প্রকান্ড একখানা বাড়ি, ভাঙাচোরা, ভগ্নপ্রায়।৷ পাশে বহমান হুগলি নদীর কুলুকুলু ঢেউ ও রাতের অন্ধকারের নীরবতা মিলে তৈরী করেছে বিচিত্র এক পরিবেশ ৷৷ লাল ইট দিয়ে অতি সযত্নে বানানো হয়েছে ভবনটি, যেন প্রাচীন এক জমিদারবাড়ি, রাজকীয় নকশা সম্বলিত৷৷ বাড়ির ছাদের অনেকগুলো মূর্তির মধ্যে একটা মূর্তি রাজকীয়ভাবে আকাশের দিকে হাত তুলে রেখেছে৷৷
ছায়াসুশীতল বৃক্ষসুশোভিত পরিবেশ , দেখেই বোঝা যায় যে বেশ পুরোনো৷৷ অনেক পুরোনো অতীত এখানে গুপ্ত অবস্থায় আছে৷ টর্চের আলোয় চারপাশ ঘুরে ঘুরে অবাক হয়ে দেখেছি ও ভাবছি।৷ কিন্তু দোতলার একটা ঘরে প্রবেশ করতেই এক ভয়াবহ দৃশ্যের সম্মুখীন হলাম৷ অন্য ঘরগুলোর থেকে বেশ আলাদা করে নকশা করা হয়েছে এই ঘরটিকে।৷ বোঝাই যাচ্ছে জলসাঘর এটি৷৷ অপ্রাকৃত এক আলোয় চারপাশ আলোকিত এখানে , মেঝেতে চোখ পড়লো হঠাৎ, এক তরুণী সেখানে পড়ে আছে ছিন্নবস্ত্র পরিহিত অবস্থায়,তার চোখে জল, আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সে।৷
কেন যেন মনে হলো, একে আমি চিনি, কোথায় যেন দেখেছি, অভাবনীয় এক টান, অজানা এক আকর্ষণ কাজ করছে আমার মনের অন্দরে।৷ আমাকে প্রাণপণে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে সে, কিন্তু পারছে না।৷ তার কণ্ঠনালী রক্তাক্ত, আলুথালু কেশবিন্যাস, শরীরে নির্যাতনের ছাপ স্পষ্ট৷৷ মুখমন্ডলের আভা দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে বেশ মার্জিত পরিবারের মেয়ে, পেছনে চোখ পড়লো এবার, সম্ভ্রান্ত পোশাক পরিহিত এক বাবু টাইপের ভদ্রলোক অট্টহাসি হাসছে পিশাচের মত৷৷ কিন্তু এই পরিণতি কেন হলো মেয়েটার???!!!! এত চেনা চেনা লাগছে কেন তাকে???? বুকের মধ্যে যেন ছিড়েখুঁড়ে যাচ্ছে৷৷ আমাকেই বা কি বলতে চাইছে সে??!!!!
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম বিছানায়, সবেমাত্র চোখটা লেগে এসেছিলো,দুঃস্বপ্ন দেখে কাঁচা ঘুমটাই ভেঙে গেলো৷৷
উঠে বসে জল খেয়ে নিলাম ঢোক ঢোক করে৷৷ চোখেমুখে জলের ছিটে দিলাম৷৷ বুক ধড়ফড় করছে৷ উফফ কি ভয়ংকর দুস্বপ্ন!!!! এমনভাবে প্রতিভাত হচ্ছিল যেন বাস্তবেই দেখছি৷৷ মনটা একদমই ভালো নেই ইদানীং । বেশ কিছু দিন ধরেই এই একই দুঃস্বপ্ন দেখে দেখে রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।৷ আজও তার ব্যত্যয় ঘটলো না।৷ অস্বস্তি, বিচলিত বোধ হচ্ছে রীতিমত।৷ বাতাসে জানালার পর্দা উড়ছে।৷ চাঁদের মোলায়েম আলোয় চারপাশ আলোকিত, কিন্তু এখন এই রূপ উপভোগ করার মত মানসিক অবস্থা নেই আমার।৷
দিনের পর দিন স্বপ্নের মধ্যে বারবার আবছা আবছা ভেসে উঠছে দৃশ্যটি, কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমাকে, শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছি।৷ মনে হচ্ছে, যেন সবসময় সাথে সাথে কেউ আছে, অলক্ষ্যে খেয়াল করছে আমাকে৷৷ কিসের এক অব্যক্ত যন্ত্রণা, কষ্টে মন ভার হয়ে আছে। যেন বারবার স্বপ্নে দেখা তরুণীর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মনকে৷৷ কিন্তু, এই স্বপ্নের তাৎপর্য কি???? নাকি স্মৃতির ঝলক আমাকে অতীতের গর্ভে সঞ্চিত কোনো বিশেষ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করছে, যা স্মরণেও নেই আমার!!!!! এ কিসের দুঃখ অনুভব করছি আমি???!!!! সকালে মুখে রোদ পড়তেই ঘুম ভেঙে গেলো।৷ এভাবে আর না৷৷ কিছু একটা করতেই হবে৷
আমি আকাশনীল, একজন প্যারাসাইকোলজিস্ট।৷ অন্ধ্র ইউনির্ভাসিটি থেকে প্যারাসাইকোলজির উপর পড়াশোনা শেষ করেছি আমি। কলকাতাতে ছোটোখাটো একটা চেম্বার খুলে, নিজের ক্যারিয়ার দাড় করানোর চেষ্টা করছি সবেমাত্র।৷ কিন্তু, এ কি বিড়ম্বনায় পড়লাম এবার!!!!! অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি বা Extrasensory perception (ESP) বলতে বোঝায়, মনের বিশেষ ক্ষমতার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহকে। একে অনেক সময় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নামেও অভিহিত করা হয়।৷ প্যারাসাইকোলোজি হল অতীন্দ্রিয় (ইন্দ্রিয়ের অতীত) উপলব্ধি সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক বিদ্যা।
যেখানে জীবের চেতনা, মানুষের মন, অতীত ইতিহাস ও পরিবেশের পারস্পরিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে হিপনোসিস, টেলিপ্যাথি, মনের সাইকিক স্তর, অশরীরী অস্তিত্ব, সিক্সথ সেন্স, নেয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স, জাতিস্মর, পুনর্জন্ম, ডেজাভু, প্রিকোগনিশন,সাইকিক পাওয়ার, টেলিওফিলিয়া এসব গুরুত্বপূর্ণ ও বিচিত্র মনোজাগতিক বিষয়ের উপর আলোকপাত করে গবেষণা করা হয়।৷ আমরা প্যারাসাইকোলজিস্টরা বিশ্বাস করি যে, প্রকৃতি তার অদ্ভুত খেয়াল ও কুহকবলে মানুষের মনোজগত বা মস্তিষ্কে আসন্ন ঘটনার ডিজাইন এঁকে দেয়, বা পূর্বাভাস দেয়৷৷ বিজ্ঞানসম্মতভাবে সেটা জানার চেষ্টা করা ও সেই রহস্য ভেদ করা নিশ্চয়ই সম্ভব৷৷ সাইকোলজির ভাষায়, প্যারাডক্স হচ্ছে সেই বিষয়টা, যেটা আদলে সহজ মনে হলেও ঠিক ততোধিক জটিল৷৷
কিছু কিছু অ্যানোমেলাস এক্সপেরিয়েন্সের সম্মুখীন হয় মানুষ৷৷ এরকম অসংখ্য আনসল্ভড ঘটনা মেডিকেল সায়েন্সের হিস্ট্রিতেই আছে৷৷ আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেউ, কাছাকাছি থেকে অদৃশ্য কেউ লক্ষ্য করছে আমাকে , অনেকসময় শুধুমাত্র মানসিক ভারসাম্যহীনতা বলে কোনোভাবেই দায় এড়ানো যায় না এর, সাইকিক পাওয়ারও হতে পারে এটা, হয়তঃ প্রকৃতি আমাকে আমার ষষ্ঠইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে কোনো ম্যাসেজ দিতে চাইছে৷৷ প্যারাসাইকোলজিস্টরা বিশ্বাস করেন যে, অবচেতন মনে আমাদের মস্তিষ্ক অতীতের প্রতিচ্ছবি বা ভবিষ্যতের আয়না হিসেবে কাজ করে৷ যেটার কোনো সীমাবদ্ধতা বা বাঁধাধরা নিয়ম নেই৷৷
মস্তিষ্কের তরঙ্গপ্রবাহ অবচেতনমনেই আমাদের যেকোনো সময় অতীত, ভবিষ্যতের দৃশ্য কল্পনা বা স্বপ্নে স্পষ্ট দেখাতেই পারে৷ কিন্তু, তাৎক্ষণিকভাবে, নির্দিষ্ট মানুষকেই কেন দেখাচ্ছে, সবাইকে কেন নয়, সেটার আসলেই কোনো উত্তর নেই।৷ কেউ এটাকে বলে, প্রকৃতির বিচিত্র খেয়াল, আর কেউ কেউ বলে বিধাতার ইচ্ছে।৷ কোনো একটি বিশেষ স্থান বারবার স্বপ্নে দেখা,কিংবা এখানেই কিছু অতীতে ঘটে গিয়েছে, এমনটাই বাস্তবের মত অনুভব করা (Intuition) -এই কেসটাকে আমরা বলি ডেজাভু৷৷ হ্যা, যদি পেশেন্টের মস্তিষ্কের ভ্রান্তি, মনের ভুল বা অন্ধবিশ্বাস, অতি সন্দেহ প্রবণ মন বা সবাইকে অনাকাঙ্ক্ষিত শত্রুভাবার মনমানসিকতা থাকে, সেটাকে আমরা প্যারানয়া বা মানসিক সমস্যা বলে থাকি৷৷
এখন বুঝতে হবে, আমার সাথে আসলে কোনটা ঘটছে৷৷ সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।৷ ব্যাপারটা বের করতে হবে, সাইকোকাইনেসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে৷৷ প্রক্রিয়াটি হল, আমার চিন্তাভাবনা ও চারপাশের পরিস্থিতি থেকে সত্যিটা বের করার চেষ্টা করা৷৷ যেহেতু স্বপ্নে জায়গাটাকে পুরোনো পোড়োবাড়ি বলে মনে হয়েছে আমার, বারবার স্বপ্নে আসায় ভবনটির বহিরাংশের গঠনটিও মোটামুটি চোখে ভাসছে, তাই আমাকে প্রথমে চেক করে দেখতে হবে, এ ধরনের কোনো জায়গা পুরোনো কলকাতার আশেপাশে আছে কিনা৷৷ সেক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সাহায্য নেওয়াই যায়।৷
ভালোভাবে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে এরকম একটা বাড়ীর খোঁজ পেয়ে গেলাম৷৷ শোভাবাজারের আহিরীটোলা ঘাটের কাছে একটা বহু পুরোনো বাড়ি আছে, ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা ছবিগুলো দেখে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, বাড়ীটার বহিরাংশ দেখতে অনেকটাই আমার স্বপ্নে দেখা ভগ্নপ্রায় বাড়িটির মতোই৷৷ আশ্চর্য এক মিল বলা চলে ।৷ বাড়িটির নাম পুতুলবাড়ি ৷৷ কিন্তু না।৷ ভবনের বাইরের গঠন দেখে এভাবে হুটহাট সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না, তাই ঠিক করলাম, সেখানে যেতেই হবে আমাকে৷৷ নাহলে মানসিক টানাপোড়েন কিছুতেই যাবে না৷৷ কুমোরতলি থেকে দশ, পনের মিনিট হেঁটে আসার পর , সরু গলির মধ্যে এই বাড়িটির অবস্থান৷৷ অসংখ্য বাড়ির ভিড়ে, এখানে আলো প্রবেশ করে খুবই সামান্য পরিমাণে ।
২২, হরচন্দ্র মল্লিক লেনের এই বাড়ির সামনে এসে যখন পৌছেছি, তখন একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়লো, তাতে লালকালিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির লেখা আছে, এবং নীল কালি’র অক্ষরে গুজব না ছড়ানোর জন্য স্থানীয় জনগণ ও বাড়ির সত্ত্বাধিকারীর পক্ষ থেকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে দর্শনার্থীদের । উত্তর কলকাতার বেশ পুরোনো বাড়ি এটি।৷ ১৮০০ সাল বা তারও আগে নির্মিত হয়েছে “হাউস অব ডলস” নামের এ বাড়িটি । এতটাই পুরোনো যে, শ্যাওলা পড়েছে ভবনের গায়ে৷৷ দেওয়ালে-ছাদে আগাছা জমাট বেঁধেছে৷৷ আশেপাশের ভবনগুলোর নির্মাণশৈলীও চোখে পড়ার মত।৷ পুরোনো কলকাতার প্রাচীনত্ব এবং ইতিহাসের স্বাদ পাওয়া যায় এখানটায় আসলে। শোনা যায়, জমিদার, বিত্তবানদের প্রমোদভবন ছিল এই ভবনটি।৷ জুড়িগাড়ি, পালকি, পানসিতে চড়ে এসে এখানে ভিড় জমাতেন তারা।৷
শীতের বিকেল, আকাশে তখনো সাদা মেঘের ভেলা, ঝুপ করে চোখের পলকে অন্ধকার নেমে আসবে ৷৷ নিচ থেকে চোখে পড়লো বাড়ির ছাদের দিকে অনেকগুলো মূর্তি বসানো , তার মধ্যে একটা মূর্তি হাত তুলে আকাশের দিকে নির্দেশ করছে৷৷ স্বপ্নে যেমনটা দেখেছিলাম, সেটাই আজ বাস্তবে দেখেছি৷৷ কেন যেন, বেশ পরিচিত ঠেকলো বাড়িটি, যেন অতীতের কোনো একসময় বাড়িটি জড়িয়ে আছে আমার স্মৃতি ও আবেগের সাথে !!!!! কিন্তু, সেটাই বা কি করে সম্ভব!!!! আমি তো এদিকটাই জীবনে এই প্রথমবার এসেছি৷৷
পাখিরা দলবেঁধে নেমে আসছে বাড়িটার ছাদে, উড়ে যাচ্ছে আবার।৷ রোমান স্থাপত্যের আদলে তৈরি করা হয়েছে ভবনটি এবং ভবনের ভেতরে অসংখ্য পুতুলের ভাস্কর্য আছে বলে শোনা যায়। দর্শনার্থীদের ভিড় ও ভূতপ্রেতের গুজবে এখানকার স্থানীয় মানুষেরা বেশ বিরক্ত ।৷ যার কারণে, পুরোনো ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে, এখানে কারো প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে৷৷ তবে, পরিচিতসূত্রে অনেক কষ্টে ভেতরে যাওয়ার পারমিশন জোগাড় করেছি আমি৷৷ বাড়ির গৃহকর্তা জানালেন, এখন এই বাড়িতে কাউকেই প্রবেশ করতে দেয়া হয় না, তাকে বাধ্য হয়ে প্রতিশ্রুতি দিতে হলো যে, সর্বোচ্চ এক ঘন্টার মধ্যে সবকিছু ঘুরে দেখা শেষ করে বিদায় নেবো৷৷
জনশ্রুতি আছে যে, পুতুলবাড়ির প্রতিটি ইট অজস্র নারীর অশ্রু, রক্তপাত, বঞ্চনা ও নির্যাতনের সাক্ষী হয়ে আছে।৷
আগেকারদিনে কিছু নিকৃষ্ট বাবু বা জমিদারেরা এ বাড়িতে সুরাপান করে বাইজি নাচ উপভোগ করতেন৷ তারপর, রাতের বেলা বাইজি নারী, কিংবা গরীব পরিবার থেকে লুঠ করে আনা তরুণী ও দাসীদের জোরপূর্বক অকথ্য অত্যাচার,যৌন নির্যাতন করতেন৷ । লালসার শিকার হয়ে যারাই প্রতিবাদ করতে যেত, তাদের সবাইকেই খুন করে হত্যার পর বাড়ির পেছনে লাশ মাটি চাপা দেওয়া হত।৷ পরবর্তীতে সহৃদয় রাজা ও মহৎ মানুষদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় যেকোনো অবস্থাতেই এখানে বাইজিনৃত্য, সুরাপান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।৷ গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয় ভবনটি।৷
বাড়ির প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে চোখে পড়লো, এখনো বাড়ির নিচতলায় মানুষ বসবাস করে, একটা টিউবওয়েলও চোখে পড়লো।৷ শুনেছি এরা এই বাড়ির দীর্ঘদিনের স্বত্বাধিকারী নট্ট পরিবারের সদস্য৷৷ কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকলাম আমি।৷ ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে প্রতিবাদ করছে জীর্ণ সিঁড়িটা ।৷ দোতলায় উঠে খেয়াল করলাম, ভেতরটা আরো ভগ্নপ্রায়৷ এমনিতেও এখানটায় আলো আসে না তেমন একটা, তার উপর বিকেল গড়িয়ে গেছে, বোধ হচ্ছে, ইটগুলো স্পর্শ করলেই যেন ফিরে যাবো পুরোনো দিনে, অতীতে ।৷
সরু, লম্বা এক প্যাসেজ চলে গেছে শেষ পর্যন্ত , গা ছমছমে পরিবেশ সর্বত্র ।৷ টর্চের আলোয় কক্ষগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছি। পুরোনো একটা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ বিরাজ করছে এখানটায়, ধূলিধূসরিত মেঝেতে জুতোর ছাপ বসে যাচ্ছে৷ সম্ভবতঃ খুব কম মানুষেরই পায়ের ছাপ পড়েছে এখানে৷ জিনিসপত্র ঠাসাঠাসি করে রাখা আছে চারপাশে।৷ অ্যান্টিক জিনিসপত্রে ঠাসা, পুরোনো দিনের গ্রিলগুলোতে মরচে পড়ে গেছে৷৷ একের পর এক ঘরে ঢুকে দেখছি, স্বপ্নে দেখা ঘরটিই খুঁজছি আসলে।৷ একদমই ফাঁকা, শূন্য, ময়লা ঘরগুলো।৷ তেমন একটা পরিষ্কার করা হয় না হয়তো।৷ মার্বেলের কারুকাজ আছে প্রায় প্রতিটি ঘরে।৷
ঘুরতে ঘুরতে কোণের একটা ঘরের দিকে চোখ পড়লো।৷ দরজাটা বাইরে থেকে আটকানো৷৷ দরজা খুলে, টর্চের আলোতে ভেতরে প্রবেশ করলাম৷৷ ঘড়িতে সময় দেখলাম, বেশ খানিকটা সময় কেটে গেছে।৷ একঘন্টা পর বিদায় নেওয়ার কথা দিয়ে এসেছি বাড়ীর কর্তাকে।৷ ভেতরে ঢুকতেই মেঝেটা ভীষণ পরিচিত ঠেকলো।৷ স্বপ্নে ঠিক এমনটাই দেখেছিলাম!!!!!!! এ ঘরে আসার পর থেকে যেন অ্যাড্রেনালিন হরমোন ক্ষরণ হওয়া বেড়ে গেছে হঠাৎ করে, উত্তেজনা, ভয় যে যুগপৎ কাজ করছে, নিজেই টের পাচ্ছি তা৷৷ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, কিছু একটা এবার সত্যি সত্যিই ঘটতে চলেছে৷৷ মার্ক টোয়েনের কথাটি মনে পড়ে গেলো, “Truth is stranger than fiction.”
অপূর্ব কারুকাজ করা ঘরের মেঝেটায় ৷৷ বেশ চেনা চেনা ঠেকছে ।৷ অন্যান্য ঘর থেকে একদমই আলাদা নকশা করা এ ঘরটিতে । যদিও মাকড়সার জাল ও ধূলোবালিতে চারপাশে ময়লা আস্তরণ পড়ে গেছে।৷ তবে, এটাই কি জলসাঘর বা নাচঘর???? যেখানে বাইজি’নৃত্য হতো!!!!! একটা বিরাটাকারের পুরোনো আয়না কক্ষটিকে অতিলৌকিক করে তুলেছে।৷ কোণে কোণে অসংখ্য পুতুলের ভাস্কর্য, বইপত্র, পুরোনো যুগের রাজকীয় তৈজসপত্র, কার্পেট, এবং ঘুঙুর রাখা আছে৷৷ অনেক বছরের পুরোনো বিরল, দুষ্প্রাপ্য কিছু পত্রিকা রাখা আছে মাটিতে৷৷ তাতে রয়েছে অনেক পুরোনো খবর৷৷
অবাক হলাম কিছুটা।৷ পুতুলগুলোকে অদ্ভুতভাবে জীবন্ত মনে হচ্ছে। শোনা যায় যে, পুতুলের ভাস্কর্যগুলো নাকি আগেকার এক জমিদারের মেয়ের জন্য শখ করে আনা হয়েছিলো।৷ যদিও মেয়েটা পরবর্তীতে আত্মহত্যা করে৷৷ হঠাৎ করেই মাথাটা বোঁ করে ঘুরে উঠলো৷৷ অনেক কষ্টে মাটিতে বসে পড়লাম৷৷ মানসপটে আবার দুঃস্বপ্নের সেই তরুণীর মুখ ভেসে উঠলো৷৷ তার চোখগুলো যেন জ্বলজ্বল করে উঠলো এবার।৷ পার্থক্য হচ্ছে, এতদিন শুধু রাতে ঘুমের ভেতর দুঃস্বপ্নে দেখেছি তার মুখখানা, আর এখন দিব্যি দিনের বেলা জেগে জেগে তাকে স্বপ্নে দেখছি!!!!! তাহলে কি এই ঘরের সাথেই তার সব স্মৃতি জড়িয়ে আছে???!!!!!
পদশব্দ কানে এলো, কিন্তু পেছনে ফিরে, টর্চের আলো ফেলে কাউকে চোখে পড়লো না৷৷ চোখের সামনে কয়েকটা পুতুলের ভাস্কর্য নিজে থেকেই উল্টে পড়ে গেলো ৷৷ দিব্যি তো সাজিয়ে রাখা ছিলো সেগুলো৷৷ নারীকণ্ঠের আর্তনাদ কানে এলো এবার।৷ অবাক লাগলো।৷ কক্ষটিতে আমি ছাড়া আর কেউই নেই, বাতাসেরও অস্তিত্ব নেই এখানে৷৷ বুক কেঁপে উঠলো৷৷ গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো হঠাৎ করে ।৷ শিরদাঁড়া বেঁয়ে ভয়ের শীতল স্রোত নেমে গেলো৷৷
হাত নাড়াতেই হঠাৎ করে একজোড়া ঘুঙুর হাতে ঠেকলো।৷ স্পর্শ করতেই যেন শক খেলাম ।৷ চারপাশ যেন হঠাৎ করে দুলে উঠলো, শরীর টলমল করে উঠলো।৷ যেন অতলে তলিয়ে যাচ্ছি আমি।৷ ঘুঙুরের ধ্বনি শুনতে পেলাম৷ একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি৷৷ দুঃস্বপ্নে অনুভূত হওয়া যন্ত্রণা, পীড়া, দুঃখের অনুভূতি আবার ফিরে ফিরে আসছে ।৷ কয়েকফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চোখ বেয়ে৷৷ মনে পড়ে গেলো সব।৷ দিব্যচোখে সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পেলাম এবার৷৷ চোখের সামনে সাঁই সাঁই করে কিছু দৃশ্য পরপর ভেসে উঠলো ।৷ নিজেকে আবিষ্কার করলাম শোভাবাজারের আহিরিটোলা ঘাটে, হুগলি নদীর তীরে, প্রহরীর পোশাক পরিহিত আমি , বুঝতে পারলাম যে, পুতুলবাড়ির দ্বাররক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ৷৷
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়, অস্তগামী সূর্যের শেষ আলোতে বসে আছি এক শুচিস্মিতা তরুণীর কোমল হাত নিজের হাতে রেখে৷৷ লম্বা নাক তার, হাস্যোজ্জল মুখশ্রী ।৷ ঠিক স্বপ্নে যেমনটা দেখেছি এতদিন ধরে৷৷ বেশ সুন্দর করে সেজেগুজে এসেছে সে, পায়ে ঘুঙুর শোভা পাচ্ছে৷৷ হুগলি নদীর শীতল, নির্মল বাতাসে তার মোহনীয় চুলগুলো বারবার আমার চোখেমুখে এসে পড়ছে৷৷ মিষ্টি গন্ধে মনকে মাতাল করে তুলছে মনকে৷৷ বারবার তাকে অনুরোধ করছি, পুতুলবাড়ির জলসার আসরে না যেতে, বাইজি’নৃত্য বাদ দিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে৷৷ কারণ, আমি জানি যে আমাদের জমিদারবাবু লোকটিকে দেখতে মোটেও সুবিধার মনে হয় না ৷৷
কিন্তু প্রিয়তমা আমাকে বললো যে, আজকে সে শেষবারের মতো নাচবে, নাহলে তার মায়ের চিকিৎসার খরচ কোথা থেকে আসবে ৷৷ জমিদারবাবু বলেছে, আজকে বিরাট অঙ্কের এনাম দেবে তাকে৷৷ তাছাড়া জমিদারবাবু তার পিতৃতুল্য৷৷ কথা দিয়ে ফেলেছে সে৷৷ কিন্তু তাকে যেতে দিতে মন মানছে না আমার ৷৷ অস্বাভাবিক কু ডাকছে মনে।৷ তারপরও যেতে দিলাম৷৷ অর্থাভাবে কি আর করার থাকতে পারে!!! আজকে শেষবারের মতোই তো৷৷ তাছাড়া অর্থের খুবই প্রয়োজন তার।৷ আমি নিজেও স্বল্প বেতনে অর্থসংকটে ভুগছি এখন৷৷ কবি সুকান্তের ভাষায়, “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি ॥” বিদায় দেওয়ার আগে, প্রিয়তমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম৷৷ কপালে চুমু এঁকে দিলাম।৷ কেন যেন মনটা ভীষণ বিচলিত হয়ে আছে৷৷
এরপর আসলো সেই কালরাত্রি ।৷ বাইজি নাচ শেষে পিতৃতুল্য জমিদারের লোলুপ দৃষ্টি ও গোপন ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা পেলো না সে।৷ তার সম্ভ্রম, সম্মান সব ভেঙেচুরে একশেষ হয়ে গেলো৷৷ বাকী দ্বার’রক্ষক দের কাছ থেকে খবর পেয়ে যতক্ষণে আমি সেখানে পৌছেছি, ততক্ষণে সবকিছু শেষ৷৷ আমার প্রিয়তমাকে ছুরিকাঘাত করে, রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে ফেলে রাখা হয়েছে৷৷ আমার দিকে শেষবারের মত হাত বাড়িয়ে কথা বলার বৃথা চেষ্টা করে নিশ্চুপ হয়ে গেলো সে৷৷ আর পেছনে দাঁড়িয়ে এখনো অট্টহাসি হাসছে সেই লম্পট পিশাচটা৷৷
গগনবিদারী চিৎকার করে জমিদারবাবুকে আক্রমণ করলাম, ঘুষি বাগিয়ে নাক ফাটিয়ে দিলাম , কিন্তু তার আদেশে তার স্যাঙ্গাতরা আমাকে জাপটে ধরে , বুকে ছুরি গেঁথে দিলো৷৷ ভীষণ যন্ত্রণায় তড়পাতে তড়পাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লাম আমি।৷ যেভাবে শুরু হয়েছিলো, ঠিক সেভাবেই দৃশ্যগুলো চোখের সামনে থেকে আবার পর্দার মত অদৃশ্য হয়ে গেলো।৷ স্বজ্ঞানে ফিরে আসলাম আবার৷৷ পরক্ষণেই অলৌকিক এক আভায় কক্ষটি ভেসে গেলো।৷ তীব্র আলোকপুঞ্জে এখন চোখ খোলা দায়৷৷ তার সাথে টর্চের আলো মিলে অশরীরী, ভৌতিক এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে৷৷
ঘুঙুরের শব্দ আবার কানে এলো৷৷ মিষ্টি গন্ধটি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে গেছে৷৷ আমার বেশ পরিচিত সেটা৷৷ চোখে পড়লো, আমার হাত ধরেছে এক রহস্যময়ী সাদাটে নারী অবয়ব, যার শরীর থেকে আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হচ্ছে৷ যার মুখখানা আমি এতদিন বারবার স্বপ্নেই দেখে গেছি , আজ তাকে পুতুলবাড়ির জলসাঘরে স্বচক্ষে দেখছি ৷৷ ফিসফিস করে, কান্নাজড়িত কণ্ঠে সেই অবয়বটি বললো, “এ জন্মে তোমার সাথে শেষবারের মত দেখা করার জন্যই এতদিন এখানে আঁটকে ছিলাম আমি৷৷ আজ তোমার আগমনে আমার মনের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ হলো, তৃপ্ত হয়ে মুক্তি পেয়ে গেলাম।৷ ভালো থেকো, প্রিয়তম।৷ বিদায়।৷ ” চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে, আলোকরশ্মিটি আবার বিলীন হয়ে গেলো।৷
টলতে টলতে অতিকষ্টে উঠে দাঁড়ালাম ৷৷ ততক্ষণে আলোকপুঞ্জ অদৃশ্য হয়ে গেছে৷৷ কক্ষের পুরোনো অন্ধকার ও ধূলিধূসরিত পরিবেশ আবার ফিরে এসেছে৷৷ সবকিছুই এখন স্বাভাবিক৷৷ এখন এখানে আছি আমি, এবং নিদারুণ শূন্যতা৷৷ আর কিচ্ছু নেই৷৷ টর্চের আলোতে ঘড়ি দেখে বুঝলাম, একঘন্টা পেরিয়ে গেছে, ফিরতে হবে এবার৷৷ নিচে নেমে বাড়ীর কর্তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম৷৷ আমার অভীষ্ট লক্ষ্য , অসমাপ্ত কাজ আজ সমাপ্ত হয়ে গেলো।৷
এখন হালকা লাগছে কিছুটা, যেন মনের উপর থেকে বিশাল একটা বোঝা নেমে গেলো৷৷ মুক্তি দিয়ে দিয়েছি আমার প্রিয়তমাকে।৷ চলে গেছে সে চিরশান্তির দেশে, করুণাময়ের নিবিড় ক্রোড়ে৷৷ শান্তিতে থাকুক সে, এই প্রার্থনাই করি৷৷
আমাদের জীবন প্রতিনিয়তই চলছে তার নিজের স্রোতে, জন্মান্তরের ছোঁয়ায় মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে কত স্মৃতি যে সঞ্চিত আছে, আমরা তার কতোটুকুই বা খবর রাখি।৷ সব স্মৃতি ছাপিয়ে প্রিয় মুখ তো একদিন না একদিন ভেসে উঠবেই৷৷ এটাই হয়তো অদৃশ্য বিধাতার লীলা বা প্রকৃতির খেলা।৷ শেষবারের মত পুতুলবাড়ির দিকে তাকিয়ে, পা চালালাম৷৷ অশ্রুর বন্যা এবার আর বাঁধ মানলো না।৷ দূর থেকে কানে ভেসে এলো রবি ঠাকুরের গান “মনে রবে কি না রবে আমারে সে আমার মনে নাই, মনে নাই। ক্ষণে ক্ষণে আসি তব দুয়ারে, অকারণে গান গাই॥”