পিসতুতো দাদার বিয়েতে গিয়েছিলাম সেবার ওই আধা মফস্বল আধা গ্রাম জায়গা টিতে।বয়স কম, স্কুলের ছুটি পড়ে গেছে, দাদার বিয়েতে জমিয়ে আনন্দ করা আর গ্রাম বাংলার সুন্দর সবুজ দৃশ্য দু চোখ ভরে নেওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য।বাড়ি ভর্তি লোকজন আসতে আসতে কম হতে থাকলো বৌভাত এর পরদিন থেকে।আমারও ব্যাগ গুছিয়ে যাওয়ার পালা এবার দু দিনের ভরপুর আনন্দ শেষে।এই দুদিন বিয়েবাড়ির মজা ছাড়াও জমিয়ে পুকুরে স্নান করেছি, পুকুরের মাছ খেয়েছি।কাল ই চলে যেতে হবে ভেবে একটু মন খারাপ করে সন্ধ্যেবেলা বসেছিলাম পুকুরঘাট এ গিয়ে একলা।
@দেবমিতা “কি কাল ফিরে যেতে হবে বলে মন খারাপ?” – আচমকা প্রশ্নে ঘুরে পাশে তাকিয়েই দেখলাম নতুন বৌদি কখন চুপিসারে এসে পাশে বসে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।ভারি সুন্দর মুখশ্রী আগে খেয়াল করিনি। অবাক হয়ে বললাম হ্যাঁ,মানে দুটো দিন আসলে খুব ভালো কাটলো আর কি।এরপর বৌদি আমার সঙ্গে বেশ অনেক্ষন গল্প করে গেলো কলকাতায় আমি কোথায় থাকি কি পড়াশুনো করছি এইসব বিষয়ে।আসতে আসতে সন্ধ্যে বাড়ছে, চারপাশে জোনাকির আসা যাওয়া, ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ কিন্তু গ্রাম বাংলা বলে রাস্তায় আলো জ্বলার কোনো ব্যাপার নেই।আর কেনো জানিনা পুকুরের দিক থেকে বয়ে আসা বাতাসে হঠাৎ করে খুব আঁশটে গন্ধ আসতে শুরু করলো।বৌদি কে জিজ্ঞেস করতেই বললো হতেই পারে ইদানিং অনেক মাছ পচেছে তো সেই জন্যই হবে নিশ্চই।যাই হোক আমি এবার বললাম চলো বৌদি এবার উঠি তুমি নতুন বউ এতক্ষন বাড়িতে না দেখলে নিশ্চই সবাই খোঁজা খুঁজি শুরু করে দিয়ে থাকবে।বৌদি কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়াল।
ফিরতে শুরু করলাম বাগান আর উঠোন পেরিয়ে বাড়ির দিকে।স্বল্প চাঁদের আলোয় ঠাহর করলাম বাগানের মধ্যে দিয়ে যে পায়ে চলা পথ টা বানিয়ে নেওয়া হয়েছে তার বাঁদিক বরাবর একটু দূরে পাশাপাশি অনেক গুলো জামরুল গাছ এ থোকা থোকা জামরুল ঝুলে রয়েছে।তখনও আঁশটে গন্ধটা আমাদের সঙ্গ ছাড়েনি। হঠাৎ গলার কাছ টা ভীষণ শুকনো লাগলো আর অদ্ভুত ভাবে ভীষণ ইচ্ছে করলো এক্ষুনি ওই জামরুল গাছ থেকে জামরুল নিয়ে আমাকে খেতেই হবে।কিছুটা যেনো আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই বৌদি বললো, দাঁড়াও এখানে, আমি কয়েকটা জামরুল নিয়ে এখনি আসছি।তারপরের ব্যাপারটা আমি শুধু ওই রাস্তার ধারে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখেই গেলাম।
বৌদি যেনো হাওয়ার বেগে সাঁ সাঁ করে জামরুল গাছ গুলোর দিকে ছুটতে শুরু করলো আর পরিস্কার দেখলাম পেছন থেকে কোনো একটা কিছু মানে একটা আবছা আকারের হাওয়ার ঝাপটা ওকে ঠেলে জামরুল তলায় নিয়ে যাচ্ছে।আমি খুব চেষ্টা করছি বৌদি কে ডাকার কিন্তু গলায় একটুও জোর পাচ্ছিনা।পা দুটোকে টানতে টানতে আমি ওর পেছন পেছন যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকলাম।কতটা হেঁটেছি জানিনা, একসময় দেখি সেই জামরুল তলায় দাঁড়িয়ে আছি আর বৌদি গাছ তলায় মুখ থুবড়ে পড়ে। কাঁধে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ওর দেহ টা আমার দিকে ঘোরাতেই যা দেখেছিলাম এখন লিখতে গিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে।ওর নতুন সবুজ ধনেখালি শাড়ীটার ওপর দিয়ে সোনার গয়না গুলো হাত, গলা আর কান এ যেখানে যেখানে পরানো সেই জায়গা গুলো বিলকুল ফাঁকা।
আর শাড়ি টা যেমন শাড়ির দোকানে ম্যানিকুইন দের গায়ে জড়ানো থাকে তেমন একটা দেহহীন অবয়ব এর ওপর নিভাঁজ করে পরা আছে।চারদিকের আঁশটে গন্ধতে তখন শ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়।সমস্ত সাহস একজায়গায় করে বাগানের পায়ে চলা রাস্তা লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি ছুটতে শুরু করলাম ।জানিনা কোনদিকে পুকুর কোনদিকে বাড়ি সব তখন গুলিয়ে গেছে।একজায়গায় কিছু লোকের ভিড় দেখে বুঝলাম বাড়ির কাছেই এসে পড়েছি।দুর থেকে দেখলাম পিসেমশাই আমার নাম ধরে চিৎকার করতে করতে এদিকেই আসছে।তারপর আর কিচ্ছু মনে নেই। দেবমিতা পরদিন সকালে তৈরি হয়ে বসে আছি কিছুক্ষন পরেই ট্রেন এর টাইম।রাত টা কিভাবে কেটেছে কিচ্ছু জানিনা।পিসির প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা।কালকের ভিড়ের ব্যাপারে জানতে চাইতে জানালো হঠাৎ করে সন্ধ্যেবেলা বৌমা অসুস্থ হয়ে পড়ে।প্রথমে সবাই মৃগী বা ভিরমি জাতীয় কিছু ভেবেছিল কিন্তু ডাক্তার আসার আগেই সে আবার সুস্থ ও হয়ে যায়।ইতিমধ্যে আমাকে ওইভাবে ছুটে আসতে দেখে সবাই আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ।
সব খুলে বলতে পিসে মশাই গম্ভীর মুখে অনেকক্ষণ বসে ছিল।পরে বলল “আসলে বাড়ি ভর্তি লোকজন ছিল বলে আলাদা করে তোকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম সন্ধ্যের পর ওই দিক টা না যাওয়ার জন্য, তার মাঝে এত কিছু দেখে ফেলবি ভাবিনি।জামরুল গাছ আমার বাগানে কোনোকালে ছিলনা। কিন্তু অনেকের মুখেই শুনেছি এই বাগানের পেছনের বেড়া পেরিয়ে কিছু ছায়া ছায়া মূর্তির আনাগোনা প্রত্যক্ষ করেছে সন্ধ্যের পর আর এই দিকটা লোকজন কম ই আসে। বেড়ার ওদিকে কিছু আধ খাওয়া জামরুল ও প্রায়শই পাওয়া গেছে।আমরা এখনো সত্যি জানিনা ব্যাপারটা কি কিন্তু ওই দিক টা সচেতন ভাবে এড়িয়ে চলি সকলেই।”
বৌদি আজ সম্পূর্ণ সুস্থ।দেখা করে এলাম যাওয়ার আগে ,শুধু মনে হলো আমাকে যেনো ঠিক করে চিনতে পারলোনা, নতুন করে পরিচয় দিতে হবে আবার।কথা বাড়ালাম না।বেরিয়ে আসার আগে আলনায় গুছিয়ে রাখা সবুজ ধনেখালির ওপর চোখ পড়ে গেলো বেখেয়ালে কিন্তু আর পেছনে না তাকিয়ে সোজা স্টেশন এর দিকে রওনা দিলাম।