সিট নাম্বার ডি টু

সিট নাম্বার ডি টু

কুয়াশা ঘেরা সকালে কনকনে এই ঠান্ডায় বাসস্টপে বসেও আমি বেশ ঘামছিলাম।আমার হাতে ফোনটাও বেশ কাপছিল।আসলে আমার হাত কাপছিল বলেই ফোনটাও কেপে উঠছিল। আমি হাত ঘড়িটার দিকে আবারও তাকালাম।ছয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট। বাস ছাড়তে এখনও আধঘণ্টা বাকি।সাতটায় বাস।কিন্তু মেয়েটা এখনও না আসায় আমার হাত কাপাটা আরও একটু বেড়ে গেলো।এক বিরল রোগে আক্রান্ত আমি।টেনশন হলেই হাত কাপবে আবার একটু উত্তেজিত হলেই পা কাপা শুরু করবে।তখন হয় বসতে হবে নয়তো চুপ থাকতে হবে।আমি আবার কাউন্টারের দিকে গেলাম।লোকটা এবার আর গতবারের মত মন খারাপ করে নেই।হাসি মাখা মুখে বললো,

-একটা টিকেট ম্যানেজ করতে পেরেছি।আর একটা সামনে কোন যাত্রি নেমে গেলেই হয়ে যাবে।

লোকটার কথায় আমি কিছু বললাম না।আমি যখন কাউন্টারে আসি তখন টিকেট প্রায় শেষ।তবুও তারা একটা জোগাড় করে দিয়েছে।আমি টাকাটা বাড়িয়ে দিয়ে টিকিট টা নিলাম।সিট নাম্বার ডি টু। মানহার সাথে আমার পরিচয় এই বাসস্টপেই।সেদিন কাউন্টারে ভুল করে আমাদের দুজনকেই দিয়েছিল একই সিট।সেটার নাম্বার ও ছিল ডি টু।আজও ডি টু।সেই ভুল থেকেই মানহার সাথেই আমার পরিচয়।এরপর ভাল লাগা, কথা বলা সবকিছু মিলিয়ে ভুল থেকেই আমাদের ভালবাসার শুরু।

সাতটা বাজতে আর মিনিট পাচেক বাকি।কিন্তু মেয়েটা এখনও আসলো না।এদিকে ফোনটাও ধরছে না।ওর কি কোন বিপদ হলো নাকি অন্যকিছু।আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না।ঘেমে শার্টটা একদম ভিজে গেছে।এই কালো শার্টটা মানহা আমাকে দিয়ে বলেছিল,যেদিন আমরা বিয়ে করবো সেদিন এই শার্ট পড়ে আসবা।মানহার কথায় আমি হেসে বলেছিলাম,শার্ট পড়ে কেও বিয়ে করে?মানহার সেই একই জবাব,তুমি করবা।

মানহার যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনেছি তার ভাল চাকরির সাথে বিশাল বাড়িও আছে।কিন্তু অন্ধ ভালবাসা কি এতকিছু খেয়াল করে,করে না।মেয়েটাও করেনি।তাই আজ অপেক্ষা করছি পালিয়ে যাব বলে।অবশ্য এই বুদ্ধিটাও মানহার নিজেরই দেওয়া।এখন সবকিছু থেকে বেচে যাওয়ার এই একটাই সমাধান,পালিয়ে যাওয়া। কাউন্টারের লোকটার ডাকে আমার ধ্যান ভাঙলো।লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে আবারও বললো,

-ভাই যাবেন না?বাস তো ছেড়ে দেবে।

লোকটার কথায় আমি কি বলবো ভেবে পাই না।যাকে নিয়ে যাব সে তো এখনও আসেনি।মানহার ফোনটা এখন বন্ধ পাচ্ছি।এতক্ষন কল গেলেও এখন আর যাচ্ছে না।হয়তো ফোনে চার্জ শেষ।আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম,

-আচ্ছা ভাই,পরের বাসটায় যাই।

আমার কথায় লোকটা কিছু বললেন না।আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন।আসলে এই বাসটার টিকিটের জন্যে এতটাই আকুল ছিলাম যে টিকেটের দামটা তিন ডবল হলেও আমার এই বাসের টিকেট লাগবেই।
আর পাওয়ার পর যখন যেতে চাচ্ছি না তখন এভাবে তাকিয়ে থাকাটা আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে না।

এরপর প্রায় তিনটা বাস চলে গেছে কিন্তু মানহা আসেনি।ওর ফেসবুক আইডিটাও ডিএকটিভ দেখাচ্ছে।ফোনটা এখনও বন্ধ।এই পরিস্থিতিতে এখন আমার কি করা দরকার সেটা আমার মাথায় আসছে না।কেমন যেন সব তালগোল পেকে যাচ্ছে।ও কি তাহলে আসবে না,না আসলে পালাতেই বা চাইলো কেন!কোন বিপদ হয়নি তো।মাথায় যখন এসব খুরপাক খাচ্ছে তখন আবারও কাউন্টারের লোকটার কথায় আমি ওনার দিকে তাকালাম।উনি যে আমার উপর বেশ বিরক্ত এটা আমি ওনার মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম। লোকটা বিরক্তি মাখা মুখে বললো,

-শেষ বাসটাও চলে গেছে।এখনও কি এভাবে বসেই থাকবেন?

লোকটার কথায় আমি আশেপাশে তাকালাম।দু একজন দেখা গেলেও দিনের আলোটা আর দেখতে পেলাম না।সন্ধ্যা গড়িয়ে প্রায় রাত হয়ে গেছে।দু একটা গাড়ি মাঝে মাঝে ফুল স্পিডে চলে যাচ্ছে সামনে দিয়ে।আমি হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় দশটা বেজে গেছে।যার জন্যে অপেক্ষা করছি সে যেহেতু এতক্ষনেও আসেনি মনে হয়না সে আর আসবে।

আমি ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।সোডিয়ামের আলো এতদিন ভাললাগলেও আজ কেমন যেন বিরক্ত লাগছে।
মন খারাপ থাকলে আমার হাটতে ইচ্ছে করে কিন্তু আজ সে ইচ্ছেটাও নেই।এখন একটা রিক্সা পেলে মন্দ হয় না।মাথাটাও বেশ ধরেছে।বাসায় গিয়ে আগে এই ব্যথার ওষুধ খেতে হবে।কিন্তু ওষুধ কি আছে নাকি ফুরিয়ে গেছে ঠিক মনে পড়ছে না।সবকিছু কেমন যেন ভুলে যাচ্ছি।সবকিছু যেন ঝাপসা হয়ে আসছে।চোখটা যে কখন ভিজে উঠেছে বুঝতেই পারিনি।মাথা ব্যাথা করলে যে কেও কান্না করে সেটা আমি জানতাম না।আজ আমাকে দেখে জানতে পারলাম।আমি নিজেই নিজেকে সান্তনা দিলাম,ধুর বোকা মাথা ব্যথা করলে কেও কান্না করে।করে না।করে না।

মানহার সাথে আর কথা হয়নি আজ দু বছর হবে।মানহার দেখা আমি আর না পেলেও চাকরীটা আমি ঠিকই পেয়েছিলাম।পেয়েছিলাম বললে ভুল হবে,বলতে হবে পেয়েছি।বেশ চলছিল, শুধু ভাবনা জুড়ে মানহার সেই মায়ামাখা মুখটা।যেটা আমাকে রাতে ঘুমাতে না দিলেও সকালে আমাকে ঠিকই অফিস করাতো। অফিসে আজ কাজ নেই।বসে অলস সময় কাটাতেও আজ ভাল লাগছে না।এসময় একটা লম্বা ঘুম দরকার হলেও সেটা এই পরিস্থিতিতে কোন ভাবেই সম্ভব না।আমি সামনে রাখা গ্লাসের পানি টুকু খেয়ে একটু দাড়াতেই রফিক সাহেব এসে বললেন,

-স্যার,বড় স্যার ডেকেছেন আপনাকে।

রফিক সাহেব।আসলে ওনার নাম রফিক তালুকদার।এই অফিসের পিয়ন।কেমন যেন লোকটাকে আমার অসম্ভব ভাল লাগে।আর তারচেয়ে বেশি ভাল লাগে ওনাকে রফিক সাহেব বলে ডাকতে।আমি ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,আপনি যান,আমি আসছি।

আমি যখন স্যারের রুম থেকে বের হলাম তখন আমার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলেও ভেতরটা কেন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো।আমার অন্য জায়গায় পোষ্টিং হওয়াতে আমার খারাপ লাগেনি,খারাপ লাগছে এত মায়া কাটিয়ে কিভাবে অন্যমায়ায় জড়াবো সেটা ভেবে।রফিক সাহেবকে কি তাহলে আমি আর রফিক সাহেব বলতে পারবো না।উনি কি আমার মুখে রফিক সাহেব শোনার জন্যে অপেক্ষা করবে নাকি অন্যকারও ডাকে সবকিছু ভুলে যাবে।ভুলে যাওয়াটা কি অস্বাভাবিক কিছু,না অস্বাভাবিক না।এই যে আমি মানহাকে ভুলে দিব্বি সবকিছু চালিয়ে দিচ্ছি।চলছে তো চলছে না,এভাবেই চলবে। ছোট চারা গাছগুলা আস্তে আস্তে বড় হয়।বড় হতে হতে কিছু গাছ ঝড়ে ভেঙে যায় আবার কিছু গাছ বেড়ে ওঠে তার নিজস্ব গতিতে।যেটা একসময় থেমে যায় যখন আর মাটি থেকে রস গ্রহন করতে না পারে।আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায়,পাতা পড়ে যায়,তারপর সেই কচি গাছটাও বয়সের তালে বৃদ্ধ হয়ে যায়।

ঠিক আজ এত বছর পরে আমিও সেই গাছের ন্যায় একজন বয়স্ক মানুষ।চুলে পাক ধরেছে।অবশ্য চামড়া ঝুলে যাওয়ার মত বুড়ো এখনও হইনি।গায়ে যথেষ্ট শক্তি আছে।তবুও এই বয়সটাকে মাঝ বয়স বলা চলে।তাই আজ আমি এই মাঝ বয়সে দাঁড়িয়ে। অফিসের সেই রফিক সাহেবের সাথে দেখা করতে আসছিলাম কিন্তু পাইনি।লোকটা নাকি আমার বদলি হওয়ার পরেই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছেন।তারপর আর তাকে দেখা যায়নি।আমি বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আশপাশ একটু তাকিয়ে দেখছিলাম,তখনি কাউন্টারের লোকটা এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

-স্যার,এই নিন আপনার টিকিট। আমি টিকেটটা হাতে নিতেই লোকটা আবারও বললো,
-স্যার সিট নাম্বার ডি টু।

ডি টু!লোকটার মুখে ডি টু শুনে আমি মুচকি হাসলাম।আজ আর কোন অপেক্ষা নেই।বাস চলে এসেছে।সবাই যে যার সিটে গিয়ে বসছে। আমিও আর দাঁড়ালাম না,বাসে উঠে পড়লাম।হেলপার আমাকে সিট দেখিয়ে দিতেই আমি গিয়ে দাড়ালাম আমার সিটের পাশে,সিট নাম্বার ডি টু।

পাশের সিটে একজন ভদ্র মহিলা বসলেও আমি সেদিকে তাকালাম না।তবে উনি হয়তো আমার দিকে বেশ ভালভাবেই তাকিয়েছিলেন।সেটা আমি বুঝতে পারলাম যখন তিনি আমার নাম ধরে ডাকলেন।আপনি আহাদ না?
মহিলার কথায় আমি ওনার দিকে একটু ভাল করে তাকালাম।বাস চলতে শুরু করলেও আমার সেদিকে খেয়াল ছিল না।আমি দেখছি এই মাঝ বয়সি ভদ্র মহিলাকে।আমার মুখ থেকে অজান্তেই বেড়িয়ে গেলো, মানহা। মহিলাটা কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,

-চিনতে পেরেছো তাহলে?
-আমি মানুষকে সহজেই ভুলি না।
-কেমন আছো?
-বেশ ভাল।তুমি?
-ভাল।

এই বয়স্ক মানহা আর আগের মানহার মধ্যে আমি কোন তফাৎ দেখতে পাচ্ছি না।শুধু চুলগুলো হালকা পেকেছে।আমি মানহার দিকে তাকিয়ে বললাম,

-তোমার বরকে দেখতে পাচ্ছি না।
-আমি একাই এসেছিলাম।ও বাসস্টপে নিতে আসবে আমায়।তুমি বিয়ে করেছো?

মানহার কথায় আমি হাসলাম।কেমন যেন হাসি পেলো।আমি হাসতে হাসতে বললাম,এই চুলপাকা ছেলেকে কে বিয়ে করবে,কে।কথাটি বলে আমি আর বসলাম না, বাস থামাতে বললাম।এই মেয়ের সাথে একসাথে বসে এতটা পথ যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।কোন ভাবেই না।

এই মাঝ রাস্তায় আমার নেমে যাওয়াটা বাস চালকের সাথে মানহাও বেশ অবাক চোখেই তাকিয়েছিল আমার দিকে।কিন্তু কোন উপায় ছিল না।বাস আবার চলতে শুরু করেছে।মানহা জানালার কাচ সরিয়ে অপলক দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে আমার দিকে।কিন্তু আমার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।আজও কেমন যেন সেদিনের মত চোখে ঝাপসা দেখছি।ভিজে উঠেছে চোখ দুটো।তবে আজ মাথা ব্যাথা করছে না।আজ তো আমার বুকের ব্যাথাটা বেড়েছে।গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা।ওষুধ খেয়েও কাজ হচ্ছে না।হয়তো এভাবেই একদিন কোন ওষুধের কাজ না করাতে হুট করেই আটকে যাবে নিশ্বাস নেওয়া।কিন্তু বাস আর আটকাবে না।বাস চলবে তার নিজস্ব গতিতে।একজনের আমানত আরেকজনকে ফিরিয়ে দিতে।হ্যা ফিরিয়ে দিতে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত