রেশমি আর ঋষভ,দুই ভাই বোন।দুজনের মধ্যে অসাধারণ ভাব,একে অপরের অবর্তমানে কিছুতেই থাকতে পারেনা,একেবারে হরিহর আত্মা।দুজনেই কলকাতার একটা নামকরা বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশুনা করে।দুজনেই যথেষ্ট মেধাবী লেখাপড়ায়।মেধাবী হলে কি হবে, দুজনে ভারী দুরন্ত স্বভাবের!দুস্টুমিতে তাদের জুড়ি মেলা ভার,অনেক নজির গড়েছে দুজনে ইতিমধ্যেই।কতরকমের ফন্দিফিকির এঁটে দুজনে মিলে সর্বক্ষণ মা-বাবা কে জ্বালাতন করে মারে, বা-মাও তাদের দুরন্ত সন্তানদের নানারকমের দুস্টুমির ছোটখাটো শাস্তি দিতে দিতেও নাজেহাল হয়ে পড়েছেন,একটা সময়ের পর হাল ছেড়েও দিয়েছেন।বয়সে ছোট বলে দুই পুচকে শয়তান বেশিরভাগ সময়তেই বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।যতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে ততক্ষণই বাড়ি ঠাণ্ডা থাকে,বাকি সময়টুকু এই দুই পুচকেই বাড়িখানা একেবারে মাথায় করে রাখে,এভাবেই দিন কাটে পাল পরিবারের।
একদিন দুপুরবেলায় স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসে ঋষভ প্রথমেই বোনের সাথে দেখা করতে গেল। রেশমিকে জানালো,যে সে নাকি আজ স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে এক নতুন বিষয়ে আলোচনা করেছে।সেদিন রেশমির, ঠান্ডা ice cream খেয়ে জ্বর বাধানোর কারণে তাদের মা বাধ্য হয়েই রেশমি কে স্কুলে পাঠায়নি।তাই রেশমি সারাদিন নিজের ঘরের খাটে শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল।দাদাভাই এর থেকে এরকম একটা নতুন জিনিস শোনবার জন্য সে আগ্রহ প্রকাশ করল।ঋষভ বললো যে তার বন্ধুরা আজ তাকে নাকি ব্লাডি মেরি র সম্বন্ধে জানিয়েছে।স্কুলে যখন জিরো পিরিয়ড চলছিল তখন নাকি তার বন্ধুরা তাকে এই বিভৎসরূপী রাক্ষসীর সম্বন্ধে জানিয়েছে।রেশমি কথার মাঝেই দাদাকে প্রশ্ন করলো,”কে এই bloody Mary,দাদাভাই?
“ঋষভ বোনের করা এই প্রশ্নের উত্তরে বললো যে সে সেই রাক্ষসীর কথা বিশেষ কিছু জানে না তবে যেটুকু বন্ধুদের থেকে শুনেছে তা হলো তার নাম অর্থাৎ Bloody Maryর অভিশপ্ত নাম যদি কোনো ব্যক্তি মাঝরাতে, যেমন তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তিনবার উচ্চারণ করে,তাহলে সেই ব্যক্তি দেখতে পাবে যে দর্পনের কাঁচ ধীরে ধীরে ঘোলাটে হয়ে ফুটে উঠছে এক ভয়ংকর রাক্ষসীর মুখমন্ডল,বন্ধুরা বলেছে সেই মুখমন্ডল নাকি bloody maryর!যেকোনো দর্পনই নাকি মৃত জগতের সাথে জীব জগতের মধ্যেকার সংযোগস্থল অর্থাৎ portal হিসেবে কাজ করে আর বন্ধুরা বলছিল Bloody Mary র নাম ধরে ডাকলে সে নাকি এই portal এর সাহায্যেই বর্তমান দুনিয়াতে ফেরত আসেন,ওই রাক্ষসী নাকি অপরিসীম অশুভ ক্ষমতার অধিকারিণী।”
“জানিস বোন আমাকে না ওরা খুব খেপাচ্ছিলো!বলছিল আমি নাকি ভীতুর ডিম তাই আমার নাকি সেই রাক্ষসীকে ডাকার ক্ষমতা নেই…,খুব রেগে গিয়ে জানিস আমিও ওদের চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করে নিয়ে বলে দিয়েছি যে আমি আজ রাতেই সেই রাক্ষসীকে এই পদ্ধতিতে ডাকবার চেষ্টা করবো,আর সেইসাথে পুরো ঘটনাটা ভিডিও করে তোদের দেখাবো,তখন তোদের বিশ্বাস হবে,যে আমি ভীতু না তোরা!তবে আমিও ওদের শেষে বলে দিয়েছি,যে আমার পাপা বলেছে ওসব ghost,spirits, witches সিনেমাতেই হয়,বাস্তবে নয়,ওরা কত বোকা তাই নারে বোন?” রেশমি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল,”একদম ঠিক বলেছিস দাদা, চলো আজ রাতেই এটা করে দেখি!পাপা-মাম্মা যখন রাতে শুয়ে পড়বে তখন আমরা চুপি চুপি বাথরুমে গিয়ে এটা করে দেখবো।” ঋষভ ও বোনের প্রস্তাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
সেদিন রাত্রিবেলায় আনুমানিক তিনটে-ফিনটে নাগাদ আলার্মের আওয়াজে দুজনের ঘুম ভাঙল,রেশমি ফিসফিসিয়ে ঋষভ কে বলল,”দাদা চল,তিনটে বাজে,সময় হয়ে গেছে।” ঋষভ বোনের কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়লো।দুজনেই তারপর যে যার খাট থেকে আস্তে আস্তে মাটিতে পা রেখে নামলো যাতে পাশের ঘরে ঘুমিয়ে থাকা তাদের মা-বাবা বিন্দুবিসর্গ কিছু টের না পায়।তারপর ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে দুজনে আলতো করে বাথরুমের দরজার লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো।ঋষভ একটা সুইচ টিপে বাথরুমের আলোকবাতিটা জ্বালাল।
তারা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে,তাদের সম্মুখের দেয়ালেই টাঙানো রয়েছে তাদের বিশাল বেলজিয়াম গ্লাসের তৈরি দর্পন!আগের বছর তাদের বাবা চাকরিসূত্রে বিদেশ গিয়েছিলেন,সেখানের এক জাদুঘর থেকেই এটা সংগ্রহ করে এনেছিলেন!বেশ পুরোনো আমলের আয়না সেটি,জায়গায় জায়গায় রং চোটে গিয়েছে,তবে দেখলে বেশ বোঝা যায় এককালে বেশ শৌখিন ছিল এটি,কোনো আভিজাত্য পরিবার এর মালিক ছিল।এই আয়নাতে শুধু মানবদেহের মুখটাই দেখা সম্ভব ,শরীরের বাকিটুকু আর এই আয়নায় দেখা যায় না! তা সে যাই হোক গে,সেই দর্পনের সামনেই এখন দুজনে দাঁড়িয়ে!ঋষভ দর্পনের দিকে তাকিয়ে থেকে রেশমিকে উদ্দেশ্য করে বললো,”কিরে বোন,ক্যামেরাটা এনেছিস তো?” পাশ থেকে রেশমি বলে উঠলো,”হ্যাঁ দাদা,এনেছি।”
“তাহলে ক্যামেরাতে ভিডিও রেকর্ডিং স্টার্ট কর!”তারপর কিছুক্ষন অপেক্ষা করে আবার বললো,
“স্টার্ট করেছিস তো বোন?”
“হ্যাঁ দাদা করেছি!”
“তাহলে চল,একসঙ্গে বলবো,বুঝলি?”
“হম্ম…”
“ওয়ান,টু, থ্রি…স্টার্ট…” দুজনে সমস্বরে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো-
“Bloody Mary”
“Bloody Mary”
“Bloody Mary”
তারপর বেশ কিছুক্ষণ আয়নার সামনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো দুজনে,হয়তো দর্পনের কাঁচের স্বচ্ছতায় কিছু পরিবর্তন হচ্ছে কিনা খুব মন দিয়ে লক্ষ্য করছিল। আয়নাতে কিছুই হচ্ছে না দেখে ঋষভ পাশ ফিরে রেশমিকে বললো,”দেখলি তো বোন,বলেছিলাম না,এসব কিছুই হয়না,ওই গরুগুলো মিছি মিছি ধপ দিয়ে আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিল,দাঁড়া,কালকে ওদের ভিডিওটা দেখাই তাহলেই ওরা টের পাবে কে বা কারা আসলে ভয় পায়!” রেশমি দাদার কথা শুনে মিটি মিটি হাসছিল,হটাৎ ঋষভ লক্ষ্য করলো ভিডিও করতে করতে ক্যামেরায় কিছু একটা দেখতে পেয়ে রেশমির হাসি মুখেই মিলিয়ে গেছে, তার মুখের ভাব সমস্ত একেবারে পাল্টে গেছে,যেন কিছু একটা অস্বাভাবিক দেখে,খুব ভয় পেয়েছে সে! ঋষভ রেশমিকে প্রশ্ন করলো,”তোর কি হয়েছে বোন?এমন করছিস কেন?শরীর খারাপ করছে?” রেশমি প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় জবাব দিলো,”আয়নাতে ওটা কে,দাদাভাই!”
রেশমির কথা শেষ হতে হতেই এক তীক্ষ্ণ,পিলে চমকে দেয়ার মতন ভয়ঙ্কর মেয়েলি কন্ঠস্বর নির্গত হলো আয়না থেকে,”Why did you called me back…..From Hell…?” প্রচন্ড ভয় পাওয়ার কারণে রেশমির হাত থেকে ক্যামেরাটা মাটিতে পড়ে গেল!ঋষভ আয়নার দিকে তাকিয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের বাথরুমের আলোটা দু-তিন বার দপ দপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেল,পেছন থেকে আপনা হতেই বাথরুমের দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।রেশমি ভয়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে,ঋষভ ও তারস্বরে সাহায্যের জন্য সমানে চেঁচিয়ে চলেছে,কিন্তু এই অন্ধকার মৃত্যুপুরীর ভেতর থেকে তাদের চিৎকার চেঁচামেচি কেউ শুনতে পেলোনা।
হটাৎ ঋষভ আর রেশমির দুজনেরই মনে হল,অন্ধকারের মধ্যে থেকে দুটো বিশাল ধারালো নখযুক্ত হাত এসে তাদের গলার টুঁটি চেপে ধরেছে,তারপর বেশ কিছুক্ষণ মরণ যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতেই সব শেষ। বাথরুমের দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পেয়ে ঋষভ আর রেশমির মায়ের ঘুম ভেঙে গেল।পাশে ঘুমিয়ে থাকা স্বামীকে ডেকে বললো,”ওই যে শুনতে পাচ্ছ,বিচ্ছুগুলো আবার মনে হয় এই এত রাত্তিরে না ঘুমিয়ে বাথরুমে ঢুকে কি জানি আবার কি নতুন শয়তানি করছে,চিন্তা হচ্ছে বড়,চোট-আঘাত পেলে কি হবে বলো তো?” ঋষভ-রেশমির বাবা নিদ্রাছন্ন অবস্থায় জড়ানো গলায় বলল,”বেশি চিন্তা করো না তো তুমি,শুয়ে পড়,ওরা ছেলেমানুষ,ওদের দুস্টুমি করতে দাও,শেষে ক্লান্ত হয়ে এমনিতেই ঘুমিয়ে পড়বে!”
সমাপ্ত