চরণ ও সাধক

চরণ ও সাধক

সন্ধ্যে নামতেই শ্মশান চত্তর টা একদম খাঁ খাঁ নিস্তব্ধ হয়ে গেল, কাক গুলো এতক্ষন উড়ছিল মাথার উপর এখন একটাও নেই, কতগুলো বাঁদুড় উল্টো হয়ে বসে আছে ঝাঁকড়া পিপুল গাছটার নিচু ডালটায় | ধীরে ধীরে ধূনি থেকে ওঠা গাড়ির মতো কালো ধোঁয়ায় আরও অন্ধকার হতে লাগল আসন্ন অমাবস্যার রাত্রি | শব্দহীন প্রানীস্পন্দন হীন এই ধূধূ শ্মশান চত্তরটায় ছিল শুধু চরণ আর সেই সাধু বাবা | মাথায় গগনচুম্বী জটা আর তা থেকে নেমে আসা পাক খাওয়া মোটা চুলের গোছা পিঠের উপর নিস্পন্দ সাপের মতো পড়ে আছে |

অঙ্গারের মতো কঠিন চোখ যেন ঠিক পাকা করমচা , গলায় রুদ্রাক্ষের মোটা মোটা মালা , কপালে লাল রক্তচন্দন ও সিঁদুরের মিশ্রিত টিকা | সারা গায়ে মৃতদেহের ছাই মাখা যা এখন ঘামের সাথে মিছে কালো ছোপ দাগ ধরেছে আর পড়নে মাত্র গেরুয়া একটা ছোট্ট নেংটি , তিনি ধ্যান করছেন এখন | চরণ সাধুটার নাম জানে না, তার কান্ডকারখানা দেখবে বলেই এই কদিন সে মাঠে কাজ সেরে বাড়ি না গিয়ে শ্মশানেই পড়ে আছে, আর বাড়ি গিয়েই বা কি হবে স্ত্রী গত হওয়ার পর তার ঘরের প্রতি আর মায়া নেই | সাধুবাবা একমাত্র ভক্ত তাকে পেয়ে খানিক খাতির করছিল ঠিকই ,কিন্তু সে এইটুকু বুঝেছে যে ইনি ঠিক সুবিধার লোক নন | এই কদিনে নিজের চোখে যা সব দেখেছে, আর তার কাছে খুঁচিয়ে কায়দা করে ,কথার প্যাঁচে ফেলে যা বুঝেছে তাতে বলা যায় ভগবানকে পাওয়ার সাধনা তার নয় | কোনো এক গূঢ়, কুটিল ,অহিতকারী সাধনায় তিনি লিপ্ত আর এই সাধনা শেষ না করলে সাধুর ও নিস্তার নেই |

এবারে ধুনিটাকে উস্কে দিয়ে তার মধ্যে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে কি একটা যেন নিক্ষেপ করতেই আগুনটা এক মানুষ সমান উঁচু হয়ে উঠল আর তার সাথেই সে দেখল আগুনের মধ্যে ধীরে ধীরে তৈরী হচ্ছে একটা মুন্ডহীন মানুষের অবয়ব | চরণ এই গ্রামের ডাকাবুকো ছেলে , এই শ্মশানে দিনের পর দিন পড়ে থেকেছে , কেউ মারা গেলেও তার ডাক পড়ত সবার আগে | কিন্তু এ দৃশ্য যেমন অবর্ণনীয় তেমনি আশ্চর্য রকম অলৌকিক, গায়ের লোম সব কাঁটার মতো খাঁড়া হয়ে উঠল তার | চমকে উঠে দুপা পিছিয়ে যেতে গেল সে , এমন সময় মেঘ গর্জনের মত নির্দেশ এল সাধুর কাছ থেকে” নড়বিনা একদম | চুপ করে বসে থাক , নড়লে তোকে আগে জবাই করে দেব |”

এতদিনে এই প্রথম সাধুর রুদ্রমূর্তি দেখল সে , সেকি প্রচন্ড মূর্তি চরণের হাত পা পেটের ভিতর ঢুকে যেতে লাগল এসব কি সত্যি হচ্ছে তার সামনে নাকি স্বপ্ন দেখছে স্বপ্নেও কি এসব দেখা যায়? বিকট উচ্চকন্ঠের অজানা অং বং মন্ত্রে যেন জেগে উঠছে শ্মশানের প্রত্যেকটি অতৃপ্ত অাত্মা , তাদের অবিরাম ছোটাছুটি টের পাচ্ছে চরণ | গায়ের পাশ দিয়ে সেই অপ্রাকৃতিক হাওয়া যেন তাকে ধাক্কা দিয়ে বেড়তে চাইছে , সাধুবাবা থামছেন না , তিনি মন্ত্রপাঠে যেন ডুবে গেছেন | আর সেই ধুনির জ্বলন্ত আগুন থেকে যেন বেড়িয়ে আসতে চাইছে এক দানব রূপী শয়তান ..আক্রোশে তার সেই লেলিহান চিৎকার চরণের কানের ভিতর দিয়ে কোনো মনের এক গভীর গহ্বরে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে আসছে | সে বুঝল এটা আর বেশিক্ষন চললে সে নিজেই বাঁচবে না …তখনই দেখল সাধুবাবা মন্ত্রের জোড় কমিয়েছেন আর আগুনটাও নেমে এসেছে হাতের কাছে | কিন্তু বাবার মুখে সংশয় আর ভয় মিশ্রিত শঙ্কাটা এখনও কাটেনি মনে হচ্ছে তার |

গরম ছাই এর ভিতর নরমুন্ডের কোটরে মদ মিশ্রিত দশ দিন বয়সের একটা সাদা পায়রার রক্ত ছিল, সেটা তিনি এবার ঢকঢক করে পান করলেন ,আর বাকিটা ছিটিয়ে দিলেন ধূনির আগুনে | একটা পট্ পট্ করে কাঠের গিট ভাঙা আওয়াজের সাথে সেটা নিভে গেল দপ করে | সাধুবাবা এবার চিন্তিত মুখে গাঁজা কলকে নিয়ে দূরে খোলা হাওয়ায় গিয়ে বসলেন | মুখে একটা নিষ্ঠুর , ব্যঙ্গাত্বক হাসি হেসে বললেন “বল হে কি বুঝলে?” চরণ এতক্ষনে একটু স্বাভাবিক হয়েছে , সে মিন মিন করে বলল “এসব কি সাধুবাবা ? এ কোন সাধনা আপনার?আপনি কি তবে কাকতান্ত্রিক?”

সাধুবাবা জ্বল জ্বলে চোখ করে রাগী গলায় বললেন ” কাকতন্ত্র কাকে বলে জানিস ? নাম টাই শুধু জানিস তোরা , কাজ কেমন হয় কোনো ধারনা নেই | কাক তন্ত্র অনেক দিনের অভ্যাসে রপ্ত হয় | এদিয়ে মানুষকে বশ করা হয় , তাদের দিয়ে সাধকরা যা চায় করিয়ে নিতে পারে | বান মারা, নিশির ডাক , রোগ প্রতিস্থাপন , পুতুলতন্ত্র এসব ও করে | এ অতি নিকৃষ্ট কাজ , আমি এসব ছুটকো কাজ করি না তবে জানি সবই | কাওকে বানমারতে হবে ? বল ..তোর জন্য করে দের তবে দুটো পিতলের ঘটি আর পাঁচিশশো টাকা দিতে হবে |”

চরণ তড়িঘড়ি বলে … “নানা বাবা এসব করতে হবে না | আপনি তবে তখন ওরকম ধমকালেন কেন বুঝলাম না | আমাকে কি আপনি বলি দিতে চান?তা দিয়ে দিন | বেঁচে থেকেই বা কি করব? বউটা অকালে চলে গেল, আর তো কেউ ছিল না , তাও যদি আমার শরীর টা আপনার সাধনায় কোনো কাজে লাগে | ” এবার বেশ খোশ মেজাজে তিনি বললেন “শোন ব্যাটা , তোকে আমি আমার শিষ্য বানিয়ে নেব , তোকে বলি দিলেও আমার কোনো কাজে লাগবে না | তোর রাশি টা সাধকের, বুঝলি? জাতকের নয় |

আর সাধনার সময় আসন থেকে উঠলে সাধনায় বিঘ্ন হয় , অপদেবতারা রাগ করে ঘাড় মটকে রক্ত চুষে খেয়ে নেয় | আমার চোখের সামনে হয়েছে , আমার তখন যুবা বয়স , এক কাক তান্ত্রিকের কাছে মন্ত্র দীক্ষা নিয়ে রোগ প্রতিস্থাপন করা শিখছি | কারো কঠিন কোনো ব্যামো হলে সেই লোক কে নিয়ে কাকতান্ত্রিকের কাছে নিয়ে গিয়ে সেই রোগ অন্য কোনো সুস্থ দেহে তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়, বিশেষ করে জাতকের কোনো শত্রু কেই তা পাঠানো হয়ে থাকে | তবে তান্ত্রিক কে অনেক কঠিন সাধনায় লিপ্ত হতে হয় ,তাই অনেকে কাজ জানলেও করতে চায় না | কৌশিকি অমাবস্যায় শ্মশান থেকে নিয়ে আসা সদ্য মৃত বিধবার লাশের উপর বসে আর ১০৮ বার বীজমন্ত্র জপ করে সেই সাধনা করার নিয়ম ,তবেই ওই লাশের মুখ থেকে ওষুধ বেড়িয়ে আসবে |

তা আমার গুরু তো কাজ শুরু করলেন , হঠাৎ জাতকের এক কাকা সেখানে উপস্থিত হয়ে সব দেখে হল্লা শুরু করে দিল ,তাও সাধনা ভঙ্গ করা যাবে না এটাই নিয়ম | এবার সেই কাকা লোকটা জাতককে ধরে টানাটানি করে আসন ত্যাগ করাতে গেলে হঠাৎ এক প্রচন্ড ঝড়ের মতো হাওয়া এসে ঘর কাঁপিয়ে দিল সাথে সাথে গুরুর ফিনকি দিয়ে রক্তবমি শুরু হল | দেখলাম গুরুর চোখ মুখ ঠেলে রক্ত বেড়িয়ে আসতে চাইছে , মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে ছটফট করতে করতে ইহলোক ত্যাগ করলেন তিনি | তাই সাধনায় একবার বসে পড়লে ওঠার কোনো নিয়ম নেই | তুই শিখে রাখ কাজে লাগবে পরে | ”

গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে চরণের , একি অলক্ষুণে সব কান্ড!!! .সে এতটা আশা করেনি , কেন যে মরতে এসেছিল এই ভয়ংকর সাধুটার কাছে এখন ফিরে যেতে গেলে যদি তার পিছনেই প্রেতাত্মা লাগিয়ে দেয়! মানুষ যতসহজে মরার কথা বলে তত সহজে নিজের মৃত্যুর কারন টা মেনে নিতে পারে না ,বুক কেঁপে যায় | ভয়ে ভয়ে চরণ তবু জিজ্ঞাসা না করে পারল না ….” তা বাবা , আপনি এখন কিসের সাধনা করছেন? আর ওই যে আগুন থেকে বেড়িয়ে আসছিল সেই জিনিসটাই বা কি?” এবার সাধুবাবা একটু মনক্ষুণ্ণ স্বরে বললেন ” আমার সাধনা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে , বীরভদ্রকে ধ্যানজপে তুষ্টকরা ওতো সহজ কাজ নয় , বিগত ৪ বছরের মধ্যে ধরে বিজোড় সংখ্যার বছরে প্রতি ত্রয়দশী থেকে অমাবস্যার মধ্যে তাঁর পুজোর আয়োজন আমাকে করতেই হয় ,নয়তো দেবতা রূষ্ঠ হবেন | আমার সাধনায় কোনো না কোনো ত্রুটি ঠিকই হচ্ছে , আমি বুঝতে পারছি ,শেষবারের চেষ্টাটা আমাকে করতেই হবে | ”

আজ গল্পের ঘোরে রয়েছে সাধুবাবা , বলুক যা মন চায় | চরণ বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছে সাধুর আসল মতলবটা কতটা সাধু | গাঁজার ধোঁয়ার সাথে মিশে রাতের অন্ধকারটা আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে, রাতচরা পাখি গুলো উড়ছে আকাশ পথে , ঝিঁঝিঁ পোকা গুলো এতক্ষন কোথায় ঘপটি মেরে ছিল কে জানে , এখন একত্রে কলতান জুড়েছে | চোখ লাল করে ঘোরের মধ্যে তিনি বলে চললেন.. “তপস্যায় সিদ্ধ লাভ করলে তোমাকে কাক বিদ্যা আমি শিখিয়ে দেবো, দীক্ষাও দিয়ে দেবো বিনিপয়সায় | তখন লোকের কাছে তোমাকে হাত পাততে হবে না , তারা এসে তোমার পায়ে পায়ে ঘুরবে | কিন্তু তার জন্য তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে চরণ হ্যাঁ না কিছুই বলল না, রকমসকম তার একদম ভাল লাগছে না | একটু ঝিমিয়ে নিয়ে চোখ রগড়ে এবার তিনি একটা প্রশ্ন করলেন “তোমার গ্রামে কোনো সুন্দরী তুলা রাশি দেব গন এর বলিকা আছে যার বয়স আট থেকে বারো বছরের মধ্যে ? যে এবছরে প্রথম রজোঃস্বলা হয়েছে ? আর যার চোখের মনি ঘোলা? আছে এমন কেউ ??”

ঘোলা চোখ বলতেই চরণের মনে পড়ে গেল মাকুর কথা , পাশের পাড়ার গনেশ মুদির মেয়ে সে | ফলপাকুড় খেতে খুব ভালবাসে , তড়তড় করে গাছে উঠে যায় , চরণদের ডেঁয়ো আর জাম গাছ গুলোয় ঠিক বাঁদরের মতো উঠে পড়ত আর নাহলে ঢিল ছুঁড়ে পথের লোক কে অস্থির করত | বকা দিলেই চোখ থেকে লেবুর রস , তবে ঘোলা চোখ বলে গ্রামে ওর আলাদা খাতির , বয়স ওরকমই হবে | কিন্তু বাকি শর্ত গুলো মিলবে কিনা সে জানে না | কথায় কথায় মাকুর কথা সাধু বাবাকে বলে ফেলেই নিজেকে গাল পাড়তে লাগল সে | আসলে সাধুবাবার চোখে যেন কেমন সম্মোহনের অদৃশ্য মায়াজাল আছে ,একবার সেখানে ঢুকলে আর বেড়োনোন কোনো রাস্তা নেই | মাকুর কথায় তিনি মনে মনে খুশি হলেন মনে হল , উঠে গিয়ে পাশের দড়মার বেড়ার ঘরটায় গিয়ে থেকে কি একটা যেন থলিতে পুরে রাখলেন | তারপর ফিরে এসে রীতিমতো হুকুমের সুরে ,নেশায় ঢুলুঢুলু চোখে বললেন ….”একটা ফর্দ করে দেবো | কাল বেলাবেলি বাজার থেকে নিয়ে আসবি |

সব বাজারে পাবি না কিছু জোগাড় করতে হবে … যেমন অপমৃত্যুতে মরেছে এমন বিবাহিত বাজা মেয়ের পুরোনো একটা কাপড় , তারপর সদ্য জন্ম নেওয়া বকনা বাছুরের রক্ত , উত্তর দিকের হাওয়ায় উঁড়ে যাওয়া বটগাছের তিনটি পাতা আগুনে পুড়িয়ে শুকনো করে গুঁড়ো করা , কালো বেড়ালের লেজের একগোছা লোম , শুয়েরের চর্বি এসব | বাজার থেকে আনবি পুজোর উপাচার …চন্দন তেল, রক্তজবার মালা, পাতলা নরম একটা গেরুয়া কাপড় , গামছা আরো অনেক কিছু | তবে সব যোগাড় করতে হবে পরশু রাতের মধ্যে | আর যে প্রধান উপকরন টা আনতে হবে সেটা তুই আনতে পারবি না | ” এই বলে একটা বিকট ক্রূঢ় হাসি দিলেন , দাঁতে জিভে এখনও লেগে আছে সেই পায়রার কাঁচা রক্ত , কী যে বিভৎস সে হাসি!!

ফর্দ নিয়ে বাড়ি ফিরে চরণ নিজের সম্বিৎ ফিরে পেল | কী করতে যাচ্ছে সে? মাকুকে নিয়ে লোকটা কি করবে ? সাধক সঙ্গীনি বানানোর তালে আছেন নাকি? কিন্তু তা কি করে হয়? সে তো খুবই ছোটো মেয়ে , তার সাথে এই বুড়ো সাধু বিয়ে করবে ? নাঃ এটা ঠিক বিশ্বাস যোগ্য না , বুড়ো সাধু সাধনা শেষ না করে অন্ন স্পর্শ ও করবেন বলে মনে হয় না , কাজ ফতেঃ করে তবেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে | তবে? মেয়েটার কোনো বিপদ হলে সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না ,মাকুটা তার বৌ এর খুব নেওটা ছিল | সাধু বাবাকে নজরে নজরে রাখতে হবে , কাল ও শ্মশানে গিয়ে দেখতে হবে সে কি করছে |

পরদিন কিছু উপাচার নিয়ে রাতের দিকে শ্মশানে হাজির হল চরণ | সাধুবাবা তাকে সন্দিগ্ধ চোখে মেপে নিয়ে বললেন …..”কিরে তুই আজ এসেছিস যে বড় , কাল তো তোর জিনিস পত্র নিয়ে আসার কথা | আজ কেন এসেছিস?” চরণ আমতা আমতা করে বলল আজ্ঞে সব তো একবারে আনা যাবে না তাই আজ কিছু দিয়ে গেলাম | কাল টাটকা পুজোর জিনিস আপনাকে পৌঁছে দেব সময় মতো , তবে ওই কিছু জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না কিনা তাই আপনার কাছে শুনতে এলাম কোথায় পাওয়া যাবে  এবার একটু নরম হয়ে সাধু জিজ্ঞাসা করলেন নীচু স্বরে কি কি পাসনি?”

ওই যে বাজা মেয়েমানুষের কাপড় টা তো ” তোর বাড়িতেই পাবি “বলেই কুটিল অট্টহাসিতে বিশাল শরীর কেঁপে উঠছে , যেন এক মজার ধাঁধাঁ য় চরণকে ফেলে হারিয়ে খুব মজা পেয়েছেন | হাসির দমকে লম্বা দঁড়ির জটা গুলো পেঁচিয়ে যাচ্ছে একে অপরের সাথে | রাতের অন্ধকারে এমন ডাকাতে হাসিতে গাটা ছমছম করে উঠন চরণের | তার বৌ তো মাথায় বাজ পড়েই মারা গেছিল , কিন্তু এই সাধু তা জানল কি করে? একথা তাতে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বললেন ….”.তোর পিছনে আমি এক শাড়ি পড়া ঘোমটা দেওয়া ছায়া দেখেছি , তুই আসলেই আঁশটে গন্ধে বাতাস ভরে যায় | কে এই ছায়া দেখতে গিয়ে ধ্যানযোগে জানতে পারলাম তোর বউ | তোর কোনো অনিষ্ট সে করবে না ,তবে তার মুক্তি হচ্ছে না বলে কষ্ট পাচ্ছে , তাকে এবার মুক্তি দে | তার পরনের কাপড় যদি কিছু থাকে কাল নিয়ে আসবি আমি তাকে মুক্ত করে দেব ” |

নাঃ…সাধুকে যতটা খারাপ ভেবেছিল ততটা সে নয়, তবে কোথায় যেন এক খটকা লাগছে | বউটা যদি অশরীরি অতৃপ্ত আত্মা হয়েই তার সাথে থাকবে তবে সে কেন টের পেল না?আর অাঁশটে গন্ধের কথা কই আর কেউতো বলেনি কখনও !! এটাও বেশ সন্দেহজনক কথা | যাই হোক , বেশী কথা না বাড়িয়ে চরণ চলেই যাচ্ছিল হঠাৎ দেখল ধূনির পাশে কি একটা কলা পাতায় মোড়ানো জিনিস রয়েছে | সে অপলক সেটা দেখছে বলে সাধু বাবা এগিয়ে এসে বললেন …”ওটা জাত কেউটে , বিষ দাঁতটা লাগবে কাল পুজোতে আর মাংসটা লাগবে পুজোর আগের রাতের ভক্ষণে| ”

অমাবস্যার ঘন কালো গভীর রাত্রী, চারিদিকের গাছপালার শরীর বেয়ে সর্পিল গতিতে নেমে আসছে অন্ধকারের কীট | শ্মশানের আশেপাশে কোনো জনপ্রাণী নেই , শুধু থেকে থেকে শেয়ালের হুহু ডাক ভেসে আসছে প্রহরে প্রহরে শয়তানের পুজোর সব উপাচার সুন্দর করে সামনে সাজিয়ে রেখে মস্ত বড় এক ধূনি জ্বালিয়েছেন সাধুবাবা , আজ তিনি সেজেছেন গেরুয়া কৌপিনে , কপালে সেই টকটকে সিঁদুরের টিকা , গলায় ঝুলছে রুদ্রাক্ষ ও রক্তজবার মালা , মাথায় জটার নীচে লাল ফেট্টি বাঁধা , কোমরে গোঁজা পিতলের বাটে কারুকার্য করা ছোট্ট একটা ছোরা |

তিনি এখন ধ্যানমগ্ন , কিন্তু বিড় বিড় করে মন্ত্র উচ্চারনের বিরাম নেই | একটু দূরে মুখ ,হাত ,পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে মাকু , নিস্তেজ , অজ্ঞান | পরনে চরনের বউ এর একটা আটপৌড়ে শাড়ি | চরণেরও কোনো হুঁশ নেই , সে নিস্পলক চেয়ে আছে ধূনির আগুনের দিকে | সাধুবাবা পজোর শুরুতেই সিদ্ধি বলে কি যে ছাই খাইয়ে দিল উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই আর | ক্লান্ত চোখ চেয়ে সে বসে আর অপেক্ষা করছে সেই কালো লেলিহান শিখা কি ভাবে গ্রাস করে নেবে যাবতীয় শুভ শক্তি | এ বীরভদ্রের পুজো নয় , মা কালীর সাধনাও নয় , এ অশুভের আগমনের সূচনা , শয়তানের কাছে আত্মার আহুতি | চরণের চেতনা একবার ফিরে আসছে আবার মনের গভীরে ঢুকে খানা খন্দের মধ্যে তা ঘূর্ণীপাক খেয়ে নীচে চলে যাচ্ছে | কখনও দেখছে যে সেই সাধু মন্ত্র পড়ে কি যেন একটা .সম্ভবত পান অচৈতন্য মাকুর মুখে পুরে দিলেন |

চরণ আজ কিছু করেই মাকুকে বাঁচাতে পারেনি , সকালে শুধু উপাচার কিনে গনেশ মুদির বাড়িতে গিয়ে আদ্যপান্ত বিবরণ দিয়ে এসেছে, তবে তার অনেক আগেই মাকু নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার বাড়ির সদস্যরা কান্নাকাটি জুড়েছে | সে গিয়ে এসব বলাতে তারা এবার মড়া কান্না জুড়লো, গনেশ এর সাথে গোপনে শলা করে সন্ধ্যায় শ্মশানে গিয়ে চরণ দেখল ,সাধু খুশি মনে বসে গাঁজায় টান দিচ্ছেন আর মাকু একমনে শান্ত হয়ে বসে গায়ে চন্দনের তেল মাখছে , তার ফরসা রং যেন ফেটে পড়ছে মশালের আলোয় |

সাধুবাবা জোড় করে দড়মের ঘরটায় তাকে নিয়ে গিয়ে একটা মাটির গ্লাস হাতে দিয়ে বললেন..” এতে আমি সিদ্ধ বানিয়েছি তুই এক ঢোকে মেরে দে ” | চরন বুঝল হুকুম না মেনে তার উপায় নেই | সে খেতে গিয়ে বুঝল এ সিদ্ধি নয় অন্য কোনো আঁশটে গন্ধ যুক্ত বশীকরন করার দ্রব্য যা তাকে ঠুটো করে রাখবে | বাইরে এসে চমকে উঠে চরণ দেখল মাকুর চোখে কোনো দৃষ্টি নেই ,কাচের চোখের মতো নিস্পলক দৃষ্টি সেই চোখে মনিটার ঘোলা রং চলে গিয়ে গাঢ় কালো রং দেখা যাচ্ছে | মাকু এর পর উঠে এসে কাঠের পুতুলের মতো হেঁটে এসে সাধুবাবার কাছে দাঁড়াল , সাধু চরণের আনা তার বউ য়ের আটপৌড়ে শাড়িটা তার দিকে ছুঁড়ে দিতেই সে তাদের সামনেই নিজের গায়ের জামা খুলে শাড়িটা পড়তে লাগল , প্রথম যৌবনের ছোঁয়া তার শরীর জুড়ে | লোলুপ দৃষ্টিতে গোগ্রাসে সাধু সেই দৃশ্য গিলতে লাগলেন, তার কষ্ গড়িয়ে লালা উপচে পড়ছে |

শয়তান, বর্বর সে দৃষ্টি মাকুর শরীরের দিকে আটকে আছে  এই প্রথম বার চরণের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল , মাকুকে এই অবস্থায় দেখে হিতাহিত জ্ঞান না পেয়ে সে পাঁজাকোলা করে তাকে তুলে দড়মার ঘরে রেখে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিল | সাধুবাবা দৌড়ে এসে এক প্রচন্ড ধাক্কা মেরে প্রবল আক্রোশে চিৎকার করে বললেন” তোর এত বড় সাহস আমার পুজোর প্রসাদে তুই হাত দিস…সরে যা এখান থেকে নাহলে তোর ভোগ ও চড়িয়ে দেব | ওই মাগীর যোনীর রক্ত আমার চাই” মটিতে পড়ে কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞান হয়ে গেছিল সে, টের পেল ওষুধ কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে |

জ্ঞান ফিরতেই বুঝল অনেক দেরী হয়ে গেছে পুজো শুরু হয়েছে আর আজ তাদের দুজনের সামনেই মূর্তিমান বিপদ বসে আছে সঠিক প্রহরের অপেক্ষায় | গনেশ রা কি ঠিক সময়ে আসতে পারবে? এই ভন্ড চশমখোর , পাষন্ড সাধুকে ওরা কি জব্দ করতে পারবে? ভাবতে ভাবতেই দেখল সাধুর আসনের বাঁদিকে শুয়ে মাকু চোখ মেলে তাকিয়েছে , স্বাভাবিক দৃষ্টি , কিন্তু মুখ বাধা থাকায় কেবল গোঁ গোঁ শব্দ করছে, |

সাধু আগুনের শয়তান কে জাগিয়ে তুলছে ধীরে ধীরে , সেদিন শূন্য রাতের সেই বুক চিঁড়ে চলছে তার অশুভ শক্তির আস্ফালন , কীট পতঙ্গ হাওয়ার মতো উঁড়ে এসে পড়ছে আগুনে | দেখতে দেখতে একটুকরো ঘোর কালোমেঘ এসে জমা হতে শুরু করল ওদের মাথার উপর , ধুনির আগুন থেকে বেড়িয়ে আসছে সেই অগ্নিমানব অতি স্পষ্ট, তার মুন্ডুটাও আজ স্পষ্ট হুঙ্কার উঠছে দিক্বিদিক থেকে , তীব্র কটু গন্ধে ভরে উঠছে বাতাস , নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ওদের দুজনের | আগুনের মধ্যে থেকে বেড়িয়ে ধীরে ধীরে আসছে একটা বিরাট হাত , মাকু এদৃশ্য দেখতে না পেরে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল আবার | এমন সময়ে চরন দেখল সেই ছোড়া টা কোমর থেকে খুলে সাধু হাত বাড়িয়ে নিস্তেজ মাকুকে পা ধরে টান মেরে নিজের কাছে নিয়েছে, আর তড়িঘড়ি নীচের দিকের শাড়ির অংশটা টেনে টেনে ছিঁড়ছে , তার নজর মাকুর নিম্নাঙ্গে | চরণ ইষ্ট মন্ত্র জপ করতে লাগল….হে ঈশ্বর কোথাও যদি তোমার কোনো শুভ শক্তি অবশিষ্ট থাকে তবে তুমি এই পাষন্ডর হাত থেকে মেয়ে টাকে তুমি বাঁচিয়ে দাও |

চরণের আরতি ভগবানের কাছে পৌঁছোল কিনা বোঝা গেল না তার আগেই এক প্রবল ঝড়ের মতো শন্ শন্ করে হাওয়ায় ওদের উপর দিয়ে একটা ধুলোর ঝড় উঠে গেল …আর সাথে সাথে দেখল মাকু পায়ে দড়ি বাধা অবস্থায় খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেড়োচ্ছে তার , বিকট এক হাড়কাঁপানো হুঙ্কার দিয়ে সে ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠল” তুই আমাকে ছুঁবি? তোর রক্ত চুষে খাব আমি, তোকে পুঁতে দেব এই শ্মশানের মাটিতে….তোকে আমি বাঁচতে দেব না…বাঁচতে দেব না ” ভয়ংকর এক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে আকাশ এ গলা চরণের খুব চেনা, এ মাকুর গলার স্বর নয় |

কিন্তু সে কিছু করবে না, সে এখন দর্শক  সে বিস্ফারিত চোখে দেখতে লাগল ওই টুকু মাকুর দুটো ছোট্ট কোমল হাত অতবড় শরীরের সাধুকে আসন সমেত আকাশের দিকে তুলে ধরেছে | আর সাধু তার মন্ত্রের জোড় তীব্র থেকে তীব্র তর করছে | মাকু তাকে দুহাতে উঁচু করে দোলাচ্ছে যেন সেটা একটা খেলনা পুতুল আর অবিকল চরণের বউ এর গলায় হাসছে চিৎকার করছে , গালাগালি দিচ্ছে | তার যেন কোনো হুশ নেই , আকাশের দিকে মুখ তুলে সে এবার বিকট সুরে কান্না শুরু করল অন্ধকার যেন ঘণীভূত হয়ে আছে শুধু তার মাথার উপরে |

ধূনির আগুন এবার আহুতি চাইছে তার শিখা আকাশ ছুঁতে চাইছে , অগ্নিরূপী শয়তান যে এবার তার প্রসাদ চাইছে তা না পেলে সে গ্রাস করবে সমস্ত জগৎ সংসার | চরণ বুঝল এখন কিছু একটা করা প্রয়োজন , সাধুর মন্ত্রে মাকু আটকে আছে ঠিকই কিন্তু তার ভেতরে আশ্রয় নেওয়া চরণের বউ তার কথা বুঝবে | সে আসন ত্যাগ করে উঠতেই মাকু তার দিকে মাথা ঘোরালো , এদৃষ্টি মাকুর নয়, এই চাহনি সে ভাল ভাবে চেনে, এই চাহনি তার কথা শুনত , ও জানতে চায় এখন কি করা উচিত চরণ আগুনের দিকে হাত তুলে নির্দেশ করতেই প্রবল এক চিৎকার করে মাকু ওরফে চরণের বৌ সাধুকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করল |

আগুনের উদ্যোত সাপের মতো ফনা এক শয়তান তান্ত্রিককে ভোগ হিসাবে পেয়ে লালসার জিভ দিয়ে চেটেপুটে আত্মসাৎ করছে | মাথার উপরের কালো মেঘটা যেন ধূনি থেকে ওঠা ধোঁয়ার সাথে মিশে সেই ভীষন কালো রাতকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে | সাধুর যম যন্ত্রনার গগনভেদী আর্তনাদ শ্মশানের সব ভয়াবহতা যেন ছাপিয়ে গেল , শ্মশানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নরমুন্ড গুলো যেন হা হা শব্দে প্রানখোলা পৌশাচিক হাসি হাসছে | সেই গুরুগম্ভীর চিৎকারে গ্রামের লোক শ্মশানের সেই বিশেষ জায়গাটা খুঁজে পেল , তারা যতক্ষনে সেখানে পৌঁছালো তখন বেলকাঠের ধূনির অর্ধেক ছায় জমে স্তূপ হয়ে গেছে |

মাকু নিশ্চল হয়ে ড্যাবড্যাবে চোখ নিয়ে তাকিয়ে ছিল আগুনটার দিকে , তার চোখে এখন সেই হিংস্রতা চলে গিয়ে উদাসিনতার ভাব , এতক্ষণে সে বুঝল শত্রু নিধন হয়েছে | এবার সে আস্তে আস্তে টলতে লাগল ,চরণ তাকে জাপটে ধরে বসিয়ে দিল মাটিতে | মেঘটা সরে গিয়ে রাতের তারা ভরা আকাশ দেখা গেল, শ্মশানের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে এল ধীরে ধীরে ,জোনাকি রা জ্বলছে এদিক ওদিক | চরণের মনে হল এত স্বচ্ছ আকাশ সে কখনও দেখেনি | মাকু এবার প্রবল এক ঝাঁকুনি দিয়ে ফের জ্ঞান হারালো |

একটা ছোট্ট নিঃশ্বাসের মতো বায়ু তার মুখ দিয়ে বেড়িয়ে গেল ….সেটা চরণের কান ঘেঁষে যাওয়ার সময় ফিস্ ফিস্ করে কিছু একটা বলতে লাগল | ভাল করে কান পেতে শুনে বুঝল হাওয়াটা খুব নীচু স্বরে তাকে বলছে …..”আমি অাসি ..তুমি ভাল থেক” | পর পর তিনবার সে শুনল এটা , নাঃ কোনো ভুল নেই, স্বর নীচু কিন্তু দারুন স্পষ্ট | মাকুকে খুব ভালবাসত বৌটা তাই মরনের পর ও মেয়েটার ক্ষতি হতে দিল না সে, চোখে জল এল চরণের | কিছুক্ষণ সব চুপচাপ , তার পর হঠাৎ করে একটা দমকা বাতাসে মড়াৎ শব্দ করে শুধু পিপুল গাছের একটা লিকলিকে ডাল ভেঙে পড়ল মাটিতে | ততক্ষণে গ্রামবাসীরা এসে অজ্ঞান মাকুকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে…….

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত