অন্ধকার ঘন গভীর রাত ; বাইরে থেকে ভেসে আসছে হুহু করে হাওয়ার শব্দ – খোলা প্রান্তরের ওপর দিয়ে। তার সাথে মাঝে মাঝে আসছে ভেসে, বিভিন্ন অজানা অচেনা পোকামাকড় এর আওয়াজ। কখনো কখনো বা সরসর , গরগর শব্দ, যেন ভারী কোনোকিছু টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। এর মাঝে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত ছোট্ট গ্রামটি। নামেই গ্রাম, আসলে কয়েকটা মাত্র ঘর নিয়ে তৈরী ছোট্ট একটি বসতি। বাড়িগুলো সব তৈরী বাঁশ , কাঠের টুকরো, পাতার ছাউনি দিয়ে। হাওয়াতে সেগুলোও দুলে দুলে কেঁপে উঠছে। এখানে বাস করে কুড়িটি পরিবার একসাথে। আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই যে ওদের। কোথায় যাবে ? যেদিকেই তাকায়, শুধু ধু ধু প্রান্তর। খরা কবলিত এলাকা , চারদিকে মাটি ফেটে চৌচির, গাছ আছে, গাছের ডাল ও আছে, কিন্তু নেই কোনো সবুজের সমাহার , শুকনো কিছু পাতা দোলে, ঝরে ঝরে পড়ে শুধু। কতদিন যে বৃষ্টি হয় নি সেখানে ! এই তো, গেলো বছর ওই দূরের একটা গাছে দড়ি টাঙিয়ে ঝুলে পড়েছিলো তিনজন। চাষ করার জন্য দূরে গ্রামের একটা ব্যাঙ্ক থেকে ধার করেছিলো বছর তিনেক আগে। সে আর শোধ করতে পারে নি। দেনার দায়ে…
হঠাৎ মেঘ চিরে বিদ্যুতের ঝলক। আকাশে ছুটে আসছে ঘন কালো মেঘ চারদিক থেকে। একসাথে এসে জমা হচ্ছে ঠিক এই ছোট্ট গ্রামের ওপরে। তাহলে, তাহলে কি অবশেষে এতো বছর পরে ‘মা’ মুখ তুলে চেয়েছে ? এতো বছর পরে কি প্রাণ ফিরে পাচ্ছে এই ভূমি ? তাহলে কি আবার আজ বৃষ্টি হবে ? মুষলধারে বৃষ্টি ? ভাসিয়ে নিয়ে চলে যাবে সবকিছু ? ভাবতে ভাবতে কোনোরকমে উঠে দাঁড়ায় ছেলেটি। কাপড় দিয়ে তৈরী অস্থায়ী দরজাটা সরিয়ে বাইরে পা রাখতে না রাখতেই শুরু হয়ে গেলো বৃষ্টি, ভীষণ জোরে। বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটাগুলো মাটিতে পড়তে না পড়তেই, মাটি টেনে নিচ্ছে সেই জল। কত বছর জল পাই নি এই মাটি – আজন্ম পিপাসার্ত ‘মা’ আজ জলের ধারায় স্নান করবে , তারপর সেই ভেজা মাটিতে ফলবে সবুজ ফসল, উজ্জীবিত হবে নতুন প্রাণ। “গোপাল ? এই গোপাল ? কি বলছো তুমি বিড়বিড় করে ? ঘুমের ঘোরে কি বকবক করছো ? ” ধড়মড় করে উঠে বসে গোপাল। “ককক কি হয়েছে ? বাইরে বৃষ্টি, জোরে বৃষ্টি…” বলতে বলতে গোপাল ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো বাইরে। কোথায় বৃষ্টি ? কোথায় মেঘ ? চারদিকে সেই রুক্ষ শুষ্ক মাটি, সেই তীব্র জ্বালা ধরানো হাওয়া।
“আআআআআ” আর্তনাদ করে আকাশের দিকে তাকায় গোপাল, মাটির ওপরে আঙ্গুল দিয়ে খুঁড়তে খুঁড়তে কিছু মাটির ডেলা হাতের মুঠোয় টেনে ওপর দিয়ে ছুঁড়ে মারে ও। কার উদ্দেশ্যে ? কে জানে ! গত চার বছর এই অঞ্চলে কোনো বৃষ্টি হয় নি। সবাই আজ ধুঁকছে , কোনোরকমে বেঁচে আছে। ভেতর থেকে ইন্দু বাইরে ছুটে আসে, জড়িয়ে ধরে স্বামীকে। কাঁদতে কাঁদতে তুলে নিয়ে যায় ওকে ভেতরে , শুইয়ে দেয় মাটির ওপরে শতচ্ছিন্ন তোষকের ওপরে। নিজেও, গোপালের পাশে শুয়ে পড়ে। গোপালের শুকনো , খড়ি পড়া পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে ঘুমিয়ে পড়ে ইন্দু।
সকাল হয়। গোপাল শুয়ে আছে পাশে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে ইন্দু ভেতর থেকে। সূর্য উঠে গেছে মাথার ওপরে এখনই, বাকিরাও বেরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে , সবার হাতে বড়ো কলসী, আর হাতে বালতি। ওদের সাথে যোগ দেয় ইন্দু। হেঁটে যেতে হবে প্রায় চার কিলোমিটার, সেখানে রয়েছে অনেক পুরোনো একটা কুয়ো। ওখান থেকে নিয়ে আসবে জল ইন্দু, অন্যদের সাথে। সেই জলে চলবে সারাদিনের কাজ। এটাই প্রতিদিনের কাজ ওর, আর ওর মতো বাকি মেয়েদের। ঘরের মরদরা বাইরে বেরিয়ে আসছে , ঘুম ভেঙে গেছে ওদের ও। ওরা এখন গিয়ে বসবে গোল করে , নেড়া গাছের তলায়। সেখানে ওরা হুঁকো টানবে, বা ধরাবে বিড়ি , আর আলোচনা করবে কি করে কাজ জোগাড় করা যায়।
প্রায় দুঘন্টা পরে ফিরে আসে ইন্দু বাকিদের সাথে। জল তুলতে গিয়ে ওরা মেয়েরা স্নান সেরে আসে ওখানেই। মাথার ওপরে সূর্য আরো গরম হয়ে রাগ ঝরাচ্ছে ওদের সবার ওপরে। ইন্দু দেখে বাইরে আর কেউ নেই , শুধু একা বসে আছে গোপাল , মাথা নিচু করে কি যেন করছে একটা। ইন্দু তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতরে জলে ভর্তি কলসী রেখে আসে গোপালের কাছে। এই মানুষটাকে নিয়ে যে কি করি, বাকিরা কেউ নেই এখানে, কে জানে কোনো কাজের সন্ধান পেলো কিনা। আর এই মানুষটা সারাদিন এতো কি যে ভাবে, ওদের সাথে গেলেই তো পারে !
গোপালের কাছে আসতে আসতে শুনতে পায় ইন্দু “কি গরম পড়েছে , কোথাও কোনো বৃষ্টি নেই। কত মাস হয়ে গেলো, একটুও জলের দেখা নেই গো। মাটির বুক ফেটে চিড় ধরেছে সেখানে। ফসল কি করে ফলবে ? আসে পাশের নদী নালা যা ছিলো, সে ও আজ শুকনো যে ! ধরিত্রী মা কেন যে এতো রুষ্ট, কুপিত আমাদের ওপরে – জানি না। হয়তো আগের জন্মের কোনো পাপ , বা আমাদের বাপ ঠাকুর্দার কোনো কাজ – কে জানে ? কবে থেকে মাটি খুঁড়ে যাচ্ছি আঙ্গুল দিয়ে। আঙ্গুলগুলো ও ভেঙে যাচ্ছে, নখের ডগা ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে , সেই রক্তও রাক্ষসীর মতো শুষে নিচ্ছিস তুই তোর বুকে। তবুও জল দিলি না তুই। একটু ভেজা মাটি – বের কর না রে মা ! কিন্তু, কোথাও কিছুই নেই রে। না আছে জল, না আছে ঘরে খাওয়ার, না আছে কোনো রোজগার। কি করে যে চলবে আমাদের !”
ঝাঁঝিয়ে ওঠে ইন্দু, ” কি বলছো তুমি তখন থেকে ? কি বিড়বিড় করে যাচ্ছ? বলি, এ বছরেও কি কোনো সুরাহা হবে না আমাদের এই দুর্দশার ? আর কত দূরে আমাকে যেতে হবে জলের জন্য ? কোমর ভেঙে যাচ্ছে তো আমার। আর যে সহ্য হয় না গো। বাকিরা কোথায় ? ওরা নিশ্চয়ই কোনো কাজের সন্ধানে গেছে পাশের গ্রামে, তাই না ? আর তুমি? একটা অকর্মন্য লোক ! কেন যে তোমার সাথে মা বাবা বিয়ে দিয়েছিলো আমার ! “ও ইন্দু, রাগ কোরো না গো। আমি, আমি ওখানে যেতে পারবো না গো।
আমাকে জোর কোরো না ! ও দালাল যে কাজ দেবে, সেটা ভালো না গো , একদম ভালো না ! “ও, তুমি তাহলে জানো ? কেন ভালো না ? না না, আমাকে জানতেই হবে। ” হঠাৎ একটা কোলাহলে ওরা দুজনেই ঘুরে দাঁড়ায়, তাকিয়ে দেখে, গ্রামের বাকি পুরুষগুলোর সাথে আরো একজন আসছে , বেশ হোমরা চোমরা গোছের কেউ। চোখে কালো চশমা, গায়ে দামী কুর্তা , পায়ে নাগরাই জুতো। লোকটি এসে দাঁড়ায় ওদের গ্রামের মাঝে। তাড়াতাড়ি একজন একটা ভাঙা খাটিয়া নিয়ে এসে বসতে বলে ওনাকে। উনি কোনোরকমে বসে, চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখেন। তারপর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করেন একজনের উদ্দেশ্যে, “তাহলে বুধিয়া, এই কয়েকজনই আছে এখানে ? কতজন হবে তাও ? ”
“আজ্ঞে হুজুর , বাইশটা পরিবার। ”
“আচ্ছা ,আচ্ছা। সবার স্ত্রী আছে তো ? আর বাচ্চা ? ”
“জি হুজুর। তা আছে। ”
“আচ্ছা আচ্ছা। সবাইকে আসতে বলো তো এখানে। আমি কথা বলি সবার সাথে। আমি বাপু সব জানিয়ে দেবো তোমাদের, আর তারপরে তোমরাই ঠিক করো কি করবে ! ”
তাড়াতাড়ি ইশারা করে বুধিয়া বাকিদের। সবাই যে যার ঘরে গিয়ে সবাইকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, লোকটির সামনে মাটির ওপরে বসে পড়ে। ইন্দু ও গোপালকে টানতে টানতে নিয়ে আসে ওদের মাঝে, শাড়ির আঁচল টেনে ঘোমটা করে বসে থাকে চুপ করে। ওদের এখনো বাচ্চা হয় নি , তাই নিয়ে বাকিদের কম কথা শুনতে হয় নি ওদের, তবে সে সব এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। এমনিতে দুটো পেট টানতে টানতেই অবস্থা খারাপ আর একটা বাচ্চা থাকলে…বাকিদের কথা তো শুনি, ভাবতে ভাবতে সামনে তাকায় ইন্দু।
লোকটি বলতে শুরু করে, “আচ্ছা শোনো তোমরা আমার কথা ভালো করে। এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে একটা জায়গা আছে যেখানে চাষ হয় , আখের চাষ। এখন সেপ্টেম্বর এর পনেরো তারিখ, অক্টোবর এর এক তারিখ থেকে ওখানে কাজ শুরু হবে। আর চলবে পরের বছরের মার্চ পর্যন্ত, মানে , ছয় মাস। প্রতিদিন স্বামী স্ত্রী মিলে একসাথে কাজ করতে হবে। একসাথে প্রতিদিন দুজনে মিলে চার টন পর্যন্ত আখ তুলতে হবে , আর প্রত্যেক টন আখ এর জন্য সাড়ে তিনশো টাকা পাবে। এইভাবে কাজ করলে, ছয় মাসে তোমরা রোজগার করবে আড়াই লাখ টাকা। আড়াই লাখ, দেখেছো কখনো এতো টাকা তোমরা ? তবে ওর থেকে আমাকে কিছু দিতে হবে তোমাদের, লাখখানেক মতো। এই যে আমি তোমাদের এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছি, ওখানে কাজে লাগাবো, মালিকের সাথে কথা বলতে হবে, এইসব খরচপাতি আর কি। বুঝেছো ? তাহলে, তারপরেও তোমাদের হাতে থাকে দেড় লাখ টাকা। ” সবার মুখে জেগে ওঠে আশার আলো। সবাই তাকায় এ ওর দিকে। গোপাল উঠে দাঁড়ায়, বলে ওঠে “তোরা সব ভুল করছিস, এই ফাঁদে পা দিস না , এই লোকটা চোর, খচ্চর ! “এই গোপাল, চুপ কর ; আমাদের শুনতে দে। হুজুর আপনি বলেন। কেউ পেছন থেকে ধমকে ওঠে। ”
লোকটা গোপালের দিকে তাকায় , বাঁকা হাসি হেসে বলে ওঠে, “তবে একটা ব্যাপার আছে কিন্তু। ছয় মাস, কাজে একদিন ও ফাঁকি দেওয়া যাবে না। প্রতিদিন কাজ করতেই হবে, আর প্রতিদিন চার টন করে আখ তুলতেই হবে। আর সেটা স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে। বাচ্চা থাকলে, তাকেও কাজে লাগাতে পারো, সেটা তোমাদের ইচ্ছে। তবে তার জন্য আলাদা করে টাকা দেওয়া হবে না। একটা থোক টাকা আমি সবাইকে এখন-ই দিয়ে যাবো, আর বাকিটা কাজ শেষে পাবে তোমরা। ” বুধিয়া জিজ্ঞেস করে, “হুজুর, একদিন ও ছুটি নেওয়া যাবে না ? মানে শরীর খারাপ টারাপ তো হতে পারে। আর মেয়েদের, মানে , বুঝতেই তো পারছেন….”
মনে মনে হেসে ওঠে লোকটা, বলে, “না , একদিন ও নয়। যদি স্বামী বা স্ত্রীয়ের মধ্যে কেউ একদিন ও কাজ না করে, বা দুজনেই যদি কাজ না করে, তবে সেই দিনের ফাইন ভরতে হবে পাঁচশো করে। আর মেয়েদের, মানে তোমাদের স্ত্রীদের যে সমস্যার কথা বলছো, মানে, মাসের ওই চার কি পাঁচ দিন, সেই সমস্যার ও ওষুধ আছে আমার কাছে। আমাদের মালিকের চেনা ডাক্তার আছে।
ডাক্তারবাবু একটা ছোট সার্জারি করে , ওই মেয়েদের শরীর থেকে ওই অংশ বের করে দেবে, আর তারপর কোনোদিন তার আর ওই সমস্যা হবে না। আর সে কোনোদিন বাচ্চার জন্মও দিতে পারবে না। এবার তোমরা ভেবে দেখো, তোমরা টাকা কামিয়ে ভালোভাবে থাকবে , না কি, নিজেদের শরীরের কথা ভেবে – হাতে আসা লক্ষীকে পায়ে ঠেলে দেবে ? তোমরা ভেবে নাও, আমি একটু বসি এখানে। তবে বেশি সময় নেই বাপু আমার হাতে , তোমরা না বললে, আরো লোক আছে আসে পাশের গ্রামে। ওরাও যেতে রাজি আছে। তোমাদের এখানে গত কয়েকবছর বৃষ্টি হয় নি, পরের আট দশ বছর ও বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। তোমাদের কারোর কোনো রোজগার নেই, সেই সব ভেবে এখানেই আগে এলাম। তাড়াতাড়ি জানিও তোমরা। ”
লোকটা উঠে চলে যায় পেছনের দিকে, একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। মনে মনে ভাবে, পেট, পেটের দায়, পেটের জ্বালা বড়ো বেশি। আর এই টোপ ওরা লুফে নেবে , আমি জানি। কেউ আজ পর্যন্ত না বলেনি। এরাও বলবে না , পারবে না বলতে। নিজের শরীর এর সব অংশ ছিঁড়ে ফেলে দেবে, কিন্তু টাকা ওদের ও চাই। শুধু, স্বপ্ন দেখাও সেই টাকার। সেই যে গাধার সামনে গাজর ঝুলিয়ে রাখা ! একটু পরে লোকটি ফিরে আসে ওদের সামনে, “কি হলো ? কিছু ভাবলে তোমরা ? ”
“ভেতর থেকে বুধিয়া উঠে আসে , জি হুজুর। আমাদের এখনকার যা অবস্থা, তার থেকে তো ভালো হবে। কিছু টাকাও আসবে হাতে। সেই টাকা দিয়ে আমরা চলে যাবো পরের বছর শহরে। এখানে আর পারবো না এভাবে থাকতে। কতদিন ভালো করে খাই নি আমরা , না নিজেরা খেতে পেরেছি, না বাচ্চাগুলোকে খেতে দিতে পারি। আমরা রাজি হুজুর। ” “আর তোমাদের বৌয়েরা ? অপারেশন করবে তো ? ওটা না হলে কিন্তু তোদেরই ক্ষতি। তোদের টাকা ফাইন দিতে হবে দ্বিগুন। ”
“হ্যাঁ হুজুর। আমরা রাজি। আর কি বা হবে ওই সমস্যা কে সাথে নিয়ে ঘুরে। শালা প্রতি মাসের এই এক জ্বালা। পেট ব্যথা, সারা গা হাত পা অবশ হয়ে যাওয়া, কোনো কিছু ইচ্ছে করে না করতে, না পারি কাজ করতে, জামা কাপড় নোংরা হয়ে যায় ! কেন যে ভগবান আমাদের মেয়েদের এতো কষ্ট দিয়েছে কে জানে ! আমাদের দরকার নেই ওইসবের। ” চেঁচিয়ে ওঠে ইন্দু। ইন্দু আবার বলে, “কিন্তু কিভাবে ওটা হবে হুজুর ? ”
“তোদের আজকেই আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি , সবাইকে সত্তর হাজার করে। ওখানে তোরা চলে আয় আঠাশ তারিখের মধ্যে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে রাখবো। তোদের কিছু দিতে হবে না ডাক্তারকে। তোদের মজুরি থেকে কেটে নেওয়া হবে। আমি কাগজ রেডি করে রেখেছি , টিপ ছাপ দিয়ে দে দেখি একে একে। যা যা বলেছি সেটাই লেখা আছে ওই কাগজে। তোদের মধ্যে কেউ পড়তে জানলে, পড়ে নে ভালো করে। ” বলে ওঠে লোকটি। একে একে সবাই টিপসই করতে থাকে। গোপাল হাত ধরে ইন্দুকে টেনে নিয়ে যায় ঘরের ভেতরে। “কি করলে এটা তুমি ? তুমি নিজের শরীরকে শেষ করে দেবে এভাবে ? আমার দিদি এভাবেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমি জানতাম এদের কাজ কিরকম, আর তাই না বলছিলাম তোমাকে ! ”
“তুমি বেশি কথা বোলো না। আমি যা করেছি, ঠিক করেছি। এমনিতে তো আমাদের বাচ্চা হবে না আর। কি হবে শরীরের ওই জিনিস রেখে যেটার জন্য প্রতি মাসে আমাকে রক্ত ফেলতে হয় ? আর ওই রক্ত যখন বেরোয় তখন নিজেই তো তুমি ঘরে থাকতে পারো না , গন্ধ গন্ধ বলে সরে সরে থাকো। জামা কাপড়ে দাগ লেগে কি অবস্থা হয়। তার সাথে শরীর খারাপ। কি দরকার এইসব এর ? তার থেকে এটাই তো ভালো হলো, ওই ডাক্তার কি সব কেটে বাদ দিয়ে দেবে, আর সারাজীবন এইসব যন্ত্রনা থেকে মুক্তি ! চলো, বাইরে গিয়ে সই করবে। আর টাকার কথাটা ভেবে দেখেছো তুমি? কত টাকা, সেটা দিয়ে আমরা নতুন করে ভালোভাবে থাকতে পারবো ওই শহরে। বুঝেছো ? খালি তোমার আজেবাজে কথা সব। ” ইন্দু বাইরে বেরিয়ে আসে, গোপালকে নিয়ে। অসহায় হয়ে ইন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকে গোপাল, টিপ সই করে কাগজের ওপরে। “ডাক্তার ? বলছি খুব ব্যথা লাগবে ?”
“না না। ব্যথা কেন লাগবে ? এ তো আমাদের রোজকার কাজ। আর তোদের নিচের অংশ তো অবশ হয়ে থাকবে। কিছুই বুঝতে পারবি না তোরা। তোদের নাভীর নিচে কেটে দেওয়া হবে, তারপরে এই, এইযে যন্ত্রটা আছে এটা দিয়ে তোদের জরায়ু , টেনে বের করে আনবো। তোরা বুঝতেও পারবি না। তারপরে ওখানে স্টিচ করে দেবো , তোদের ছেড়ে দেবো। একদিন একটু শুয়ে থাকবি, ঠিক হয়ে যাবে। আর জরায়ু বেরিয়ে গেলে, তোদের ওই মাসিক বা পিরিয়ড আর হবে না কোনোদিন। আর তোরাও প্রতিদিন কাজ করবি, টাকা রোজগার করবি। কত লাখ লাখ টাকা তোরা পাবি রে। এই বুড়োটাকেও একটু দিস কিছু। তোদের কত উপকার করে দিচ্ছি আমি। ” বুড়ো ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকে সব মেয়েরা। সত্যিই, ডাক্তার-ই তো ভগবান !
গোপালের কাঁধে ভর দিয়ে ডাক্তারের কাছ থেকে বেরিয়ে আসে ইন্দু। খুব ব্যথা হচ্ছে, কিন্তু ডাক্তার বলেছে, একদিনে সব ঠিক হয়ে যাবে। দুদিন পরেই কাজ শুরু করতে হবে, মাসের এক তারিখ যে ! গোপালের সাথে এসে ঢোকে ওদের ঘরে। ঘরগুলোর অবস্থা খুব খারাপ। বাশ দিয়ে তৈরী কাঠামো, তার ওপরে নীল প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা , ভেতরে সমান মাটির ওপরে একটা করে মাদুর রাখা। এখানেই থাকতে হবে পরের ছয় মাস। কোনো জলের ব্যবস্থা নেই, নেই কোনো ইলেকট্রিসিটি। ইলেক্ট্রিসিটির কি দরকার, আগেও তো ছিলো না। কিন্তু জল ? চাষের জমির একধারে রয়েছে একটা কুয়ো, বিশাল বড়ো কুয়ো। সেখান থেকেই জল নিয়ে আসতে হবে। ব্যথায় হঠাৎ ইন্দু কাতরে ওঠে। গোপাল ওর মুখের ওপরে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, “কষ্ট হচ্ছে তোমার ? ”
গোপালের হাত নিজের হাতের মধ্যে চেপে কোনোরকমে মুখে হাসি এনে বলে ইন্দু, “না গো। আমার কষ্ট হচ্ছে না গো একটুও। আমি ভাবছি, আমাদের যখন অনেক টাকা হবে, তুমি আমাকে একটা শাড়ি কিনে দেবে ? আর ওই মেলাতে আমরা ঘুরবো, সিনেমা দেখবো। আমি লিপস্টিক লাগাবো, তোমাকে না একটা কালো চশমা কিনে দেবো। তোমাকে খুব মানাবে গো। ” “তুই, তুই ঘুমিয়ে পড় ইন্দু। তুই ঘুমো এখন। ” দু দিন পরে, সবাই একসাথে কাজ শুরু করে। সকালে সাতটার সময়ে হঠাৎ সাইরেনের শব্দে ঘুম ভাঙে ওদের। তাড়াতাড়ি করে কিছু খেয়ে নিয়ে, সকালের কাজ শেষ করে, আটটার সময়ে এসে হাজির হয় মাঠের একদিকে। মালিক ও আসে, ওদের ভালো করে দেখে।
মালিক বলে উঠলো, “তাহলে আজ থেকে তোমাদের কাজ শুরু হলো। যা বলা হয়েছিলো, সেটাই যেন হয় রোজ। প্রতিদিন এক একজন স্বামী-স্ত্রী মিলে, চার টন আখ তুলবে , বিকেলে তিনটের মধ্যে। তারপর গাড়ি আসবে, সেই গাড়িতে আখ তুলে দিতে হবে। সেই গাড়ি যাবে ওই যে পেছনের ফ্যাক্টরি, ওখানে। দুপুরে একটা পর্যন্ত কোনো বিশ্রাম নেওয়া যাবে না, যদি কেউ বিশ্রাম নেই, প্রতিদিনের যা মজুরী, তার দ্বিগুন কেটে নেওয়া হবে। আর চার টনের কম আখ ছাড়ালেও , দ্বিগুন মজুরী কাটা হবে। তবে কেউ যদি বেশি আখ ছাড়াস, মানে ধরে নে পাঁচ টন, তাহলে সে একটু বেশি টাকা পাবে। আর তোদের সব হিসেবে করে রাখা থাকবে, একদম ছয় মাস শেষে সব টাকা পাবি তোরা। শুরু করে দে কাজ। ” মালিক যাওয়ার আগে ভালো করে দেখলো সব মেয়েদের একবার, মোটা কালো হয়ে যাওয়া জীভটা বুলিয়ে নিলো নিজের শুকনো ঠোঁটের ওপরে।
কেটে গেলো বেশ কিছুটা সময়। সবাই কাজ শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎ তলপেটে ব্যথা শুরু হয় ইন্দুর আর আরো কয়েকজন মেয়ের। সবাই বসে পড়ে পাশে। তাদের দিকে ছুটে আসে তাদের স্বামীরাও। ওদের চুপ করে বসে যেতে দেখে, কয়েকজন গার্ড দৌড়ে আসে ওদের দিকে। চেঁচিয়ে ওঠে ওরা , “বসে থাকলে চলবে না, বসে পড়লেই কিন্তু ফাইন। বারবার বলেছি তোমাদের। ওহ, ওই লোকটা যে কোথা থেকে সব মেয়েদের নিয়ে আসে কে জানে। কাজ পারে না কিছুই করতে পারে না। এই, ওঠো তোমরা। ” পুরুষদের দিকে তাকিয়ে গর্জে ওঠে, “কি হলো তোমাদের ? তোমরা কাজে ফিরে যাও। মালিক জানতে পারলে কিন্তু খুব অশান্তি হবে। ”
প্রচন্ড ব্যথা পেটে নিয়েই, উঠে দাঁড়ায় মেয়েরা , সেই অবস্থায় আবার শুরু করে কাজ ধীরে ধীরে। স্টিচে খুব তন্ পড়তে থাকে ইন্দুর। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করতে থাকে গোপালের পাশে দাঁড়িয়ে। গোপাল আলতো কোমল স্বরে বলে ওঠে, “তুমি বসে একরু বিশ্রাম করো। আমি এখানে আখ ছাড়াচ্ছি। ” “না গো ! তুমি একা করলে হবে না। একা পারবে না অতো কাজ করতে। আমাকে করতেই হবে। আর একটু ব্যথা , আমি সহ্য করে নেবো গো। ভাবো তো কত টাকা পাবো আমরা ! ” চলতে থাকে ওদের লড়াই, রোজ, দিনের পর দিন। কেটে যায় সপ্তাহ দুই।
এক রাতে, হঠাৎ গোপালের ঝুপড়ির সামনে এসে হাজির হয় কয়েকজন। গোপাল আর ইন্দু কে নিয়ে যায় সাথে করে ওরা, ফ্যাক্টরিতে। ফ্যাক্টরিতে গোপালকে নিচে অপেক্ষা করতে বলে ইন্দুকে নিয়ে যায় ওপরে মালিকের কাছে। মালিক বসেছিলো মদের গ্লাস হাতে। হাসতে হাসতে ইন্দুকে ডাকে পাশে। বসতে বলে। ইন্দু ভয় পায়, অস্বীকার করে। মালিক বলে ওঠে, “তোকে আরো ভালোভাবে রাখবো রে আমি। আয়, আমাকে আজ একটু সুখী করে দে। বেশি সময় লাগবে না রে। আয়। কাছে আয়। বলতে বলতে মালিক ধুতি খুলে এগোতে থাকে ইন্দুর দিকে। ইন্দু চেঁচিয়ে ওঠে, গোপালের নাম ধরে ডাকে। গোপাল ওপরে উঠতে গেলে ওর হাত ধরে ওকে আটকে রাখে কয়েকজন। ইন্দু পালাতে যায়, দরজা ভেতর থেকে জোর করে বন্ধ করে রাখা। কোনো কিছু বুঝতে না পেরে, সামনের বড়ো জানালা দিয়ে লাফ দেয় ইন্দু। আর্তনাদ করে ওঠে ও, একটু পরে ধুপ করে মাটির ওপরে ভারী কিছু পড়ার শব্দ। নিস্তেজ হয়ে, পড়ে থাকে রক্তাক্ত ইন্দু। মালিক মুখ দিয়ে চুকচুক শব্দ করতে করতে , ধুতি পরে নিচে নেমে আসে।
গোপাল চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় ? কোথায় আমার ইন্দু ? ” “জানি না রে। ওকে একটু আমার পা টিপে দিতে বললাম, কি যে হলো ওর ! খোলা জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে দিয়েছে। দেখ তো তোরা গিয়ে মরে আছে না বেঁচে আছে ? তোরা যে কি করিস না। মেয়েটাকে বললাম , আরো টাকা দেবো, তোরা আরো ভালোভাবে থাকতে পারবি। কিন্তু। যাক গে। তুই ফিরে যা। ” গর্জে ওঠে গোপাল, “ছাড়বো না আমি, ছাড়বো না ! সবাইকে শেষ করে দেবো ! ”
হা হা হা হা করে হেসে ওঠে মালিক। রক্তাক্ত চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে গপালের মুখের সামনে নিজের মুখ এনে চেঁচিয়ে ওঠে, “তাই ? আমাকে শেষ করে দিবি ? কি করে করবি ? এইরকম দুর্ঘটনা, প্রতি বছর হতেই থাকে কিছু না কিছু। সবাই, সব জানে, বোঝে। কিন্তু মুখ খুললে কি হবে জানিস ? তুই তো এখান থেকে পারবি না বেরোতে , আর তুই প্রমাণ ও করতে পারবি না কিছু। তোর কি আছে ? জোর আছে? ক্ষমতা আছে তোর? আমার এই মহান দেশ – আখ এক্সপোর্ট করে সারা পৃথিবীতে আজ দ্বিতীয় স্থানে। আমাদের দেশ প্রতি বছর পাঁচশো বিলিয়ন ডলার ব্যবসা করে এই আখ এক্সপোর্ট করে, ডলার বুঝিস তুই ? ডলার ? শালা , টাকাই চিনলি না, তো ডলার ! আর আমাদের এই রাজ্য – মহারাষ্ট্র, আমরা আখ উৎপাদনে দ্বিতীয় সারা দেশের মধ্যে। আমাদের দিকে কে হাত দেবে ? কোন সরকার ? কোন প্রশাসন ? কেউ না ! কেউ আমাদের ঘাঁটায় না ! তুই কে ? যা যা ! গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। কাল আবার কাজ করতে হবে। আর বৌ গেছে তো। ভয় পাচ্ছিস কেন ? আবার একটা বিয়ে করে নিবি না। যা তো ! এই একে কেউ ছেড়ে দিয়ে আয় বাইরে। আর বেশি কিছু করলে, তোরা জানিস কি করতে হবে ! ”
মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায় গোপাল। কোনো কিছুই আর বলতে পারে না। বিড়বিড় করে বলে নিজের মনে, “বারবার বলেছিলাম ইন্দু, দরকার নেই আমার এতো টাকার , দরকার নেই এই জীবনের। শুনলি না ! শুনলি না রে ! ” দু চোখ ছাপিয়ে জল বেরিয়ে আসে,, থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দৌড়ে যায় ও ইন্দুর কাছে , গলায় তীব্র এক আর্তনাদ ইন্দু উউউউউউউ !!!
সমাপ্ত