তীব্র ঝাঁঝালো একটা গন্ধ পাচ্ছি। আমি এই গন্ধের সাথে পরিচিত নই। গন্ধটা নাসারন্ধ্রের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে দিচ্ছে। কী বিশ্রী গন্ধ! আসছে কোথা থেকে? আমি ছোটবেলা থেকেই প্রবল ঘ্রাণশক্তির অধিকারী। আমার বাবার গায়ের গন্ধ, মায়ের গন্ধ, সবকিছুর গন্ধ বুঝতে পারি। চোখ বন্ধ করে পরিচিত কারও কোন কাপড় শুঁকে বলে দিতে পারি এটা কার কাপড়।
নিম্নশ্রেনীর প্রাণীদের ঘ্রাণশক্তি খুব বেশি থাকে। গণ্ডার, কুকুর এদের প্রবল ঘ্রাণশক্তি আছে। কুকুর গৃহপালিত ও প্রভুভক্তির জন্য এর ঘ্রাণশক্তিকে কাজে লাগানো হয়। আসামী ধরতে পুলিশ, র্যাব বিদেশী জাতের কুকুর ব্যবহার করে। ছোটবেলায় আমার এই ঘ্রাণশক্তির জন্য পরিচিতরা, বন্ধুবান্ধব আমাকে “কুকুর” বা “কুত্তা” বলত। আমি অবশ্য রাগ হতাম না। আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম আমি আধ্যাত্মিক একটা ক্ষমতা নিয়ে এসেছি।
তাই তাদের ডাকে আমি “ঘেউঘেউ” করে সাড়া দিতাম। ব্যাপারটা হাস্যরসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। স্কুলজীবনে কোন ছেলে মেয়েকে প্রেমপত্র দিলে সেই মেয়ে যদি স্যারের কাছে নালিশ করত, তখন আমাকে ডাকা হত সেই চিঠির প্রেরককে খুঁজে বের করার জন্য। আমি চিঠিটা শুঁকে পত্রলেখকের নাম বলে দিতাম। যার কারণে সেই সময়ে কেউ প্রেমপত্র দিত না।
বন্ধুবান্ধবদের সাথে কানামাছি খেলায় আমি যাকে ধরতাম, আমি তার নাম বলে দিতে পারতাম শুধুমাত্র তার গন্ধের জন্য। স্কুল কলেজের বার্ষিক ক্রীড়াপ্রতিযোগি তায় ‘হাড়ি ভাঙা’ নামে একটা খেলা ছিল। হাতে লাঠি দিয়ে চোখ বেঁধে দিত। একটু সামনে থাকত মাটির হাড়ি। ওটা ভাঙতে হবে। প্রতিযোগিতা শুরুর আগে আমি এক ফাঁকে হাড়ির গন্ধটা শুঁকে নিতাম। আর ফলাফল স্বরূপ আমিই বিজয়ী।
আমি লেখাপড়া করলাম ফলিত রসায়ন নিয়ে। সব রাসায়নিক বস্তুর বিভিন্ন ধরণের গন্ধ থাকে। আমি গন্ধ শুঁকে বলে দিতাম কোনটা কোন পদার্থ। এমনকি তথাকথিত গন্ধহীন বস্তুতেও আমি কোন গন্ধ পেতাম। সব দ্রব্যের গন্ধ শুঁকে নাম বলতাম। মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার সময় ক্যাম্পাসে একটা মেয়েকে দেখেছিলাম। মেয়েটা আমার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিল। তার গায়ের পারফিউমের গন্ধের সাথে অন্যরকম একটা মিষ্টি গন্ধ ছিল। মেয়েটার রূপের নয়, তার গায়ের গন্ধের প্রেমে পড়েছিলাম। শ্যামলা রঙের সেই মেয়েটিকে একদিন বলেই ফেললাম ‘ভালবাসি’। দুইবছর প্রেম করার পর, মেয়েটিকে প্রোমোশন দিলাম।
প্রেমিকা থেকে স্ত্রী হল। তার নাম ছিল মৌরী। নামের জন্য না, আসলেই তার শরীরে মৌরিফুলের মিষ্টি গন্ধ ছিল। আর একটা ভাল চাকরিও পেয়ে গেলাম। সুখেই ছিলাম। বিয়ের পর খেয়াল করলাম, তার শরীরে একেক সময় একেকরকম গন্ধ। ঘুম থেকে ওঠার পর একটা গন্ধ, ক্লান্ত দুপুরে আরেকটা গন্ধ, বিকেল একটা শান্ত গন্ধ, সন্ধায় স্নিগ্ধ গন্ধ আর রাতে আবেদনীয় একটা মিষ্টি গন্ধ। জোসনারাতে ছাদে গিয়ে ও জোসনা বিলাস করত। আর আমি করতাম গন্ধ বিলাস। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে ওর পিঠে, বুকে নাক ঘষতাম, গন্ধ নিতাম।
কিন্তু বেশিদিন গন্ধ শুঁকতে পারলাম না। বিয়ের দুইবছর পর আমাদের মেয়েটার জন্ম হল। জন্ম দিতে গিয়ে মৌরী আমাকে ছেড়ে চলে গেল পরপারে। জন্মের আগে মৌরী তার অনাগত মেয়ের নাম রেখেছিল আয়রা। কিন্তু আমি আমার মেয়েকে ডাকি মৌ। কারণ মৌ ডাকলে আমার স্ত্রীর কথা মনে পড়বে।
মৌয়ের জন্মের দিনের ঘটনাটা খুবই মর্মান্তিক ছিল। সারারাত আমি তার পাশে বসেছিলাম। নার্স এসে বলে গেল যে রোগীর পাশে থাকা যাবে না। কর্তব্যরত ডাক্তার এসে দেখলে রাগারাগি করবে। আমি বললাম, তাহলে কর্তব্যরত ডাক্তারকে এসে এখানে বসে থাকতে বলেন। নার্স কিছু বলল না। আমি আমার স্ত্রীর শরীরে একটা নতুন গন্ধ পাচ্ছি। হয়তো এটাই আমার অনাগত সন্তানের গায়ের গন্ধ। ভোররাতে তার পেইন শুরু হয়। তার সিজার করা লাগে। অদ্ভুত ব্যাপার! সূর্যোদয়ের সময়েই মৌয়ের জন্ম হল। ডাক্তার বলল, আপনার মেয়ের নাম প্রভাতি বা প্রভা রাখতে পারেন।
আমার স্ত্রীর জ্ঞান ছিল না। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম কখন আমার স্ত্রীর হাসিমুখটা দেখব। কিন্তু আমার সেই ইচ্ছাটা পুরন হল না। অজ্ঞান থাকা অবস্থায়ই সে মারা গেল। দুঃখ একা এলে সহ্য করা যায় কিন্তু সুখ এবং দুঃখ একসাথে এলে সহ্য করা যায় না। আমার অবস্থাটা খুব খারাপ হল। মেয়েকে একা একা বড় করলাম। শুধু আমার মেয়ের নামে নয়, মেয়ের গায়ের গন্ধেও আমার স্ত্রীকে খুঁজে পাই আমি।
তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধটা মৌয়ের রুম থেকে আসছে। কিছু পোড়ার গন্ধ। যখন আমার মেয়ের মধ্যে নারীত্ব দেখা দিল, তখন থেকে তাকে আলাদা রুম দেই। তারপর থেকে তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। আমি একমাসের জন্য সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম আমার চাকরির কাজে। এসে আমার মেয়ের চালচলনে পরিবর্তন দেখি। তার শরীরের পরিবর্তন খুব দ্রুত হল। কিন্তু মানসিক পরিবর্তন এতটা দ্রুত হবে ভাবতে পারিনি। যে মেয়ে রাতে একা ঘুমাতে ভয় পাই, সে এখন মধ্যরাতে ছাদে গিয়ে ফোনে কথা বলে। আমার আর মৌয়ের মধ্যে মানসিক দূরত্ব বাড়তেই লাগল। বেশ কিছুদিন দেখছি মৌয়ের একটা ছেলে বন্ধু সময়ে অসময়ে বাসায় আসে। আমাকে দেখলে চোরের মত তাকায়। তার শরীর থেকে একটা বিশ্রী গন্ধ আসে। কেন জানি, ছেলেটাকে আমি পছন্দ করতে পারি না। আমাকে দেখলে, গুড মর্নিং/গুড আফটারনুন/গুড ইভিনিং আঙ্কল বলেই মাথা নিচু করে মৌয়ের রুমে চলে যায়। বাবা হয়ে আমার উচিৎ ছিল মেয়েকে জিজ্ঞেস করা। কিন্তু আমি করতে পারিনি। মেয়ের প্রতি অন্ধ ভালবাসার জন্যই আমি তাকে এই প্রশ্ন করতে পারি নাই।
শুক্রবার। ছুটির দিন। ভাবলাম আজ মৌকে সময় দিব। দুপুরে সিনেমা দেখব, বিকেলে ঘুরতে যাব। আমি আর মৌ প্রায়ই ছুটির দিনে পার্কে ঘুরতে যেতাম। সেই সময়গুলো আসলেই মধুর ছিল। মৌয়ের রুমের দরজা বন্ধ। হাত দিতেই দরজা খুলে গেল। মৌ শুয়ে আছে। তার গায়ে টিশার্ট। টিশার্টটা অনেক উপরে তোলা। বুকের নিচ থেকে পেট পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। আর অবাক করা ব্যাপার, ঝাঁঝালো গন্ধটা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আমি ওকে ডাকলাম। আমার দিকে শুধু তাকালো। কোন কথা বলল না। পাশ ফিরে কোলবালিশের উপর পা তুলে দিয়েছে। আমি মৌয়ের কাঁধে হাত রাখলাম।
-কী হয়েছে মা?
-কিছু হয়নি বাবা।
-শরীর খারাপ? জ্বর হয়েছে নাকি?
না। ওর শরীরটা ঠাণ্ডা আছে। ওর টেবিলের দিকে চোখ গেল। একটা কাগজে গোলাপি রঙের ছোট ছোট কয়েকটা ট্যাবলেট দেখলাম। পাশে দুইটা লাইটার, একটা লাইটারে সিরিঞ্জের সুচ লাগানো, একটা পাতলা কাগজ, এক প্যাকেট সিগারেট। আমার হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। এ আমি কী দেখছি? আমি রুমে চলে এলাম। দেয়ালে টাঙানো মৌরীর ছবির দিকে তাকিয়ে আছি। আমার মনে হচ্ছে মৌরী আমাকে বলছে, আমার মেয়ের সামনে মহাবিপদ। তুমি ওকে বিপদ থেকে রক্ষা কর। আমি টেরই পেলাম না। কখন থেকে আমার চোখ বেয়ে পানি ঝরছে তো ঝরছেই। সন্ধ্যা পার হয়ে কখন যে রাত হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। মৌয়ের রুমে উঁকি দিয়ে দেখি, সে রুমে নেই। কয়েকবার ডাকলাম, মৌ, মৌ? কোন সাড়াশব্দ নেই। ওকে মোবাইলে কল করলাম।
-হ্যাঁ বাবা, বল।
-কোথায় তুই মা?
-আমি একটু বাইরে এসেছি।
-রাত দশটা বাজে। এত রাতে কী জন্যে?
-আমার এক ফ্রেন্ডের বাসায় পার্টি আছে। আজ ফিরব না। তুমি ঘুমিয়ে পড়।
ফোনটা কেটে দিল। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। জীবন থেকে একটা অংশ দূরে, বহুদূরে চলে যাচ্ছে। আমি আটকাতে পারছি না। আমি তো আটকানোর চেষ্টাও করছি না।
পরদিন সকালে আমি অফিসে যাওয়ার আগে মৌ ফিরল। ওর চোখ দুইটা লাল। ওর টিশার্ট কুঁচকানো। ওর শরীর থেকে আমার মৌরীর গন্ধ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তার পরিবর্তে ওর শরীর থেকে সিগারেট, গাঁজা, ইয়াবার গন্ধ পাচ্ছি। আমাকে দেখে একটা কথাও বলল না। কেমন টালমাটালভাবে হেঁটে চলে যাচ্ছে। কিচেন থেকে থালাবাসন পড়ার ঝনঝন শব্দ পেলাম। দৌড়ে গিয়ে দেখি, মৌয়ের হাত কাঁপছে। কেটলি পড়ে আছে নিচে।
-চা খাবি মা?
-হুম।
-যা, তুই ঘরে যা। আমি চা বানিয়ে আনছি। চা নিয়ে ওর ঘরে গেলাম। ও তখন বাথরুমে। শাওয়ার নিচ্ছে। আমি ডেকে বললাম, চা তো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
-রেখে দাও।
-কলেজে যাবি না?
-না।
-মৌ?
-বল বাবা।
-না, কিছু না। অফিসে যাচ্ছি।
ও বাথরুমের দরজা খুলে বের হল। সাদা একটা তোয়ালে জড়ানো গায়ে। বুকের উপরে কালো তিলটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু অবাক করা বিষয়, ওর বুকের উপরে লালচে ছোপছোপ দাগ। ওর সাদা গায়ে দাগগুলো যেন কলঙ্ক।
আমি বের হয়ে এলাম। অফিসে এসে কিছুতেই মন বসছে না। কয়েকটা ফাইলে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম, আমি এই মুহূর্তে খুবই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছি। অফিস থেকে দুইদিন ছুটি নিয়ে বের হলাম।
বাসায় ফিরলাম না। সারা শহর হাটলাম একা একা। ক্লান্ত হয়ে বিকেলে বাসায় এসে একটা বিশ্রী গন্ধ পেলাম। সেই ছেলেটার গন্ধ। মৌয়ের রূম থেকে আসছে। তার সাথে ভেসে আসছে মৌয়ের হাসির খলখলানি শব্দ। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। একবার ভাবলাম, গিয়ে দেখি। মেয়েকে শাসন করি। পা এগোচ্ছে না। আমার অবচেতন মন বলছে, আমি সেখানে গেলে খুবই আপত্তিকর কিছু দেখব। ড্রেস চেঞ্জ না করেই কফি বানালাম। কফির মগ নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। আমার ভাবনা মায়ার বেড়াজালে বন্দি হয়ে আছে। প্রায় ঘণ্টাখানিক পর ছেলেটা বের হল। আমাকে দেখে একটু অবাক হয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছে।
-গুড ইভেনিং আঙ্কল।
আমি উত্তর দিলাম। ছেলেটার গা থেকে আমি একটা অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছি। আমার পরিচিত গন্ধ। সেনসেশন ডটেড, স্ট্রবেরি ফ্লেভার। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। ভোররাতে ঘুম এসেছে। ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারছি, কেউ একজন আমাকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে। চোখ মেলে দেখলাম, ভেজা চুলে মৌরী আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার চেষ্টায় ব্যস্ত। আমার স্মৃতিবিভ্রম নাকি দৃষ্টিবিভ্রম? না, মৌরী নয়, মৌ ডাকছে আমায়।
-বাবা।
-বল মা।
-এত সকাল পর্যন্ত ঘুমাচ্ছ যে? শরীর ঠিক আছে তো?
-হুম। তুই কি কোথাও..?
-আমি ফ্রেন্ডদের সাথে ট্যুরে যাব।
-কোথায়?
-কক্সবাজার।
-আমি আসি তোদের সাথে?
কথাটা বলেই কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমি আমার মেয়ের সাথে আগে অনেক যায়গায় ঘুরতে গিয়েছি। আমাকে ছাড়া কোথাও যেত না। আজ বন্ধুদের সাথে যাচ্ছে।
-না বাবা। বিপত্নীক লোক অ্যালাউ না। ওর কথায় আমার ঘুমঘুম ভাব একেবারে কেটে গেল। হা করে তাকিয়ে আছি। আমার বিস্ময় দেখে মৌ হাসছে।
-বাবা, আমি মজা করলাম। কিন্তু তুমি যেতে পারবে না।
-কয়দিন থাকবি?
-চার-পাঁচ দিন।
-এতদিন?
-হুম, পনেরো হাজার টাকা লাগবে।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত আলমারির চাবিটা দিলাম। কোন কথা বলতে পারলাম না। টাকা নিয়ে আমার মেয়েটা চলে গেল। আমি প্রতিদিন মৌকে ফোন করলাম কিন্তু তার মোবাইল বন্ধ ছিল। এক সপ্তাহ পর আমার মেয়ে ফিরল। আমি বিকেলে বাসায় ছিলাম। সে এসে আমাকে দেখল কিন্তু কোন কথা বলল না।
আমি আর আমার মেয়ে একই বাসায় থাকি কিন্তু আমাদের মধ্যে যেন এক আলোকবর্ষ দূরত্ব। দূরত্ব দিনদিন বাড়ছে। আগে অফিসে যাওয়ার আগে মৌয়ের কপালে চুমু খেয়ে যেতাম, এখন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘর থেকে বের হই। সারাদিন সে দরজা বন্ধ করে থাকে। ফোনে কথা বলে। মাঝেমধ্যে সেই ছেলেটা আমাদের বাসায় আসে। কোন কোন দিন রাতেও সে থাকে। বলা বাহুল্য, সে মৌয়ের রুমেই রাত কাটায়। আমি বোবা দর্শক মাত্র। রাতে অফিস থেকে আসার পর যদি কপাল ভাল থাকে, তাহলে মেয়ের সাথে দেখা হয়। আর না হলে তো হলই না। সারা ঘরে খুব বিশ্রী গন্ধ। মদ, গাঁজা, ইয়াবা, হিরোইন এর গন্ধ। প্যানথার, সেনসেশন এর স্ট্রবেরির ফ্লেভার।
তিনমাস পরের কথা। মৌয়ের শরীর ভেঙে গেছে। কয়েকমাস আগেও তার চেহারায়, শরীরে কিশোরী ভাব ছিল কিন্তু ইদানীং তাকে ত্রিশোর্ধ্ব মহিলার মত লাগে। শরীর ফুলে গেছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। একদিন সন্ধ্যায় ছেলেটা ওর রুম থেকে খুব রাগীভাব দেখিয়ে বেরিয়ে গেল। আমাকে ‘গুড ইভিনিং, আঙ্কল’ বলল না। রাতে মৌ ফোনে কথা বলছে। চিৎকার করেই বলছে। আমি আমার রুম থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। ওপাশের কথা শুনতে পাচ্ছি না।
-টেস্টে রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে।
-এই সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করবে আমাকে।
– তাহলে আমি এখন কী করব, রাজ?
তুমি জান না মানে? করার সময় খেয়াল ছিল না?
-আমি খেয়াল করেছি। তোমাকে বিশ্বাসও করেছি। কিন্তু তুমি….
-শাট আপ। আমার বাবাকে নিয়ে একটা বাজে কথা বলবে না।
-জাস্ট গো টু হেল।
মৌ কাঁদছে। আমি তার চোখের জল দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু গন্ধ পাচ্ছি। অনুশোচনার গন্ধ, প্রায়শ্চিত্তের গন্ধ। রাতে ও ডিনার করল না। আমিও খেতে পারলাম না। খাবার নেড়েচেড়ে রেখে দিলাম। রাতে কোন বিশ্রী গন্ধ পেলাম না। আমার মেয়ের গায়ের সেই সোঁদা গন্ধ যা ওর জন্মের সময় পেয়েছিলাম, সেরকম একটা গন্ধ পাচ্ছি। ঘুম থেকে উঠে দেখি মৌ কিচেনে। চুল খোঁপা করা। শুধু একগোছা চুল মুখের উপরে পড়ে আছে। মৌরী যখন বাসায় কাজ করত, তখন ওর মুখের উপরও এভাবে চুল পড়ে থাকত। আমি আমার মেয়েকে ফিরে পাচ্ছি। সেই মেয়ে যে তার বাবাকে খুব ভালবাসত।
-বাবা, তুমি বস। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে ব্রেকফাস্ট রেডি করে দিচ্ছি।
-তুই কাজ কর মা, আমি দাঁড়িয়ে থাকি।
-তুমি অনেকদিন বাসায় ব্রেকফাস্ট কর না, তাই না?
-আমি অনেকদিন ব্রেকফাস্টই করি না।
মৌ আমার দিকে খুব মায়াবী চোখে তাকাল। আমি আমার মেয়েটার দিকে একটা ভরসার হাসি দিলাম। মৌ আমাকে জড়িয়ে ধরল। ডাইনিং টেবিলে আমি আর মৌ বসেছি।
-বাবা, তোমাকে আরেকটা পরোটা দেই?
-না, থাক মা।
-আরে নাও। খেতে কেমন হয়েছে?
-খুব ভাল। দুজনে খাওয়া শেষ করে চা খাচ্ছি।
-বাবা, আজ অফিসে না গেলে হয় না?
-না, মা। আজ দশটায় একটা জরুরী মিটিং আছে।
– ও। মৌয়ের মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেছে।
-মন খারাপ করিস না। আমি মিটিং শেষ করে যত দ্রুত পারি চলে আসব। তুই রেস্ট কর। আজ কলেজে যাওয়া লাগবে না।
-ঠিক আছে বাবা। আমি বের হয়ে গেলাম। অফিসে পৌঁছানোর আগমুহূর্তে মৌ ফোন দিল।
-কী হয়েছে মা?
-কিছু না বাবা।
-মন খারাপ?
-বাবা, আমার মা আমাকে কী নাম রেখেছিল?
-আয়রা।
-তুমি এই নামে ডাকো না কেন?
-আমি মৌ ডাকি। প্রতিটা ডাকে তোর মায়ের কথা মনে পড়ে।
-আচ্ছা বাবা, তুমি কাকে বেশি ভালবাস? আমাকে নাকি মাকে? মেয়ের এই প্রশ্নে আমি অবাক হলাম। কিছু বলতে পারলাম না।
-বাবা?
-হ্যাঁ মা।
-কিছু বলছ না কেন?
-না মানে, মিটিংয়ে দেরী হয়ে যাচ্ছে। এখন রাখছি মা। মিটিং শেষ করে বাসায় আসছি। ওকে?
-আচ্ছা বাবা।
মিটিংয়ে মন বসাতে পারলাম না। এজিএম স্যারকে বলে মিটিং শেষ করেই বের হয়ে গেলাম। মনটা খুবই ছটফট করছে। অস্থির হয়েই বাসায় এলাম। মেইন গেট হাট করে খোলা। ঘর কেমন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। আমি আমার মেয়ের গন্ধ পাচ্ছি না। ও কী বাসায় নেই? বাথরুমের ট্যাপ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ার শব্দ পাচ্ছি। কেমন একটা ভৌতিক পরিবেশ। আমি বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। বাথরুমের ফ্লোরে ময়লা পড়ে আছে। বমির টকটক গন্ধ। আমি এক দৌড়ে মৌয়ের রুমের দিকে গেলাম। আমি গন্ধ পাচ্ছি। খুব বিপদের গন্ধ।
ঘরের সিলিংফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে আমার মেয়ে। জিহ্বা বের হয়ে আছে। সাদা ড্রেস পরা। চোখদুটো খোলা। চুলগুলো এলোমেলো, কিছু মুখের উপর। আমি নড়তে পারছি না। পা অবশ হয়ে আসছে। আমার খুব জোরে চিৎকার দেওয়া উচিৎ। কিন্তু আমি চিৎকার দিতে পারছি না। খাটের কোনায় পেপার ওয়েটে ভারা দেওয়া একটা কাগজ। তাতে লেখা, “বাবা, প্রথমেই তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি আমার জীবনে কখনো আশাভঙ্গের হতাশায় ভুগিনি। তুমি আমাকে শত কষ্ট করে আমার প্রতিটা চাওয়া পুরন করেছ। তুমি একজন অতি বিশুদ্ধ মানুষ, বিশুদ্ধ বাবা। তুমি বলেছ যে আমার মাও খুব ভাল ছিলেন।
তাহলে একটা কথা বল তো, শুদ্ধ বাবা ও শুদ্ধ মায়ের সন্তান অশুদ্ধ হয় কিভাবে? আমার ধারনা, প্রকৃতি মাঝেমাঝে শুদ্ধ আর অশুদ্ধ এক করতে চায়। আমি নষ্ট হয়ে গেছিলাম বাবা। ইচ্ছা ছিল, আজ তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদব। যতক্ষণ না মন শান্ত হবে, কেঁদে যাব। অশ্রু শেষ হয়ে চোখ থেকে রক্ত বের হবে, তবুও তোমাকে ছাড়ব না। আমার পাপের ফল তোমাকে ভোগ করাতে চাইনি বলেই আমি। আমার শেষ আশাটা পুরণ হল না বাবা। তুমি এই চিঠি যখন পড়বে, তখন আম থাকব না। আমার লাশটাকে কি জড়িয়ে ধরে কাঁদবে তুমি? নষ্ট সন্তান বলে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিবে না তো? আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।
তোমার নয়নের মণি আয়রা(মৌ) মৌ আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে আমি কাকে বেশি ভালবাসি? উত্তর দিতে পারি নি। তোকে বলতে পারলাম না, মা। আমি তোকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসি। আমি চিঠির দিকে তাকিয়ে আছি অপলক চোখে। উপরে মৌয়ের ঝুলন্ত লাশ থেকে ফোটায় ফোটায় রক্ত পড়ছে চিঠির উপর। মৌয়ের যোনি বেয়ে রক্ত পড়ছে। সাদা সালোয়ার রক্তাক্ত হয়ে গেছে। আমি সেই রক্তে একটা অনাগত সন্তানের গন্ধ পাচ্ছি। যে কখনো পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে না।