আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগের কথা। রমজান আলী তখন তাগড়া যুবক, বেশ শক্তিশালী। কুস্তি, কাছিটান, লাঠি খেলায় খুবই পারদর্শী। লাঠির এক বারিতে (আঘাতে) শুকনা নারিকেল দিখণ্ডিত করা চারটেখানি কথা নয়, সবার দ্বারা সম্ভবও নয়। তয় রমজান আলী বেশ ভালই পারতেন তাই সেইসময় এই ধরনের খেলায় তার খুব কদর ও বেশ নামডাক ছিলো। খেলার নেশা ছিলো প্রচুর।
পুটলিতে চিড়া, মুড়ি, গুড় এসব লাঠির আগায় বেঁধে কাঁধে ঝুলিয়ে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতেন গাঁওয়ের পর গাঁও, মাঠের পর মাঠ, গঞ্জের পর গঞ্জ। কোথায় খেলা ডাকা হয়েছে এবং সেটা কতদূরে সেই অনুযায়ী রওনা দিতেন কখনো ভোরে আবার কখনো মাঝরাতে, খেলা শেষে বাড়ি ফিরতে আবার সেই মাঝরাত কিংবা ভোর হয়ে যেতো। তেমনি একদিন লাঠি খেলায় অংশগ্রহণের জন্য ফজরের পর রওনা দিলেন। বহুদূরের পথ তাই পুটলিতে করে শুকনা খাবার চিড়া গুড় নিতে ভুললেন না। মাঝপথে বটের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নেয়ার পাশাপাশি পেট বাবাজির চেচাঁমেচিও বন্ধ করা যাবে। যাইহোক অবশেষে দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ গন্তব্যে পৌঁছলেন রমজান আলী। খানিকপর খেলা শুরু হবে।
ছিপছিপে দেহ লাঠি যখন ঘুরায় যেনো বাতাই ঘুরে। সজোরে লাঠি ঘুরিয়ে মাটিতে রাখা সেই ঝুনা নারিকেলের ওপর আঘাত করতে হবে। এক আঘাতেই ছালসমেৎ নারিকেল দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। যে বেশী নারিকেল দ্বিখন্ডিত করতে পারবে জিত টা তার। সেদিনের মত খেলায় হেরে রমজান আলী মুখভার করে বাড়ি পথে রওনা দিলেন আসরের শেষ বেলায়। খুবই সাহসী, উদ্দমী তরুণ। চলতে চলতে বাড়ির প্রায় কাছাকাছি কিন্তু বাড়ি অবধি পৌঁছাতে এই জঙ্গলটি পেরুতেই হবে। এখানে হিন্দুদের বিরাট শশ্মান আছে। পোড়াবাড়ি, বট গাছ, ছাতিম গাছ আরও বিভিন্নপ্রকারের গাছপালায় ঘেরা এই বড়ভিটা। হিন্দুরা এখানকার একটা স্থানে প্রদীপ জ্বালাতো, অশ্বরিরী আত্মার উদ্দেশ্যে ভোগ দিতো! অনেক দূর দূরান্ত থেকেও লাশ এনে এখানে পোড়ানো হতো। দিনে দুপুরেও মানুষ এই বড়ভিটার পাশ দিয়ে যেতে ভয় পেতো।
হ্যাঁ, এটা বড়ভিটা নামে পরিচিত ছিলো। রমজান আলী যখন বড়ভিটায় এসে পৌঁছলেন তখন রাত প্রায় বারোটা, বড়ভিটা থেকে রমজান আলীর বাড়ি আর মাত্র দেড় দুই মাইলের পথ। বড়ভিটার আশপাশে কোনো জনবসতি নেই। এই বড়ভিটা নিয়ে নানাপ্রকার হরর কথাবার্তা প্রচলিত আছে কিন্তু রমজান আলী অকুতোভয়! জ্যোৎস্না রাত, জঙ্গলের পাশ দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ রমজান আলীর চোখে পড়লো লাল পাড় শাড়ি পরিহিতা, আলগা চুলে এক নতুন বউ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দ্রুত হেটে যাচ্ছে। রমজান আলীর মনে একটা সংশয় এলো, ভাবলো কার বাড়ির বউ এত রাতে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। রমজান আলী ভাবলো হয়তো ঝগড়া টগড়া করে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। জঙ্গলের ভেতর কোনো গাছের ডালে হয়তো শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে ঝুলে পড়বে।
নাহ্ এভাবে মরতে দেয়া যায়না কিছু একটা করতেই হবে। চেনা নাই জানা নাই কার বাড়ির বউ কিভাবে কি করা যায় রমজান আলী ভাবতে লাগলো! সেও মেয়েটির পিছু নিলো এবং ডাকতে লাগলো এই তুমি কার বাড়ির বউ এত রাতে কোথায় যাও? কোনো সাড়া শব্দ নাই! রমজান আলী এবার চলার গতি বাড়ালো কিন্তু কিছুতেই নাগাল পাচ্ছেনা। রমজান আলী এবার রেগে গেলো সে ভাবলো হাতের লাঠিটি ছুঁড়ে মারবে কিনা তারপর আবার ভাবলো কার বাড়ির বউ। লাঠি ছুঁড়ে মারলে কি জানি কি হয়! ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে গেলো তবুও এতটুকু সাড়া দিচ্ছেনা৷ এলোকেশ কোমরের নিচ অবধি তার ওপর লালপেড়ে শাড়িপরা এ যেনো এক মুগ্ধতা, মাদকতা। নাহ্ রমজান আলী নিজেকে আর সংবরন করতে পারছেনা সে স্থির করলো লাঠি ছুড়েই মারবে যা আছে কপালে। যেই না লাঠি উঁচায়, এটেম্পট নেয় মেয়েটি নিশানার বাইরে চলে যায়।
এই মনে হয় রমজান আলী মেয়েটির চুলের মুঠি ধরে ফেলবে, যেইনা কাছাকাছি এসে থাবা দেয় অমনি মেয়েটি হাতের নাগালের অনেক দূরে চলে যায়। ধরে ফেলবে ফেলবে করেও কিছুতেই ধরতে পারেনা। এবার রমজান আলীর একটু সন্দেহ্ হলো কিন্তু সে নাছোড়বান্দা কি হয়, মেয়েটি কোথায় যায়, কি করে সেটা তাকে দেখতেই হবে। রাত গভীর হতে লাগলো রমজান আলী মেয়েটির পিছু পিছু হেটেই চললো পথ যেনো আর ফুরায় না। মেয়েটি যেতে যেতে শশ্মান অবধি পৌঁছলো। বিরাটাকার এক তেঁতুল গাছ যেটাতে মেয়ে মানুষ তো দূরের কথা শক্ত সামর্থ্য বলবান পুরুষ মানুষের উঠাটাও দূরুহ এবং সময় সাপেক্ষ কিন্তু মেয়েটা মুহূর্তের মধ্যে গাছ বেয়ে মগডালে ওঠে গেলো।
রমজান আলী শুধু হা করে চেয়ে রইলো নিচে দাঁড়িয়ে। এবার সেই মেয়েটি বিকট শব্দে খিলখিল করে হেসে ওঠলো আর রমজান আলীর দিকে পাশ ফিরে তাকালো। রমজান আলীর চোখ তখন ছানাবড়া! একি মেয়েটির নাক কোথায়, ঝলসানো মুখ, রক্তবর্ণ চোখ, ঠোঁটের দুইপাশ দিয়ে দুটো বড় বড় দাঁত বাইরে বেরিয়ে আসছে….রমজান আলী ভয় পেয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলো। মাঠ ঘাট ধানের ক্ষেত কোনোদিকেই নজর দেয়ার অবকাশ নেই। এসবের মধ্যদিয়েই দৌড়াতে দৌড়াতে এক বাড়ির উঠোনে গিয়ে ধপাস করে পড়লো। ততক্ষণে ফজরের আজান দিয়েছে…..