সৌরভ হেসে বললো দেখ আপুনি, বকুল ফুল ! ও বেশ কিছু ফুল আমার মাথায় ঢেলে দিলো। আমি ওর পাগলামি দেখে হাসি। কালই যেন কোথায় গিয়েছিল। কি নাকি এক বিরাট মার্কেট, সিঁড়ি গুলো নাকি ট্রেনের মত চলছে আর চলছে, কোনো থামাথামি নেই। ওর সেকি হাসি শোন আপুনি সবাইকে চেক করে দেখলো, শুধু আমি ছাড়া। বেশি লোক দেখে আমি স্যুট করে ভেতরে ঢুকে গেছি। আর একদিন তো প্রায় কান্না কান্না অবস্থা ওর।
– জানিস আপুনি!
একটা মা তার বাচ্চা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। কী সুন্দর দৃশ্য বাবুটা শুধু বায়না করছে। ঠিক আমার মতো। অমনি একটা গাড়ি এসে পিছন থেকে দিলো ধাক্কা। আমার এতো রাগ হচ্ছিল। ভাবলাম দেই ড্রাইভার ব্যাটাকে একটু কড়কে। সবাই মা আর বাচ্চাটাকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল গেলো আমিও সাথে গেলাম। ইশরে মা বেচারিকে রেখে আসতে হলো। কষ্ট লাগেনা বল ! আমি মাথা নাড়ি – হুম কষ্ট লাগে। খুব কষ্ট লাগে।
মাঝে মাঝে সৌরভের গায়ে হাত বুলোতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ও এতো দুষ্টু দেখা মেলাই ভার।শুধু এদিক ওদিক ঘোরা আর গুচ্ছের গল্প। ‘জানিস আপুনি পাশে যে বাচ্চাদের একটা পার্ক আছেনা? ওখানে যে কী মজা! যত্তো খুশি দোলনা চড়ো কেউ কিচ্ছু বলার নেই। তুই চলনা আমার সাথে একদিন। আমি হাসি, হাত দিয়ে ওর চুল গুলো এলোমেলো করে দিতে ইচ্ছে করে। অনেক কষ্টে ইচ্ছেটা বুকে চাপা দেই । ওর ছেলেমানুষি দেখে মাঝেমাঝে হাসি পায়। হাসা ছাড়া কিই বা করার আছে আমার !
আম্মা যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। বারডেম থেকে এপারে আসার ওভার ব্রিজে দেখতাম নানান জিনিসপত্রের পসরা। সৌরভ ছেলে মানুষ, ওর বুঝি কিনতে ইচ্ছে হতো। আম্মাকে দেখতে এসে মামা একদিন ওর হাতে একটা ১০০ টাকার নোট দিয়েছিল। ওর কি খুশি, উলটে পালটে দেখলো আধা ঘন্টা গন্ধ শুকলো আমি যতবার বলি ভাইটি কিছু কেন ! ও তত হাসে, সব জিনিস দামাদামি করে। শেষ মূহুর্তে মত পালটে ফেলে। কেনেনা কিছুই।
মাঝেমাঝে পকেটে হাত দেয়, টাকাটা ঠিক আছে তো?আমার এতো মায়া লাগে, আমার যদি অনেক টাকা থাকতো ভাইকে দিয়ে বলতাম নে আর তোর যা খুশি কেন। ওর কোন বন্ধুর নাকি গিটার আছে,ও হাত পা নেড়ে এমন করে গিটার এর গল্প করতো, যেন ওটা গিটার না,জ্যান্ত একটা মানুষের গল্প করছে। ভেবেছিলাম আম্মাকে বলবো দাওনাগো মা ভাইকে একটা গিটার কিনে। আম্মা রেগে গিয়ে হয়তো আমার বেনী ধরে একটা ঝাঁকুনি দিতেন। তাতে কী গিটার তো কেনা হতো। একদিন ঝাঁঝালো এক দুপুর গড়িয়ে বিকেল, তারপর সন্ধ্যা নামে। কেউ আমাদের জন্য হাসপাতালে ভাত নিয়ে আসেনা। এদিকে আমার কাছে কোনো টাকা নেই।
রোগামত এক ডাঃ আম্মার জন্য একটা ইঞ্জেকশন আনতে বললেন। ৫৫০টাকা দাম, আমার শেষ ৫০০ টাকা দিয়ে সেই ইঞ্জেকশন কিনে এনেছি। দোকানী আরো ৫০ টাকা দাবি করছিলো। আমি পরে দেবো বলে মাথা নিচু করে বের হয়ে এসেছি। রাত গড়িয়ে সকাল, আবার একটা বিষণ্ণ দুপুর, সময় না কাটা সন্ধ্যে ও একসময় শেষ হয়। সবাই হয়তো ভুলে গেছে। আমরা দুটি ভাই বোন না খেয়ে তাদের অপেক্ষায় আছি। পাশের বেডের মহিলা সব সময় অচেতন থাকেন। তার ছেলে মাঝেমাঝে দেখতে আসে আজ কেউ আসেনি।
আজ তৃতীয় দিন, আমার সৌরভ না খেয়ে আছে। ওর পকেটে শুধুমাত্র সেই ১০০ টাকার নোটটি আছে।আমার কিছু বলার সাহস হয়না। ওর এতো সাধের টাকা। আজ হয়তো কেউ না কেউ আসবেই। আম্মা হাত ইশারায় আমাকে ডাকেন। আম্মার কাছে যেতে প্রায় দুইবার মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নেই । সৌরভ তো আমার ছোট ওর ঠোঁট শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে কই ওর তো মাথা ঘুরে পরে যাচ্ছেনা! নিজের উপর নিজেরই রাগ লাগে। আম্মা আস্তে আস্তে বলেন, ‘তুই বাবুকে নিয়ে কিছু খাইয়ে নিয়ে আয়। আমার ছেলেটা বলে আম্মা কাঁদতে থাকেন। আম্মার কান্না দেখে আমার বুকটা ভেঙে যেতে থাকে। আমি মাথা নেড়ে হ্যা বলি।
ভাই চল! আম্মা কষ্ট পাচ্ছে। তুই কী আম্মাকে কষ্ট দিবি! ওর কথা বলতে আমার লজ্জা লাগে। আমার চেয়ে ছোট হয়েও ও একবারো খাওয়ার বায়না ধরেনি। মাত্র এগারো বছর বয়স সৌরভের। আম্মাকে হাসপাতাল থেকে লিকুইড ডায়েট দেয়। পাতলা সুজি বা স্যুপ। নাকে রাইস টিউব পড়ানো আম্মাকে সেটাই খাইয়ে দিতে হয় সিরিঞ্জ দিয়ে।
ও আমার সাথে হাটে আর বলে মাত্র তো ১০০ টাকা।বড় হলে আমি যখন বেতন পাবো তখন আমার কাছে এরচে অনেক বেশি টাকা আমার থাকবে না বল আপুনি? আমি আবার মাথা নাড়ি। ওর হাত ধরে পিজি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসি। এটুকু পথ তবু হেঁটে আসতে খুব কষ্ট হয়। সৌরভ ওর পকেটে হাত দিয়ে দেখে নেয় টাকাটা আছে কি না? ঐ তো রাস্তার ওপারেই সাড়ি সাড়ি লোভনীয় সব খাবার দোকান। যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সৌরভ পরম নির্ভরতায় আমার হাত ধরে।
দৌঁড়ে আমরা রাস্তা পাড় হতে যাই। , তারপর তারপর আর কি..!! একটা শব্দ, একটা ধাক্কা, আমি সজোরে সৌরভের হাত চেপে ধরি। ও পরম মমতায় আমার বুকে মাথা রাখে। কে যেন বলে ‘আহারে ভাইবোন মনে হয়। আহারে এখনো হাত ধরে আছে। আহা কেউ একটা কিছু দিয়ে ঢেকে দেয়না কেনো? তারপর থেকে আমি এখানে আছি। অনেক ভাই-বোন আমার ভিতরের হাড় গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে। মানুষের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে পড়ে। সৌরভের শরীর দিয়ে কিছু করা যায়নি। তাই ওর খুব মজা শুধু ঘোরে আর ঘোরে। আর প্রতিদিন কি দেখে আমাকে এসে গল্প করে। বেঁচে থাকতে আমি সৌরভের বড় বোন হয়ে ওর জন্য কিছু করতে পারিনি।
তাই মেডিকেল থেকে কোথাও যাইনা। সৌরভের মতো আরো অনেক ছোট ভাইদের কাজে লাগছি আমি। এটা ভেবেই আমার বড় ভাল লাগে। শুধু সৌরভ’টার জন্য খুব কষ্ট হয়। ওকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারিনা। ঢাকা মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীরা আজ অবাক হয়ে একটা জিনিস দেখলো। ওদের ডিপার্টমেন্টের কঙ্কালটার পাশে কিছু বকুল ফুল পড়ে আছে। কি আশ্চর্য!!