-গেট আউট ফ্রম মাই ওটি রুম!! এটা কি নাট্যশালা পেয়েছো? এটা কোন নাচ গানের থিয়েটার না, এটা হলো অপারেশন থিয়েটার! আনিকার হাতে আর্টারি ফরসেপস টা তখনো ধরা। ধমনীর রক্তপাত বন্ধের জন্য আর্টারি ফরসেপস দিয়ে ধমনী গুলো ধরতে হয়।
-আই সেইড ক্যাচচ ইট এন্ড ইউ ওয়ের জাস্ট লাইক ইন এন এবসেন্ট সেজার। গেট আউট!
আনিকার হাত কাঁপছে। ঠোঁট কাপছে। একটু পর সে বোধহয় কেঁদেই ফেলবে। সে এই মেডিকেলে সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদান করেছে এক সপ্তাহ আগে। পেডিয়াট্রিক সার্জারীতে ট্রেনিং করছে। তার আন্ডারে কিছু ইন্টার্নও আছে। ইন্টার্নদের সামনে কলিগদের সামনে বের করে দেওয়াটা মেনে নেওয়া গেলেও ওটি বয় নার্স আর আয়াদের সামনে এভাবে অপমান করে বের করে দেওয়াটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। নূরানী স্যার এর এই এক সমস্যা। স্যারের সাথে তাল মেলানো টা অসম্ভব। প্রথম প্রথম তাই কষ্টটা হচ্ছে আরো বেশি। সে মোটেও এবসেন্ট সেজারে ছিল না। তিন সেকেন্ড দেরি হয়েছে শুধু ব্লিডিং ভেসেলটা ক্যাচ করতে। তাতেই স্যার খেপে গেছেন। আনিকা কী করবে বুঝতে পারছিল না। স্যার আবার হুংকার দিলেন,
-আই সেইড গেট আউট! এন্ড রাব্বি কে যেয়ে ওয়াশ নিতে বলো!!
-স্যার,আমি পারব!
-এই বাচ্চার স্প্লিন খুব বাজে ভাবে রাপচার হয়ে গেছে।
অবস্থা দেখেছ? আর তুমি ওটিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুচ কুচ হোতা হ্যায় মুভির সিন মনে মনে জাবর কাটলে হবে?
কেউ একজন ফিক করে হেসে উঠল! নূরানী স্যার ধমকে উঠলেন,এই কে হাসে!!
-সরি স্যার!
-ডক্টরস সরি ইজ ভেরি ডেঞ্জারাস ইয়াং লেডি। ভেরি ভেরি ডেঞ্জারাস!!
এই বাতচিতের স্বল্প সময়টায় ডক্টর নূরাণী খুব সূক্ষভাবে স্প্লিনটা কেটে কিডনী ট্রেতে রাখলেন। এনেস্থেশিওলজিস্ট জানালেন অক্সিজেন স্যাচুরেশনটা ফল করছে। আনিকা টের পেল এডরেনালিন রাশ হচ্ছে ওর। পেশেন্ট পার্টি বেশ পাওয়ারফুল। বাচ্চার মামা কোন মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রীর দূরসম্পর্কের শালা হয়ে থাকেন। প্রফেসর নূরাণী অবশ্য এসব থোড়াই কেয়ার করেন। তবু আনিকার মনে কু ডাক উঠছে থেকে থেকে।
-ব্লাড দরকার। দুই ব্যাগ ব্লাড ম্যানেজ করার কথা বলেছিলাম কেউ আনল কিনা দেখ। এক ব্যাগ হলেও চলত। একজন ইন্টার্ন বের হয়ে গেল। একটু বাদেই ফিরে এল। চেহারা ভর্তি রাজ্যের দুশ্চিন্তা।
-স্যার, ব্লাড পায়নাই।
-ব্লাড গ্রুপ কী ছিল?
-এ পজেটিভ।
-এ পজেটিভ গ্রুপের ব্লাড পায়না!
মশকারী করতেসে কিনা জিজ্ঞেস করে আসো! আর বাচ্চার মামা না কে জানি মন্ত্রী মিনিস্টারেরে শালা সম্বুন্ধী হয়! বা কতগুলা!! কাজের বেলায় ঠনঠন! আরো কয়েক পশলা গালি। নূরানী স্যার এর আরেক সমস্যা মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে তিনি গালিগালাজ শুরু করে দেন। এসিস্টে না দাড়ালে আনিকা বোধহয় কানে হাত দিত।
– স্যার, আমার ব্লাড গ্রুপ এ পজেটিভ। চার মাস আগে ব্লাড দিয়েছি। আমি দেই? ইন্টার্নটার চেহারা দেখেই আনিকার হাসি পেয়ে গেল। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে।
-এতক্ষন বলিসনাই কেন? যা এক্ষুনি ব্লাড দিতে যা!! আর আমার কোটের পকেট থেকে টাকা নিয়ে যা। ডাব আনবি। রান! আর এই মেয়ে রিট্রাক্টর ভালমত ধরো! নাস্তা করোনা সকালে? কী খাও? ডিম দুইটা খাবা সকালের নাস্তায়! কথার ফাকে ফাকে অপারেশন প্রায় শেষের দিকে। আনিকা শরীরের প্রায় সর্বশক্তি দিয়ে রিট্রাক্টর ধরে রাখে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে ওর।
-এই সুতা তোলো। আনিকা সেকেন্ড এসিস্টে দাড়ানো ইন্টার্ন ডা.জহুরকে বলল,সুতা দাও। ভিক্রিলটা দাও। একটু পরেই নূরানী স্যারের চিৎকার!
-ইজ ইট ভিক্রিল!! এই মেয়ে চোখ দুইটা কি এনাসে নাকি তোমার?? আনিকা হতভম্বের মত দেখল স্যারের হাতে স্কিন ক্লোজ করার প্রোলিন সুতা ঝুলছে। বেকুব ইন্টার্ন টা ভিক্রিল মনে করে তার হাতে প্রোলিন তুলে দিয়েছে। সে এত মনযোগ দিয়ে স্যারের কাজ দেখছিল খেয়াল করেনি।
-আর প্রোলিন কেন!! কমন সেন্স সব কি লার্জ ইনটেস্টাইনে জমা করে রাখসো!
আনিকার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে অপমানে। ভাগ্যিস মাস্ক ক্যাপ পরা। গাল দুটো যে লাল হয়ে গেছে সেটা সে ভালই টের পাচ্ছে। অবশেষ অপারেশন শেষ হলো। আনিকা মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যদিও তখনো সে জানত না তার কপালে সেদিন কত বড় একটা দূর্ভোগ অপেক্ষা করছে।
*-আপনাদের বাচ্চাটা রেভার্স করেনি। রেভার্স মানে হলো অজ্ঞান অবস্থা থেকে জ্ঞান ফিরে আসা। আমরা বাচ্চাটাকে আইসিইউতে রাখতে চাচ্ছি।
-আসিইইউতে কেন? প্রশ্নকর্তা লোকটার নাম ফজল রহমান।
-বললামতো,সার্বক্ষনিক মনিটর দরকার।
-কীসের মনিটর? সব বুঝি আমরা। আইসিউতে রেখে বিল বাড়ানর ধান্ধা। বাচ্চার মামা কে হয় জানেন??
-দেখেন সরকারী মেডিকেল,আইসিইউ বিল নেই বললেই চলে। আপনারা ভুল বুঝছেন।
-আমাদের বাচ্চা আমার আইসিইতে রাখবনা! আনিকা বিরক্ত হয়ে লোকটার দিকে তাকাল। মহা ঘাড়ত্যাড়া! বুঝতেই চাইছেনা কিছু!
-বাচ্চা যে জিন্দা আছে সেটা আগে আমাদেরকে দেখান। কয়েকদিন আগে ফেসবুকেও আসছে আপনেরা বগল তলায় ফুটা করে মৃত মানুষকে জীবিত দেখাইয়া আইসিইউতে রাখেন! আমি আগেই বলসিলাম ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাই। বাংলাদেশী ডাক্তরগুলা অপারেশন টেবিলেই রোগী মেরে আইসিইতে নিয়া রাখে। আনিকা ব্যাপারটা ভালমত বুঝলনা। বগলতলায় ফুটা মানে কী!! আর ইন্ডিয়ায় নিতে নিতেই তো বাচ্চা টা মারা যেত। ঠিক সময়ে অপারেশন শুরু হয়েছিল। এনেস্থেশিয়া তো অনেক কারনেই রিভার্স করেনা। প্রচুর ব্লাড লস ছিল। কেসটা বেশ খারাপও ছিল।
-আমরা বাচচাকে দেখব। জীবিত আছে কিনা।
আনিকা ধৈর্য্য হারাতে গিয়েও হাসি হাসি মুখ করে বলল,আচ্ছা আসেন। দেখে যান বাচ্চা জীবিত আছে কিনা। আবারো বলছি আপনারা সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে ফেলতেছেন। আমরা ত শুরুতেই বলছিলাম অনেক জটিল অপারেশন এটা। আসেন তাড়াতাড়ি! লোকটা বীরদর্পে আনিকার পিছু পিছু অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলো। তার হাঁটার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছিল সে কোন এক মন্ত্রনালয়ের কোন এক মন্ত্রীর দূরসম্পর্কের শালা হয়। প্রফেসর নূরাণী বিকেলে অপারেশন শেষে একটা ইমার্জেন্সি কল পেয়ে বের হয়েছিলেন। একটু না বেশ অনেক খানি দুশ্চিন্তায় আছেন বাচ্চাটা রেভার্স না করায়। এনেশথেশিওলজিস্টকে কয়েকবার ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছেন। এখন আবার যাবেন হাসপাতালে।
এর মধ্যে হঠাৎ তার মুঠোফোন বেজে উঠল। অপারেশন থিয়েটারের সামনে গন্ডগোল চলছে। তিনি দেরি না করে ছুটে গেলেন। যেয়ে দেখলেন সেখানে হাসপাতালের সুপারও উপস্থিত। পোস্ট অপারেটিভ রুম পুলিশ,সাংবাদিকে সয়লাব। বাচ্চার মা মাটিতে শুয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। বাচ্চার বাবা সহ কয়েকজন তাকে ধরে রেখেছে। সন্তান হারা মায়ের কান্না প্রফেসর নূরাণীর সহ্য হয়না। একদম সহ্য হয়না। সেয়ানা দেখতে একটা লোক চিৎকার করছে। আশেপাশে গুন্ডা গুন্ডা চেহারার আরো পাঁচ ছয় জন।
-আমাদের বাচ্চাটকে আপনারা মেরে ফেলেছেন। নিজ চোখে দেখছি বাচ্চা নিজে নিজে নিঃশ্বাস নিতেসেনা! বেলুন দিয়া পাম্প করতেসেন দেখছি! তার উপর আমাদেরকে ধমক দেয় বাচ্চা আইসিইউতে না রাখলে ফাইলে লিখে রাখবে! আমাকে ধমক দেস। তোর মত ডাক্তার আমার আনিকার দিকেতাকিয়ে চমকে উঠলেন ডাক্তার নূরাণী। ঠোঁট কেটে গেছে। গালে ঘুষির দাগ। মেয়েটা একটু আগে ওটিতে এত বকাঝকা খেয়েও কাঁদেনি,এখন নিঃশব্দে কাঁদছে।
সুপার সাহেব বোধহয় নিজেই বুঝতে পারছেন না কী করবেন, শান্ত করার জন্য বললেন, আসলে উনারা বুঝাতে পারেননি। কিন্তু ফজল সাহেব রোগীকে আইসিইউতে রাখলে এতক্ষনে বাচ্চাটা বেঁচে থাকত। বেলুন পাম্প না ওটা মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন চলছিল। ওভাবে ডাক্তারদের কাজে বাধা দেওয়া উচিত হয়নি আপনার,ওটি রুমের দামী যন্ত্রপাতিও ভেঙে ফেলেছেন অনেক গুলো। তার উপর আপনারা ডিসিশন নিতে দেরি করে ফেলেছেন। বাচ্চা তখনো জীবিত ছিল। রেভার্স করতে অনেক সময় দেরি হয়।
-আমাকে শিখায়েন না! আমি এই হাসপাতাল ভেঙে গুড়া গুড়া করে ফেলব! দামী যন্ত্রপাতি মারাস! আমার ভাইগ্নার লাশের পর এই হাসপাতাল দাড়ায় থাকবেনা। আজকে ঢাকা শহর জ্বলবে! আগুন লাগায়ে দিব সবখানে!
প্রফেসর নূরানী আশেপাশে তাকালেন। ব্লাড দিতে যাওয়া ইন্টার্নটা এক কোনে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বাকী রা ফুসছে। তাদের সামনে তাদের সিএ র গায়ে হাত তোলা হয়েছে। কিছু একটা করার আগেই ডিরেক্টর স্যার,পুলিশ সাংবাদিক সব চলে এসেছে। ওরা শুধু অপারেশন থিয়েটারের ফটকটা আটকে দিতে পেরেছিল। ইমার্জেন্সি নতুন রোগী অপারেশন টেবিলে তোলা হয়েছিল। অপারেশন ক্যান্সেল! নার্স ওটিবয় সবাই ওটি থেকে বের হয়ে গেছে। এত হট্টগোল! এত হৈচৈ! এর ভেতরে প্রফেসর নূরাণী এগিয়ে গেলেন। বছর পঞ্চাশের ভারী শরীর। ভয়ানক জোরে শব্দ হলো! শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল ফজল সাহেবের নাক ফেটে গেছে! ব্যাপারটা এতই আকস্মিক সবাই কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখের পাতি ফেলতে ভুলে গেল! পিন পতন নীরবতা যাকে বলে! প্রফেসর নূরানী নিজের বুকে থাবা দিয়ে বললেন,
-আমি ডাক্তার নূরানী! আমাকে তুমি মন্ত্রী মিনিস্টার চিনাও! আমি ডাকাইত নূরানী! এই শহরের ত্রাস! আমার নামে বাঘে মহিষে এক ঘাটে পানি খায়। আরেকটা কথা বললে সকেট থেকে হিউমেরাস খুলে নিয়ে আসব! হারামজাদা! বা***! ফজল সাহেব ভাঙা নাক নিয়ে হতভম্ব হয়ে আশেপাশের লোকগুলোকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করতে যেয়ে দেখলেন ডাক্তার নূরানী বাচ্চার মায়ের কাছে যেয়ে পাশে বসে হাত ধরে কিছু একটা বলছে।
-মারে এই হারামজাদাটার জন্য তোর বাচ্চাটারে বাঁচাতে পারলাম না। মাফ করে দিস।
আনিকা অবাক হয়ে দেখল অপারেশন থিয়েটারের কাঠখোট্টা গালিবাজ সার্জন ডাক্তার নূরানী হাসনাত বছর বাইশ তেইশের এক মেয়ের হাত ধরে হাউমাউ করে কাঁদছেন। সাংবাদিকের দল ভিডিও ক্যামেরা খুলে এই দৃশ্য ভিডিও করতে শুরু করল! লাইভ টেলিকাস্ট মাস্ট গো অন। দেশবাসী অবাক হয়ে দেখল এক কসাই ডাক্তার বাচ্চাকে মেরে বাচ্চার মায়ের হাত ধরে শিশুর মত আকুল হয়ে কাঁদছে। সেই কান্নায় কোন কৃত্রিমতা নেই। একদম নিখাদ কিছু অশ্রুবিন্দু, মানুষের অশ্রুর মতই তার রঙ।