নিয়তি

নিয়তি

মৌ ভাবির মেয়ে হয়েছে খবরটা ২মাস পর পেলাম। তারমানে আয়ান বাবা হয়েছে। আয়ানের বিয়ের ৪মাস পেরেয়ে গেলো এরই মাঝে ভাবতেও অবাক লাগে। এই ৪ মাসে নিজেকে একটুও গুছিয়ে তুলতে পারিনি আমি। মা বাবা কয়েকবার বলেছিলেন “তিথি বিয়ে কবে করবি? ছেলে দেখি আমরা?” কিন্তু কোনো না কোনো বাহানায় এড়িয়ে গেছি। এড়িয়ে যাওয়ার অবশ্য কারন আছে। গতমাসে আমার জন্মদিন ছিল আর সেদিন সন্ধ্যায় আমি আয়ানকে দেখেছি আমার বাড়ির আশেপাশে। ব্যাপারটা কতটা সারপ্রাইজড হতে পারে আমার জন্য? ও হয়তো অন্যবারের মতো এবারো আমাকে উইশ করতে এসেছিল। কিছুটা আড়াল থেকে বারান্দার কোণঘেঁষে ওর ঘুরাঘুরি দেখছিলাম। কয়েকবার পায়চারি করে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিরে গেছিল সে।

সেদিনের পর থেকে পূর্বের সেই আসা মনের মধ্যে আবারো গেঁথে যায়। মায়ের জোরাজুরিতে গেলাম শোপিং এ শীতের কাপড় কিনতে। নিজের ব্যপারে সবসময় একটু উদাসীন আমি। আর আয়ান চলে যাওয়ার পর থেকে একটু বেশি। একটু দূরে তাকাতে চোখ আটকিয়ে যায়। “আয়ান এখানে?” দেখলাম আয়ানের কাঁধে চুপটি করে মৌ এর বাচ্চাটা ঘুমিয়ে আছে। নিরাপদ বুকে স্থান পেলে যেমন নিশ্চিন্তে থাকা যাত তেমনই। বাচ্চাটা মাশাআল্লাহ্ অনেক কিউট ছিল। ইচ্ছে করছিল ওর ঘুমন্ত mচোখের পাতায় চুমু খেতে। ওদের কাছে এগিয়ে গেলাম। যদিও ভেবেছিলাম যাওয়াটা ঠিক হচ্ছেনা, কিন্তু আমিতো কোনো আসামি কিংবা দোষী নই যে ওদের থেকে পালিয়ে বেড়াবো। মৌ ভাবি আর আয়ানকে চমকে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম

–আরে তোমরা? কেমন আছো? আমাকে দেখে, আমার এভাবে কথা বলতে দেখে ওরা mএকটু বেশিই অবাক হয়েছিল। ওরা একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছিল কিন্তু কেউ আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। আমি আবারো বলে উঠলাম

–আয়ানের কোলে কি তোমার বাচ্চা? ওকে একটু কোলে নিবো? মৌ ভাবি ভদ্রতার খাতিরে আয়ানের থেকে নিয়ে আমার কোলে দিলো। আমি সাথে থাকা হাজার টাকার নোট বাচ্চাটার হাতে গুঁজে দিয়ে খানিকটা ওদের শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম

–বাবা মাকে নিয়ে ভালো থেকো পিচ্চু। আমার তো তোমাকে নিয়ে একটু ভয় ই হচ্ছে পিচ্চু। তুমি ক্যান যে মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে? তুমি হয়তো জানো না মেয়েদের নিয়তি বড় ঠুনকো হয়। দেখলাম ওরা আবারো একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। আবারো ওদের শুনিয়ে বলার চেষ্টা করলাম

–তুমি চিন্তা কইরো না পিচ্চু। তেমনটা আল্লাহ্ তোমার নিয়তি লিখেনই নাই। আমিতো মজা করছিলাম। মৌ ভাবির কাছে বাচ্চাটা দিয়ে আমি পিছু ফিরলাম। লোকে হয়তো আমায় বেহাইয়া বলবে কিন্তু আমি আজ ওদের সামনে দাঁড়াতে ওরা ওদের দোষ, ভুল একটু হলেও টের পাচ্ছে। আমাকে নিয়ে ভাবছে। ভাবতে বাধ্য। কিছুতেই আমার স্মৃতি ওদের ভালো থাকতে দেবে না। আয়ান আর ভাবি দুজনেই আমাকে ঠকিয়েছে। চাইলে আমি এর প্রতিশোধ আরো ভয়ানক ভাবে নিতে পারি। তবে আজকের পর থেকে নতুন করে আমায় নিয়ে ওদের যে একটু হলেও ভাবনা হবে। এটাও প্রতিশোধের চেয়ে কম কিছুনা। কামিজের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে একঝলক মৃদু হাসির রেখা ঠোটের ভাজে এঁকে নিলাম। আয়ান এখন প্রতিনিয়ত আমায় ফলো করে কিন্তু সামনে এসে কিছুই বলে না। সাহস করে একদিন আমিই পথ আগলে জিজ্ঞেস করি

–তুমি কি কিছু বলবা আয়ান? আয়ান কিছুটা আমতা আমতা করে উত্তর দেয়
–কই নাতো
–তুমি কি ভাবছো আমি কিছু বুঝিনা? ৪ বছর হলো তোমায় চিনি। একটুও কি তোমায় বুঝবো না? কয়েকদিন হলো আমায় ফলো করছো। আবার আমায় না দেখার ভান করছো।

— এমনি আমি একটু হেসে, আবারো প্রশ্ন করি
–তোমার মেয়ে কেমন আছে?
–ভালো আছে
–আর তোমার বউ?
–তিথি প্লিজ।
–ও মা রেগে যাচ্ছো যে? মৌ না তোমার বিয়ে করা বউ?

আয়ান মুহুর্তে আমার হাত ধরে বাচ্চাদের মতো আচরণ করতে থাকে। বাচ্চাদের উপর যখন মিথ্যে কোনো অভিযোগ উঠানো হলে বাচ্চারা যেমন কেঁদে অভিযোগ মুক্ত হতে চাই তেমনটা। মনে হচ্ছে এই বুঝি ওর দুগাল বেয়ে মুক্তোদানার ন্যায় পানি গড়িয়ে টুপটাপ আওয়াজে পড়বে।

–আয়ান হাত ছাড়ো। এখন এসব নাটক না করলেই কি না?
–তিথি সেদিন আমার কিচ্ছু করার ছিলনা বিশ্বাস করো আমি কিছু বুঝতেও পারছিলাম না। একদিকে যেমন ভাইয়ার চলে যাওয়া, অন্য দিকে মা বাবার দুশ্চিন্তায় অসুস্থতা, ভাবিও শোকে পাথর, আর পৃথিবীতে না আসা আমার ভাতিজি। সকল দায়ীত্ব আমার কাধে এসে পরে। আমাকে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগটুকুও দেওয়া হয়নি। ভাইয়া মারা যাওয়ার ১সপ্তাহর মধ্যে সব স্বপ্নের মতো ঘটে গেলো। তুমি অন্তত ভুল বুঝো না তিথি প্লিজ।

–কিন্তু ঠিকি ভাবির কথা মতো আমায় ডিভোর্স দিয়ে দিলে? এমনকি তোমরা ২জনে মিলে আমায় বাধ্য করলে সই করাতে। আয়ানের চোখ বেয়ে ততক্ষণে বাধ ভাঙা নদীর মতো অশ্রুস্নাত হতে থাকে।

— কেনো জানিনা ভাবি হুট করে ২দিনের মধ্যে ডিভোর্স পেপার আনায়। ওর রিলেটিভ কোর্টে জব করায় খুব ইজিলি ও এটা করতে পেরেছে। জানিনা কি ভেবেছে ও। কিন্তু তিথি তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা। মৌ তোমাকে দিয়ে সই করাতে পারলেও আমাকে দিয়ে আজও সই করিয়ে নিতে পারেনি। বরং একটু অবাকই হয়েছিলাম তুমি সাথে সাথে সই করিয়ে দিয়েছো শুনে। বিয়ের এই সমর্পকটা এতটাই ঠুনকো মনে করেছো?

— মৌ ভাবির সাথে তোমার গড়ে উঠা বৈবাহিক সম্পর্কটাও তো ঠুনকো না।
–তিথি মৌ নিজেও বুঝতে পেরেছে আমায় বিয়ে করা ওর ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ও আবেগের বসে কেবলই সন্তানের কথা ভেবে এমনটা করেছে। ভাইয়ার স্থানে মৌ আমায় কোনদিন বসতে পারবে না। আর আমিও পারবো না তোমার স্থান মৌ কে দিতে।

–বিয়ের এতদিনে মনে হলো সে কথা? এতদিন পর আসার সময় হলো?
–আমি তোমার সামনে অনেকবার দাঁড়াতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি।

কারন কোনো না কোনো ভাবে তোমায় আমি কষ্ট দিয়েছি। ঠকিয়েছি। তোমার জন্মদিনে তোমার বাড়ি অবধি গেছি কিন্তু ফোন করে বলার সাহস পাইনি তিথি একটু বারান্দায় আসো। জানো তো তিথি, তোমাকে আমি বিয়ে করেছি এটা আমার মা বাবাকেও জানিয়ে দিয়েছি। তারাও আফসোস করেছে ক্যান আমি আগে বলিনি? কিন্তু ওই যে কিভাবে কি ঘটে গেলো বুঝে উঠার আগেই। তবে হ্যা দোষ আমার ছিল আমি তা স্বীকার করছি। তিথি চলো না শেষ থেকে আবারো শুরু করি!

–তবুও আমি ওই বাচ্চাটার থেকে তার বাবাকে কেড়ে নিতে চাইনা। বাচ্চাটার কথা ভেবে অন্তত সব ভুলে গিয়ে নতুন করে সংসার সাজাও। দোয়া করি তোমাদের জন্য। আমি কোনো রকমে আয়ানকে হাসি মুখ দেখিয়ে চোখের পানি মুছে বাড়ি ফেরার পথে হাটা ধরলাম। আয়ানও আর পিছু ডাকেনি। কারন ও যা বলার বলে দিয়েছে বাকি সিদ্ধান্তটা আমার হাতেই ছিল। আজও খুব কান্না পাচ্ছে আমার। রাস্তার লোকজনেরা অদ্ভুত ভাবে তাকাচ্ছে আমার দিকে। কারন আমি তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছি। ২দিন পর মৌ আসে আমাদের বাসায়, ওকে দেখে আমার কিছুটা বিরক্ত লাগছিল। এক সময়তো ওকে খুব আপন ভাবতাম কিন্তু কেনো এমন হলো ওর প্রতি, বুঝতে ধাধার চক্কোরে পরে গেলাম। মা নিজেও এড়িয়ে যাচ্ছিল মৌকে। কারন মা তো জানেন এই মেয়ের জন্য তার মেয়ের ও বাড়িতে সংসার হয়নি। এমনকি অন্য কোথাও সংসার হলো না এখনো।

–তিথি, ফিরে চলো সবাই ওবাড়িতে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। মা মৌ ভাবির কথায় প্রচন্ড রেগে গিয়ে বললেন
–তিথি কোথায় যাবে হ্যা? তিথি ওর বাড়িতেই আছে। ঝামেলা করো না তো বাড়ি যাও। আমার কিছু ভালো লাগছেনা।

–এভাবে কেনো বলছেন?
–তোমার থেকে শিখতে হবে আমায়? মায়ের রাগ তখন এতটাই ছিল, বুঝলাম মা স্বাভাবিক ভাবে কথাই বলতে পারবেনা এখন আর। তাই সামনে গিয়ে মাকে থামিয়ে বললাম

–মা তুমি ঘরের কাজ গুছাও গিয়ে আমি দেখছি। মৌ ভাবির কাছে এগিয়ে বসলাম। বললাম
–চা খাবে তুমি?
–ফিরে চলো তিথি প্লিজ।
–কোথায়?
–আয়ানের কাছে।
–তুমি তো আছো আমার আবার কি দরকার?
–আমিতো আর তিথি নই। মা আবার পাশ থেকে বললেন
–আমাদের কি তোমার ছ্যাঁচড়া মনে হয়? ভাবিকে বিয়ে করেছে আবার তার কাছে মেয়ের বিয়ে দেবো?
–আন্টি ভুল করছেন।

ভাবিকে বিয়ে করার আগেই সে তিথিকে বিয়ে করেছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে তিথিকে জিজ্ঞেস করুন। আমি তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মায়ের বুঝতে বাকি ছিলনা মৌ ভাবি যে সত্যি বলছে। মৌ ভাবি আবার বললেন

–আমার কথা চিন্তা কইরো না। আমি মায়ের ওখানে চলে যাবো একটা জব পেয়েছি সোশাল ওয়ার্কস এর। মিষ্টু মানে আমার মেয়েকে তোমাদের কাছে রেখে যাবো। পারবেনা তুমি ওর নিজের মা হয়ে উঠতে? মৌ ভাবির কথা শুনে চোখের কোণে পানি চলে আসলো। খুব করে বুঝতে পারছি সে আমার জন্য তার পুরো সংসার এমনকি মেয়েকেও সেক্রিফাইস করে যাচ্ছে। হয়তো সেদিনের ভুলের জন্য সে খুব অনুতপ্ত। তাই বাকিটা জীবন লুকিয়ে বাচতে চাই আমাদের থেকে। মৌ ভাবি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে

–প্লিজ তিথি তুমি আমার মেয়েকে দেখে রেখো। ও বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছে। তোমায় সঙ্গে করে নিয়ে আমায় আবার যেতে হবে। আন্টি প্লিজ ওকে যেতে দিন। মেয়েদের তো শশুড় বাড়িতে আসল ঠিকানা। ভয় নেই আমি তো চলে যাবো আপনার মেয়ে আয়ানের কাছে ভালো থাকবে। মায়ের থেকে অনুমতি নিয়ে আমি হাতের কাছে কয়েকটা জামা কাপড় ভাজ করে মৌ ভাবির সাথে ফিরে গেলাম আমার সংসারে।

কয়েকবার আটকাতে চেয়েছিলাম ভাবিকে কিন্তু আয়ান বলেছে তাতে কোনো লাভ নেই। সে শুনবে না বরং নিজ ভুল স্বীকার করে শাস্তি হিসেবে আমাদের ছেড়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মিষ্টুকে নিয়ে আমার জেনো দায়ীত্ব বেড়ে গেলো। সাথে মৌ ভাবির ফেলে রাখা সংসারটার দায়ীত্ব। আয়ান আর আমি নতুন করে আবারো সংসারটা সাজাবো। নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নেব। আজ আবার শেষ থেকে শুরু হচ্ছে আয়ানের সাথে পথচলা! সব ভুলে নিয়তি আমায় সাই দিয়েছে। আজ বলতে ইচ্ছে করছে আয়ান আমারই ছিল।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত