একটা আবিষ্কার

একটা আবিষ্কার

গতকাল মাঝরাতে ফ্লাইটে আমরা নাতি পিন্টু হায়দ্রাবাদ থেকে রওনা হয়েছে আমেরিকার পথে, গন্তব্যস্থল ‘নাসা’, আমেরিকার স্পেস রিসার্চ সেন্টার I দেশ থেকে এস্ট্রো ফিজিক্স নিয়ে পাস করে এক্সট্রা টেরিস্ট্রিয়াল লাইফের ওপর ওর নিজের কিছু কাজ করতে করতে পিন্টুর ডাক এলো আমেরিকার ‘নাসা’ থেকে, সেখানে জয়েন করতে; পিন্টুর ও তার বাড়ির সবার বহুদিনের ইচ্ছা যে, এই পৃথিবীর বাইরে কোনো গ্রহে প্রাণী আছে কিনা বা থাকলে তাদের স্বভাব, জীবনধরণের প্রণালী ইত্যাদি সমন্ধে জানতে I

প্রিয় নাতিকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে আসার পর থেকে আমার মনটা খুব ভার হয়েছিল, প্লেন ছেড়ে ছিল ভোর চারটেতে, সেই ভোর রাতে ঘরে ফিরে আর ঘুম হয়নি, তাই দুপুরে স্নান খাওয়া সেরেই চেয়ারে বসে টিভি চালালাম মনটাকে একটু হালকা করতে; একটু পরেই আবার বাজার বেরুতে হবে মেয়েকে আর বৌকে নিয়ে, ওরা তৈরী হচ্ছে বাজার যাবার জন্যে, ততক্ষনে আমি একটু ইজি চেয়ারে বসে টি ভি দেখি, মেয়েদের তৈরী হতে অনেক সময় লাগে তো৷

কতো কি মনে আসতে লাগলো, পিন্টুর প্লেন তো নিশ্চয় এতক্ষণে বহুদূর উড়ে গেছে গতকাল সন্ধ্যে বেলাতে হায়দ্রাবাদ থেকে ফ্লাইট ধরার আগে ঘরে কম্পিউটার ওয়েবক্যামে ওর সাথে কথা হয়েছে ওর একমাত্র মাসি আর ভাইটির সাথে; মাসিকে ও ছেলেবেলা থেকে বোনটি বলে ডাকে, কারণ ওর মা তার বোনকে বোনটি বলে ডাকে I বোনটি তাকে প্রতিবছর রাখীর দিনে হাতে রাখীও বাঁধে I

পিন্টু ওয়েবক্যামে ভাইয়াকে বলেছে যে, ও আমেরিকাতে একটু স্থিতু হয়ে ভাইয়াকে ওখানে নিয়ে যাবে এজুকেসনের জন্যে; ওদিকে আবার সামনে ওর নিজের অনেক বড় ভবিষ্যত, অনেক আশা যে ও এক্সট্রা টেরিস্ট্রিয়াল লাইফের রহস্য আবিষ্কার করবেই, এইসব অনেক কথা মনে করেও মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে I

হয়তো পিন্টুরও মনটা খারাপ হয়ে আছে; গতরাত্রে এয়ারপোর্টে সে দেখে গেছে মাযের জল ভরা চোখ, ছেড়ে এসেছে বাবার স্নেহ ভরে বুকে জড়িয়ে ধরা, আর ছেড়ে এসেছে তার প্রিয় নান্না, দাদু আর তার ঠাম্মার বুক ভরা স্নেহ ভালবাসা; (পিন্টু তার দিদাকে ছেলেবেলা থেকে নান্হা আর ঠাকুমাকে নাম্মা বলে ডাকে)৷

আমি বসে বসে ভাবছি এতক্ষনে প্লেন নিশ্চয় উড়ে চলেছে, নিচে পেরিয়ে যাচ্ছে গ(ন্ডIয়ানাল্যান্ড আর লরেসিয়া; ছেলেবেলায় ভূগোলে আমিই ওকে পড়িয়েছি যে হাজার হাজার বছর আগে পৃথিবীর দেশগুলো সব এক জায়গাতে জড়ো হয়েছিল, পরে প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে সব আলাদা আলাদা হয়ে যায় – কন্টিনেন্টাল ড্রিফটিং I

পিন্টু বড় ম্যাপ নিয়ে প্রত্যেকটা দেশকে আলাদা আলাদা করে কেটে তাদেরকে খাঁজে খাঁজে জোড়ার চেষ্টা করে দেখেছে যে ব্যাপারটা সত্যি ! আবার নাতির চিন্তায় ডুবে গেলাম – অনেক আশা যে সে নিশ্চয় কিছু করতে পারবে; আমার ছেলে বেলা থেকে এই এক্সট্রা টেরিস্ট্রিয়াল লাইফের ওপর খোঁজ করার খুব ইচ্ছা ছিল কিন্তূ সুযোগের অভাবে হয়নি, তাই ভাবছি পিন্টু যদি এর রহস্য আবিস্কার করতে পারে তো সারা দুনিয়ায় একটা আলোড়ন পড়ে যাবে !

হঠIৎ ফোনটা বেজে উঠলো….উঠিয়ে হ্যালো বলতেই ওদিক থেকে নাতির গলা ভেসে এলো.. .দাদু আমি পৌঁছিয়ে গেছি, এখন রিসার্চ সেন্টারে এসেছি, সব ঠিক আছে, ‘নাসা’ থেকে গাড়ি এসেছিল এয়ারপোর্টে আমাকে নিতে, দারুন হোস্টেল, খুব ভালো রুম দিয়েছে আমাকে – রুমটা একদম ফাইভস্টার হোটেল হোটেলের মতো ; তুমি আর নান্হা কিছু চিন্তা করবেনা, আমি মাম্মিকেও বলে দিয়েছি কিছু চিন্তা না করতে, আমি একটু গুছিয়ে নিয়ে তোমাদের আবার ফোন করব, এই বলে লাইনটা কেটে দিল I

যাক আমি একটু নিশ্চিন্তি হলাম যে সব ঠিকঠাক ছিল আর ভালোভাবে পৌঁছিয়ে গেছে; ওর আওয়াজ শুনেতো মনে হলো বেশ খুশি আছে I দিন কাটছে, নাতির সাথে রোজই প্রায় ওয়েবক্যামে কথা হয়; ওর কাজ এগুচ্ছে, ওর গাইডরা খুব খুশি ওর কাজের গতি আর ফল দেখে I

একদিন হঠাৎ মাঝরাতে ফোনটা বেজে উঠতে ঘুম ভেঙ্গে গেল, এত রাত্রে কে ফোন করবে ! ঘড়ি দেখলাম তিনটে বাজছে. ফোনটা ওঠাতেই ওদিক থেকে নাতির গলা শোনা গেল…দাদু শোনো…হাতে সময় খুব কম,…কাল সকালে তোমরা তোমাদের সময় আটটাতে টিভি নিউজটা নিশ্চয় দেখবে, মাম্মিকেও ফোন করে বলে দিয়েছি, দারুন ইন্টারেষ্টিং খবর….এর থেকে আর বেশি কিছু বলতে পারছিনা এখন, আমার ফোন হয়ত বন্ধ থাকবে, তোমরা আমাকে ফোনে পাবেনা, তবে আমি সময় পেলে তোমাদের ফোন করব, কারণ আমি এখন কিছুদিন আমেরিকার বাইরে থাকব আর খুব ব্যস্ত থাকব, তবে কিছু চিন্তা কোরোনা সব ঠিক আছে, ভালো আছে কিছু অবাক করার মত খবর পাবে খুব শিগগির এই বলে লাইনটা কেটে দিল I

আমি প্রথমটা ছিলাম ঘুমের ঘোরে, কিন্তু ওর এইসব কথা শুনে ঘোরটা কাটতে বেশি সময় লাগলো না, ওদিকে এত রাত্রে আমাকে ফোন করতে শুনে বৌ এর ঘুম ভেঙ্গে গেছে, ও একনাগাড়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলো কার ফোন ইত্যাদি.., আরে আমি তো ঘুমের ঘোরে, আগে বুঝে নিই ব্যাপারটা কি I

পিন্টুর ফোনটা ড্রপ হতে বৌকে বললাম পিন্টুর ফোন ছিল, বলল খুব কিছু ইন্টারেষ্টিং খবর আছে; কাল সকালের টিভি নিউজ শুনতে বলল, দেখি একবার মেয়েকে ফোন করি, পিন্টু ওকেও নাকি ফোন করে বলেছে সব I
মেয়েক ফোন করতে বলল বাবা বুঝতে পারছিনা ব্যাপারটা কি, আমার তো খুব ভয় করছে, পিন্টু মনে হলো খুব এক্সাইটেড, নিশ্চয় বড় কিছু হয়েছে; কারণ ও মাঝে মাঝেই বলত একটু অপেক্ষা কর, দুনিয়াকে একটা তাক লাগিয়ে দেব খুব শিগগির I

বলাই বাহুল্য এর পর আর আমাদের কারুর ঘুম হ’ল না, খুব ভোরে ঘরের সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ালো, মেয়ে আর জামাই এসে নামল, বলল আর থাকতেই পারলাম না, ভাবলাম এখানে এসেই চা খাব আর নিউজটা শুনব; যাক আমাদেরও ভালোই হলো, রাত্রে ফোন পাওয়ার পর থেকে আমরাও খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম কাল, আবার একটা এক্সাইটমেন্টও আছে I

যাইহোক, চা খেতে খেতে খেতে সকাল সাড়ে সাতটার থেকে CNN আর ইউরো নিউজ এর চ্যানেল ঘোরাতে লাগলাম; ঠিক আটটার সময় থেকে বলতে লাগলো ভারতীয় বৈজ্ঞানিকের অসাধারণ কৃতিত্ব, ‘নাসা’ কেন্দ্রের এক ভারতীয় বৈজ্ঞানিক পিনাকীর (পিন্টুর ভালো নাম পিনাকী) যুগান্তকারী আবিষ্কার! এক্সট্রা টেরিস্ট্রিয়াল লাইফের ওপর অনুসন্ধান করতে করতে পিনাকী চক্রবর্তী এক নতুন গ্রহের খোঁজ পেয়েছে এবং সেই গ্রহে আমাদের পৃথিবীর মানুষের মত লোকজনদেরও দেখা পেয়েছে, এই বৈজ্ঞানিক এখন ওই সব লোকজনদের সাথে যোগাযোগ করছে; আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিজে এই খবরের সত্যতা স্বীকার করে সারা বিশ্ববাসীকে এই খবর জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন; উনি আরও বলেছেন যে পিনাকী চক্রবর্তী তার বৈজ্ঞানিকদের দল নিয়ে ওই গ্রহের লোকদের আমন্ত্রণে আজ ‘নাসা’ সময় সন্ধ্যে সাতটায় সেই গ্রহের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে!

আমরা তো একেবারে হতবাক!একি খবর শুনছি!এ যে একেবারে অকল্পনীয়! অভাবনীয়!! এত কম সময়ের মধ্যে এত বড় কালজয়ী আবিষ্কার! ওর ‘নাসা’তে জয়েন করার তো এখনো একবছরও হয়নি, এইতো সেদিন আমেরিকা গেল ! সকাল আটটার মধ্যে সারা শহরে খবর ছড়িয়ে যেতে ঘন ঘন ফোন আসতে লাগলো মেয়ে আর জামাইয়ের কাছে শুভেচ্ছা জানিয়ে; তারা সব জানতে চাইছে যদি আরও কিছু খবর থাকে তো জানাতে I

এরপর সুরু মিডিয়া আর প্রেসের লোকেদের আসা, বাড়ির সামনে ভিড় করে সব জমা হয়েছে; ওদিকে ইন্ডিয়ান টিভি চ্যানেল গুলো থেকে খবরের প্রচার সুরু হয়েছে, সঙ্গে পিন্টুর ছবি ইত্যাদি এই চলতে লাগলো বেশ কিছু দিন ধরে এরপর একদিন টিভিতে খবর দিলো পিন্টু তার দলবল নিয়ে ওই গ্রহ থেকে ফিরে আসছে, সঙ্গে ওই গ্রহের ১০ জন প্রাণীকে নিয়ে, এবার সকলের আরও অবাক হবার পালা !! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আর সে দেশের লোকেরা সব অপেক্ষা করছে ওদের রিসিভ কররার জন্যে I

এদিকে আমাদের উত্তেজনার শেষ নেই, সারা দিনরাত ওই আলোচনা, চারিদিক থেকে ফোন, সে এক অদ্ভুত অবস্থা আমাদের ! যাইহোক, ঠিক সময়ে পিন্টুদের স্পেস ক্রাফট প্রশান্ত মহাসাগরে এসে নামল, ওদেরকে নিয়ে সে কি অভূতপূর্ব সম্বর্ধনার ব্যবস্থা! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিজে এসেছেন ওদের রিসিভ করতে ! এর প্রায় সপ্তাহ খানেক পরে পিন্টুর ফোন এলো যে ও ইন্ডিয়া আসছে কয়েকদিনের জন্যে; আমরাতো খুব খুসি, আমরা সব তৈরী হচ্ছি এয়ারপোর্টে যাব ওকে আনতে I

হঠাৎ মনে হলো কে যেন আমাকে ধাক্কা দিল – কি হলো যাবে না? ইজিচেয়ার থেকে উঠতেই বউ বলল বাহ! বেশ একটা ঘুম মারলে, বাজার যাবে বলে যে আর সাড়া শব্দ নেই… আমি বললাম হ্যাঁ চল চল, পিন্টুর প্লেনের এর সময় হয়ে গেছে, এই বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে আমার বৌ বললো পিন্টুর প্লেন! আমরাতো বাজার যাবো! আমি দেখলাম আমার মেয়ে পাসে দাঁড়িয়ে আছে, ওরা দু’জন আমার দিকে কি রকম অদ্ভুত চোখে তাকালো (অবশ্য ওদের যখনই আমার মাথার সম্মন্ধে সন্দেহ হয় তখনই দেখেছি যে ওরা আমার দিকে এই রকম দৃষ্টিতে তাকায়, এটা আমি জানি)!

বৌকে বিড় বিড় করে বলতে শুনলাম এর মাথাটা একেবারেই গেছে; তখন আমার মনে হলো আমি বোধহয় একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম; ভাবতে লাগলাম যা বাবা !তাহলে কি পুরোটাই স্বপ্ন ছিল? তাইতো ! পিন্টু তো কালকেই আমেরিকা রওনা হলো তবে যে যাই বলুক না কেন, আমার এই স্বপ্ন একদিন সত্যি হবেই, আমি যা পারিনি আমার নাতি নিশ্চয় তা পারবে, পৃথিবীটা সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে বলাতে গ্যালিলিও কেও সবাই পাগল বলেছিল….

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত