“দাদা, একটা নতুন সিম্ কার্ড দেবেন?”
“কীসের নেবেন?”
“ভোডাফোন।”
“এই নিন্। আর ফোন নাম্বার-টা পিছনে লেখা আছে।”
“এক্ষুনি একটা ফোন করা যাবে?”
“না। তার আগে আপনার নাম-টা রেজিস্টার করতে হবে। তবেই আপনার নাম্বার অ্যাকটিভ্ হবে। তো, আপনার নাম-টা যদি একটু বলেন।
মেঘ। মেঘ বাসু, আশুতোষ কলেজ, অর্থনীতি বিভাগ। স্নাতক নিয়ে পাশ করে কলেজ ছেড়েছে প্রায় চার বছর আগে। তারপর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে লেগে পরে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে। অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবারে-র কাছে সিনেমা জগৎ সম্পর্কে একটা নিজস্ব চিন্তাধারা আছে। তাই এখন অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন আলমারিতে তুলে রেখে, টালিগঞ্জেই জুনিয়র আর্টিস্ট সাপ্লাইয়ার-এর কাজ করে সে। বাড়ি উত্তর কলকাতার বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রীট্। বাড়িতে আছে বলতে মা, বাবা আর এক বোন। তবে বাবা, মা দুজনেই খুব অসুস্থ। তাই সংসারের পুরো দায়িত্ব তার কাঁধে।
“নিন্ দাদা, আপনার নাম্বার চালু হয়ে গেছে।”
“অনেক ধন্যবাদ। এই নিন্ আপনার টাকা-টা”
“ধন্যবাদ”
মেঘ ফোনে সিম কার্ড লাগিয়ে একটা নাম্বার টাইপ্ করল। কিন্তু, কোথাও যেন, তাকে কিছুটা ইতস্তত বোধ করতে দেখা গেল। পকেট থেকে একটা ডায়েরি বার করে সে যেন নাম্বারটা কয়েকবার মিলিয়ে দেখে নিল, তারপর ফোনটা করেই ফেলল। (ফোনে দুজনের কথোপকথন)
“হ্যালো?”
“হ্যাঁ, কে বলছেন?”
মেঘ চুপ করে রইল।
“হ্যালো?”
“বৃষ্টি, একবার দেখা করতে পারবি?”
এবার বৃষ্টি কিছুটা থতমত খেয়ে চুপ করে রইল।
“কীরে, পারবি একবার দেখা করতে?”
“কোথায়? কখন?”
“কাল। বিকেল চারটে। জায়গাটা তুই খুব ভালো করে জানিস কোথায়।”
“হুম্।”
“আর বলছি যে কাল আসার সময়ে পারলে তোর ওই নীল বৃষ্টি ফোনটা কেটে দিল।
বৃষ্টি রায়,পরিসংখ্যানবিদ্যা বিভাগ,আশুতোষ কলেজ। স্বভাবে একটু লাজুক, মিশুকে গোছের।বাড়িতে আছে বলতে মা, বাবা আর এক দাদা। পরিবারের সবথেকে ছোটো মেয়ে বলে,বৃষ্টি, সবার খুব আদরের। চার বছর আগে কলেজ ছাড়লেও এখনও পড়াশোনা ছাড়েনি। তার সাথে সাথে একটি ছোটো স্কুলে কম্পিউটার শেখায় বাচ্ছাদের।
“হাই। কেমন আছিস বৃষ্টি?”
“তুই ছেড়ে যাওয়ার সময় যেমন ছিলাম তেমনিই। তুই?”
“ওই চলছে।”
“হঠাৎ দেখা করতে বললি?”
“না আগে ভেতরে তো চল, তারপর বলছি।”
সময়টা ছিল ২০১৩ এর শেষের দিক। মেঘ আর বৃষ্টির কলেজের প্রথম বর্ষ। অনেকের কাছেই বছরটা আনলাকি ১৩ হলেও, মেঘ আর বৃষ্টির জন্য বছরটা ছিল অন্যরকম। কলেজের প্রথমদিনই বৃষ্টিকে দেখে ভালো লেগেছিল মেঘের। তারপর আর কী! প্রথম কথা বলা, প্রথম দেখা করা, প্রথম ক্লাস কামাই করে ঘুরতে যাওয়া, আর তাদের ভালোবাসার প্রত্যেক-টা মুহূর্তের সাক্ষী ছিল সাউথ পার্কস্ট্রীট সিমেট্রী।
“কীরে? এত চুপচাপ কেন?” “একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, মেঘ? তুই এত চুপচাপ আছিস কী করে? আমার-তো ইচ্ছা করছে তোকে খুন করে ফেলতে। কিন্তু তাও কিভাবে যে নিজেকে আটকে রেখেছি সেটা আমিই জানি।”
“তোকে অনেকগুলো কথা বলার ছিল, বৃষ্টি। অনেকদিন ধরেই তোর সাথে দেখা করতে চাইছিলাম কিন্তু তোকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। তাই নতুন নাম্বার থেকে ফোন করলাম।”
“হুম্। তোর নাম্বার-টা ব্লক করা।”
“কেন?”
“কেন? কেন মানে? চার বছর মেঘ! সময়টা নেহাতই কম নয়। মনে আছে সেই দিনটা? একটা টেক্সটে ছেড়ে চলে গেছিলি। কতবার ফোন করেছি, কথা বলতে চেয়েছি কিন্তু তুই তো…”
“কেন ফোন করেছিলি? আমিতো টেক্সটে বলেছিলাম ফোন না করতে।”
“হ্যাঁ বলেছিলি। তুই এটাও বলেছিলি যে, তুই আর আমাকে নিতে পারছিস না। কিন্তু কেন মেঘ? দোষটা কোথায় ছিল আমার?”
“আজ আমি তোকে সব বলব। তুই প্লিজ্ একটু শান্ত হয়ে বস্। আমার কথাগুলো একটু শোন।”
“না প্লিজ্। আমি তোর থেকে আর কিছু শুনতে চাই না। আর এখন বলে লাভ কী? আমি আর তোকে ভালোবাসি…”
“ভালোবাসিস না?”
“না কিছুনা। যা বলার তাড়াতাড়ি বল। বাড়ি ফিরতে হবে আমায়।”
“বৃষ্টি, তুই আমার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা।
জীবনে যত যাই হোক তোকে-তো আমি কখনও ভুলতে পারব না। কলেজের পর হঠাৎ করে বাবা অসুস্থ হয়ে পরল। বিশ্বাস কর, এক নিমেষে সব কিছু কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছিল। তাই তখন কিছু বুঝতে না পেরে তোকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম নিজে খারাপ থাকলে তোকে কী করে ভালো রাখব?।”
“আচ্ছা। এই কথাগুলো বলার জন্যই ডেকেছিলি তো? এবার আসি?” “না মানে আর একটা কথা। আমরা কী আবার নতুন করে সম্পর্ক-টা শুরু করতে পারি?” “লজ্জা করে না তোর? তুই জানিস না, তুই ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কত অসুবিধা হয়েছিল আমার। মা, বাবাও তোকে অনেক ভরসা করেছিল মেঘ। তুই শুধু আমার নয়, আমার বাড়ি থেকে পাওয়া সম্মান-টাও হারিয়েছিস।” “দেখ বৃষ্টি, আমি তোর দিকটা বুঝতে পারছি। তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝি। আমি তখন তোর থেকে সময় চেয়ে নিয়েছিলাম, একা থাকতে চাইছিলাম আমি। কিন্তু, সেই সময়-টাও আমায় তুই দিসনি।””আমি তোকে সাপোর্ট করতে চেয়েছিলাম। পাশে থাকতে চেয়েছিলাম তোর। কিন্তু তুইও সেটা তখন বুঝিস নি।” “তখন বুঝিনি কিন্তু এখন বুঝি। পায়ের তলায় হয়তো জমিটা অনেক শক্ত এখন, হয়ত এখন আমি অনেকটাই পরিণত, শুধু পাশে তুই নেই রে।”
“তুই অনেক বদলে গেছিস মেঘ!”
“জানিনা। কিন্তু, দায়িত্ব নিতে শিখে গেছি। ভালোবাসি এখন দায়িত্ব নিতে। অনেক তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলাম রে।”
“হুম্।”
“ব্যাগে জল আছে?”
“এই নে!”
(জল খাওয়ার পর)
“তুইও অনেক বদলে গেছিস, বৃষ্টি।”
“হয়তো!”
“শুধু হয়তো?”
“দেখ মেঘ, আমি মানছি যে তুই আমাকে ছেড়ে চলে গিয়ে ভুল করেছিস, কিন্তু, সেই সময়টা আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে। বুঝেছিলাম যে আমি তোর ওপর অনেকটা নির্ভর হয়ে পরেছিলাম। আমি সেই সময়ে নিজেকে চিনতে পেরেছিলাম। চিনতে পেরেছিলাম বাস্তবের ছবিটা।আর সেই জন্য অল্প হলেও আমি তোর কাছে কৃতজ্ঞ”
“আচ্ছা বৃষ্টি, আমরা কী বন্ধু হয়ে থাকতে পারি না?”
“না রে মেঘ। বন্ধুত্ব থেকেই তো সব শুরু হয়েছিল। যদি আবার কিছু ভুল করে ফেলি। তাই আমি চাই না নতুন করে আবার সম্পর্ক-টা শুরু করতে।”
“মাঝে মাঝে তোর সাথে দেখাও করতে পারব না?”
“না। আমি আর নতুন করে ভালোবাসতে পারব না কাউকে। নিজেকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি রে।”
“আচ্ছা। ভালো লাগলো শুনে যে তুই ভালো আছিস।” “তুই আগের থেকে অনেক বেশি স্মার্ট হয়ে গেছিস মেঘ। দেখিস তুই আমার থেকেও অনেক বেটার কাউকে পেয়ে যাবি। এমনকি সে তোকে সিগারেট খেতেও বারন করবে না।”
“হাসালি বটে!”
“সেই। না রে আর এসব নয়।”
“তাহলে কী সন্ন্যাস নিবি?”
“না। আবার বছর কুড়ি পর যদি জানতে পারি তুই সিঙ্গেল আছিস, তখন আবার আর একটা নতুন নাম্বার থেকে ফোন করে তোকে এখানেই ডেকে আনব। আর আবার চেষ্টা করব।”
“আচ্ছা। তুইও হাসালি বটে।”
“এই হাসিটা-ই তো দেখতে চেয়েছিলাম।”
“তাহলে, আমি এবার আসি?”
“সন্ধ্যে নামছে। তোকে বাড়ি ছেড়ে দি?”
“না রে। মানে যদি বাবা, মা দেখে ফেলে তাহলে আবার ওরা কি না কি ভাববে।”
“হুম্।”
“যাহ্। মন খারাপ হয়ে গেল?”
“না রে। তুই ভালো আছিস, এটা দেখে খুব ভালো লাগছে রে।”
“বাসে তুলে দিতে পারবি?”
“হুম্ চল্। তুলে দিচ্ছি।”
সমাপ্ত