে না বলতেই কেমন যেন গা গুলিয়ে বমি আসছিল,দৌড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে বমি করলাম।শরীর টা খারাপ লাগছিল কেমন যেন ভার ভার লাগছিল। শুভ্র সেদিন নিজের হাতে নাস্তা বানিয়ে আমাকে খাইয়ে তারপর অফিসে গেলো।বিছানায় শোবার পর কেমন যেন এক অপরিচিত ঘ্রাণ পেলাম।বুকের ভেতর টা আমার মোচড় দিয়ে উঠলো।
দুপুরের দিকে মাথা ঘুরাচ্ছিল,শরীর খারাপ লাগছিল।বেবিটেস্ট এর স্টিক দিয়ে এমনি রেগুলারের মত টেস্ট করে দেখলাম,জানি পজিটিভ কিছু হবে না তবুও। কিন্তু আমি নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না,সত্যি পজিটিভ দেখাচ্ছে। এতদিন পর এই খুশির সংবাদে খুশিতে আমার চোখে জল চলে আসার উপক্রম,কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো শুভ্রের বর্তমান অবস্থা।আমি কি এখন ও কে এই নিউজ দিব?সে তো তখন অনেক বেশি অভিনয় করবে,আমার যত্ন নিবে।কিন্তু বাসার বাইরে তো সেই সুবাহ! আমার সন্তান এক চরিত্রহীন বাবার পরিচয় নিয়ে বড় হবে!?কেন যেন এটা মেনে নিতে পারছিলাম না।ইচ্ছা করছিল নিজেকে আর নিজের সন্তান কে খুন করে ফেলি,নাহয় শুভ্রকে ই খুন করে ফেলি।
কিন্তু,আমি তো মা হতে চলেছি!!!মা!এই ভাবনায় আমার চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠছিল।পরক্ষণেই আমার সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যত টা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না।ভাবলাম,সুবাহ কে আমাদের মাঝখান থেকে সরাবো নাহয় আমি নিজেই ওদের মাঝখান থেকে সরে যাবো। হঠাত মোবাইলে টিং সাউন্ড শুনে দেখি ফেইসবুকে ম্যাসেজ,একটা ভার্সিটি ফ্রেন্ড এর নক-‘হাই’। ছেলেটার নাম দীপ্র।অন্য ডিপার্টমেন্টে পড়তো,কিন্তু আমাদের ভালোই ফ্রেন্ড ছিল।তবে ছেলেটাকে কেমন যেন লাগতো,মানে আমাকে পটাইতে চাইতো বলে মনে হতো।এখন সে মাঝে মাঝে নক দেয়,হায় হ্যালো। আবারো ম্যাসেজ আসলো-
-কিরে,কেমন আছিস?
-এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো মোটামুটি,তুই?
-আমিতো ভালোই অলওয়েজ।
-তোর কি মন খারাপ?
-হ্যাঁ,কিছুটা,কিন্তু তুই কি করে বুঝলি?
-হা হা,আমি তোকে বুঝবো না তা কি হয় নাকি?বাদ দে,কি কারণে মন খারাপ ঝটপট বলে ফেল।
-আরে তেমন কিছু না। এমনি মন খারাপ।শুভ্রের ব্যাপারে কিছু প্রব্লেম ফেইস করছি।
আমি তাকে শুভ্রের ব্যাপারের কিছু সন্দেহ খুলে বললাম।বলার পর দীপ্র আমাকে ক্রিটিসাইজ করে যা যা বলল তা সন্দেহ কে যেন আরো জীবন্ত আর প্রবল করে দিল।ভার্সিটি লাইফ থেকেই ছেলেটা এমন,এত যুক্তি দিয়ে এমন ভাবে বুঝাবে যে মানুষ বুঝবে না সে ও বুঝতে বাধ্য। আমার শুভ্রকে আরো বেশি বেশি খারাপ মনে হতে লাগলো।দীপ্র বলল বিকালে যেন কাছেধারের কোনো কফিশপে দেখা করি। কফিশপে বসে আছি,দীপ্র একটা লাল রঙের টিশার্ট পরে হাসিমুখে ঢুকেই বলে-কিরে কি অবস্থা?এই নে চকোলেট খা। আমি চিন্তিত মুখে চকোলেটগুলো নিয়ে বসে রইলাম।দীপ্র আবার বোঝানো শুরু করল,সুবাহ আর শুভ্রের সম্পর্ক টা যে নরমাল না সেটা আমি সন্দেহ করি বা ধারণা করি। কিন্তু এই ধারণা টা কে ই যুক্তি দিয়ে দীপ্র এমনভাবে প্রেজেন্ট করল যে আমি বিশ্বাস করতেই বাধ্য হলাম।
-আচ্ছা,নীরা।শুন,যে পুরুষের একবার অন্য নারীর দিকে মন চলে যায় তাকে আর শত চেষ্টা করলেও ফিরিয়ে আনা যায় না।তুই আর ও কে ফেরানোর কথা ভাবিস না।তুই ডিভোর্স দেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নে।কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও এর চেয়ে ভালো অপশন তোর হাতে নাই।তুই তোর মা এর বাসায় চলে যা,শুভ্রের সাথে থাকা তোর জন্য সেইফ না।ও তোর কোনো ক্ষতি করে ফেলতে পারে।
-কিন্তু দীপ্র,আমি একটা কথা কাউকে বলিনি।তোকে বলছি, ৫বছর পর আমি প্র্যাগনেন্ট, শুভ্র ও জানে না এই নিউজ।এই অবস্থায় এমন ডিসিশন নিব?
-ব্যাস,আর জানাইস ও না শুভ্রকে।কিছু মনে করিস না নীরা।ভার্সিটি লাইফে যখন ওর সাথে প্রেম শুরু করলি তখনি আমি প্রেডিক্ট করেছিলাম যা করছিস ভালো করছিস না।এতদিনে প্রমাণ পেলি তো হাতেনাতে?যাই হোক,বাসায় যা।ব্যাগ গুছিয়ে মা এর বাসায় চলে যা।রাতে দরকার হলে কল দিস।
-আচ্ছা,উঠি তাহলে।
বাসায় এসে নিজের সংসার টা কে যেন নতুনভাবে দেখছিলাম।এই ঘরের প্রতিটা কোণায় আমাদের ভালবাসা লুকানো। কত ভালবাসা দিয়ে যে এই সংসার টা সাজিয়েছিলাম।বিয়ের পর শুভ্রের নতুন চাকরী,বেতন কম,অল্প অল্প করে জিনিস কিনে ঘর টা সাজিয়েছিলাম তিলে তিলে।আজকে নিজের ঘর ছেড়েই নিজেকে চলে যেতে হবে।সুস্থ পরিবেশে আমার বাচ্চা টা কে জন্ম দিতে হবে।আমি তাকে একটা সুন্দর ভবিষ্যত দিতে চাই।যেখানে বাবা মা এর কলহ থাকবে,সন্দেহ থাকবে সেখানে কখনোই সন্তান ভালোভাবে বেড়ে উঠবে না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে,আর এক দু ঘন্টা পরে শুভ্র বাসায় চলে আসবে।মা কে ফোন দিয়ে বলেছি গাড়ি পাঠাতে,চলে আসবে আর আধা ঘন্টার ভিতরে।কিছু কাপড় আর আমাদের ছবির এলবাম টা গুছিয়ে নিয়েছি। কাপড় বলতে আমার বিয়ের শাড়ি টা নিয়েছি,আর মৃত শ্বাশুড়ির কিছু স্মৃতি নিয়েছি।
ড্রাইভার আসতে আসতে ভাবলাম একটা চিঠি লিখে ফেলি।কি লিখব বুঝতে পারছিলাম না।বুকের ভিতর তো একটা বিরাট আকারের পাথর জমে আছে প্রকান্ড বরফের মত,একটা খোঁচা খেলেই যেন পানির বন্যা হয়ে বেরিয়ে আসবে।
কিছুই লিখতে পারছিলাম না,২ টা পেইজ ছিড়ে ৩ নাম্বার পেইজে লিখলাম- শুভ্র, তোমাকে সারাজীবন আমার আগের শুভ্র হিসেবেই দেখতে চেয়েছি।জানি না আমার কি অজ্ঞতা,যার জন্য তোমায় অন্য নারীর সঙ্গ খুব দরকার হয়। ভালো থেকো শুভ্র।তোমার আর সুবাহর মাঝখানে কাঁটা হয়ে থাকতে চাই না।আমার এই তিলে তিলে গড়ে নেয়া ভালোবাসার সংসার টা তোমার সুখের কাছে বিলিয়ে দিলাম। তোমার নীরা,লিখার অধিকার হয়তো আর নেই।
ইতি
নীরা চিঠিটা টি টেবিলের উপর রেখে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।গাড়ি চলে এসেছে। ঘন্টা চারেক পর। রাত ১০টার উপর বাজে।এই শহরে এখন অনেক জ্যাম।ব্যস্ত নগরী,চারিদিকে কত আলোকসজ্জা।আমি একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছি সব।ও,কি বলছি আমি?একা কোথায়?আমার গর্ভে তো আছে আমার ভবিষ্যত।একটা মেয়ে হোক আমার আল্লাহর কাছে চাই।আমার সবচেয়ে আপন কেউ হবে সে,ভাবতে ভাবতেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে।কিন্তু এই অল্প পানিতে আমার বুকের পাথর কখনো নামবে না।হয়তো সারাজীবন এই পাথর বয়ে বেড়াতে হবে।
হঠাত পিছন থেকে খুব জোরে জোরে শ্বাস নেয়ার শব্দ আর সেই খুব চেনা ঘ্রাণ পেলাম।ফিরে তাকাতে খুব ইচ্ছা করলেও ফিরে না তাকিয়ে আগের মতই দাঁড়িয়ে রইলাম।হঠাত পিছন থেকে এসে জোরে জড়িয়ে ধরল শুভ্র,তখনো সে হাপাচ্ছে।আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে নীরবে পানি পরছে।কেউ কোনো কথা বলছি না।কতক্ষণ এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। নীরবতা ভাঙলো শুভ্র,
-কি হয়েছে তোমার?পাগল হয়ে গিয়েছো?আমাকে মেরে ফেলতে চাও?তুমি কিভাবে ভাবলা আমাকে ছেড়ে দূরে থাকবা সারাজীবন।জানো না তোমাকে ছাড়া আমার চলে না? ডুকরে কান্না আসছিল আমার,নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবলাম এভাবে ইমোশনাল হলে চলবে না।আমাকে আমার কথাগুলা আজ বলতেই হবে।
-কি হলো,কথা বলছো না কেন?চুপ করে আছো কেন?
-কি আর বলবো?সুবাহর সাথে তো ভালোই আছো,আমাকে আর কি দরকার?
-মানে?কিসের সুবাহ?সুবাহ আসলো কোত্থেকে?সুবাহ আমার জুনিয়র কলিগ,নাথিং এলস।তুমি সুবাহ কে নিয়ে কিভাবে ভাবলে এসব?
-তুমি নীলুর ফেইসবুক পেইজ থেকে সুবাহর জন্য ২টা শাড়ি আর নেকপিস অর্ডার করোনি?অফিসে মিটিং এর নাম করে বাইরে সুবাহর সাথে খেতে যাওনি?
-হায় আল্লাহ!!!একটাবার আমাকে জিজ্ঞেস তো করতে পারতে। এতদিনে এই চিনলে নিজের শুভ্রকে!? হ্যাঁ,আমি শাড়ি নেকপিস অর্ডার করেছি আমার কলিগ জামাল সাহেব এর জন্য,উনি সুবাহ কে প্রোপজ করেছেন গিফট দিয়ে। নেক্সট মান্থ এ ওদের বিয়ে। আর খেতে তো যাইনি,সেখানেই আমাদের ক্লায়েন্ট এসেছিল,তাই অপেক্ষা করছিলাম। তোমাকে কেউ যদি কিছু বলে থাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছে।
-কি বলছো তুমি এসব!? তাহলে লেইট নাইট চ্যাট,মোবাইলে কল,এসব কি?
-কিসের চ্যাট?সুবাহ সেদিন বাসায় গিয়ে ফোন করেছিল বাসায় পৌঁছিয়ে জানানোর জন্য আর তোমার রান্না খুব মজা সেটা তোমায় বলতে বলেছিল। আমি জাস্ট আকাশ থেকে পরছিলাম আর বুক থেকে একটা একটা করে বিশাল বিশাল পাথরগুলো নেমে যাচ্ছিল!
-কিন্তু তোমার মোবাইলে একদিন একটা ম্যাসেজ এসেছিল রাতে,আমি দেখেছিলাম।
-আরে পাগলি সেটা আমিও জানি না কার নাম্বার।আমি আর পাত্তাও দিইনি,
ডিলিট করে দিয়েছিলাম বাজে ম্যাসেজ যেন তুমি দেখে আমায় ভুল না বুঝো। কথাগুলো আমি পাগলের মত শুনছিলাম,আর অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিলাম এই ভেবে যে একটু একটু করে মনের সন্দেহের জন্য কত বড় ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলাম।আর আমার এই মেন্টাল আনস্টেবল অবস্থায় দীপ্র আমাকে ভুল পথে পা বাড়াতে উৎসাহ দিলো!
শুধু কেঁদেই যাচ্ছি তো কেঁদেই যাচ্ছি।নিজেকেই ঘেন্না হচ্ছিল শুভ্রকে এভাবে ভুল বুঝার জন্য।হঠাত কোনোকিছু না ভেবে মনের সব সংকোচ ফেলে দিয়ে শরীরের সব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম শুভ্রকে।মনে হচ্ছিল সেই মুহুর্তে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ আমি।আমার আর কিছুই চাই না।হঠাত মনে পরল না চাইলে কি হবে,আল্লাহ তো নতুন অতিথি পাঠাচ্ছেন আমাদেএ ঘরে। শুভ্র আমাকে জোরে জড়িয়ে ধরে আমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল-আরে পাগলি টা কান্না করে কেন?আর কখনো এমন পাগলামি করো না লক্ষিটি।মনে যা ই সন্দেহ হোক আমায় জিজ্ঞেস করো। কথা দিচ্ছি,কোনো অপরাধ করলেও অকোপটে স্বীকার করব তোমার কাছে। আমি চোখ মুছতে মুছতে মুখ তুলে তাকিয়ে বললাম-একটা গুড নিউজ আছে,কিন্তু তোমায় না বলে চলে এসেছিলাম।এখন বলতে চাই,কিন্তু বকা দিবে না বলো।
-আচ্ছা বাবা,বলো আগে শুনি।
-আর বেশ কয় মাস পর তুমি হয়তো কোলে একটা গিফট পেতে যাচ্ছো।
-মানে!?কি বলছো,খুলে বলো।
-আরে বুদ্ধু তুমি বাবা হতে যাচ্ছো!!!
কথাটা শুনেই এক চিৎকার দিয়ে শুভ্র আমায় কোলে নিয়ে নিল। নীরা,ও নীরা বিশ্বাস করো, আজ আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।আমার জীবনে আর কোনো আফসোস নেই। ভালবাসি নীরা, অনেক ভালোবাসি তোমাকে।আজ আমি বাবা হবো বলে খুশি নই,তুমি মা হতে পারবে,তোমার মন খারাপের দিন শেষ তাই আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া। মনের অজান্তেই খুশিতে চোখের কোণে জ্বল চলে এলো,শুভ্রের কোলে এখন আমি শুভ্র থেকে উচু।ওর কপালে কপালে ঠেকিয়ে বললাম – ভালবাসি। চোখ থেকে ভালবাসার জ্বল গড়িয়ে পরল শুভ্রের চোখে। দুজনের ভালবাসা মিলেমিশে যেন চিকচিক করছে চাঁদের আলোয়।