ট্রেনের দরজার বাইরে টাঙ্গানো লিস্টে নিজের নামটা চেক করে উঠে পড়লাম। থ্রি এ.সি র এগারো নম্বর সীট। গিয়ে প্রথমেই হাতের ট্রলি ব্যাগটা সীটের নিচে চালান দিলাম। তারপর বসে আশেপাশের সহযাত্রীদের উপর চোখ বুলালাম। এক বয়স্ক স্বামী স্ত্রী আমার সামনে। তার পাশে জানলার দিকে একটি অল্প বয়সী মেয়ে। এই স্বামী স্ত্রীর মেয়ে কিনা বোঝা গেল না। আমার পাশে একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক আর তার পাশে, জানলার ধারে একজন যুবক। এই শেষের দুইজন বাঙালি বোধহয় নয়। কারণ এই পাশের লোকটির কপালে মেটে সিঁদুরের টিকা আছে, যা সচরাচর অবাঙালিদের থাকে। আর তার পাশের ছেলেটি তো বিদেশী হলেও আশ্চর্য হবো না। সাদা ধবধবে ফর্সা গায়ের রং, ক্যাজুয়াল জীন্স আর টি শার্ট পরনে, কানে হেডফোনে গান শুনছে নিজের মনে।
ট্রেন ছাড়ল। আমি হ্যান্ডব্যাগ থেকে সেক্সপিয়ারের ‘Julius Caesar’ বের করে পড়া শুরু করলাম। আমার সামনের দম্পতি তাদের পাশে বসা মেয়েটির সাথে গল্প শুরু করেছে। তাদের কয়েকটা কথা কানে আসতেই বুঝলাম যে মেয়েটি তাদের কন্যা নয়। মেয়েটি যাচ্ছে তার কলেজে। আর এই দম্পতি যাচ্ছে তীর্থে। পড়ার ফাঁকে লক্ষ করলাম যে জানলার পাশে বসা ছেলেটি আমার বইটির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে মৃদু হাসল নিজের মনেই যেন। এদিকে ততক্ষনে আমার পাশের ভদ্রলোকটিও হিন্দী টান ওয়ালা বাংলা ভাষাতেই কথা শুরু করেছে দম্পতির সাথে। সত্যি বলতে আমার পড়তে বেশ ডিস্টার্ব হচ্ছে এইবার। তাই শেষমেষ বইটা নামিয়েই রাখলাম। এখন আমার পাশের লোকটি টয়লেট গিয়েছেন। তাই আমার আর জানলার পাশের ছেলেটির মাঝে ফাঁকা। ছেলেটি আমার বইয়ের উপরে সিজারের মূর্তির ছবিটির দিকে চেয়ে আছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে মৃদু হেসে উঠলো। পরিষ্কার বাংলায় বললঃ
– এই যে সিজারের যে মূর্তি বা সিনেমাতে তাকে দেখে অভ্যস্ত। মাথায় ঘন চুল তার দেখানো হয়। এটা একদম মিথ্যে। তার মাথায় ছিল হালকা টাক।
– তাই নাকি?? প্রশ্ন করলাম আমি। উত্তর দিলো ছেলেটি,
– আজ্ঞে হ্যাঁ। সেই সময়ের মূর্তিকাররা সম্রাট কে সুন্দর দেখতে বানিয়েছিলেন তারই নির্দেশে।
– বাহ। জানতাম না। তো আপনি কি ইতিহাসের ছাত্র। আবার মৃদু হেসে ছেলেটি বললঃ
– ছাত্র তো বটেই। তবে ইতিহাসের নয়। বিজ্ঞানের। ইতিহাসের আমি যাত্রী।
– কি??
– কিছু না। হ্যালো, আমি রুবেল।
– আমি অভি। দুজনে করমর্দন করলাম। আমিই জিজ্ঞেস করলাম,
– আপনি বাঙালি??
– হেহে। তা বলতে পারেন। আপনি কি ডাক্তার??
– আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কি করে….
– ট্রেনের বাইরে লিস্টে নাম দেখে।
– ওহহ। আর আপনি??
– আমি?? আমি একজন যাত্রী। টুরিস্ট বলতে পারেন।
এর মধ্যে আমার পাশের ভদ্রলোক ফিরে এসেছেন। উনি চপ্পল পরে গিয়েছিলেন। এসে নিজের জুতো খুঁজছিলেন। তখনই রুবেল নামের ছেলেটি জুতোটা দেখিয়ে বললঃ
– আংকে ইরুক্কিরাটু। (ওই যে ওইখানে) শুনে লোকটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– নি পেকুকিরায়?? (তুমি তামিল বলতে পারো??) উত্তরে ছেলেটি মিষ্টি করে হাসল মৃদু। এইবার আমার সামনে বসা বৃদ্ধা বললঃ
– বাহ। তুমি তো দেখছি অনেক ভাষা জানো।
– হ্যাঁ। আসলে আমার কাজের ক্ষেত্রে জানতে হয়।
– কি কাজ তোমার? উত্তরে ছেলেটি একটু ইতস্তত করতে লাগল। আমি বললাম,
-আহা… বলতে না চাইলে বলবেন না। তবে আমার কিন্ত মশাই আপনাকে স্পাই বলে সন্দেহ হচ্ছে। গুপ্তচররা শুনেছি অনেক ভাষা জানে। হেহে।
– হাহা। না না। মোটেই নয়। আমার কাজের বিষয় আপনাদের বলতে আমার আপত্তি নেই মোটেই। কিন্তু কি জানেন… আপনারাই বিশ্বাস করবেন না। আমায় উন্মাদ ঠাউরাবেন।
– বলেই দেখুন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমাদের সবার মুখের দিকে একবার দেখলো রুবেল। একটা শ্বাস টেনে বললঃ
– আমি একজন টাইম ট্রাভেলার। আমি আর সামনের মেয়েটি একসাথে বলে উঠলাম,
– কি?? কি বললেন?
– আমি একজন সময় অভিযাত্রী। রেকর্ড কিপার। আন্তর্জাতিক ‘ওয়ার্ল্ড – গর্মেন্ট’ থেকে আমাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, বিশ্বের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সমস্ত বিশেষ ঘটনার রেকর্ড বানাতে।
– আপনি মশাই মজা করছেন না পতঞ্জলি গাঁঞ্জা টেনেছেন।
– হাহাহা। আপনারা বিশ্বাস করবেন না বলেই আপনাদের এত সহজে কথাগুলো বলে দিলাম। দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোকও বললো,
– আপনি যা বলছেন তার প্রমাণ দিতে পারেন?
– পারি। কিন্তু দেবো না।
– তাহলে এইসব বললেন কেন?
– আমি মিথ্যে বলা পছন্দ করিনা। তাই।
– তাই বলে এত বড় ঢপ?
এই কথাটি মেয়েটা বললো। শুনে বেশ বুঝলাম রুবেল নামক লোকটির একটু রাগ হল। তবুও কোনও উত্তর না দিয়ে আবার কানে হেডফোন লাগিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। কিন্তু ততক্ষণে আমার এবং বাকি যাত্রীদের মনে একটা উসখুসানি ঢুকে গিয়েছে। একটু বাদেই আবার কথা তুললাম আমিই।
– আপনি সত্যি করে বলবেন কি? এরম একটা অদ্ভূত মজা কেন করলেন। রুবেল আবার কানের থেকে ইয়ার ফোন খুলে আমার দিকে তাকালো। বললঃ
– সিজারের হত্যা আমি নিজের চোখে দেখেছি। আর শেক্সপিয়ারের এই প্লে লেখার সময়ও আমি তার সাথেই ছিলাম।
– প্রমাণ দিন! নাহলে আপনাকে মিথ্যাবাদী ছাড়া কিছুই আর ভাবতে পারছি না।
– বেশ ডক্টর। আপনি এই বই থেকে যে কোনও জায়গা পড়া শুরু করুন। আমার শেক্সপিয়ারের বেশিরভাগ প্লেই মুখস্ত। কারণ সেগুলি আমার সামনে লেখা… আমি বহুবার দেখেছি। Julius Ceasar খুলে আমি পড়তে শুরু করলাম,
– Friends, romans, and countrymen. Lend me your ears. I came এই অবধি বলতেই পরের থেকে রুবেল শুরু করলো,
– I came here to bury Ceaser, and not to praise him. The evils that men do lives after them, while the good is oft intrrtd with the bones. Let it be so with Caesar. আমি বিস্ময়ের সাথে চেয়ে রইলাম ছেলেটির দিকে। আমার সামনে বসা বৃদ্ধ বললঃ
– এতে কিছু প্রমাণ হয় না। হতেই পারে এই বইটি তোমার জানা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রুবেল বললঃ
– আমি সত্যিই আপনাদের এইসব বলে আমাদের সংস্থার নিয়ম ভাঙছি। কিন্তু কেন জানিনা আজ বলতে ইচ্ছে করছে সব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললঃ
– আপনারা যে কেউ মোবাইলে টাইম ট্রাভেলার ফটোস গুগল সার্চ করে দেখুন।
আমি এবং বাকিরা সাথে সাথে সার্চ করলাম। বেশ কয়েকটি সাদা কালো ছবি বেরোয়। তার ভেতর একটি ছবিতে আমার চোখ আটকে যায়। প্রায় একইসাথে আমার পাশের অবাঙালি ভদ্রলোকের মুখ থেকে কথাটা বেরল,
– ও মাই গড!!!
একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে একদল হ্যাট- কোট পরিহিত লোকজন। লোকগুলোর পোশাক আর আশপাশের দৃশ্য দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এরা পুরোনো ভিক্টোরিয়ান আমলের ছবি। কিন্তু তাদের মাঝেই একটি অল্প বয়সী ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। তার পোশাক সম্পূর্ণ এখনকার সমসাময়িক এবং বাকিদের থেকে বেমানান। টি শার্ট আর স্বেট শার্ট পরিহিত, চোখে রোদ চশমা, পয়েন্টেড মুখ। এটা রুবেল!! আমরা প্রত্যেকে তার দিকে তাকালাম। এখন কারুর চোখেই আর অবিশ্বাস নেই। আছে বিস্ময়। রুবেল হালকা হেসে বললো,
– এটা ১৯৪০ সালে দক্ষিণ ফর্ক ব্রিজ এর রিওপেনিং এর ছবি। দেশটা সেই সময়ের ব্রিটিশ কল্মবিয়া। আমরা গোপনে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু মাঝে মাঝে ধরা পড়ে যাই অসাবধানতার ফলে। আমারও এই একবারই হয়েছিলো।
– কিন্তু… কিন্তু…
– হ্যাঁ।
জানি এটা অসম্ভব ঠেকছে আপনাদের কাছে। কিন্তু এটাই সত্যি। আমরা সর্বসাকুল্যে এরকম বারোজন ‘রেকর্ড কিপার’ আছি। প্রত্যেকেই কখনো না কখনো ছবিতে ধরা পড়েছে। আমাদের কাজ শুধু বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করা, আর তার সঠিক বর্ণনা লিখে রেকর্ড করা। কোনও ঘটনা আমরা ঘটাই না, কোনো ঘটনায় বাঁধা দেই না। শুধু প্রত্যক্ষ করি। ক্ষমা করবেন এর বেশি আমি আর বলতে পারব না। অলরেডি অনেক বেশি বলে ফেলেছি আমি।
এরপর বলা বাহুল্য যে আমরা পুরো দিন তার থেকেই অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতা শুনলাম। প্রচণ্ড নিখুঁত সমস্ত বর্ণনা। আমাদের কখনও রুবেল নিয়ে চলে গেল লন্ডন ব্রিজের পতনের সময়। কখনো নিয়ে গেলো আরো আগে প্রথম মানুষের দুইটি পাথর ঘসে আগুন আবিষ্কারের সময়। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি রচনা থেকে নিয়ে আইনস্টাইনের রিলেটিভিটির পেপার জমা দেয়া। সবকিছুর সাক্ষী এই অদ্ভূত মানুষটা। সেই গল্প আমরা সারাদিন মুগ্ধ হয়ে শুনলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম যে তোমার কাজের সবচেয়ে কঠিন অংশ কি? মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে রুবেল উত্তর দিলো,
– সবচেয়ে কঠিন হল যে পর মুহূর্তে কোনও মানুষ মারা যাবে জেনেও কিছু না করে থাকা। আমার জীবনের.. সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল 9/11 নিউ ইয়র্ক। আমরা সবাই.. বারোজন তৈরী ছিলাম সেদিনের ঘটনার জন্য। প্রচুর মানুষের আর্তনাদ, করুণ কান্না আর মৃত্যু আমরা শুধুই প্রত্যক্ষ করে গিয়েছি। সব জেনে শুনেও সেই ঘটনা আটকাইনি। কারণ তা আমরা করতে পারিনা। আমাদের সেই নির্দেশ নেই!
– কেন?
– কারণ একটি সাধারণ ঘটনাও যদি আমাদের কারণে বদলে যায় ইতিহাসের থেকে তবে তা সময়ের ধারায় সৃষ্টি করবে প্যারাডক্স।
একটি সাধারণ ঘটানাও ‘রিপেল ইফেক্ট’ এ বদলে দিতে পারে আমাদের জানা ইতিহাস। আমি লক্ষ করলাম যে সেই ভয়ানক দিনের কথা মনে করে রুবেলের চোখের কোনা চিকচিক করছিল। একটা অভিনব দিন কাটল আমাদের। রুবেল একজন হাসিখুশি আর চমৎকার মানুষ। সে নিজে আমাদের এক বিশেষ জিনিষও দেখাল বিকেলে। সেটি হল একটি ১৯২০ সালের খাঁটি রেড ওয়াইনের একটি বোতল। এটি তার আগের অভিযানের সময় সংগ্রহ করা একটি দুর্লভ বস্তু। যদিও ট্রেনে মদ্যপান করা নিষেধ তবু রুবেল এর অনুরোধে আমরা প্রত্যেকেই এক চুমুক করে খেলাম। আমি যে কিনা নিজে মদ্যপান করিনা.. সেই আমিও এমন বস্তুর লোভ সামলাতে পারলাম না। ভুলটা বুঝলাম পরেরদিন সকালে। সকাল এগারোটা নাগাদ ঘুম ভাঙার পর। উঠে দেখলাম ট্রেনের সবাই উঠে পড়লেও আমার আসে পাশের কেউ শুধু জাগেনি।
ঘড়ি তে সময় দেখে চমকে গেলাম। আশ্চর্য। এত কিভাবে ঘুমোলাম?? মাথাটা এখনও ঝিম ঝিম করছে… ঘুম কাটেনি এখনও। তখনই খেয়াল হলো আরে!! আমার হ্যান্ড ব্যাগ কই??? পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগ ও পেলাম না। তাড়াতাড়ি নেমে বাকিদের জাগালাম। আর তখনই খেয়াল করলাম যে রুবেল এর নিচের জায়গা ফাঁকা!!
বাকি প্রত্যেকেই উঠে বুঝলাম যে আমাদের প্রত্যেকের দামী কিছু না কিছু বস্তু নেই। কারুর ল্যাপটপ, কারুর ব্যাগ, কারুর ঘড়ি। আসে পাশে জিজ্ঞেস করে কেউই কিছু বলতে পারলো না। শুধু একজন বলল যে বিদেশী মত দেখতে ফর্সা একজন কে সে ভোর বেলা একটি স্টেশনে মনে হয় নামতে দেখেছে।
আমরা হতবাক!! আমার খেয়াল হলো যে কাল রাতে আমরা সকলে সেই ওয়াইনে ভাগ বসালেও, রুবেলকে তা থেকে একবারও খেতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। লোকটা আমাদের এইভাবে বোকা বানালো?? একটি ব্যাগ ভর্তি দামী জিনিষ একজন ব্যক্তি একদল ভিক্ষুকের হাতে দিলো। বড়ই খারাপ লাগছে তার সেই সহযাত্রীদের জন্যে। কাল সে মূর্খামি করে তার বহু গোপন কথা বলে ফেলেছিল। তারই দোষ। কিন্তু এটা চরম নিয়ম বিরুদ্ধ কাজ।
রাতে সে বুঝতে পারে যে সে কত বড় ভুল করে ফেলেছে। এখন একটাই উপায়। তাকে বাকিদের কাছে প্রমাণ করতে হবে যে তার সব কথা গুলো বানানো মিথ্যে। আর সেটা এরা এমনিতে বিশ্বাস করবে না। তাই তাকে এই জিনিসগুলো চুরি করতে হল। যাতে বাকিরা তার কথাগুলোকে শুধুমাত্র একজন চোরের কারসাজি ভেবে নেয়। ভিক্ষুক টি ব্যাগ খুলে জিনিসগুলো দেখে প্রচণ্ড অবাক হলো। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য চোখ তুলতেই দেখলো সামনের ব্যক্তিটি নেই। হাওয়ায় যেন মিলিয়ে গিয়েছে।