এমনও হয়

এমনও হয়

শ্রুতির দেহ দাহ করে ফিরতে ফিরতে সনৎ মনে মনে হাসে | মেয়েটাকে পড়িয়েছিল, ভালো করে মানুষ করেছিল | সাধ্যের বাইরে গিয়ে পড়িয়েছিল | পাড়ায় কেউ বলতে পারবেনা | কত কথা লোকে শুনিয়েছে তাকে | রিক্সাওয়ালার মেয়ে কিরে কালেক্টর হবে ? কত কথা | বৌয়ের কথায় কান না দিয়ে মেয়েকে ইউনিভার্সিটি তে অব্দি ভর্তি করেছিল | মেডেল নিয়ে এসে মেয়ে তার পাড়ার সবার মুখ বন্ধ করে দেয় | পাড়ায় তখন সবাই শ্রুতির নাম করে ছেলেমেয়েদের উদাহরণ দিত |

— “শ্রুতিদিদির মতো হতে হবে |”

মনে মনে হাসে সনৎ | তার বৌয়ের পাল্লায় পড়লে তো মেয়েটার কবে বিয়ে হয়ে যেত | তবে মেয়ে টিউশনি করে দিব্বি ঘরের খরচ চালাতো | শেষে তো তার বৌ ও মেনে নিয়েছিল | কোনো বড় ঠাকুর চেয়েছিল বলে তাদের ওই ঝুপড়িতে এই মেয়ে জন্মেছিলো | এর জন্মানো উচিত ছিল কোনো বড় ঘরে | সারা পাড়া নেচে উঠেছিল যেদিন শ্রুতির প্রথম চাকরির কাগজটা আসে | প্রথমবারে পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরি |

— “তোমরা তো আর এখানে থাকবেনা বলো, সনৎদা | ”
— ” কিযে বলো, ভিটে ছেড়ে কেউ যায় | ”

তারা কিন্তু যায়নি | তবে মেয়ে এই ঝুপড়ি টাকেই সরিয়ে গুছিয়ে রং করে এক্কেবারে নতুন বানিয়ে দিয়েছিলো ! তখন কি আর জানতো | সেদিন ওই মাস ছয়েক আগের ঘটনা হবে | মেয়েটা স্কুল সেরে টিউশন সেরে বাড়ি ফিরছিলো | কদিন ধরে একটা খুসখুসে কাশিতে ভুগছিল সনৎ | ওটাই কাল হলো মেয়েটার | বৃষ্টি পড়ছিলো, তার মধ্যে বাপের ওষুধ খুঁজতে বেরিয়েছিল | সেখান থেকেই তুলে নিয়ে যায় | তারপর কপালপুড়িটাকে জানে না মেরে ছেড়ে দিয়েছিলো , কেন যে মেরে ফেললোনা !!

মেয়েটা ঘরে ফিরে পুলিশ এ গেল | সেখানে সব আজেবাজে প্রশ্ন | হাসপাতালে হয়রানি | কোর্ট কাচারী| সেদিন রাতে ও যখন ফিরলো কেউ কিচ্ছুটি জানেনা, সনৎ আর ওর বৌ দুজন মিলে মেয়ের হাতে পায়ে পড়েছিল, “করিসনি, এসব পুলিশ উকিলের চক্করে পরিসনি ” — সে কি আর কথা শোনে ! রিক্সওয়ালা বাপের মাস্টার ডিগ্রী করা মেয়ে | তার এসব সমাজের লজ্জার ধার নেই, সে জানে নিয়ম, কানুন ! দেখ কেমন লাগে ! পুলিশ কি আর তাদের মতো লোকেদের কথা শোনে | উল্টে দারোগাবাবু একদিন সনৎ কেই ডেকে পাঠিয়ে লক আপে পুড়ে মারধর করে | ছেলেগুলো বড়ঘরের বিগড়ানো হীরের টুকরো ছিল সব | তাদের বাপেদের অগাধ টাকা | ক্রমে পাড়ায় রটলো | যারা মেয়ের নাম বড়াই করতো তারাই কু গাইতে লাগলো | মেয়ে পড়ালে কি হয় তার ফল নাকি শ্রুতির ঘটনা ! মেয়ে জন্মালে তাকে না পড়িয়ে ঘরকন্না শিখিয়ে বিয়ে দিলে আজ সনৎদের কত মুখ উজ্জ্বল থাকতো ! তা না ! বোঝো এবার !

কোর্ট কাচারীতে এতো মাস কেটে গেল | এর মধ্যে শ্রুতিকে রাস্তায়, স্কুলে নানান জায়গায় হেনস্তা করা হচ্ছিলো | কটূক্তি, অঙ্গভঙ্গি, এমনকি তার সহকর্মী তাকে সহবাসের কুপ্রস্তাব অব্দি দিয়েছিল | দাঁতে দাঁত চেপে মেয়েটা লড়ে যায় | শেষে যা হওয়ার তাই হয় | মাস খানেক আগে কোর্ট এ রায় চারজন একসাথে বেকসুর খালাস হয় | চোখের জলে মেয়েকে নিয়ে সনৎ বাড়ি ফেরে | সে ভেবেই নিয়েছিল এখানকার পাট চুকিয়ে তারা চলে যাবে | মেয়েটা সেই প্রথম বড্ডো ভেঙে পড়েছিল | রাত ১টা নাগাদ দরজার কড়ায় নাড়া পরে | দারোগা নিজে এসেছিলো সঙ্গে আরো পাঁচজন | সনৎ আর ওর বৌ কে মেরে ধরে ঘরের এক ধারে আটকে রাখে | নিজেদের একমাত্র মেয়ের সেই ভয়াবহ আর্তনাদে আর নিজেদের অসহায় চিৎকারে সেদিন রাতটা কেটেছিল |

— “যে শিক্ষাটা দিলাম মনে রাখিস ! শালা !”

তার বৌ এর মুখে এক লাথি মেরে দারোগা নিজের সাগরেদদের নিয়ে বিদায় হয়েছিল | ঘরে ছুটে গেছিলো ওরা দুজনে | রক্তাক্ত নগ্ন আঁচড়ে কামড়ে মারাত্মক আহত, হাত মাথার ওপর বাঁধা, আর পা দুটো ছড়িয়ে খাতের দুধারে বাঁধা — যোনি থেকে গভীর ভাবে রক্তক্ষরণ হয়ে চলা শ্রুতির সেই অবচেতন রূপ দেখে তার মা সেদিন মূর্ছা গেছিলো | সনৎ মেয়ের বাঁধন খোলে, মেয়েটাকে পরিষ্কার করে | আশেপাশে সবাই শুধু স্তব্দ ভাবে শুনলো, কেউ এলোনা !
মেয়েটাকে গরম জলে ধুয়ে, দুধ খাইয়ে, ঘরে থাকা মলম ডলে… কোনো লাভই হয়না | বাহ্যিক ক্ষততে মলম কাজ দেয়, মেয়েটাকে যে পুরো আত্মা থেকে মেরে দিয়ে গেল ! মরেনা কেন ? এতো অত্যাচার সয়ে মরেনা ! এমনই কপাল ! শেষে মরলো, বাপের ইচ্ছেপূরণ করে | আত্মহনন করে | এই দিন পাঁচেক আগে | সেই রাতের অত্যাচার ও সে ভুলিয়ে উঠে চাকরি তে আবার যাচ্ছিলো | টিউশনি সব ছুটে গেছে তার বদনাম বলে | চাকরিটা যায়নি, সরকারি বলে কথা !

বাঁধ সাধলো দিন সাতেক আগে, পাড়ার ছেলেগুলো হঠাৎ শ্রুতিকে দেখে হাসাহাসি শুরু করলো | রাস্তায় কটূক্তি যেন একটু বেড়ে গেল | লোকজন যেন কেমন বেপরোয়া হয়ে শ্রুতিকে দেখলে হাত বাড়াতে শুরু করেছিল | শেষে জানা গেল, সেই প্রথম চারজন শুধু ধর্ষণে শান্তি পায়নি | আজ এতো মাস বাদে একটা ভিডিও ছেড়েছে শ্রুতির অত্যাচারের, তার অজ্ঞান নগ্ন দেহকে নানানা অঙ্গভঙ্গিতে সাজিয়ে | ফোনে ফোনে তা ছড়িয়ে পড়েছে ভূভারত ছাড়িয়ে পৃথিবীর বিস্তার প্রান্তরে |

শ্রুতিকে তার স্কুলের প্রিন্সিপাল সেই ভিডিও পাঠিয়ে নিজের গোপন শখের ইচ্ছে প্রকাশ করে ! টাকা দিতেও তিনি নাকি রাজি ! শুধু এই এক ব্যক্তি নয়, শ্রুতির কাছে এই ভিডিওর সাথে এইধরণের সহস্র নোংরা প্রস্তাব এসে হাজির হয় ! প্রত্যেকে তার চেনা, তার আপন , তার ভাই, তার বন্ধু, তার ছাত্র, তার ছাত্রদের বাবা, তার পরিবারের আত্মীয় !!
সমাজের এই চাপা নোংরা দিকটা মেয়েটা আর সহ্য করতে পারেনি ! গলায় দড়ি দিয়েছিল ! সনৎ এর জীবন তো খালি করে সে চলে গেল, অদ্ভুত ভাবে সেদিন দাহ করে ফিরতে ফিরতে পাড়াপড়শিরা , — “যাক এবার তোর শান্তি !”, “এটা তো অনেক আগে হতে হতো ” — এক সদ্য সন্তানহারা বাপকে এই ধরণের অদ্ভুত কথায় আশ্বাস দিয়েছিল ! সনৎ কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু মনে মনে হেসেই গেছিলো ! এখানে আর তারা থাকবেনা ! কালই তাদের শেষ দিন !

কান্তির এইধরণের ধর্ষণের এটা দ্বিতীয় কেস | আগেরবার সে জিততে পারেনি | শ্রুতি নামে মেয়েটা পরে সে শুনেছিলো আত্মহত্যা করেছে নাকি | কান্তি কেন জানিনা নিজেকে তার জন্য দায়ী ভাবতো | শ্রুতির সাথে তার কতটাই বা পার্থক্য | কান্তির বাবা, সদ্য প্রয়াত বাবলু সোরেন, সুন্দরবনে মাছ ধরতো | সেখান থেকে পড়াশুনা করে কান্তি আজ উকিল | এদিকে সে পারলোনা | ছেলে চারটেকে দেখেই সে প্রথমদিন বুঝেছিলো যে ঘটনাটা সত্যি | আর এখন তো শ্রুতির যেধরনের ভিডিও বেরিয়েছে | মেয়েরা বড় অসহায় ! না, না ! মোটেও না ! আগে হলে তো শ্রুতির মতো মেয়েরা সামনেই আসতনা | এখন তো তাও আসছে, লোকে জানছে !

যেমন এই মেয়েটা বর্ষা | সাধাসিধা মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে | এড এজেন্সিতে কাজ করতো | সেই এজেন্সির মালিকের লালসার শিকার | মেয়েটা দিনের পর দিন শুধু চাকরিটার দায় সব সহ্য করে গেছে! শেষে দিন দশেক আগে, .. শ্রুতি দাহ হলো দিন দশেক আগে যাকগে দিন দশেক আগে, বর্ষাকে এক পার্টির পর বাড়ি ছাড়তে যাওয়ার নাম করে নিজের বাড়িতে নিয়ে তোলে তার বস | তার আগে বর্ষার জুসে কিছু ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল | সকালে মেয়েটির জ্ঞান ফিরতে সে বাড়ি না গিয়ে সিধে থানায় যায় ! সব রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে শেষে কেস এসেছে কান্তির কাছে ! কান্তি একে ন্যায় এনে দেবেই | কিছুতেই সে শ্রুতির ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেবেনা ! কান্তি জানে সেই রাতের দারোগার ঘটনা ! এখানে কোর্ট এ সবাই জানে ! দারোগাকে পাঠিয়েছিল কে সেটাও সবাই জানে ! কি অদ্ভুত , “irony ” বোধহয় এটাকেই বলে ! এক কোর্ট ভর্তি উকিল, জজ, একটা আদালত, সবাই সব কিছু জানে, এদিকে সেই চোখে কাপড় পড়া মহিলার দোহাই দিয়ে সবাই চুপ! আদৌ কি এখানে ন্যায় বিচার হয়?

কান্তির সাথে কিছুদিনের মধ্যেই বর্ষার দেখা হলো, বর্ষার বাড়িতে ! যেকোনো ধর্ষিতার মতো বর্ষা অদ্ভুত পুতুলের মতন অভিব্যক্তিহীন এক মুখ নিয়ে তার সাথে আলাপ করল | তার মুখের ক্ষত তখন সম্পূর্ণ বিলীন হয়নি | স্বাভাবিক ভাবে সে তখন হাটতে পারছেনা | তার ওপরে সোডোমি বা পায়ুকাম করা হয়েছে ! অতীব ঘৃণ্য ! কান্তি শান্তভাবে বর্ষাকে বোঝালো, তার বাড়িরই লোকেদের সান্তনা দিল, তারপর কাজ শুরু করল | বর্ষার বয়ান সবচেয়ে জরুরি | বর্ষাকে একদম পাই টু পাই বুঝিয়ে সে বয়ান নিলো | শুরু হলো শুনানি | এড এজেন্সির মালিক জ্ঞানচাঁদ মীরচান্দানি, নামকরা বড়লোক মাড়োয়ারি ব্যবসাদার | সে নিজের জন্য তাবড় উকিল রেখেছে | তবে কান্তি নিজের পুরোনো ভুল থেকে শিখেছে | শ্রুতির ক্ষেত্রে একজন মহিলা হিসেবে কোর্টে আবেগের বশে সে অনেক ভুল করে যার খেসারত শ্রুতিকে দিতে হয় ! বর্ষার বেলায় সে আর মহিলা নয়, উকিল হয়েই থাকবে |

একটার পর একটা সাক্ষী, সিসিটিভি রেকর্ডিং , ফোনে রেকর্ড ইত্যাদি এমনকি অন্যান্য মহিলা কর্মীদের বয়ানে চার মাস ধরে লড়ে শেষে কান্তি এবং বর্ষার জয় হয় ! কান্তি, শ্রুতির উদাহরণ পেশ করে বর্ষার জন্য আলাদা পাহারার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল, কিছু বিশেষ সাক্ষীদের ও ! তার জেদ এবং পরিশ্রমে শেষে এই জয় এলো ! ডিফেন্স এর সহবাস এবং পরে মনোমালিন্যতা থেকে ধর্ষণের অপবাদ দেওয়ার যুক্তি কোর্ট এ ধোপে টেকেনি | কান্তি একটার পর একটা যুক্তি খাড়া করে “consensual sex ” এর যুক্তি নস্যাৎ করে দিয়েছিল | মীরচান্দানির দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, এবং বর্ষা কে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ২৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার রায় বেরোয়| কান্তির জীবনের এটা এক অন্যতম জিত | সে আবার শ্রুতির কথা ভাবে, এটা একপ্রকার শ্রুতির ও জিত | সকালের থেকে ভুরি ভুরি অভিনন্দন নিতে নিতে শেষে কান্তি বর্ষার সামনে এসে দাঁড়ায় !

— “তুমি আর চিন্তা করোনা, ওরা আর কিচ্ছু করতে পারবেনা, তুমি এখন নিরাপদ ! মাথা উঁচু করে বেঁচে থেকো | ভয় পেও না |”

— ” কান্তি ম্যাডাম, আমি ভয় সেদিন ও পাইনি, কি জানেন, ওনারা ভুল বলেনি, সেক্সে আমার সম্মতি ছিল, “consensual ” আপনাদের ভাষায় | হ্যাঁ মিরচাঁদনিজির বয়স বেশি, বৌ বাচ্চা আছে, তবে আমি তো বলিনি বিয়ে করো ! তিনিতো বরাবর আমার মতো দু একজন কে রাখতেন | হঠাৎ কি ভীমরতি ধরলো, আমায় বললো আর এসব না, বাড়িতে সময় দেবে! কি করবো বলুন ম্যাডাম, আমাদের নিজের দিকটাও দেখতে হবে ! আপনি প্রচুর হেল্প করলেন | তার জন্য থ্যাংক ইউ !” কান্তি ফ্যাল ফ্যাল করে বর্ষার পিছনে তাকিয়ে থাকে ! তার চোখের কোণ থেকে এক নিস্তব্ধ জলধারা বেরিয়ে আসে ! বহুদূরে শ্মশানের ছাইয়ের আঁচের আগুনে শ্রুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে !

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত