গ্রাম্য বৌ

গ্রাম্য বৌ

বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। আমি শহরে থাকি। কিন্তু শহুরে মেয়েদের ব্যাপারে আম্মার প্রচন্ড এলার্জি। ওনার একটা “নম্র-ভদ্র, শান্ত-শিষ্ট, ঘরকুনো” স্বভাবের পুত্রবধূ চাই। আম্মার বদ্ধমূল ধারণা, এসব গুন কেবল গ্রামের মেয়েদের মধ্যেই থাকে। উনার ভাষায়, শহরের মেয়ে গুলো সব ‘টাউট-বাটপার।’

আমার অবশ্য এক্ষেত্রে কোনো পছন্দ নেই। শহর-গ্রাম যেটাই হোক মেয়েটা ভালো হলেই হলো। আর পছন্দ করেও কোন লাভ নেই, আম্মার ইচ্ছাই শেষ কথা। তবে আমি চাচ্ছিলাম বিয়েটা আরো কিছুদিন পরে করতে, পড়াশোনা শেষ করে মাত্র নতুন চাকরি নিয়েছি। এখনো সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু আম্মা আর কিছুতেই দেরী করতে রাজি নন। অফিস শেষ করে মাত্র বাসায় ফিরেছি, হঠাৎ আম্মার ফোন।

–হ্যালো, মা।
–ও মানিক, কিয়া করর?
–মা, আঁই হবে অফিসেত্তুন আইছি, কাপো-চোপো হাল্ডাই গোসল করমু।
–ও হুত, কাপো-চোপো হাল্ডন লাইগদোনো, তারাতারি করি বাইত চলি আয়, গোসল বাইত আঁই করিছ।
–আইজ্জা আবার বাইত কিল্লাই ‘মা?’
–ওমা, আইজ্জা বিষুদবার ন?
–বিষুদবার অইছে কিছে? হেই সপ্তাহে না বাইত্তুন আইছি!
–এ রে হুত, এত কতা কইচ্ছা। মায় বাইত আইবেরলাই ক‌ইছি, চলি আয়। তোর মাইজ্জা মাউ এ তোর লাই মাইয়্যা ইকগ্গা দেইখছে। আনডা বেগ্গুনে মিলি কাইল্লা হিতিরে চাইতাম যামু।
–মা, আঁর বিয়ার লাই আন্নে এইচ্ছা শুরু ক‌ইচ্ছেন কা? আঁরে এক্কেনা নিজের হায়ে দাঁড়াইবেরলাই দেন না!
–এ রে হুত, তুই এগেন কিয়া কছ? তুই কি অন আঁর ঠ্যেং দিই দাঁড়‌ই র‌ইছত নি?

আম্মার সাথে তর্ক করা বৃথা। অগত্যা “আসছি” বলে ফোন রেখে দিয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে পুনরায় বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। পরদিন দুপুরের আগেই আমরা মেয়ের বাড়িতে গিয়ে হাজির। আমি, মা আর মেজ মামা। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে মেয়েকে নিয়ে আসা হলো। আমি আড়চোখে কয়েকবার তাকালাম। মেয়ে যথেষ্ট সুন্দরী। চেহারায় একটা নম্র-ভদ্র ভাব আছে। লম্বায়ও প্রায় আমার কাছাকাছি। কিন্তু আম্মার মেয়ে দেখা যেন শেষই হয়না। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে অনেকক্ষণ মেয়েটাকে দেখলেন, অনেক রকমের প্রশ্ন করলেন। ফেরার আগে মেয়ের হাতে হাজার টাকার দুইটা নোট গুঁজে দিয়ে ঘটক কে বললেন, আমরা পরে জানাবো। বাড়ি ফিরে এসে বিকেলে বন্ধুদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার ফোনটা বেজে উঠলো,

–হ্যালো।
–হ্যালো, আঁই সুমি।
–কন সুমি?
–চিনেন ন? আইজকা দুপুরে আমগো বাড়িতে আইছিলেন, আন্নের লগে আঁর বিয়ার কথাবার্তা চ‌ইলতেছে।
আমি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম,
–অ… আন্নে আঁর নাম্বার কন্ডে হাইছেন?
–নাম্বার কন্ডে হাইছি হিয়েন কোনো কতা ন। কতা অইলো গিয়া, আঁরে আমনের পছন্দ অইছে নি?
আমি কিছুটা লাজুক স্বরে আমতা আমতা করে বললাম,

–অইছে!
–লাভ অইতো নো, কোনো লাভ অইতো নো।
–কিল্লাই?
–আঁর আরেক জনের লগে লাইন আছে।
–তই আঁই অন কিত্তাম?
–আন্নে বিয়া খান ভাইঙ্গা দেন। আন্নের মায়েরে কইবেন বলে, আঁরে আন্নের পছন্দ অয় ন। আমি কিছুটা হতাশ হওয়ার ভঙ্গিতে বললাম,
–আইচ্ছা।
–যেন্নে যেন্নে কইলাম হেন্নে হেন্নে ক‌ইরবেন কিন্তু, কোনো চুদুরবুদুর ক‌ইরেন না। নাইলে কিন্তু আমনে শেষ। আঁই কার লগে প্রেম করি জানেন নি?
–না!
–সুমইন্যা রে চিনেন নি?
–হ
–হেই সুম‌ইন্যার লগে।

আন্নে ত ভালা করি-ই জানেন, হেতে তুন বড় গুন্ডা কিন্তু এই এলাকায় আর কেহ নাই। হেতে যদি হুনে, এক্কেরে আন্নের হাত-ঠ্যাং সব ভাঙ্গি হেলাইবো। ফোনটা শেষ করে আমি রীতিমত ঘামছি। আমার মায়ের “সহজ-সরল গ্রাম্য মেয়েদের” এই রূপ দেখে আমার হাত-পা ইতিমধ্যেই ঠান্ডা হয়ে গেছে। রাতে আম্মা সহ খেতে বসেছি।

–এরে মানিক, মাইয়্যাগারে তোর কাছে কেইচ্ছা লাইগছে?
–দুই নম্বর, হুরা দুই নম্বর।
–এগেন তুই কিয়া কছ? কত কষ্ট করি এইচ্ছা ইকগ্গা ভালা মাইয়্যা তুকাই বাইর করছি। মাইয়্যার কথা হুনলে আঁর পরান খান ঠান্ডা হ‌ইয়্যা যায়।
–মা, মাইয়্যার ম‌ইধ্যে ভেজাল আছে। আমনে ত হিতির আসল রূপ দেখেন ন। হিতি ইকগ্গা মিছকা শয়তান‌।
–কিল্লাই, হিতি তোরে কিয়া ক‌ইচ্ছে?
–হিতির অন্য হোলার লগে লাইন আছে। গুন্ডা সুম‌ইন্যার লগে। হিতির লগে যদি আঁর বিয়া অয়, তাইলে হেতে আন্নের হোলারে লুলা বানাই ছাড়ি দিব।
–তুই উল্টাপাল্টা কথা কই এয়ার আগেও দুইখান সম্পর্ক ভাঙি দিছত। এসব মিছা কথা কই লাভ নাই। আঁই তোর কথা বিশ্বাস করিনা। আঁই যাচাই করি দেখমু।

পরদিন সকালেই কর্মস্থলে ফিরে এলাম। বিকেলের দিকে আবার আম্মাফোন করে জানিয়ে দিলেন যে, আগামী শুক্রবার ওই মেয়ের সাথেই আমার বিয়ের ডেট ফাইনাল। আমি যেন অফিস থেকে লম্বা একটা ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাই। মাথা বনবন করে ঘুরছে। কিছুই বুঝতে পারছিনা কি করবো। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখি মেয়ের নাম্বার থেকে আবার ফোন।

–হ্যালো।
–কি খবর, জামাই?
–আন্নের মাথায় ডিস্টার্ব আছে নি কনো?
–না, কোনো ডিস্টার্ব নাই!
–আত্মে মনে অয় ডিস্টার্ব আছে।
–কিল্লাই?
–আমনে আঁরে কইছেন বিয়া খান ভাঙি দিতে, আর আঁর আম্মারে কইছেন আমনে নাকি বিয়াতে রাজি?
–ক‌ইছিতো, অন কিছে?
–ক‌ইছি মানে? মিনিটের মইধ্যে আমনে 180 ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে কেমনে পল্টি খাইলেন?
–আমনেরে একটু টেস্টিং করি দেইখলাম আর কি!

–কিয়ের টেস্টিং?
–আমনের লগে সারাজীবন কাটামু, আমনে কি সাহসী নাকি ভীতু এইটা একটু টেস্টিং করি দেইখলাম আর কি।
–কিয়া বুইঝলেন?
–আমনে ভিতু। সুম‌ইন্যার নামে এক্কেন মিছা কতা কইলাম আর আমনে ভয় পাই আমনের মায়েরে সব বলি দিলেন।
–তার মানে সুম‌ইন্যার লগে আমানের কোনো সম্পর্ক নাই?
–আন্নে হাগল অইছেন নি কোনো? হেতের মত গুন্ডার লগে প্রেম করমু আমি?
–তই আঁই ত ভীতু, আঁরে কিল্লাই বিয়া ক‌ইত্তে রাজি অইছেন?
–জামাই সাহসী অইলে সুবিধা কম। আমনের মত ভিতুরেই আঁর দরকার।

কথা আর বাড়ালাম না, তাড়াতাড়ি ফোনটা কেটে দিলাম। ভয়ে ইতিমধ্যেই আমার গলা শুকিয়ে গেছে। কি ভয়ঙ্কর মেয়ে! বিয়ের আগেই এই অবস্থা, বিয়ের পর কি হবে! পুনরায় আম্মাকে ফোন দিয়ে অনেকভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে, “এই মেয়েকে আপনি যতটা সহজ সরল ভেবেছেন সে আসলে ততোটা সহজ সরল নয়।” কিন্তু আম্মা আমার কোন কথাই বিশ্বাস করতে চান না। আম্মা ভাবছেন- সব আমার বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার ফন্দি।

অগত্যা বিয়েটা করতেই হলো। বিয়ের দ্বিতীয় দিন আমাদের বাসর রাত। দুরুদুরু বুকে আমি বাসর ঘরে ঢুকলাম। আমি একটা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরেছি। স্ত্রী একটা টকটকে লাল শাড়ি। বাসর ঘরে ঢুকার সাথে সাথেই স্ত্রী আমার পা ধরে সালাম করলো। আমি কি করবো ঠিক বুঝতে পারছিনা। তারপর সে আবার তার নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো। আমিও তার পাশে গিয়ে বসলাম। কিন্তু আমি তার পাশে গিয়ে বসতেই সে এক লাফে তিন হাত দূরে সরে গেল! তাঁর এহেন আচরণে আমিও বেশ ভয় পেয়ে আঁতকে উঠলাম।

–কিয়ারে? আমনে এত জোরে লাফ দিলেন কিল্লাই?
–কিল্লেই লাফ দিছি আমনে জানেন না? আমনে কি আঁরে অল্প বয়সে বিধবা বানাইতে চান নি?

আমি কিছু বুঝতে না পেরে হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছি। তারপর সে যেটা ব্যাখ্যা করলো তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, “স্বামীকে সব সময় স্ত্রীর বাম পাশে থাকতে হয়। তা না হলে স্বামীর নাকি ক্ষতি হয়।” এতক্ষনে খেয়াল করলাম যে আমি তার ডান পাশে বসে ছিলাম। নিজের ভুল বুঝতে পেরে কিছুটা দুঃখ প্রকাশ করে আবার তার বাম পাশে গিয়ে বসলাম। কিন্তু তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়েছে, যেন আমি কোন মহা অন্যায় করে ফেলেছি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই সে নিজের কপাল চাপড়ে আবারও ব্যাখ্যা করলো আমার ভুলটা। এবার যে ভুলটা করেছি সেটা হচ্ছে, “আমাকে তার শাড়ির আঁচলের একটা অংশ টেনে নিয়ে সেটার উপর বসতে হবে, তা না হলে আমার নাকি অমঙ্গল হবে।” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার কথামতো শাড়ীর আঁচলটা একপাশে টেনে নিয়ে অনেক ভয়ে ভয়ে সেটার উপর বসলাম। তবে মনে মনে ইতিমধ্যেই উঠে দৌড়ানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। না। এবার আর কোনো ভুল হয়নি। সব ঠিক আছে- মনে হচ্ছে।

একটু পর স্ত্রী এক পাশে রাখা একটা পানের প্লেট থেকে এক খিলি পান তুলে নিল। কি সর্বনাশ! এই মেয়ে এই বয়সেই পান খাওয়া শুরু করছে! কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে ওই পানটার মধ্যে চুন মাখিয়ে এক টুকরো সুপারি দিয়ে সাথে আরেক পাশে রাখা একটা প্লেট থেকে একটা মিষ্টি তুলে নিয়ে সেই মিষ্টিটা পানের পাতার মধ্যে মুড়িয়ে নিল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হা করেন। আমি জীবনে কোনদিন পান খাইনি, কিন্তু ভয়ে তাকে কিছু বলারও সাহস পাচ্ছি না। তাঁর উপর এই পানের মধ্যে আবার মিষ্টি দেওয়া। আমার চৌদ্দ গুষ্টির মধ্যেও কাউকে কোনদিন পানে মিষ্টি দিয়ে খেতে দেখি নাই। ভয়ে ভয়ে পানটা মুখের মধ্যে নিয়ে বসে আছি। আমার দিকে তাকিয়ে স্ত্রী আবারো রুদ্রমূর্তি!

তারপর সে নিজেই ব্যাখ্যা করলো, এটা হচ্ছে নাকি মিষ্টি পান। এখন আমার‌ও তাকে এক‌ইভাবে একটা পান খাইয়ে দিতে হবে। বাসর রাতে এই পান খেলে নাকি সারাজীবন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেক মিল মহব্বত হয়। আমি পানটা তৈরি করে অনেক ভয়ে ভয়ে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি ডান হাতে দিবো নাকি বাম হাতে? তারপর কি হলো সেটা আর নাইবা বলি। এভাবে টানা দুই ঘন্টা পর্যন্ত চলল- আমার উপর অমানুষিক নির্যাতন। কত রকমের নিয়মকানুন যে পালন করতে হলো তার কোনো শেষ নেই। কখনো ডান, কখনো বাম- এই করতে করতে প্রায় মধ্যরাত। সবশেষে সে আমাকে শাসিয়ে দিল এই বলে যে, “ডান বাম করতে যদি আর কখনো ভুল হয়, তাহলে একটু আগে শুধু আমার পাঞ্জাবি ছিঁড়েছে, এরপর থেকে নাকি সে আমাকে ছিঁড়ে ফেলবে!”

অবশেষে তাঁর হাত থেকে নিস্তার পেয়ে সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সে উঠে ঘরের লাইট অফ করে দিলো। মাথার উপর ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ফ্যানটা ঘুরছে। কিন্তু ওই বাতাস আমার জন্য যথেষ্ট না। শরীরে চিকন গাম দেওয়া শুরু হয়েছে। আমার মায়ের “অতি শখের সহজ-সরল গ্রাম্য বৌমা” ইতিমধ্যে একবার কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, আমি মরার মত এভাবে সোজা হয়ে শুয়ে আছি কেন? ওদিকে আমি ভাবছি অন্য কথা, কোন দিক থেকে শুরু করলে মাইরের হাত থেকে বাঁচব। ডান দিক থেকে না বাম দিক থেকে!

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত