ফিরে পাওয়া বড়দিন

ফিরে পাওয়া বড়দিন

“এই নাও তোমার চা আর বিস্কিট।একটু পর কেক দিচ্ছি”, ব্যালকনিতে ইজিচেয়ারে বসা স্বামী পিটারের দিকে ধূমায়িত পেয়ালা আর পিরিচ এগিয়ে দিতে দিতে কথাগুলো বলেন ওনার স্ত্রী সোফিয়া। বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রবীণ পিটার ডিসুজার চোখ দুটো ঈষৎ আনমনা হয়ত কিছুটা অভিমানী বটে।এবারও বড়দিনে ফ্রেডরিকো মানে ওদের ছেলে কলকাতায় ফিরবেনা।অবশ্য শুধু ওনারা কেনো? এই বো ব্যারাকে থাকা অধিকাংশ পরিবারের এখন এই একই চালচিত্র।

অথচ এককালে কত ভালোবাসা আর নস্টালজিয়া কাজ করত আজকের এই বড়দিনকে ঘিরে। পুরো পাড়া জমজম করত নানারকম কেক,কুকিজ,ওয়াইন আর গানবাজনার ছন্দে।কিন্তু যুগের সাথে সাথে হাওয়া বদল হতে হতে এখন সব কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। অনেকেই এই পাড়া ছেড়ে নিজের দেশে বা কর্মসূত্রে এদিকওদিক চলে গেছেন। হাতে গুনে গুটিকয়েক মানুষ থেকে গেছেন এই কলকাতা শহরকে ভালোবেসে আবেগকে সঙ্গী করে।তবু ওই আর কি! বিশেষ বিশেষ দিনে প্রিয়জনের জন্য মনখারাপ তো হয়ই বটে।ইচ্ছা করে তাদের নিজেদের কাছে ফিরে পেতে।ডিসুজা দম্পতিও তার ব্যতিক্রম নন।

প্রায় চার যুগের বেশি হতে চলল ওনারা এখানে আছেন।ওনাদের একমাত্র ছেলে ফ্রেডরিকো আগে ওনাদের সঙ্গেই থাকত। এখানে বছর দুই হল হিউস্টন শহরে পাড়ি দিয়েছে ও কাজের জন্য।আগে ফ্রেডরিকো ছোট থাকতে কত বায়না করত মায়ের কাছে কেক আর এটাসেটা খাবে বলে। তখন দিনের বেলা কোনো কোনো বার যাওয়া হত আলো ঝলমলে পার্ক স্ট্রিটে বা কখনো ময়দানে। কোনো রেস্তোরায় দুপুরের খাওয়া সেরে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরতেন ওনারা। তারপর চলত প্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজনদের আনাগোনা।

আস্তে আস্তে ফ্রেডরিকো বড় হবার পর ওর স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের কত বাঙালি বন্ধুবান্ধবরাও আসত বড়দিনে ওদের বাড়ি আড্ডা দিতে। রকমারি খাবার, সাজগোজ আর পিয়ানোর উষ্ণতার ছন্দে “ডিসুজা ম্যানশনের” বড়দিন উদযাপন হার মানাতো প্রকৃতির শীতলতাকে। ফ্রেডরিকো বিদেশ চলে যাবার পর এখন নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরে এই বাড়ির দুই বুড়োবুড়িকে। সময় ঘড়ির কাঁটা যেন আর চলতেই চায়না। যদিও ওনাদের ছেলে ওখান থেকে ভিডিও কল বা স্কাইপে যোগাযোগ করে ওর সাধ্যমত। তবুও দুধের স্বাদ কি আর ঘোলে মেটানো যায়?

তবে বেশি আর ভেবেও কি হবে? চা আর অল্প কেক মুখে দিয়ে বাজার সেরে আসা যাক,এই মনে করে ধূমায়িত চায়ের কাপে সবে চুমুক দিয়েছেন ডিসুজা দম্পতি মিলে এমন সময় ওদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় একটা অ্যাপ ক্যাব।শোনা যায় ফ্রেডরিকোর সেই চিরচেনা গলা,”মাম্মি অ্যান্ড পাপা আমি এসে পড়েছি। কেমন দিলাম বলো আজকের সারপ্রাইজ?দু বছর পর সোজা বড়দিনের দিন ল্যান্ড করলাম এই দেশে।”

__”তবে যে দিন চারেক আগেও বললি আসবিনা? তাহলে তো অন্য ব্যবস্থা করতাম রান্নাবান্নার। দুই বুড়োবুড়ি মিলে কতটুকুই বা খাই? তোর বাবা এখন সবে বাজার যাবে বলে ঠিক করছে।এখন যে কখন কি করব কে জানে?”অভিমানের সুরে বলেন সোফিয়া ওনার ছেলেকে।

মিষ্টি হেসে ফ্রেডরিকো বলে,”তোমাদের স্নেহের টান আর এই শহরের চিরচেনা আবেগটাকে বড্ড মিস করছিলাম বিদেশের মাটিতে। তাই ভাবলাম চুপিচুপি এসে চমকে দেব।নাও চলো এবার, বড্ড খিদে পেয়েছে খেতে দাও। আগে সকালের খাবারটা তো কেক আর আমার আনা কুকিজ দিয়ে সেরে ফেলি। তারপর দুপুরে তিনজন মিলে একসাথে বেরোব সেই পুরনো দিনগুলোর মত।” হিয়া টুপটাপ,জিয়া নস্টাল সুরে আবার বেজে ওঠে ডিসুজা পরিবারের সকলের মনের সাতরঙা ইচ্ছেগুলো। বছর দুই পরে বড়দিনের খুশি আবার নতুন প্রাণ করে ফিরে পায়। পিয়ানোর ধুলো ঝেড়ে বেজে ওঠে,”জিঙ্গেল বেলের”সুর।।।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত