কারো বৌ চলে যাওয়া কোনো খুশির খবর নয়। যার চলে যায় সে বুঝে, বৌ ছাড়া থাকা যে কী কষ্টের। ব্যাপারটা আমার কাছে একটুও ভালো লাগছে না। কিন্তু বসদের সামনে কিছু বলতেও পারছি না। “ জয়! এরকম একটা খুশির খবর শুনে তুমি গোমড়া মুখ করে আছো কেনো? মুখ দেখে মনে হচ্ছে, বৌ আশিকের নয়, তোমার পালিয়েছে! ” পায়ের জুতো খুলে মুখে মারতে ইচ্ছে করছে! নিজেকে শান্ত রাখলাম।
একবার আমার বৌ রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিলো। রাগ বললে ঠিক হবে না মনে হয়। কঠিন ঝগড়া হয়েছিলো। কারণটা ছিলো আমি দিনরাত খাটি আর সে বসে বসে খায়! এটা নিয়ে তুমুল ঝগড়া। এরপরে সে বাপের বাড়ি চলে যায়। পুরো দেড় মাস থেকেছে! মুখে বলে দেয়া খুবই সহজ, ছেলেমেয়েদের আমি একাই দেখতে পারবো। কিন্তু কাজটা একদমই সহজ নয়। দুটো ছেলে একটা মেয়ে আছে আমার। বড় ছেলে হাইস্কুলে আর ছোট দুজন প্রাইমারিতে।
যে কয়টা দিন ইরা ছিলো না সে কয়টা দিন যে আমি কীভাবে কাটিয়েছি! ভোরে উঠো, ছেলেপেলেদের জন্য রান্না করো! জীবনেও তো রান্নাঘরে যাইনি কিন্তু তখন করতে হবেই এমন অবস্থা ছিলো। লবণ হলে মরিচে হয় না। মরিচে হলে মসলায় হয় না! ছোট মেয়েটা মাত্র তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। সে আর কী রান্না করবে? এতেই কী শেষ? সবার টিফিনের ব্যবস্থা করো। কাপড়চোপড় বের করে রাখো। জুতো নাই কারো। একটা আলমারির তলে আরেকটা সোফার নিচে! বের করো। তাঁদের স্কুলে নামিয়ে যাও, তারপর অফিসে আসো। আসতে আসতে কয়েকঘন্টা দেরি! তারপর বকা শুনো। ছোট্ট মেয়েটার বারোটা বাজে স্কুল ছুটি হয়।
সে এসে একা বাড়িতে কী করবে? এ চিন্তা করতে করতে আর অফিসের সময় শেষ হয় না। যেই না শেষ হয়েছে। হুড়মুড়ে বাড়ি যাও। আবার রান্নার চিন্তা করো। পেঁয়াজ কাটো, মরিচ কাটো, পাতিলে ধুও, গ্যাস নেই! লাকড়ি আনো।
এদিকে আমার গোসল করা হয়নি! কোনোরকমে খাওয়াদাওয়া শেষ হলো। এদের একেকজনের একেক চ্যানেল পছন্দ। কেউ ফুটবল, কেউ ক্রিকেট। সেই মারামারি! আমার কথা কেউ শুনে না! ইরা একটা ঝারি দিলেই সবাই শান্ত!
ছোট মেয়েটার মায়ের কোলে ঘুমিয়ে অভ্যাস। রাতে ঘুম হয় না। যদি বলি “ আম্মির কথা মনে পড়ছে? ” সে মাথা নাড়িয়ে মানা করে আর চোখ বেয়ে পানি পড়ে! ওহ, সে দিনগুলোর কথা আর মনে করতে চাই না। হারে হারে টের পেয়েছিলাম, সে বাড়িতে বসে বসে খেতো, না দাঁড়িয়েও খাওয়ার সময় পেতো না! আর এই ভদ্রলোকেরা পার্টি করছে আশিকের বৌ চলে যাওয়াতে! আশিকের দুটো মেয়ে দুটো ছেলে।
দুটো মেয়ে বড় হয়েছে কিন্তু দুটো ছেলের দেখাশোনা কে করবে? সে তো সারাদিন কাজেই ব্যস্ত। আশিকের সাথে এদের কাজের শত্রুতা। বাজারে একমাত্র লোক আশিকই আছে যে এদেরকে টক্কর দিতে পারে। বৌ চলে যাওয়াতে আশিক মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বে, এ সুযোগে তাঁরা আবার বাজারের শীর্ষে চলে আসবে! এদের বলতে একজনই, রিমন সাহেব! আর বাকী সব চামচারা তো থাকেই চারপাশে। পার্টির কারণটা হলো এই। কোনো কারণ ছাড়া তো আর সাহেবরা টাকা খরচ করেন না। এসব ওয়াইন-টুয়াইন আমি খাই না বললে খুব বড় মিথ্যা বলা হবে। মাঝেমধ্যে খাই। কিন্তু এই ওয়াইনের বোতলটা আমার কাছে বিষ্যের চেয়েও তিতে লাগবে! রিমন সাহেব বললেন, “ তোমাদের সবার বেতন বাড়বে পঁচিশ পার্সেন্ট। ” এটা নিশ্চয়ই আরেক খুশির খবর। কিন্তু আমি খুশি হতে পারছি না। মানুষ হিসাবে আমি যে ভালো তাও না। কিন্তু এটা একদম মানছে না শরীরটা।
এর মাঝে ইরার ফোন, “ ঝিনুকের কালকে জন্মদিন। রাত বারোটা হয়ে যাচ্ছে, বাড়িতে আসার সময় কী হয়নি? ”
মেয়েটার জন্মদিনে আমি কোনোদিনও সঠিক সময়ে উপস্থিত হতে পারিনি! সকালে তাঁর মন খারাপ করা মুখটা দেখতে হবে! রিমন সাহেব আবার বললেন, “ জয়, তুমি পার্টিটাই নষ্ট করে দিচ্ছো। “কাম অন ইয়াং ম্যান”। বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছা না থাকা সত্যেও ওয়াইনের বোতলটা খুলে মুখে দিতে যাবো এমন সময় টিভিতে “ব্রেকিং নিউজ”
“ শিল্পপতি সৈয়দ রিমন মাহমুদের বৌয়ের নতুন স্বামী এখন তাঁরই একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী আশিক জুবায়ের! তাঁদের বিয়ের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল! ” রিমন সাহেব টিভিতে চোখ রেখে যেন অজ্ঞান হওয়ার পথে। খবরের সাথে সাথে কিছু ছবিও দেখাচ্ছে! তা দেখে রিমন সাহেবের হাত থেকে ওয়াইনের বোতলটা পড়ে গেলো!
আশিক সাহেবও একটা জিনিস বলতে হবে! কালকে তাঁর বৌ পালিয়েছে, এ খবরটা শুনে সবচেয়ে বেশি খুশি যে হবে, সে আজকে তাঁর বৌকেই বিয়ে করে নিলো! আমি এবার ওয়াইনের বোতলে বেশ আবেগ নিয়ে চুমুক দিলাম! বেশ ভালোই লাগলো। বিদেশী জিনিস। পার্টিটা এবার জমেছে! রিমন সাহেবের মুখটা দেখে বলতে ইচ্ছে করছে, বস! জীবনটা কাটারপিলার, আজকে আমার জন্য তো কালকে আপনার জন্য! কোনদিন কার বুক খালি হয় কেউ জানে না। অন্যের দুঃখে দুঃখী হতে না পারলেও, খুশি হতে নেই!