আজ ক্লাস শেষ করে খুব দ্রুতই বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ চোখ আটকে গেলো শিউলি গাছ দেখে। গাছগুলো যেনো ঝিরঝির বাতাসের ছোয়ায় দুলে দুলে একে অপরের সাথে কথা বলছে। মনের অজান্তেই এতো সুন্দর দৃশ্য দেখেই সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানালাম। কিছুক্ষন পর অনুভব করলাম কেউ একজন আমার শার্টের কোণা ধরে টানছে। পেছন ফিরে দেখি একটা পিচ্ছি ছেলে। চেহারাটা এতোই মায়াবী যে কেউ দেখলে তার মন কাড়বে। বয়স ৭/৮ হবে। একটা শর্ট পেন্ট ছাড়া আর কিছুই নেই শরীরে।
– কিছু বলবে? ( আমি )
– হ্যা।( ছেলেটি )
– হুম। বলো কি বলবে?
– কচি এবং মায়াভরা ভয়েস এ বললো,
১০টি টাকা দেবেন?দুইটা সিংগারা খাবো। সকাল থেকে কিছুই মুখে দি নাই। খুব ক্ষিধে পেয়েছে। ( এ কথা বলেই চোখ ফেটে অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে পড়লো তার) যখন থেকে যাহরা আমার জীবন থেকে গিয়েছে তখন থেকে অনেককে অবিশ্বাস করেছি কিন্তু এই ছেলেটার কথা কেনো যেনো অবিশ্বাসই করতে পারছিনা। তার কথাগুলো শুনে তাকে ভীষণ ভাবে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো। পরিচিত এক মামার দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে দিলাম। খাবার পেয়ে সে এমনভাবে খাওয়া শুরু করলো মনে হলো অনেক দিনের ক্ষুধার্ত পথিক সে। আমি বললাম,
-তাড়া নেই ধীরে ধীরে খাও।
– ( শুধু মাথা নাড়ালো )
– কোথায় থাকো তুমি?
– এই পুরো শহরের প্রতিটা রাস্তায় আমার ঘর।
– কেন? তোমার মা-বাবা কোথায়? ( অবাক হয়ে)
-( কথা না বলেই কান্না করা শুরু করলো। মনে হলো গভীর কোনো বেধনা তার হৃদয় কে ক্ষণে ক্ষণে পিষ্ট করছে)
– কি হয়েছে? কথা বলো কান্না থামাও।
– ভাইয়া, জন্মের পর থেকে আব্বারে দেখিনাই।
মনে হয়, আমি দুনিয়াতে আইবার আগেই আমার আব্বা দুনিয়া চারছে। একদিন রাতরো বেলা শুইয়া ছিলাম। ঘুম থেকে উডার পর দেখি মাও নাই বইনও নাই। আমারে রাইখা কই চইল্লা গেছে এরপর থেকে আর খুইজ্জাও পাইনাই। আজও খুজি তাদের। কথাগুলো বলেই থেমে গেলো সে তখনও অশ্রু বেয়ে নামছিলো চোখ দিয়ে। আমার খুব মায়া হলো তাকে দেখে। তাকে বললাম,
– যাবে,আমার সাথে?
-কোথায় নিয়ে যাবেন?
-আমি যেখানে থাকি সেখানে।
– ( এক পলক কি চিন্তা করে বললো) হ্যা,ভাইয়া যাবো। ব্যাস,একটা রিকশাওয়ালাকে ডাক দিলাম,
– মামা যাবেন নাকি?
– কোথায় যাবেন মামা?
– এইতো, ২ নম্বর। কত দিতে হবে?
– ২০ টাকা।
– ১৫ টাকা দিলে হবে না? ( আসলে টাকা কম ছিলো তাই)
– ( চিন্তা করে বললো) ঠিক আছে মামা দিয়েন। ( এক চিলতে হাসি দিয়ে বললাম চলেন। আর পিচ্ছিটা থেকে জিজ্জাস করলাম) ::
– তোমার নাম কি?
– তুষার।
– আরে,এতো দেখি আমার সাথে মিল। আমার নামও তুষার।
– কিন্তু ভাইয়া,আপনি শিক্ষিত আর আমি অশিক্ষিত। ( আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম তার জবাবে )
– পড়ালেখা করতে চাও?পড়ালেখা করে বড় হতে চাও?
-ভাইয়া,ইচ্ছেতো আছে কিন্তু সেই ইচ্ছের বাঁধাও আছে কারণ…
– চুপ,কোনো কারণ, কোনো কিন্তু নই তোমার পড়ালেখার সব ব্যবস্থা আমি করবো ।।।।
বাসায় ওর সাথে কথা বলতে বলতে সারাদিন কেটে যেতো।ওকে স্কুলে ভর্তি করার আগে কিছু সাধারণ ধারণা আমি তাকে শিখালাম। এভাবে কেটে গেলো কয়েক মাস। ডিসেম্বর মাসে আমি একটি “শিশুকল্যাণ” নামক একটি প্রতিষ্টানে ভর্তি করিয়ে দিলাম। ওকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে আসার সময় কেনো যেনো মনটা হু হু করে কেঁদে ওঠলো। এতোদিনের সক্ষতা তো তাই সবকিছু স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে তাও বুঝতে পারছি।
তুষার ভীষণ ভাবে কান্না করছে, আমারও পাচ্ছে কিন্তু আমি তা তাকে দেখাতে চাইনা তাই আসার সময় প্রমিস করলাম তার সাথে ফ্রি টাইমে দেখা করতে আসবো। এভাবে কেটে যায় ২ বছর। আমি মাঝে মাঝেই দেখা করি ওর সাথে। টিচারদের সাথে কথা বলি ওর ব্যাপারে সবাই ভালো বলেন। তাকে নিয়ে বড় বড় স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। আমার ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার কারণে বেশ কয়েকদিন অনেক ব্যস্ত ছিলাম তুষারের সাথে দেখা করার সুযোগই হয়নি। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের দিন চলে গেলাম ওর সাথে দেখা করতে বেশ জামা কাপড়,খাবার নিয়ে রওনা দিলাম। মূল ফটকের কাছাকাছি চলে আসলাম। এমন সময় একটি ভ্যানগাড়ি দ্রুত ক্রস করলো।
হঠাৎ শুনতে পেলাম এক চিৎকার। পরিচিত মনে হওয়ায় ছুটে গেলাম সেইদিকে। ভীড় ঠেলে কাছাকাছি আসতেই তাকিয়ে দেখি আমার তুষু(তুষার)। ওকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম। চলে গেছে না ফেরার দেশে যেখান থেকে কেউ কখনো ফিরেনা। হারিয়ে গেলো আমার কথা বলার সাথী। ও আমাকে ছেড়ে গেছে অনেক বছর পার হয়ে গেলো কিন্তু ওর রেখে যাওয়া স্মৃতি,আমার সাথে কাটানো স্মৃতি আজও মন থেকে মুছে ওঠতে পারিনি।