আজ অনেকদিন পর আমার বেশ ভালো লাগছে। প্রাণহীন জিনিস গুলোতেও প্রাণ খুঁজে পাচ্ছি। আগের মতোই আবার সবকিছু স্বাভাবিক লাগছে। বহমান নিঠুর সময়টা আমার কাছে হার মানবে আজ। হ্যাঁ হারতে তাকে হবেই। বারোটা মাস শুধু দংশন করে ক্ষতবিক্ষত করেছে আমাকে। ধূর আমার বোধহয় মাথার গোলমাল হয়েছে। এখন মাঝে মাঝেই এমন হয়। নিজের মনেই বকতে থাকি। এক এক সময় চারপাশের মানুষ গুলোকে কেমন অদ্ভুত লাগে। মনে হয় আমি স্থির আর বাকি সব প্রচণ্ড গতিশীল। ট্রেনের বা বাসের জানালায় এক মনে বাইরের চলমান কোলাজ গুলোকে দেখলে যে রকমের অনুভূতি হয়,ঠিক সেই রকম। আমি তিয়াসা। টাইটেল নিয়ে খুব গন্ডগোল। জন্মসূত্রে পাওয়াটা নিজেই হারিয়েছি আর বরেরটা গ্ৰহণ করতে পারিনি এখনও।
আজ আমার বিবাহবার্ষিকী। অভিরুপের সাথে এতগুলো দিন একসাথে কাটালেও সম্পর্কের মিষ্টতা তৈরী হয়নি। সুন্দরী মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি। লোকে বলে মায়ের মুখটা কেটে বসানো যেন। একটা রাজপুত্রের স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। সেই মতোই প্রেমে পড়লাম । ভাতটা নামিয়ে ফ্যানের গতিবেগটা বাড়িয়ে বসলাম একটু। বিজবিজে ঘামটা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিলাম খানিক। আজকের দিনটা গুমোট বেঁধে আছে। মেঘও ঘনীভূত হয়েছে যত্রতত্র। আচমকা বৃষ্টি নামতে পারে।
কলেজের গেটে আলাপ রাজপুত্রের সাথে। তারপর দৃষ্টি বিনিময়, কথা দেওয়া নেওয়া, লুকিয়ে সিনেমা দেখা,জলে পা ডুবিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে হারিয়ে যাওয়া, হাত ধরে অনেকটা পথ হাঁটা, রাত্রি জেগে লুকিয়ে কথা বলা, ঝগড়া, খুনসুটি ,গোপন বোঝাপড়া সবটুকু । একসাথে ঘর বাঁধার স্বপ্ন। নতুন সংসার সাজিয়ে তোলার গল্প।
তারপর সবটা গোলমাল। নাহ্ আর নয়। ঘামটা বসে গেলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। অভিরুপ আসার আগে স্নানটা সেরে নিতে হবে। আজ ওর পছন্দের ডিসগুলো নিজের হাতে যত্ন করে বানিয়েছি। জানিনা কেন আজ রান্না করতে ইচ্ছে করলো খুব। জলের ধারার নীচে নিজেকে সঁপে দিতেই অতীতটা ফিরে ফিরে আসছে বারবার…
অভ্রের কথা মতো স্থানেই দাঁড়িয়ে রয়েছি। হাতে একটা ভারি ব্যাগ। নতুন সংসার গড়বো বলে ভালো লাগার জিনিসগুলো সবই গুঁজেছি । বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বসলাম সামনের একটা বেঞ্চে। জায়গাটা দারুণ নির্বাচন করেছে অভ্র। বেশ নিরিবিলি। অবশ্য মানুষ একদমই নেই এমনও না। বেশ কিছু মানুষ যাতায়াত করছে ,আড় চোখে দেখেও নিচ্ছে আমাকে। কনের সাজে বসে আছি আমি। নিশ্চয়ই আমাকে জরিপ করে নিজেদের মতো গল্পও সাজাচ্ছে মনে। কৌতুহলী চোখগুলোতে সন্দেহ দানা বাঁধছে ক্রমশ। এবারে আমারও বেশ অস্বস্তি লাগছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে । কখনও এতো দেরি করেনা অভ্র।
তবে কি সে আসবেনা আর? ধূর তাও কি আবার হয়! চার বছরে মানুষটাকে বুঝতে এতটা ভুল হবে ! আরও কিছুক্ষণ দেখি। এতক্ষণে বাড়িতে তোলপাড় শুরু হয়েছে নিশ্চয়। বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে অপমানে মাথা নিচু হয়ে গিয়েছে হয়তো বাবার। চোখের কোণে হয়তো বাষ্প জমেছে খানিকটা, তারপর সেটা রাগ ও ক্ষোভে পরিণত হয়েছে । আর মা ? মা হয়তো এখনও খুঁজে চলেছে আমাকে। হয়তো ভাবছে তার মতোই অবলা হবো আমি ,কখনও ফোঁস করবোই না। অভ্র একটা বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে,হতে পারে তার মাইনে কম । কিন্তু সে যথেষ্ট ব্রাইট স্টুডেন্ট, ভবিষ্যৎ উন্নতি অবসম্ভাবী। বাবা মানতেই চাইলোনা। বলপূর্বক বিয়ে ঠিক করে ফেললো আমার । অভ্রর কথা মতো টয়লেট যাওয়ার নাম করে বাড়ির পিছনের গেট দিয়ে দৌড়… দৌড়..
-একেবারে বিয়ের পোশাকেই চলে এলে? পাক্কা একঘন্টা পর এসেই অভ্রর চোখে বিস্ময়। অভ্রর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমস্ত ভয়,উৎকন্ঠা বিসর্জন দিতে চাইলাম,
-এতক্ষণ পর এলে? আমি তো ভয় পেয়েছিলাম। তুমি না এলে আমি কোথাও মুখ দেখাতে পারতাম না।
অভ্রর হাত আজ শিথিল। আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধছেনা আমাকে। চোখে চোখ রাখলাম। বিশ্বস্ত চোখগুলোতে অবিশ্বাসের ছায়া।
-আমাকে ক্ষমা করো তিয়াসা। বাবা-মায়ের অমতে যেতে পারবোনা। অনেক চেষ্টা করলাম বোঝানোর। হলোনা ।
-আমি তো তোমায় বিশ্বাস করতে গিয়ে বাবার বিশ্বাসকে খানখান করলাম। তুমি ঠিক বলছো তো? এখন ঠাট্টা করার সময় নয় অভ্র।
-আমি ঠাট্টা করছিনা তিয়াসা। তুমি ফিরে যাও । পারলে ক্ষমা করো।
অভ্র ফিরে গিয়েছে অনেকক্ষণ। রাত্রি নেমেছে গঙ্গার পাড়ে। জলের উপর সুন্দরী চাঁদের প্রতিবিম্ব। মুহূর্তরা থেমে গিয়েছে আমার কাছে। কোনোরকম আবেগ,অনুভূতি কাজ করছেনা যেন। নিজেকে বড্ড বেমানান ঠেকছে আজ। গুটিগুটি পায়ে গঙ্গার কাছে এগোতে থাকলাম। বাবা-মায়ের মুখটা হঠাৎই চোখের সামনে ভেসে উঠলো,মায়া জড়ানো মুখ! কোথাও এতটুকু নিষ্ঠুরতা নেই ! স্রোতস্বিনীর বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়তে গিয়ে হ্যাচকা টানে সিঁড়িতে এসে পড়লাম।
-মৃত্যুকে দেখেছেন কখনও? খুব কাছ থেকে? ফুটপাথের মানুষগুলোকে দেখেছেন? বা মারণ রোগে আক্রান্ত কোনো রোগী, যে জেনেছে তার সময়সীমার নির্দিষ্টতা? এতো জ্ঞান শুনে মাথা গরম হলেও বসলাম পাশে। জানিনা কেন খুব ইচ্ছে হলো অপরিচিত লোকটাকে সবটুকু বলতে। ঠিকানা হীন আমি চললাম অপরিচিতর আস্তানায়। মন্দিরে গিয়ে সে রাঙিয়েছে আমার শূন্য সিঁথি।
স্নান সেরে পরিপাটি করে সাজলাম আমি। লাল বেনারসিটায় হাত বুলিয়ে চড়িয়ে নিলাম গায়ে। অভিরুপের ফেরার সময় যতই ঘনিয়ে আসছে অভ্রর মুখটা ততই স্পষ্ট হচ্ছে। তবে কি এখনও আমার সবটা জুড়ে অভ্রর উপস্থিতি !
অভিরুপ একটা কাপড়ের দোকানে কাজ করে। গায়ের রং কালোর দিকে। মোটাসোটা চেহারাটা দেখলেই ঘেন্না করে আমার। যতক্ষণ সে বাড়িতে থাকেনা প্রাণ খুলে বাঁচি আমি। অভি বাড়িতে এলেই আমার অস্বস্তি হয়। ও কখনও স্বামীর দাবি নিয়ে আসেনি আমার কাছে। যতটুকু পারে আমার থেকে দূরে থাকে। আড়ালে থেকেই আমার চাহিদা গুলো পূরণ করে। কথাও হয়না ঠিক মতো তার সাথে। সে ভালোই বোঝে তাকে আমি সহ্য করতে পারিনা। কিন্তু আমার উপায় নেই ,কোথাও যাওয়ার নেই।
খোঁপা থেকে কাঁটাগুলো খুলে ফেললাম একে একে। জলের ঝাপটায় মুছে দিলাম কাজল। শাড়িটা খুলতে যেতেই দরজায় শব্দ। ঠক্…ঠক্…দরজাটা খুলে পাশে দাঁড়াতেই অভিরুপের চোখে মুগ্ধতা দেখলাম। ঘরে গিয়ে বসতেই আমার হাতে তুলে দিলো একটা প্যাকেট। বিস্মিত হয়ে চাইতেই ,খুলে দেখতে ইশারা করলো সে। প্যাকেটটা খুলতেই আরও অবাক হলাম। স্মার্টফোন । হাল্কা নীল । আমার প্রিয় রং।
-পছন্দ হয়েছে? আপনার সময় কাটেনা ভেবে এটা আনলাম। মায়ের সাথে কথাও বলতে পারেন। মা অনেক নরম অনুভূতির জিনিস । অভিমান করে থাকবেন না আর। সিঁদুর মুছে ফিরে যেতেও পারেন। কখনও সামনে যাবোনা কথা দিলাম। কিছু একটা বানিয়ে বলে দেবেন।
বলেই পিছু ফিরতেই হাতটা ধরলাম শক্ত করে। অদ্ভুত কোনো ঘটনা ঘটছে এমনভাবে তাকালো সে। হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার বুকে। মোটাসোটা, কদর্য চেহারার মানুষটার শরীরে আপনের গন্ধ। চোখ বুজে ঘাড়ে মাথা রাখতেই অভ্রর মুখটা অস্পষ্ট হতে লাগলো…মোটা চেহারাটা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর…
-তিয়াসা ..ফিরবে তোমার বাড়ি?
-হু মুখ তুলতেই কয়েক ফোঁটা অশ্রু আমার ঠোঁটে এসে পড়লো। শান্ত হাতে চোখ দুটো মুছিয়ে দিয়ে বললাম,
-তিয়াসা ভট্টাচার্য্য। অভিরুপ ভট্টাচার্য্যর স্ত্রী। আর এটাই আমার বাড়ি। বাবার টাইটেল কাটলেই বাড়িটা বদলে যায় মশাই!
বলতেই শক্ত করে জড়িয়ে নিলো অভিরুপ আবার। আমিও মাথা রাখলাম নিরাপদ আশ্রয়ে। অভিরুপের বুকে..যার অলিগলিতে শুধুই আমার স্থান মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে জানালার বাইরে…ঝড়ের গতিবেগ উল্টেপাল্টে দিচ্ছে প্রকৃতির সাজ সজ্জা। ভেতরটা এখন অনেক শান্ত। একের মাঝে অন্যকে খুঁজে পাওয়া..