অভিশাপ

অভিশাপ

আমার নাম আকাশ সরকার | বয়স এখনো পর্যন্ত 34+ মানে 35 বছর হতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি । আমি একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করি | বারাসাতের এই ফ্ল্যাটে আমি একাই থাকি | বিয়ে করিনি | সেভাবে বলতে গেলে ইচ্ছেও করেনি , বিয়ে না করেই বেশ তো দিব্যি আছি | ছোটো বেলায় অবশ্য আমি এখানে থাকতাম না | বালিগঞ্জে আমাদের তিনতলা নিজস্ব বাড়ি ছিল | বিশাল বাড়ি , বড়ো গাড়ি সব ছিল | বাবা মা দাদু ঠাম্মাকে নিয়ে আমার দিনগুলো বেশ ভালোই ছিল |

সেবার সেদিনও আমার জন্মদিন ছিল | আমার সপ্তম জন্মদিন | প্রতি বছর আমার জন্মদিনের দিনে বেশ বড়ো পার্টি হতো বাড়িতে | প্রচুর অতিথি আসতো | কেক কাটা হতো | তারপরে আরো কতো কিছু | সেবার আমার জন্মদিনের দিন দাদু আমাকে স্কুল থেকে নিতে গিয়েছিল | স্কুল থেকে দাদুর সঙ্গে আসার সময় আমি আইস্ক্রিম খাব বলে বায়না করি | দাদু ড্রাইভারকে গাড়িতেই অপেক্ষা করতে বলে আমার হাত ধরে আইস্ক্রিম দোকানে যায় | তারপর আমার পছন্দের চকলেট ফ্লেভার আইস্ক্রিমটা খেতে খেতে যখন আবার গাড়ির দিকে ফিরে আসছিলাম তখন ,…. হঠাৎ দাদু আমাকে সজোরে সামনের দিকে ধাক্কা মারে | আমি হুমড়ি খেয়ে সামনে ছিটকে পড়ে যায় | আমার আইস্ক্রিমটা মাটিতে পড়ে দুটুকরো হয়ে ভেঙে যায় | আমি ঘুরে দাদুর দিকে তাকাতেই দেখি একটা বড়ো লরি দাদুকে চাপা দিয়ে চলে গেল আমার চোখের সামনে | দাদু ওখানেই মারা যায় | ঐ ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে যায় | জ্ঞান ফিরে দেখি আমি আমার বাড়িতে বিছানায় শুয়ে | ঐ ঘটনার ট্রমাটা কাটিয়ে উঠতে আমার অনেকদিন সময় লেগেছিল |

সময় কারো জন্য থেমে থাকে না | আমাদেরও জীবন কাটতে লাগলো দাদুকে ছাড়া | আমরা আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠলাম | বেশ কয়েক বছর কেটে গেল | আমি তখন হাইস্কুলে পড়ি | সেদিনও আমার জন্মদিন ছিল আমার চোদ্দতম জন্মদিন | তবে , বাড়িতে আর আগের মতো আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠান হতো না | কারন আমার জন্মদিনটা দাদুর মৃত্যুদিনও ছিল | সেদিন দুপুরে আমি ডাইনিং টেবিলে খেতে বসি মা আমাকে খাবার পরিবেশন করছিল | এমন সময় একতলায় বসারঘরে ল্যান্ড ফোনটা বেজে ওঠে | ঠাম্মা ফোনটা রিসিভ করতে যান | আর তখনি একটা শব্দ শুনে আমি আর মা দৌড়ে যায় গিয়ে দেখি ঠাম্মা সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে | আমি দৌড়ে ঠাম্মাকে কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসি | সঙ্গে আমার মাও | হসপিটালে ডাক্তার ঠাম্মাকে দেখে বলে ঠাম্মা অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছেন | পরপর আমার দাদু আর আমার ঠাম্মা দুজনেই আমার জন্মদিনেই মারা গেলেন | নিজেকে কেমন অপরাধী লাগতো | মনে হতো এর জন্য বোধ’য় আমি দায়ী | বাবা মা আমাকে অনেক বোঝাতো যে এগুলো নিছকই দুর্ঘটনা |

এরপর আরো কয়েকবছর কেটে গেল আমি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠি | আমার জন্মদিন এলেই ভয়ে আমার বুক দুরদুর করতো | বাবা মাও ভয় পেত আমার সামনে কিছু না বললেও | আমার একুশতম জন্মদিনে আমি কলেজে ছিলাম | সেদিন সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার কথা | কলেজ ক্যান্টিনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম , এমন সময় আমার মোবাইলে রিং হয় |

আমি ফোনটা ধরতেই ওদিক থেকে পাশের বাড়ির কাকীমা চিৎকার করে বলে — হ্যালো হ্যালো আকাশ তুই কোথায় ? শিগগিরি বাড়ি আয় তোর মা এটুকু বলেই থেমে যান | আমি পাগলের মতো কলেজ থেকে ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে দেখি আমাদের সারাটা বাড়ি দাও দাও করে জ্বলছে , আর বাবা পাগলের মতো চিৎকার করে বলছে —- এসব পাপের ফল পাপ কাওকে ছাড়ে না এজন্মের পাপ এজন্মেই শোধ করতে হবে | গ্যাস সিলিন্ডার বাস্ট করে বাড়িতে আগুন লেগে যায় | আর আমার মা  আমার মা সেই আগুনে  সব শেষ হয়ে যায় | সব শেষ | এরপর আর ও বাড়িতে আমাদের থাকার সাহস হয়নি | আমি আর বাবা এই ফ্ল্যাটে চলে আসি | বাবা সারাক্ষণ গুম হয়ে থাকতো | বাবাকে আমি অনেকবার জিজ্ঞেসা করি কেন বাবা সেদিন সব পাপের ফল বলছিল ? কেন ? কার পাপ ? কিসের পাপ ?

বাবা কোনো উত্তর দিত না | কিন্ত আমি হয়তো একটু একটু আন্দাজ করতে পারছিলাম | তখন আমার বয়স চার কি সাড়ে চার হালকা হালকা মনে আছে এক মহিলা একটা বাচ্চার হাত ধরে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কেঁদে কেঁদে আমার বাবা আমার দাদুকে অভিশাপ দিচ্ছিল — তোরা যেভাবে আমার পরিবারকে শেষ করলি , ঠিক তেমনি ভাবে তোদের পরিবারও সম্পত্তি ভোগ করতে পারবি না , সমূলে শেষ হয়ে যাবি তোদের বংশে বাতি দেওয়ার কেও থাকবে না  এ আমার অভিশাপ | আমি যদি সৎ হয় তো আমার চোখের জলের দাম তোদের গোটা পরিবারকে দিতে হবে | আমার দাদু বাবা ঐ মহিলার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছিল | ঠাম্মা ঘরের ভিতরে হাও হাও করে কাঁদছিল আর আমার মা আমাকে কোলে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল | সেই মহিলা কে ? কেন ওসব বলছিল ? আমি কিচ্ছু জানতাম না |

মায়ের মৃত্যুর পর থেকে বাবা সারাক্ষণ গুম হয়ে থাকতো | বাবাকে ওরকম দেখে আমি নিজের শোকটা সামলে বাবার সামনে শক্ত থাকতাম। বাবা কথা খুব কম বলতো | সবসময় আমার খোঁজ করতো | আমি বাড়ির বাইরে থাকলে বাবা পনেরো মিনিট অন্তর আমাকে ফোন করতো | বাবাকে দেখে মনে হতো একটা অপরাধ বোধ বাবার মধ্যে কাজ করছে | আমি হাজার বার শুধালেও বাবা কিছু বলতো না | এর উপর একদিন বাবার পুরো ব্যাবসাটা বাবার ম্যানেজার বাবাকে ঠকিয়ে নিজের নামে করে নেয় | আমি বাবাকে ওর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলি কিন্তু বাবা নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দেয় — আমার আর ওসব ভালো লাগে না | ও নিয়ে নিয়েছে বাঁচা গেছে | তোকে ও বিষয়ে মাথা ঘামাতে হবে না |

বাবার কথা শুনে প্রচন্ড রাগ হলো | কিন্তু বাবা নিজে যদি না চাই তবে আমি কি করতে পারি | এমনিতেই মানুষটা শোকে-তাপে রয়েছে | আমি অবশ্য ততদিনে একটা চাকরি পেয়ে গেছি | বেশ কয়েক বছর কেটেও গেছে | একদিন অফিসে কাজ করতে করতে হঠাৎ মনে হলো , কৈ বাবা ফোন করলো না তো ? আর তখনি আমার ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল | সেদিনটা আমার জন্মদিন আমার আঠাশতম জন্মদিন এবং আমার দাদু ঠাম্মা ও আমার মায়ের মৃত্যুদিন | আমি পাগলের মতো এক ছুটে অফিস থেকে বাড়ি আসি | ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি সবসময় আমার কাছে থাকে | চাবি দিয়ে দরজা খুলতে খুলতে এক অজানা আশঙ্কায় আমার ভিতরটা কেঁপে ওঠে | দরজা খুলে বাবার ঘরে আসতেই আমার পা দুটো জমে যায় | বাবা সিলিং থেকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলছে | আর টেবিলে পেপারওয়েট চাপা দেওয়া একটা চিঠি ফরফর ফরফর করে উড়ছে । চিঠিতে লেখা —

আকাশ ,
সব আমাদের পাপের ফল | আজ তোকে সব সত্যি কথা বলবো | তোর জানা দরকার | আমাদের বালিগঞ্জের বাড়ি আমাদের ব্যবসা এগুলো কোনোটাই আমাদের নয় | ঐ সমস্ত সম্পত্তির মালিক মিস্টার বাসু | মিস্টার বাসু বিষয়ী মানুষ ছিলেন না , উনি কবিতা গান বেড়ানো এসব নিয়েই মেতে থাকতেন | আমার বাবা মানে তোর দাদু ওদের ফ্যামেলি লইয়ার ছিলেন | বাবা ওনার দুর্বলতার সুযোগে ওনার সব সম্পত্তি নিজের নামে করে নেয় | তারপর রাতারাতি আমরা ওদের সম্পত্তিতে দখল নিই | মিস্টার বাসু এই সব সহ্য করতে না পেরে মারা যান | ওনার মারা যাবার পর ওনার স্ত্রী আমাদের অভিশাপ করেন । এই সবই তার ফল | দেখ সত্যিই তোর দাদু ঠাম্মা তোর মা সবাই মরে গেল কেও সম্পত্তি ভোগ করতে পারলো না | বড়িটাও পুড়ে গেল |

ব্যবসাটাও আবার আমাকে ঠকিয়ে আরেকজন নিয়ে নিল | এজন্যই তোকে সেদিন বারণ করেছিলাম | আমি তোর মায়ের মৃত্যুর পর মিস্টার বাসুর স্ত্রী ছেলেদের খোঁজ করি ওদের সম্পত্তি ওদের ফিরিয়ে দেব বলে  কিন্তু ততোদিন বড়ো দেরি হয়ে গেছে | খোঁজ নিয়ে জানতে পারি ওনার স্বামীর মৃত্যুর পর ওনারা খুবই গরীব হয়ে পড়েছিলেন | বিনা চিকিৎসায় ওনার ছেলে সাত বছর বয়সে মারা যায় তারপর উনি নাকি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন এবং একদিন ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান | তাই হয়তো সাত বছর অন্তর অন্তর আমাদের সবচেয়ে আনন্দের দিন মানে তোর জন্মদিনে একটা করে আঘাত আসে আমাদের পরিবারে | তোর মায়ের মৃত্যুর পর সাত বছর আজ পূর্ণ হলো | তোকে হারিয়ে আমি বাঁচতে পরবো না |তার চেয়ে আমিই চলে যাচ্ছি | তুই সাবধানে থাকিস | আর পারলে তোর দাদুকে আমাকে ক্ষমা করিস |

ইতি , তোর বাবা

বাবার মৃত্যুর পর আরো সাতটা বছর কেটে গেছে | তবে এবার কি আমার পালা ? কিন্তু আমি তো এসবের কিচ্ছু জানতাম না | দেখা যাক তবে ল্যাপটপে সবটা লিখে ল্যাপটপটা অফ করতেই ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজলো | অর্থ্যাৎ আমার জন্মদিন শুরু হলো | খাট থেকে নেমে জানলার ধারে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম | তারপর বাথরুম থেকে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ি | কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না শুধু একটাই চিন্তা কখন মরবো ? কীভাবে মরবো ? শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন দুচোখের পাতা এক হয়ে যায় | সকালে ঘড়িতে এর্লাম বাজতেই ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে দেখি ঘড়িতে আটটা বাজছে |

অর্থ্যাৎ আমার মরার জন্য এখনো ১৬ঘন্টা আছে | আজ অফিসে ছুটি নিয়েছি তাই আরো কিছুক্ষণ বিছানায় কাটিয়ে উঠে বাথরুম যায় এরপর কিছুক্ষণ যোগা করি । তারপর খাবার খেয়ে একটা বই নিয়ে বসি | আজ আর কেও আসবে না আমার কাজের লোককে ছুটি দিয়েছি | দুপুরে সিদ্ধ ভাত রান্না করে একটু ঘুমিয়ে নিই বিকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘড়িতে ছ’টা বাজছে মানে এখনো ছ’ঘন্টা সময় বাকী | টিভি খুলে টিভি দেখি সন্ধ্যে থেকে | রাত ন’টা নাগাদ উঠে এক প্যাকেট চাওমিন করি নিজের জন্য | খেয়ে নিজের বিছানায় বসে দেখি ঘড়িতে রাত দশটা মানে আর দু ঘন্টা | একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করি | ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজলো | আমি এখনো মরলাম না দেখে এবার আমার নিজেরই হাসি পেলো |

আমি লাইটা অফ করে শুয়ে পড়লাম | পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুম স্নান করে রেডি হয়ে নিলাম | তারপর ব্রেড বাটার খেয়ে উঠে মনে মনে ভাবলাম আমার বয়স আজ পঁয়ত্রিশ বছর একদিন | ড্রেসিং টেবিলের সামনে টাইটা ঠিক করে নিয়ে গায়ে আরেকটু ডিও স্প্রে করে নিলাম | কাজের লোক রজত আসে বারোটা নাগাদ | আমি দরজার পাশে গনপতির মূর্তিতে প্রণাম করে অফিস যাবার জন্য যেই দরজাটা খুলি দেখি দরজার সামনে আমার সামনের ফ্ল্যাটের কাকীমা সিকিউরিটি গার্ড রামসিং যাদব নিচের ফ্ল্যাটের মুখার্জিদা এবং আরো কয়েকজনের সঙ্গে তিনজন পুলিশ দাঁড়িয়ে | আমি দরজা খুলতেই ওরা একটু হকচকিয়ে যায় | তারপর আমি কিছু বলার আগেই সবাই দুমদাম করে ঘরে ঢুকে যায় | আমি কিছুই বুঝতে পারছি না |

এমন সময় দরজার বাইরে দেখি চারজন দাঁড়িয়ে | আমার সারাটা শরীর পাথরের মতো জমে যায় …… আমি ঘামতে শুরু করি | আমার দাদু ঠাম্মা মা বাবা দাঁড়িয়ে আমাকেই দেখছে | কিন্তু ওরা তো মারা গেছে ….তাহলে ? আমি ওদের কীভাবে দেখতে পাচ্ছি ? কীভাবে ? আমি মুখ ঘুরিয়ে ভিতরের দিকে যেতে যায় তখনি দেখি সামনের ফ্ল্যাটের কাকীমা আঁচলে নাক মুখ ঢেকে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে সঙ্গে সিকিউরিটি গার্ড রামসিং নাকে রুমাল চাপা দিয়ে | আমি ভেতরের ঘরে গিয়ে দেখি আমার লাশ বিছানায় পড়ে আছে | পুলিশরা নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বলাবলি করছে-

— মনে হয় পরশু রাতেই মরেছে  হার্ট অ্যাটাক মনে হয় | তখনি কানে আসে কে যেন বলছে  পাপ বাপকেও ছাড়ে না এই জন্মের পাপ এই জন্মেই শোধ করতে হবে ||

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত