উফফ জবরদস্ত ঠান্ডাটাও পরেছে বেশ কদিন ধরে।অনেক রাতে বাড়ি ফিরে কলতলায় গিয়ে এক মগ জল গায়ে ঢালতেই হাত,পা অবশ যায় বিশ্বনাথ ওরফে বিশু মান্নার।কোনোমতে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে টেনে ঘরে নিয়ে গিয়ে ভাত ঢাকার ঝুড়িটা সরিয়ে খাবারের থালাটা টেনে নেয় ও।অনেকক্ষণ রাখার ফলে খরখরে হয়ে এসছে ভাতের দানাগুলো,তার পাশে নুন,লঙ্কা আর সামান্য আলুর ছেঁচকি সাজিয়ে রাখা অভ্যস্ত হাতে। যদিও একটু পেঁয়াজ হলে মন্দ লাগেনা কিন্তু যা অগ্নিমূল্য দাম তাতে ওদের মত দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের ওদিকে ফিরে তাকানোও বারণ।খিদের ঝাঁঝে গরীবের মুখে এই যা জুটছে সেটাই মনে হয় অমৃতসমান।তাছাড়া এর থেকে বেশি আর কে করবে বিশুর জন্য?ছোটবোন ঝিনুক ছাড়া আর কেইবা আছে বিশুর এই পৃথিবীতে?
ওদের মা,বাবা তো সেই কোন ছোটবেলায় মারা গেছে ট্রেনে কাটা পরে।ঘরে তৈরি করা ঝালছোলা,চিঁড়েবাদাম,সবুজ মটর ভাজা বিক্রি করত ওরা কল্যাণী লাইনের ট্রেনে হকারি করে।তেমনি একদিন সকালবেলায় রোজের অভ্যাসমত কাজে বেরিয়ে আর জ্যান্ত বাড়ি ফেরেনি ওরা।ফিরেছিল শুধু দুটো ডেডবডি। বাস্তবের ধাক্কায় একনিমেষে অনেকটা বড় হয়ে গেছিল বিশু।ছোটবোন ঝিনুককে মানুষ করার তাগিদে পথে নেমেছিল সেই পনেরো বছর বয়সে। তারপর পেরিয়ে গেছে আরও পনেরো বছর। কৈশোরের বিশ্বনাথ আজ পূর্ণবয়স্ক তরুণ।
কখনো পার্ক স্ট্রিট কখনো বা ময়দান আবার কোনো সময় নিউ মার্কেট চত্বরে ঘুরে ঘুরে নানারকমের জিনিস ফেরি করে ও। গত কয়েক বছর ধরে শীতের এই মরশুমে সান্টাক্লজ সাজে ও।খাটনি হলেও রোজগারপাতি মন্দ হয়না।বাচ্চা,বুড়ো অসংখ্য উৎসবপ্রেমী মানুষের ঢল নামে রাস্তায়।কেউ কেউ খুশি হয়ে ভালো বকশিশ দিয়ে যান। এসব ভাবতে ভাবতেই গোগ্রাসে ভাতগুলো গিলছিল বিশু। ঘড়ির কাঁটা প্রায় সাড়ে এগারোটা ছুঁতে চলেছে। কসবার অনেক ভিতরের দিকে একফালি জায়গার উপর টালির চালের দু কামরার এই বসতবাড়িতে একমাত্র জেগে আছে এখন বিশ্বনাথ। দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়াশুনো করা ওর বোন ঝিনুকও নিশ্চয় পড়াশুনো করে অকাতরে ঘুমিয়ে পরেছে। তাছাড়া পড়াশুনোর ফাঁকে কয়েকটা টিউশনও করে ও বিকেলের দিকে।
বড়দাদা হিসেবে বিশু ঝিনুককে বারণ করলেও মিষ্টি হেসে ঝিনুক বলেছে,”সংসারটা কি তোর একার নাকি দাদা? নিজের খরচটা যদি নিজে চালিয়ে নিতে পারি তাতে মন্দ কি? তোরও কিছুটা কষ্ট কম হয়।”অগত্যা ওর কথায় রাজি হতেই হয়েছিল বিশুকে। কিন্তু ঝিনুককে দেখলে বোঝা যায় পড়াশুনো,রান্নাবান্না উপরন্তু সামলে ঠিক কতটা ধকল যায় ওর উপর দিয়ে। ওর বয়সী মেয়েরা এখন রঙিন প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় এদিক ওদিক আর ঝিনুক সেখানে খোলসের মধ্যে নিজের সব সখ আহ্লাদগুলো লুকিয়ে রাখে শুধুমাত্র দাদার পাশে থেকে সংসারটাকে দাঁড় করাবার কাজে সামিল হবে বলে। তবুও বড় ইচ্ছে করে ওর ঝিনুককে একটা সুন্দর জীবন দিতে।পড়াশুনো যদিও বেশিদূর করেনি বিশু, অভাবের তাড়নায় অষ্টম শ্রেণীতে থামতে হয়েছিল ওকে।তবুও ও জানে সান্টাক্লজ নাকি মনের সব ইচ্ছেপূরণ করেন,নানারকম সুন্দর উপহার দেন।
আসলে পয়সা থাকলে অমন বিলাসব্যসন করাই যায়। বড়দিনে পারেনি বিশু বোন ঝিনুককে কিছু কিনে দিতে। রাত পোহালেই নতুন বছর। তাই বিশু ঠিক করেছে নতুন বছরের প্রথম দিনে ঝিনুক সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই আজ বাড়ি ফেরার পথে ওর জন্য কেনা গোলাপী লেহেঙ্গাটা রেখে আসবে ওর মাথার কাছে।ঝিনুককে এই নতুন পোশাকে পুরো গোলাপী পরীর মত দেখতে লাগবে।যদিও বড়বাজার থেকে সস্তায় কেনা তবুও কি ভাইবোনের ভালোবাসার কাছে অর্থমূল্যটা কোনোভাবেই ধারেকাছে আসেনা। যাইহোক আগামীকাল ইংরেজি নববর্ষ।অনেক সকাল সকাল উঠতে হবে রোজগারটার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।এলোমেলো চিন্তাভাবনার মাঝে কখন যে ঘুমিয়ে পরে বিশ্বনাথ। কদিন ধরে অতিরিক্ত পরিশ্রমের চাপে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে।
রাত তখন কতটা গভীর ঠিক ঠাওর করতে পারেনা ও কানে আসে একটা কথা,”হ্যাপি নিউ ইয়ার দাদাভাই। দেখ এটা পছন্দ হয় কিনা তোর?”;এতো ওর ছোটবোন ঝিনুকের গলা। ধড়মরিয়ে বিছানায় উঠে বসে বিশু। চোখ কচলে বলে,”কিরে তুই ঘুমাসনি এখনও?তবে যে বাড়ি ফিরে দেখলাম তোর ঘরের আলো বন্ধ।”
__”হ্যাঁ রে ঘুমিয়েছিলাম তো। বারোটায় অ্যালার্ম দেওয়া ছিল।খাতায় কলমে পয়লা জানুয়ারি তো চলেই এলো। তাই ভাবলাম তোর জন্য এই কেনা উপহারটা তোকে নিজের হাতেই দিয়ে আসি।” ঝিনুকের হাত থেকে উপহারের প্যাকেটটা নিয়ে খুলে বিশু দেখে একটা লাল, সাদা রঙের সোয়েটার অবিকল সান্টাক্লজ যেমন পরে ঠিক তেমনি।
__”কিরে কি দেখছিস ওমন হাঁ করে?সত্যি করে বল তোর পছন্দ হয়েছে কিনা?নইলে দোকানে বলে পাল্টে নিয়ে আসব।বিলটা রেখে দিয়েছি যত্ন করে।”,ঝিনুক বলে ওর দাদাভাইয়ের গায়ে ধাক্কা দিয়ে। পরম মমতায় সোয়েটারের উপর হাত বোলাতে বোলাতে বিশু বলে,”খুব পছন্দ হয়েছে রে পাগলি। কিন্তু এসব আবার কেন করতে গেলি? যা ছিল তাতে এবারের শীত দিব্যি চলে যেত। বিশেষ অসুবিধা হতনা।”
__”হ্যাঁ সেতো বলবিই। তোর চাদরটা প্রায় ছিঁড়ে গেছে সেদিন কাচতে গিয়ে দেখলাম। হয়ত কোনোমতে চালিয়ে নেওয়া যেত কিন্তু কেন কিনলাম জানিস দাদা? সেই পনেরো বছর বয়স থেকে তুই সান্টাক্লজের মত আমার সব সখপূরণ করে চলিস তার জন্য নিজের টিউশানের টাকা দিয়ে এটুকু করতে পারবনা?”
__”নিশ্চয় পারবি।তোর নাম ঝিনুক।তোর মনের কোণে মুক্তোর মত ভাবনারা থাকবে নাতো কার মধ্যে থাকবে। এমনই থাকিস তুই। তবে আমার উপহারটা দিতেই বা বাকি থাকে কেন? ভেবেছিলাম সকালে উঠে দেব।কিন্তু দেওয়া নেওয়ার পালাটা এখনই চুকিয়ে ফেলি কি বলিস!দেখ দেখি এটা কেমন?”, এই বলে বিছানা থেকে নেমে বিশু ওর বোনের দিকে বাড়িয়ে ধরে গোলাপী লেহেঙ্গাটা।
দাদার কাছ থেকে বড়দিনের উপহার পেয়ে খুশিতে ঝকঝক করে ঝিনুকের মুখ। বোনের খুশিতে সামিল হয় বিশুও। দাদা আর বোন আজ দুজন দুজনের কাছে সান্টাক্লজ হয়ে ধরা দেয় নবরূপে নবসাজে। ফাঁকা টালির চাল বেয়ে নামা টুপটাপ কুয়াশায় আস্তিনরা হার মানে ওদের ভালোবাসা মাখা উষ্ণতার কাছে। বোনের মাথার নরম চুলগুলোতে পরম স্নেহের সাথে হাত বোলাতে বোলাতে বিশু বলে,”নে অনেক রাত হল এবার ঘুমাতে যা দেখি।কাল সকালে একসঙ্গে দুজন মিলে গরম ফ্যানা ভাত খাব।”
__”ঠিক আছে দাদাভাই”, বলে নিজের ঘরে যায় ঝিনুক।
ঠাণ্ডা হয়ে আসা কম্বলটা আবার গায়ে টেনে নিতে নিতে বিশু ভাবে নাইবা থাকল পিটার ক্যাট বা পাঁচতারা কোনো রেস্তোরাঁতে নতুন বছরের উদযাপন।কখনো কখনো জলদি হাতের রান্না করা ভাত আর খোসাশুদ্ধু মাখা নতুন আলুসিদ্ধতেও খুশিরা ভিড় করে আসে।আর হবে নাই বা কেন?দাদা আর বোন শব্দদুটো যে দুটোর পরিপূরক।বিশু আপনমনে ওর দরাজ কণ্ঠে গেয়ে ওঠে জিঙ্গেল বেলের সুর। একমুঠো উষ্ণতার খোঁজে ওদের একফালি বারান্দায় ঠাই নেওয়া কালু কুকুরটাও আনন্দে ডেকে ওঠে “ভৌ ভৌ।।।”